Beta
সোমবার, ৬ মে, ২০২৪
Beta
সোমবার, ৬ মে, ২০২৪

কেন বড় হচ্ছে বিশ্বের অস্ত্র বাণিজ্য, কার কত হিস্যা

যুদ্ধ-সংঘাতের কারণে প্রতিদিন বহু মানুষ মারা যাচ্ছে, তবু থামছে না বুলেটের বাণিজ্য। প্রতীকী ছবি।
যুদ্ধ-সংঘাতের কারণে প্রতিদিন বহু মানুষ মারা যাচ্ছে, তবু থামছে না বুলেটের বাণিজ্য। প্রতীকী ছবি।

কোভিড মহামারী, রাশিয়া-ইউক্রেন ও ইসরায়েল-গাজা যুদ্ধ এবং জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় বিশ্বে দারিদ্র্যের হার বাড়ছে। শুধু যুদ্ধে নয়, যুদ্ধের কারণে খাদ্য সংকটেও প্রতিদিন মৃত্যু হচ্ছে বহু মানুষের।

জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি- ইউএনডিপি বলছে, ব্যয় বাড়ায় ও আয় কমায় ঋণের চাপে ২০২০-২৩ সালের মধ্যে বিশ্বে সাড়ে ১৬ কোটি মানুষ দরিদ্র্য সীমার নিচে নেমেছে। বিশ্ব ব্যাংক বলছে, ২০২২ সালে ২ কোটি ৩০ লাখ মানুষ চরম দারিদ্রসীমায় ছিল।

দারিদ্র্যের এই হার বাড়ার পেছনে শুধু কোভিড নয়, যুদ্ধও প্রভাব ফেলেছে।

যুক্তরাজ্যভিত্তিক আন্তর্জাতিক দাতব্য সংস্থা অক্সফাম বলছে, ২০২২ সালে বিভিন্ন অঞ্চলে যুদ্ধ-সংঘাতের কারণে প্রতিদিন কেবল ক্ষুধায় ৯ হাজারের বেশি মানুষ মারা গেছে।

বিশ্বজুড়ে যখন ক্ষুধার এই চিত্র, তখন একই বছর বিশ্বের শীর্ষ পাঁচ অস্ত্র রপ্তানিকারক দেশ- যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ফ্রান্স, চীন ও জার্মানি ৮৫ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি মূল্যের অস্ত্র বিক্রি করেছে।

দুই বছরের ইউক্রেন যুদ্ধে ৫ লাখ কিংবা ছয় মাসের গাজা যুদ্ধেই ৩৫ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যুতেও বদলাচ্ছে না আগ্রাসী নীতির ওপর ভর করে অর্থনীতি গড়ে তোলা দেশগুলোর মনোভাব।

২০১৮-২২ সাল পর্যন্ত বিশ্বে প্রতিবছর গড়ে ১১২ বিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছে অস্ত্রের পেছনে। আগের দশকের চেয়ে ২০১৮-২০২২ সাল পর্যন্ত সময়ে বিশ্বে অস্ত্র রপ্তানি ৪ দশমিক ৮ শতাংশ বেশি ছিল। একই সময়ে সংঘাত ও যুদ্ধে প্রায় ৪৮ হাজার বেসামরিক মানুষ নিহত এবং প্রায় ৯ কোটি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে বলে অক্সফামের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

সুইডেনভিত্তিক গবেষণা সংস্থা স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এসআইপিআরআই বা সিপ্রি) ১৯৪৯ সাল থেকে বিশ্বের সামরিক ব্যয় পর্যবেক্ষণ করে আসছে।

গত ২২ এপ্রিল (সোমবার) সিপ্রি প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্ব ২০২৩ সালে সামরিক বাহিনীতে ২.৪ ট্রিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে, যা এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ। গত ৯ বছর এই ব্যয় ধারাবাহিকভাবে বেড়ে এই অবস্থায় এসেছে, যা আরও বাড়বে বলেই মনে করা হচ্ছে।

সামরিক খাতে গত বছর বৈশ্বিক জিডিপির ২.৩ শতাংশ ব্যয় করা হয়েছে, যা আগের বছর ছিল ২.২ শতাংশ। অর্থাৎ গত বছর এই পৃথিবীর নর-নারী-শিশু মাথাপিছু ৩০৬ মার্কিন ডলার সামরিক ব্যয়ের জন্য কর দিয়েছে, যা স্নায়ু যুদ্ধের (১৯৪৭-৯১) পর থেকে সর্বোচ্চ।

সামরিক ব্যয় বাড়ার এই হার যদিও বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতির হার ৬.৮ শতাংশের সঙ্গে মিলে যায়, তার মানে এই নয় যে সব দেশের সামরিক সক্ষমতা বেড়েছে।

সিপ্রি বলছে, সামরিক ব্যয় সব দেশে সমানভাবে বাড়েনি। গুটিকয়েক দেশকে কেন্দ্র করেই এটি বেড়েছে।   

২০২৩ সালের ২২ মে বিশ্বের অস্ত্র বাণিজ্য নিয়ে এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে অক্সফাম ইন্টারন্যাশনাল।

সেখানে সংস্থাটির নিউ ইয়র্ক অফিসের প্রধান ব্রেন্ডা মোফিয়া বলেন, “নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য পাঁচটি দেশের মধ্যে চারটিই বিশ্বে যুদ্ধ সংগঠনের রসদ অস্ত্র বিক্রিতে শীর্ষে, যা একেবারে দ্বিমুখী, সহযোগী ও অনৈতিক আচরণ। তাদের বন্দুক ও বোমা কেবল সংঘর্ষে জর্জরিত দেশগুলোর নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করছে না, বরং যারা বেঁচে থাকে তাদেরও ক্ষুধায় মারছে।”

