ক্যাসেটের গোল ফাঁকা অংশে আঙ্গুল নয়তো পেনসিল-কলম দিয়ে ঘুরিয়ে আটকে যাওয়া ফিতা ঠিক করে আবারও চালিয়ে গান শোনার দিন গত হয়েছে। সিডি আর এমপিথ্রি অনাদরে পড়ে রয়েছে। ইউটিউব আর স্পটিফাইয়ের যুগে ভিনাইল রেকর্ড নিয়ে আজকের প্রজন্মের অনেকেই জানেন না।
ক্যাসেট প্লেয়ার দেখেনি কখনও এমন প্রজন্ম আছে এখন। ওদিকে কমপিউটার ও ল্যাপটপে সিডি ড্রাইভে ধুলো পড়ে চলছে না সেসব। কিন্তু গানপ্রেমী শ্রোতাদের এক অংশ এখনও গ্রামোফোন চালিয়ে আয়েশী কানে এলপি মানে লং রেকর্ডে বিসমিল্লাহ খানের সানাই নয়তো নজরুল আর রবি ঠাকুরের গান শোনেন।
আজকের ছুটন্ত দিনে ধীরস্থিরতায় বসে গানে ডুবে গান শোনে কম লোকই। এসব ধারণা বাইরে কেউ কেউ আছেন, যারা বসার ঘরে চোখ মুদে কান পেতে বুক ভরে গান শুনতে ভালোবাসেন।
বাংলাদেশ অডিওফাইল সোসাইটি সব প্রজন্মের কাছে গান শোনার সেই পুরনো আমেজ তুলে ধরেছে; ফিরিয়ে আনতে উদ্যোগী হয়েছে।
এই সংগঠনের উদ্যোগে ২০ এপ্রিল দিনব্যাপী উদযাপিত হলো রেকর্ড স্টোর ডে।
২০০৭ সালে ১৪০০ রেকর্ড বিক্রেতা যুক্তরাষ্ট্রে এবং আন্তর্জাতিক ভাবে আরও হাজার বিক্রেতা মিলে এক উদযাপন আয়োজন করেছিল। এরপরের বছর, ২০০৮ সালের ১৯ এপ্রিল প্রথম রেকর্ড স্টোর ডে পালন হয়।
বাংলাদেশে প্রথমবার রেকর্ড স্টোর ডে আয়োজন করা হয়েছিল ২০২৩ সালের ২৯ এপ্রিল; ঢাকার ডেইলি স্টার আর্ট গ্যালারিতে। ওই আয়োজনে ১৬ জন রেকর্ড সংগ্রাহক ও বিক্রেতা অনেক দুর্লভ এলপি নিয়ে এসেছিলেন। অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেছিলেন সংগীতশিল্পী সৈয়দ আবদুল হাদী।
ভিনাইল আর ডিজিটাল মাধ্যমে গান শোনার পার্থক্য উপলব্ধি করাতে এবার ওই একই জায়গাতেই রেকর্ড স্টোর ডে হলো বাংলাদেশের আয়োজকদের পক্ষ থেকে।
এই আয়োজন উদ্বোধন করেন সংগীতশিল্পী মো. খুরশিদ আলম। মূল আলোচনায় ছিলেন প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান। অসুস্থতার কারণে এবার সৈয়দ আবদুল হাদী অংশ নিতে পারেননি। তবে গতবারের মতো এবারও যোগ দিয়েছিলেন লালনগীতির কণ্ঠ ফরিদা পারভীন।
এবারের আয়োজন উপলক্ষে একটি স্মরনিকা সবাইকে শুভেচ্ছা হিসেবে দেওয়া হয়। এতে ‘গান মানুষকে সুন্দর করে’ শিরোনামে নিবন্ধ লিখেছেন প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান।
কলের গানের যুগ ফিরে আসার সম্ভাবনা নিয়ে তিনি লিখেছেন, “গানের রেকর্ড হারিয়ে যাচ্ছিল। টেপ রেকর্ডার, সিডি প্রাধান্য পেয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু এ উপলক্ষ্যে প্রকাশিত ব্রোশিউরটা পড়ে আজ যে হিসাব জানলাম, তাতে বুঝলাম যে রেকর্ড আবার ফিরে আসছে।”
এলপিতে গান শোনার যুগ মনে করে তিনি বলেন, “ষাটের দশকের মাঝামাঝি থেকে ঢাকায় গান রেকর্ড করা শুরু হয়েছে। শিল্পী সৈয়দ আবদুল হাদী ভাই বলছিলেন, ১৯৬৭ সালে তার প্রথম গান রেকর্ড হয়। তারপর এলপি রেকর্ড বের হয়।
“মনে পড়ে, তখন আগা খান সম্প্রদায়ের এক ব্যক্তির ঢাকার পুরানা পল্টনে একটা খাবারের দোকান ছিল। তিনি নানাভাবে ছোট-বড় রেকর্ড নিয়ে আসতেন। সেখান থেকে সংগ্রহ করতাম আমরা।”
এলপি কী?