প্রশ্ন হচ্ছে, কেন বাড়ছে অস্ত্র বাণিজ্য? বিশ্ব অস্ত্র বাণিজ্যে কোন কোন দেশের হিস্যা বড় হচ্ছে? আসুন এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজি।

যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি ও অস্ত্র বাণিজ্য 

যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক অর্থনীতি ও অস্ত্র বাণিজ্য যেন ওতপ্রতভাবে জড়িয়ে আছে। অনেকেই দেশটির অর্থনীতির অনেকটাই অস্ত্র বাণিজ্যনির্ভর বলে থাকেন।

দেশটির অর্থনীতির এই অবস্থাকে ঐতিহাসিকভাবেই ‘গানস অ্যান্ড বাটার’ বলে আখ্যা দেওয়া হয়।

প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এবং পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন দেশে যুদ্ধ উসকে দিয়ে ব্যাপকভাবে লাভবান হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র—এমন অভিযোগও বিশ্বের অনেক নিরাপত্তা বিশ্লেষকর।

বিশ্বের সবচেয়ে বড় বহুজাতিক কোম্পানির ২০টির মধ্যে ১৬টির মালিক মার্কিনরা।  

যুক্তরাষ্ট্রের পুঁজিপতিদের এই অভাবনীয় বিকাশের পিছনে দেশটির রাজনৈতিক অর্থনীতি বিশেষ করে বিশ্বজুড়ে তাদের `সামরিক কেইনসিয়ানবাদ’ কাজ করেছে।

অস্ত্র বাণিজ্যে বিনিয়োগ অনেক বেশি লাভজনক বলেই পুঁজিপতিরা এই খাতেই বিনিয়োগ করছেন।

নিউ ইয়র্কভিত্তিক সাময়িকী মান্থলি রিভিউয়ে ২০২২ সালের ১ এপ্রিল প্রকাশিত ‘দ্য পলিটিকাল ইকোনমি অব সিস্টেমিক ইউএস মিলিটারিজম’ শীর্ষক নিবন্ধে এমন বক্তব্য তুলে ধরেছেন ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির অর্থনীতির ইমেরিটাস অধ্যাপক ও গবেষক জেমস এম সাইফার।

সেই নিবন্ধে তিনি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক কেইনসিয়ানবাদ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দেশটিতে বিভিন্ন পর্যায়ের নীতিতে প্রতিষ্ঠানিক রূপ পায়। 

প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সামরিক ব্যয় বাড়ানোয় ধস নামে শিল্পোন্নত অনেক দেশের অর্থনীতিতে। তবে বিপরীত দিকে সুযোগ কাজে লাগিয়ে অস্ত্র বাণিজ্য বাড়ায় যুক্তরাষ্ট্র। যুদ্ধের ফলে যুক্তরাষ্ট্রের পুঁজির ব্যাপক বিকাশ হয়।

সাইফার তার নিবন্ধে বলেন, ইউরোপ ও এশিয়া থেকে যুদ্ধাস্ত্রের চাহিদা বাড়ায় মহামন্দা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয় যুক্তরাষ্ট্র।

১৯৪০ সালের জুন থেকে ১৯৪১ সালের জুন পর্যন্ত এক বছরে সামরিক খাতের ব্যয় বাড়ে ৬০০ শতাংশ, তা ১৯৪৩-৪৪ সাল নাগাদ যুক্তরাষ্ট্রের জিডিপির ৪২ শতাংশে দাঁড়ায়। 

১৯৩৯-৪৪ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রকৃত জিডিপির ৫৪ শতাংশ উল্লম্ফন ঘটে। এ সময়ে দেশটির সেনাবাহিনীতে দেড় লাখ লোকের নিয়োগ হয় এবং বেকারত্বের হার নেমে যায় মাত্র ১ দশমিক ৪ শতাংশে, যা ইতিহাসে সর্বনিম্ন।


এখানে বলে রাখা দরকার, সামরিক কেইনসিয়ানবাদ হচ্ছে এমন একটি নীতি যা, দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য সামরিক ব্যয় বাড়াতে বলে। এই অর্থনৈতিক মতবাদের প্রবক্তা ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ ও দার্শনিক জন মেনার্ড কেইনস। তবে তার পরামর্শ, আগে নাগরিকের গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক খাতে ব্যয় (যেমন- শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থান) বাড়াতে হবে; আর এরপর ব্যয় করতে হবে সামরিক খাতের জন্য। 

এই ধরনের অর্থনীতি কল্যাণ ও যুদ্ধবাদী রাষ্ট্রের মধ্যে একটি নির্ভরশীল সম্পর্ক তৈরি করে; যেখানে যুদ্ধবাদী রাষ্ট্র কল্যাণ রাষ্ট্রকে রসদ সরবরাহ করে এবং কল্যাণ রাষ্ট্র যুদ্ধবাদী রাষ্ট্রের জন্য জনসমর্থন তৈরি করে।

যুক্তরাষ্ট্রের এই নীতির কঠোর সমালোচক বুদ্ধিজীবী নো’ম চমস্কি। তার যুক্তি, “সামরিক কেইনসিয়ানবাদ রাষ্ট্রকে অসামরিক কেইনসিয়ানবাদের চেয়ে বেশি সুবিধা দেয়।”

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোকে উন্মোচিত করে। ১৯৫০ ও ১৯৬০ এর দশকে, অর্থনীতিবিদ অ্যালভিন হ্যানসেন যে নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গিতে কেইনসিয়ানবাদ তুলে ধরতেন, সেভাবেই যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক খরচের বিষয়টি দেখা হতো।