আশির দশক থেকে সিডির বাজারে প্রতিযোগিতায় আর টিকতে পারেনি এলপি রেকর্ড। তবে ২০১০ সাল থেকে পশ্চিমে আবারও এলপি বাজার লাখ লাখ আয়ের মুখ দেখে। তখন থেকেই শ্রোতাদের মনে একটি কথা বেজে ওঠে, এলপির দিন তাহলে ফিরছে?
১০ থেকে ১২ ইঞ্চি ব্যাসের কালো ডিস্কের মাঝে সাঁটানো কাগজে ৩৩ ১/৩ লেখা থাকার অর্থ আজকের প্রজন্মের অনেকে বুঝতে অপারগ হতে পারেন।
৩৩ ১/৩ আরপিএম বলতে রেভুলুশনস পার মিনিট বা ঘূর্ণন গতি বোঝায়। একটি ১২ ইঞ্চির এলপির একেক পাশে ২২ থেকে ২৫ মিনিট পর্যন্ত গান চলতে পারে। সাত ইঞ্চি ব্যাসের ডিস্কে সাধারণত ৪৫ আরপিএম লেখা থাকে; এগুলোকে ইপি বা এক্সটেনডেড প্লে রেকর্ড বলে।
কলের গান কথাটা শোনা রয়েছে অনেকের। এর অন্য নাম গ্রামোফোন। এলপি আর ইপি বাজাতে দরকার গ্রামোফোন। কম হলেও ঢাকায় গ্রামোফোন কেনার দোকান রয়েছে, যেখানে ৬০ হাজার থেকে লাখ টাকায় গ্রামোফোন কেনা যায়।
এলপির দাম ৬০ হাজার টাকা
ডেইলি স্টার আর্ট গ্যালারির দরজার ঠিক বাইরে গলিতে বসেছিল ভিনাইল রেকর্ডের মেলা। বড় বড় রঙিন খাম উল্টেপাল্টে যেন ইতিহাস দেখছিলেন একেকজন দর্শনার্থী।
এসব খামের রাখা রেকর্ডে সংগ্রহে রয়েছে অজয় চক্রবর্তী, ক্লাসিকাল মিউজিক অব ইন্ডিয়া, ওয়েস্ট মিটস ইস্ট, পান্নালাল ঘোষ, ওস্তাদ আলী আকবর খান।
সকাল সন্ধ্যার কাছে সুরসপ্তক প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার মাহমুদ হোসেন ডন জানালেন, অনেকের ব্যক্তিগত যেমন বাবা-দাদার সংগ্রহ থেকে এলপি কিনে নিয়েছেন তারা।আবার দেশের বাইরে থেকেও কিনে আনা হয় কিছু কিছু এলপি। এগুলো পরে আগ্রহী শ্রোতাদের কাছে বিক্রি হয়।
১৯৫৪ সালের রেকর্ডও সংগ্রহে আছে সুরসপ্তকের কাছে।
“এমন অ্যালবামও আছে, যার মধ্যে ১৯০৮ সালে জোহরাবাইয়ের গানও আছে।”
কোন প্রজন্মের শ্রোতারা এখনও এলপি কেনেন?
“বেশির ভাগই ৪০ পেরোনো শ্রোতা… বলা যায় ৯৮ শতাংশই এই বয়সী। অল্প বয়সীদের কম দেখা যায়।”
আজকের এলপি রেকর্ড কিনতে কেমন খরচ পড়বে শ্রোতাদের?
“সর্বনিম্ন দাম এক হাজার। আবার হাজার তারের বীণা অ্যালবামটা – এটার দাম ৬০-৭০ হাজার টাকার কম না। এই অ্যালবাম রেকর্ড হয়েছিল শহীদ আলতাফ মাহমুদের নির্দেশনায়। তারমানে এটার রেকর্ড হয়েছিল স্বাধীনতার আগে।”
ইউনিভার্সাল মিউজিক প্রতিষ্ঠানের প্রধান সৈয়দ দানিক সকাল সন্ধ্যাকে বললেন, তাদের সংগ্রহে সবচেয়ে পুরনো রেকর্ড আছে ১৯০১ সালের। এছাড়া ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত প্রকাশিত রেকর্ডও আছে।
এখান থেকে ইংরেজি, বাংলা এবং হিন্দি গানের এলপি ১৫০০ টাকা করে কেনা যাবে।
৩৩ ১/৩ এবং ৪৫ আরপিএমের ভিনাইল রেকর্ড দেখালেন তিনি সকাল সন্ধ্যাকে।
এলপি রেকর্ড চিরদিনের
“যতই ডিজিটাল হোক না কেন, এই জিনিস (এলপি রেকর্ড) চিরদিন থাকবে যদি যত্ন করা হয়”; মঞ্চে দাঁড়িয়ে একথা বললেন খুরশীদ আলম।
তবে এর সঙ্গে বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভের ভূমিকা থাকার বিষয়েও দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তিনি।
কলের গান যুগের সঙ্গে আজকের প্রজন্মকে পরিচয় করিয়ে দিলে তারা ‘আব্বাস উদ্দিন, আবদুল আলীমকে নিয়ে জানবে’ বলে মনে করনে এই শিল্পী।
অনুষ্ঠানের আয়োজকদের উদ্দেশ্যে এই কণ্ঠশিল্পী বলেন, “রুনা লায়লা এখনও জীবিত আছেন … আপনারা যদি ফান্ড রাইজ করতে চান … সরকারকে ভালো করে বোঝাবেন তাদের অর্থের প্রয়োজন নাই, আমরা ফান্ড কালেক্ট করব। এই শিল্পীগুলোকে নিয়ে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী কেন্দ্রিক আয়োজন করেন।”
স্মৃতি থেকে খুরশিদ আলম বলেন, ১৯৬৬ সালে গানের জন্য অডিশন দিয়েছিলেন তিনি।
খুরশিদ আলম শুরুতে সি গ্রেড শিল্পী ছিলেন; সম্মানি ছিল ২০ টাকা। ওই সময় এ গ্রেডের শিল্পীরা পেতেন একশ টাকা।
অনুষ্ঠানে তিনি বললেন, আজাদ রহমানের সুরে জেবুন্নেসা জামানের লেখা চঞ্চল দুনয়ন গানটি আজকেও অনেকে ‘এত স্পিডে করা গান’ বলে থাকেন।
গানটি খালি গলায় গেয়েও শোনান তিনি।
দর্শক-শ্রোতাদের থেকে চুমকি চলেছে গানটির অনুরোধ আসে অবধারিত ভাবেই। সময় না থাকায় তুমুল জনপ্রিয় এই গান না গাইলেও, বন্দি পাখির মতো গানটি প্রায় পুরোটাই গান এই শিল্পী।