তবে হ্যানসেনের তত্ত্বে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির অভ্যন্তরীণ চালিকাশক্তিগুলো ধসে পড়ছিল।

তখন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন কাউন্সিল অব ইকোনমিক অ্যাডভাইজারের চেয়ারম্যান অর্থনীতিবিদ লিওন কেইসারলিং সামাজিক ব্যয় বাদ দিয়ে ব্যাপক সামরিক ব্যয় বাড়ানোর প্রস্তাব করেন।

লিওনের প্রস্তাব বাস্তবায়নের সঙ্গে সঙ্গে পেন্টাগনের অস্ত্র বিক্রির চুক্তি ১৯৫০ সালের ১৪ দশমিক ৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে বেড়ে ১৯৫১ সালে ৫১ দশমিক ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার হয়, যা জিডিপির ১৫ দশমিক ১ শতাংশ। জিডিপির এই ব্যাপক উল্লম্ফন ঘটে পেন্টাগনের অস্ত্র বিক্রির কারণে। পরবর্তী সময়ে সামরিক খাতের ব্যয়ের এই ধারাবাহিকতা চলতে থাকে।

সাইফারের বক্তব্যের সত্যতা উঠে এসেছে সুইডেনভিত্তিক গবেষণা সংস্থা সিপ্রির গত ১১ মার্চ প্রকাশিত প্রতিবেদনেও।

সেখানে বলা হয়েছে, রাশিয়া-ইউক্রেন ও ইসরায়েল-গাজা যুদ্ধ শুরুর পর মিত্রদের কাছে রপ্তানি বাড়িয়ে বিশ্বের অস্ত্র বাণিজ্যে বড় হিস্যা দখলে নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্স। তবে রাশিয়ার অস্ত্র বিক্রি উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। ২০১৮-২২ সাল পর্যন্ত অস্ত্র বিক্রি করা ৬৬টি দেশের মধ্যে বেশিরভাগই ছোট আকারের বিক্রেতা ছিল।

২০১৯-২৩ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলো বিশ্বজুড়ে প্রতি ১০০টি অস্ত্রের মধ্যে ৭২টি অস্ত্র বিক্রি করেছে, যা ২০০৪-২০১৮ সাল পর্যন্ত সময়ের চেয়ে ১০ শতাংশ বেশি। ২০১৯-২৩ সাল পর্যন্ত অস্ত্র রপ্তানিকারক পাঁচ দেশ- যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, রাশিয়া, চীন ও জার্মানির বিশ্বের মোট অস্ত্র রপ্তানিতে হিস্যা ছিল ৭৫ শতাংশ।  

সিপ্রির তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে বিশ্বব্যাপী ১২৭ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র বাণিজ্য হয়, যা ২০১২ সালে ছিল ৯৫ বিলিয়ন ডলার। ২০২১ সালে বিশ্বজুড়ে যত বাণিজ্য হয়েছে তার প্রায় শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ হয়েছে অস্ত্র বাণিজ্য।

সামরিক খাতে কোন দেশের কতটা ব্যয়

বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতি (২৮ ট্রিলিয়ন ডলার) যুক্তরাষ্ট্র গত পাঁচ বছরে (২০১৯-২৩) সামরিক খাতে বছরে ৯১৬ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করে, যা বিশ্বে সর্বোচ্চ এবং মোট ব্যয়ের ৩৭ শতাংশ। আর দ্বিতীয় অর্থনীতি (১৮ ট্রিলিয়ন ডলার) চীন ব্যয় করে ২৯৬ বিলিয়ন ডলার।

এদিক দিয়ে রাশিয়া তৃতীয়, ব্যয় করে ১০৯ বিলিয়ন ডলার। তবে এই পরিসংখ্যান ‘প্রকৃত ব্যয়ের চেয়ে কমই’ হবে বলে মনে করছে সিপ্রি। সংস্থাটি বলছে, ২০২২ সালে রাশিয়া ইউক্রেনে পুরোমাত্রায় সামরিক অভিযান শুরুর পর থেকে দেশটির কর্তৃপক্ষ যে তথ্য দিচ্ছে, তাতে অস্পষ্টতা রয়েছে।

সামরিক খাতের ব্যয়ে বিশ্বে চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে ভারত, ব্যয় করছে ৮৩.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। 
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে ইউরোপের দেশগুলোর সামরিক খাতের বাজেটও অসমভাবে ফুলে উঠেছে।

ইউরোপে অস্ত্র আমদানি বেড়ে দ্বিগুণ 

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে ২০১৪-১৮ সালের তুলনায় ২০১৯-২৩ সালে ইউরোপে অস্ত্র কেনার পরিমাণ দ্বিগুণ হয়েছে। সিপ্রির প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর ইউক্রেন ইউরোপের সবচেয়ে বড় অস্ত্র আমদানিকারক দেশ হিসেবে আবির্ভূত হয়। দেশটি এখন বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তর অস্ত্র আমদানিকারকে পরিণত হয়েছে।

সিপ্রির অস্ত্র বাণিজ্য বিষয়ক কর্মসূচির জ্যেষ্ঠ গবেষক পিটার ওয়েজম্যান বলেন, এই অস্ত্র আমদানি বাড়ানোর পেছনে মূলত চীনের অভিলাষ নিয়ে উদ্বেগ ইন্ধন জুগিয়েছে। 

এর একটি উদাহরণ জাপান; দেশটি তাদের আমদানি আড়াইগুণ বাড়িয়েছে। দেশটি অন্যান্য সমরাস্ত্রের মধ্যে উত্তর কোরিয়া ও চীনে পৌঁছাতে সক্ষম এমন ৪০০টি দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র কিনেছে।

গত পাঁচ বছরে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র কাতার, মিসর ও সৌদি আরবও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে সমরাস্ত্র কেনার ক্ষেত্রে এগিয়ে ছিল, যা বিশ্বব্যাপী আমদানির ৩০ শতাংশ।

শীর্ষ অস্ত্র আমদানিকারক দেশগুলো  

অস্ত্র আমদানিতে এগিয়ে এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো। এর মধ্যে ভারতের অস্ত্র কেনার প্রবণতা বেশি। এর পর রয়েছে সৌদি আরব ও কাতার। আর ইউরোপের মধ্যে এগিয়ে ইউক্রেন, দেশটি এখন বিশ্বের আমদানিকারকদের মধ্যে চতুর্থ অবস্থান দখলে নিয়েছে।  

মধ্যপ্রাচ্যে অস্ত্র আমদানি বাড়ার প্রসঙ্গে সিপ্রির জ্যেষ্ঠ গবেষক ওয়েজম্যান আল জাজিরাকে বলেন, “এটি কেবলই ইরান-ভীতি নয়, এটা মূলত যুদ্ধবাদী চিন্তা থেকে করা হচ্ছে।

“গত ১০ বছরে সৌদি আরব নিজেদের নেতৃত্বে ইয়েমেনসহ বিভিন্ন জায়গায় হামলায় তাদের কেনা অস্ত্র ব্যবহার করেছে। এটাকে সৌদি আরব ইরানের প্রক্সিদের সঙ্গে সরাসরি লড়াই বলে মনে করে।”

আর আঞ্চলিক শত্রুতাও এখানে এক ধরনের ভূমিকা রাখে বলে মনে করছেন ওয়েজম্যান।

২০১৭ সালে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত কাতারের উপর অবরোধ দেওয়ার পরই নিজেদের নিরাপত্তার জন্য কাতার যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্য থেকে যুদ্ধবিমানের কেনে। এরপর তাদের অস্ত্র আমদানি চার গুণ বাড়ে।

আমেরিকান কলেজ অব গ্রিসের ইতিহাসের অধ্যাপক কনস্টাটিনোস ফিলিস আল জাজিরাকে বলেন, “আমরা একটি ক্রান্তিকালীন বিশ্বে বাস করি। এই বিশ্ব অনেকটাই অস্থির। জাতিসংঘের ভূমিকা আলঙ্করিক। আর শক্তি পুনর্বিবেচনায় সরব রয়েছে একটা শ্রেণি।

“মার্কিন শক্তি তাদের উপর আক্রমণ ঠেকাতে পারবে কি না- তা নিয়ে নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছে পশ্চিমাবান্ধব রাষ্ট্রগুলো।” 

ফিলিস বলেন, “তারা বলছে, আমারা শক্তি না বাড়ালে আমাদের রক্ষা করার কেউ নেই। আগের বছরগুলোর মতো কোনও শক্তিশালী বহুপক্ষীয় ব্যবস্থা এখন আর নেই। তাই আক্রমণের জন্য আগাম প্রস্তুত থাকতে হবে।”

অস্ত্র বাণিজ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্স এগিয়ে

সিপ্রির প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বের অস্ত্র বাণিজ্যের হিস্যায় এগিয়ে রয়েছে দশটি দেশ। সেগুলো হলো- যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, রাশিয়া, চীন, জার্মানি, ইতালি, যুক্তরাজ্য, স্পেন, ইসরায়েল ও দক্ষিণ কোরিয়া।

বিশ্বের শীর্ষ অস্ত্র রপ্তানিকারক দেশ যুক্তরাষ্ট্রের গত পাঁচ বছরে (২০১৯-২৩) রপ্তানি ১৭ শতাংশ বেড়েছে। বিশ্ব অস্ত্র বাণিজ্যে ২০১৪-১৮ সালে দেশটির হিস্যা ছিল ৩৪ শতাংশ, যা এখন দাঁড়িয়েছে ৪২ শতাংশে।

অন্যদিকে রাশিয়ার অস্ত্র রপ্তানি কমে অর্ধেক হয়ে গেছে। গত পাঁচ বছরে দেশটির হিস্যা দাঁড়িয়েছে ১১ শতাংশ, যা আগের একই সময়ে ছিল ২১ শতাংশ।   

প্রথমবারের মতো রাশিয়াকে পিছনে ফেলে দ্বিতীয় বৃহত্তম অস্ত্র রপ্তানিকারক দেশ হয়ে উঠেছে ফ্রান্স।

গত পাঁচ বছরে বিশ্বে অস্ত্র বাণিজ্য ৩ দশমিক ৩ শতাংশ কমেছে। তবে এ সময়ে ইউরোপে অস্ত্র আমদানি বেড়েছে প্রায় ৯৪ শতাংশ।

সিপ্রি বলছে, গত পাঁচ বছরে রপ্তানিকারক দেশগুলো আগ্রাসীভাবে ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়ায় অস্ত্র বিক্রি বাড়িয়েছে।

বিশ্বে সবচেয়ে বেশি অস্ত্র কেনে এশিয়া; মোট রপ্তানির ৩৭ শতাংশ যায় এ অঞ্চলে। এক্ষেত্রে এগিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও ভারত।

মূলত এশিয়া, ওশেনিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যে অস্ত্রের আমদানি অনেক বেশি, এই অঞ্চলগুলোতেই বিশ্বের ১০টি বৃহত্তম অস্ত্র আমদানিকারক দেশের মধ্যে ৯টির অবস্থান।

রপ্তানিকারকদের নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্র

যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্ররা অস্ত্র বাণিজ্যের বড় হিস্যা দখলে রেখেছে।

তবে মিত্রদের সামরিক খাতের ব্যয় বৃদ্ধি যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ অস্ত্র রপ্তানিকারকের তকমাকে আরও শানিত করেছে।

এখানে বলে রাখা দরকার, বিশ্বে ১০০ কোম্পানি অস্ত্র বিক্রি করে, এর মধ্যে ৪২টিই যুক্তরাষ্ট্রের। আর বাণিজ্যে এগিয়ে থাকা শীর্ষ ২০টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৯টিই যুক্তরাষ্ট্রের। এর মধ্যে লকহিড মার্টিন করপোরেশন, রেথিয়ন টেকনোলজিস, নর্থরপ গ্রুম্যান করপোরেশন, বোয়িং ও জেনারেল ডাইনামিকস করপোরেশন বিশ্বের অস্ত্র বাণিজ্যের শীর্ষ ৫ প্রতিষ্ঠান।   ২০১৩-১৮ সাল পর্যন্ত ৩৪ শতাংশ রপ্তানি বাড়িয়ে বিশ্বের অস্ত্র বাণিজ্যের ৪২ শতাংশ হিস্যা দখলে নেয় যুক্তরাষ্ট্র।

তবে এই পরিসংখ্যান একটি আংশিক অবস্থা তুলে ধরেছে। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রই একমাত্র দেশ যার কাছে রপ্তানিযোগ্য পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধবিমান, এফ-৩৫ লাইটনিং ২ আছে এবং এসব বিমানের স্টিলথ প্রযুক্তি গ্রহণের জন্য অনেক মিত্র দেশ তাদের বিমানবাহিনীর আধুনিকায়ন করছে।     

ইউরোপ অন্তত ৮০০টি নতুন প্রজন্মের যুদ্ধবিমান অর্ডার দিয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে এফ-৩৫, ইউরোফাইটার টাইফুন ও ফ্রান্সের রাফাল।

মূলত রাজনৈতিক কারণেই পশ্চিমা মিত্রদের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র বিক্রি বেড়েছে। বিশ্বের শীর্ষ ১০ আমদানিকারকের ৮টিই ইউরোপের দেশ।

এতের পশ্চিমা অন্যান্য আস্ত্র উৎপাদকরাও লাভবান হচ্ছে। ফ্রান্স রপ্তানি বাড়িয়ে রাশিয়াকে টপকে দ্বিতীয় অবস্থান দখল করেছে। আর ইতালিরও রপ্তানি বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। 

ফ্রান্সের ফাইটার জেট বিমানের অর্ডার ব্যাপকভাবে বেড়েছে। দাসো এভিয়েশন ২০১৩-১৮ সালের মধ্যে ৪.৫তম প্রজন্মের ২৩টি রাফাল যুদ্ধবিমান বিক্রি করেছিল। তবে গত পাঁচ বছরে তার ৯৪টি বিমান বিক্রি করেছে। এসময়ে তাদের ১৯৩টি যুদ্ধবিমানের অর্ডার রয়েছে।

যুক্তরাজ্য ও সুইজারল্যান্ডসহ ইউরোপের অস্ত্র রপ্তানিকারকরা ২০১৯-২৩ সালের মধ্যে বিশ্বের মোট বাণিজ্যের ৩১ শতাংশ করেছে।

দক্ষিণ কোরিয়াও বড় রপ্তানিকারক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। দেশটি পোল্যান্ডের সঙ্গে ট্যাংক, কামান, বিমান ও রকেট কামানের বড় চালান বিক্রির জন্য চুক্তি করেছে।

গত পাঁচ বছরে বিশ্ব অস্ত্র বাণিজ্যের ৫.৮ শতাংশ করেছে চীন। এর মধ্যে ৬০ শতাংশ করেছে পাকিস্তানে এবং বাকি বেশি অংশই বাংলাদেশ ও থাইল্যান্ডে রপ্তানি করেছে।

অস্ত্র বাণিজ্যে যুক্তরষ্ট্রের এক সময়ের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী রাশিয়ার রপ্তানিতে হিস্যা অর্ধেক কমে ১১ শতাংশে নেমেছে। এটি হয়েছে মূলত ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরুর করণে।

রাশিয়ার রপ্তানি কমে যাওয়ার পেছনে একটা কারণ হলো, ১৯৯০ এর দশক থেকে তাদের প্রধান ক্রেতা চীন নিজেদের অস্ত্র তৈরি করতে শুরু করেছে। এছাড়া দীর্ঘদিনের রুশ অস্ত্রের ক্রেতা ভারতও রাশিয়ার অস্ত্র প্রযুক্তি ও সরবরাহের ক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছে।

সিপ্রির অস্ত্র বাণিজ্য বিষয়ক কর্মসূচির জ্যেষ্ঠ গবেষক পিটার ওয়েজম্যান বলেন, “ভারত রুশ অস্ত্র-সরঞ্জাম থেকে দূরে সরছে বলে মনে হচ্ছে।

“ভারত কিছু অস্ত্র অর্ডার দিয়েছিল, যা এখনও ডেলিভারি হয়নি। যেমন- পারমাণবিক শক্তি চালিত সাবমেরিনটি চলতি বছর বা আগামী বছরে ডেলিভারি দেওয়ার কথা ছিল। কিছু ফ্রিগেট ও কয়েকটি বিমানের অর্ডার আছে।” “এছাড়া আগে কেনা রুশ অস্ত্র সরঞ্জামের প্রযুক্তিগত বিষয়েও ভারতের হতাশা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এ কারণে গত ২০ বছরে ভারত যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও ইসরায়েলের দিকে ঝুঁকেছে”, যোগ করেন ওয়েজম্যান। 

যুদ্ধবাজিতে বেড়েছে খরচ

সিপ্রি বলছে, ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা ব্যয় ৫১ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ৬৮.৮ বিলিয়ন ডলার। এর বাইরে দেশটি ৩৫ বিলিয়ন ডলারের সামরিক সহায়তা পেয়েছে। দেশটি তার জিডিপির ৩৭ শতাংশ এবং প্রতিরক্ষা খাতে সরকারের মোট ব্যয়ের মধ্যে ৬০ শতাংশ এই খাতে ব্যয় করেছে।   

একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের আর্থিক সাহায্য সত্ত্বেও যুদ্ধের প্রথম বছর ২০২২ সালে ইউক্রেন ৭০ লাখ করদাতা হারিয়েছে। বিশ্ব ব্যাংকের পরিসংখ্যান মতে, দেশটির অর্থনৈতিক উৎপাদনের এক পঞ্চমাংশ খুইয়েছে।

তবে এত ক্ষতি রাশিয়ায় হয়নি বলেছ সিপ্রি।

গত বছর রাশিয়া সামরিক খরচ ২৪ শতাংশ বাড়িয়ে জিডিপির ৬.৯ শতাংশ করেছে, যা সরকাররের মোট ব্যায়ের ১৬ শতাংশ। এটি সোভিয়েত ইউনিয়ন বিলুপ্ত হওয়ার তিন দশকের মধ্যে সবচেয়ে বড় প্রতিরক্ষা বাজেট। এরপরও দেশটির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ২২ শতাংশ। এক্ষেত্রে ব্যাপক পরিমাণ জ্বালানির রপ্তানি ও ঋণ বণ্টন দেশটির অর্থনীতি স্থিতিশীল রেখেছে। 

২০২২ সালে রাশিয়া ৯ শতাংশ সামরিক খচর বাড়ায়। এরপর ২০২৩ সালে সামরিক খাতের বাজেট বাড়ায় ২১ শতাংশ, এতে ব্যয় বাড়ে ২৪ শতাংশ। ফলে যুদ্ধের সময় দীর্ঘ হতে থাকে, বাড়তে থাকে হতাহতের সংখ্যা।   

বার্তাসংস্থা রয়টার্স এক প্রতিবেদনে বলছে, ২০২৪ সালে রাশিয়া ৭০ শতাংশ বাড়িয়ে প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা খাতের বাজেটের আকার আরও বড়, ১৫৭ বিলিয়ন ডলার করার পরিকল্পনা করছে।  

উত্তর গাজা উপত্যকার জাবালিয়া শরণার্থী শিবিরে ইসরায়েলি হামলার একদিন পর হতাহতের সন্ধা এক ফিলিস্তিনি। ২০২৩ সালের ১ নভেম্বর, রয়টার্সের ছবি।

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামলা চালায় গাজার শাসকদল ও ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র গোষ্ঠি হামাস। এতে গাজায় যুদ্ধ শুরু করে ইসরায়েল। এর ফলে ২৪ শতাংশ খরচ বাড়িয়ে গত বছর ইসরায়েল প্রতিরক্ষা বাজেট করে ২৭.৫ বিলিয়ন ডলার, যা জিডিপির ৫.৩ শতাংশ। 

গত ২০০ দিনে গাজায় ৭৫ হাজার টন বিস্ফোরক ফেলেছে ইসরায়েল। এতে অধিকাংশ বেসামরিক স্থাপনা ধুলায় মিশে গেছে।

গাজার স্থানীয় সরকারের প্রকাশ করা তথ্য অনুযায়ী, ইসরায়েলি হামলায় গাজার ৩ লাখ ৮০ হাজার বাড়িঘর, ৪১২টি স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়, ৫৫৬টি মসজিদ, ৩টি গির্জা, ২০৬টি প্রত্নতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক স্থান ধ্বংস অথবা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।  

গাজার হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোও ইসরায়েলের হামলার হাত থেকে রেহাই পায়নি। ৩২টি হাসপাতাল ও ৫৩টি স্বাস্থ্যকেন্দ্র রোগীদের চিকিৎসা দিতে পারছে না। এসব হাসপাতালের ১২৬টি অ্যাম্বুলেন্সও হামলার নিশানা ছিল।  

গাজায় হামাস যোদ্ধাদের প্রবেশ ঠেকাতে ২০২৩ সালের ১৪ অক্টোবর দক্ষিণ ইসরায়েলের কিবুটজ বিরিতে টহলরত একটি ইসরায়েলি ট্যাঙ্ক। ছবি : রয়টার্স

সৌদি আরবও প্রতিরক্ষা খাতের ব্যয় বড় করে চলেছে। ইসরায়েল ও সৌদি আরব ব্যয় বাড়ানোয় গত বছর মধ্যপ্রাচ্যের প্রতিরক্ষা বাজেট বেড়েছে ৯ শতাংশ, যা গত এক দশকের সর্বোচ্চ। 

মধ্যপ্রাচ্য বড় ধরনের সামরিক ব্যয়ের বোঝা বয়ে চলেছে। এই ব্যয় মধ্যপ্রাচ্যের জিডিপির ৪.২ শতাংশ। এতে বৈশ্বিক সামরিক ব্যয় প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে।  

ইউরোপে বদল

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইউক্রেনকে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সহায়তা বিঘ্নিত হওয়ায় পথ খুলেছে ইউরোপের রপ্তানিকারকদের। এই সুযোগে ফের উৎপাদন বাড়িয়েছে ইউরোপের অস্ত্র শিল্পগুলো।  

ওয়েজম্যান বলেন, “ইউরোপ গোলাবারুদ ও অন্যান্য অস্ত্র উৎপাদন বাড়াতে ব্যাপক প্রচেষ্টা চালাচ্ছে- সেটা এখন আরও খোলাখুলিভাবে।” 

গত মে মাসে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ আরও বেশি ইউরোপীয় প্রতিরক্ষা স্বায়ত্তশাসনের আহ্বান জানিয়েছিলেন। তবে সে বিষয়ে সবাই একমত নন।

কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসবিদ হিউগো ব্রোমলি আল জাজিরাকে বলেন, “ইউরোপজুড়ে আঞ্চলিক দেশগুলোকে রক্ষা ও ইউক্রেনকে সমর্থনে প্রতিরক্ষা শিল্পের অংশীদারিত্ব ইউরোপের সীমানা ছাড়িয়েছে।

“শেষ পর্যন্ত, প্রতিরক্ষায় ‘ইউরোপীয় স্বায়ত্তশাসন’ লক্ষ্যটি ছোট হওয়া উচিৎ। বরং বন্ধু ও মিত্রদের মধ্যে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিকাশে বেশি জোর দেওয়া উচিত।” 

“আমরা অবশ্যই নেতিবাচক কিছুর বাধা দেব”, যোগ করেন তিনি।  

সিপ্রির প্রতিবেদন বলছে, রাশিয়া পুরোমাত্রায় ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরু করায় গত বছর ন্যাটো সদস্য দেশগুলো তাদের সামরিক ব্যয় ১৬ শতাংশ বাড়িয়ে ৫৮৮ বিলিয়ন ডলার করে। এতে ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ন্যাটোর জিডিপির ২.৮ শতাংশ, যা ২০১৪ সালে ছিল ২ শতাংশ। তবে এই হারে ন্যাটোর সব দেশ ব্যয় করেনি। 

সিপ্রির পরিচালক ড্যান স্মিথ আল জাজিরাকে বলেন, ন্যাটোর এই ব্যয় বৃদ্ধি ইউক্রেনের মজুত বাড়াতেও একভাবে সাহায্য করেছে। এই সময় ইউরোপের নীতিনির্ধারকরা তিনগুণ চাপে পড়েছে।    

তিনি বলেন, “রাশিয়ার হুমকির মুখে তারা তাদের সামরিক মজুতকে অপর্যাপ্ত মনে করে। তাই মজুত আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হবে, … সঙ্গে সঙ্গে ইউক্রেনকে সরবরাহ চালিয়ে যেতে হবে।”  

এ কারণেই ইউরোপের সামরিক ব্যয় বাড়ছে, যা মহাদেশটিতে এ খাতে বদল আনছে বলে মনে করেন তিনি। 

যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনের জন্য ৬১ বিলিয়ন ডলারের সহায়তা প্যাকেজ ঘোষণা করে। তবে তার অনুমোদন গত অক্টোবরে কংগ্রেসে আটকে যায়। ছবি : এএফপি

পোল্যান্ড গত বছর ৭৫ শতাংশ ব্যয় বাড়িয়েছে। দেশটি জিডিপির ৩.৯ শতাংশ প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের দিকনির্দেশনায় দেশটির সশস্ত্র বাহিনীকে আধুনিকীকরণের জন্য ২ বিলিয়ন ডলারের ব্যাপক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাপনা কর্মসূচি আগেই ছিল। সেইসঙ্গে তাদের অস্ত্রশস্ত্রের মজুতও ব্যাপকভাবে বাড়ানো হয়েছে। 

রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণের পর থেকে পোল্যান্ড যুক্তরাষ্ট্রের লকহিড মার্টিন থেকে ৫০০টি হাইমার্স রকেট লঞ্চার, জেনারেল ডাইনামিকস থেকে ২৫০টি আব্রামস ট্যাংক এবং সাউথ কোরিয়া থেকে রকেট লঞ্চার, ট্যাংক, হাউইটজার ও যুদ্ধবিমান কিনেছে। ২০২০ সালে পোল্যান্ড লকহিড মার্টিন থেকে এফ-৩৫ মাল্টিরোল যুদ্ধবিমানের জন্য ৪.৬ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি করে। 

ন্যাটো সদস্য ফিনল্যান্ড। দেশটির রয়েছে রাশিয়ার সঙ্গে সবচেয়ে বড় সীমানা। তারাও প্রতিরক্ষা ব্যয় ৫৪ শতাংশ বাড়িয়ে জিডিপির ২.৪ শতাংশে নিয়ে গেছে। তারাও পরবর্তী প্রজন্মের যুদ্ধবিমান হিসেবে এফ-৩৫ কিনেছে এবং বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কিনেছে। এক বছরে ক্রয় ব্যয় তিনগুণ বাড়িয়েছে দেশটি। অন্যান্য উত্তর ইউরোপীয় ও বাল্টিক সাগরীয় দেশগুলো গত বছর ব্যাপকভাবে সামরিক ব্যয় বাড়িয়েছে। যুক্তরাজ্য এই অঞ্চলে এগিয়ে ছিল, ব্যয় বাড়ায় ৭.৯ শতাংশ। 

জার্মানির সামরিক খরচ 

ন্যাটোর অন্য দেশগুলোর চিত্রের বিপরীতে ছিল জার্মানি। ন্যাটোর চাহিদার ২ শতাংশের কাছাকাছি ব্যয় করতে দেশটিকে বেগ পেতে হয়েছে। 

২০২১ সালের ডিসেম্বরে চ্যান্সেলর এঙ্গেলা মের্কেল ক্ষমতা ছাড়ার আগে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের বারবার অনুরোধের পর প্রতিরক্ষা ব্যয় জিডিপির ১.৩৩ শতাংশে উন্নীত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। 

তবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর দুই মাস পর চ্যান্সেলর ওলাফ শোলজ জানান, তিনি প্রতিরক্ষায় আরও ১০০ বিলিয়ন ইউরো (১০৬ বিলিয়ন ডলার) খরচ করবেন, যা জার্মানিকে ২ শতাংশের সীমা অতিক্রম করাবে। 

তবে গত বছর জার্মানি তার প্রতিরক্ষা বাজেট ৯ শতাংশ বাড়িয়ে ৬৬.৮ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার পরও তা ছিল জিডিপির মাত্র ১.৫ শতাংশ। 

শোলজ চলতি বছর ২ শতাংশের সীমা অতিক্রম করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তবে সিপ্রির ড্যান স্মিথ মনে করেন না এটি ঘটবে।

স্মিথ বলেন, “এটি (২ শতাংশের সীমা অতিক্রম) হলে এক বছরে সামরিক ব্যয় এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি বৃদ্ধি হবে। আর তা জার্মানির মতো দেশে ঘটার কথা নয়। শিল্পসহ অন্যান্য খাতের গতির চাহিদায় বাজেট ঘাটতি পড়তে পারে।” 

জার্মানির সংবিধান তাদের সরকারকে জিডিপির শূন্য দশমিক ৩৫ শতাংশের বেশি বার্ষিক ঘাটতির সীমা বেঁধে দিয়েছে। এ জন্য সামগ্রিক ভারসাম্যপূর্ণ বাজেট দিতে হয় সরকারকে।    

কোভিড -১৯ মহামারীর পর ফেডারেল সাংবিধানিক আদালত দুই বছরের জন্য সেই নিয়মটি স্থগিত করে দিয়েছিল, যা জাতীয় জরুরি হিসেবে দেখা হয়েছিল। তবে দ্রুতই দেশটি সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতায় ফিরে আসে। 

গত বছর শোলজের সরকার জার্মানির পুনঃনবায়নযোগ্য শক্তিতে গতি আনতে কোভিড তহবিলের অব্যবহৃত অর্থ থেকে ৬০ বিলিয়ন ইউরো (৬৪ বিলিয়ন ডলার) খরচ করতে চাইলে তাও তাদের করতে দেওয়া হয়নি। 

স্মিথ বলেন, “এটি কোনও সাধারণ সমস্যা নয়, যে সহজে সমাধান করা যাবে। এটি আইনি, রাজনৈতিক ও শিল্প সংক্রান্ত বিষয়।”

অস্তিত্বের হুমকি 

সিপ্রির পরিসংখ্যান দেখিয়েছে, কখন কোন ইউরোপীয় সরকার রাশিয়াকে কৌশলগত হুমকি হিসেবে মনে করেছে। তবে এ বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেশের সরকারের মধ্যে খরচের পার্থক্য দেখা গেছে। 

২০১৪ সালে রাশিয়ার ক্রিমিয়া দখলের পর রাশিয়ার সঙ্গে সীমানা থাকা লাটভিয়া প্রতিরক্ষা ব্যয় ব্যাপকভাবে বাড়াতে শুরু করে। ২০২২ সালে তাদের বাজেট প্রায় তিনগুণ বেড়ে ৮২২ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়ায়।

লাটভিয়ার প্রতিবেশী লিথুয়ানিয়ারও ঘটনাও প্রায় একই। দেশটির রাশিয়ার কালিনিনগ্রাদ এলাকার সঙ্গে সীমানা রয়েছে। তাদের প্রতিরক্ষা ব্যয় ২০২২ সালে প্রায় চারগুণ বেড়ে ১.৭ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়ায়। ইউক্রেনের সঙ্গে সীমানা থাকা রোমানিয়াও ২০২২ সালের মধ্যে তাদের প্রতিরক্ষা ব্যয় দ্বিগুণ করে, তা ৫ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। 

পূর্ব ইউরোপের প্রতিরক্ষা ব্যয় গত বছর পশ্চিম ও মধ্য ইউরোপের তুলনায় তিনগুণ বেড়েছে। কারণ হিসেবে বলা যায়, রাশিয়া সংলগ্ন হওয়ায় তা একরকম ‘হুমকি’ মনে করছে পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো। তারা গত বছর ৩১ শতাংশ প্রতিরক্ষা ব্যয় বাড়িয়েছে।   

পশ্চিম ইউরোপের তুলনায় পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো সাধারণত জিডিপির একটি বড় অংশ প্রতিরক্ষা খাতে ব্যবহার করে। কারণ এই অঞ্চলের অর্থনীতি ছোট এবং তার উপর হুমকি আশঙ্কাও বেশি। 

এক্ষেত্রে গ্রিসের কথা বলা যায়। গ্রিস প্রতিবেশী তুরস্কের হুমকির কারণে তাদের জিডিপির ৩.৭ শতাংশ বাজেটে প্রতিরক্ষার জন্য বরাদ্দ রাখে। 

জার্মানি ছাড়া পশ্চিম ইউরোপও ধীরে ধীরে পূর্ব ইউরোপের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে একমত হচ্ছে। যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স রাশিয়াকে একটি হুমকি হিসেবে দেখে।

রাশিয়াকে ঠেকাতে পূর্ব ইউরোপের সামরিক বাড়ানোর যুক্তির সঙ্গে একমত ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)।  গত ১৮ এপ্রিল জি-৭ এর এক সভার পর ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রনীতি প্রধান জোসেপ বোরেল এক্সে লিখেছেন, “ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিরাপত্তাও ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। রাশিয়া আমাদের জন্য একটি অস্তিত্বের হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।”  

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ad

সর্বাধিক পঠিত