Beta
রবিবার, ১৯ মে, ২০২৪
Beta
রবিবার, ১৯ মে, ২০২৪

সাক্ষাৎকার

গণহত্যার স্বীকৃতি নিয়ে আমাদের সম্মিলিত সাধনা দরকার

মফিদুল হক

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার ও তাদের দোসরদের নৃশংস গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের শিকার হয়ে সেটাকে প্রতিরোধ করেই স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ২০১০ সালে দেশে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার শুরু হয়েছে এবং ২০১৭ সাল থেকে ২৫শে মার্চ জাতীয় গণহত্যা দিবস রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন করা হচ্ছে। এখন আলোচনা হচ্ছে বাংলাদেশে একাত্তরের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি নিয়ে। বাংলাদেশ গণহত্যা-১৯৭১-এর বিভিন্ন দিক নিয়ে সকাল সন্ধ্যার সঙ্গে কথা বলেছেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আশফাকুর রহমান

গণহত্যার স্বীকৃতি নিয়ে আমাদের সম্মিলিত সাধনা দরকার

মফিদুল হক

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার ও তাদের দোসরদের নৃশংস গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের শিকার হয়ে সেটাকে প্রতিরোধ করেই স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ২০১০ সালে দেশে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার শুরু হয়েছে এবং ২০১৭ সাল থেকে ২৫শে মার্চ জাতীয় গণহত্যা দিবস রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন করা হচ্ছে। এখন আলোচনা হচ্ছে বাংলাদেশে একাত্তরের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি নিয়ে। বাংলাদেশ গণহত্যা-১৯৭১-এর বিভিন্ন দিক নিয়ে সকাল সন্ধ্যার সঙ্গে কথা বলেছেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আশফাকুর রহমান

সকাল সন্ধ্যা: গণহত্যা বিষয়টি কি মানবসভ্যতার আধুনিক পর্বের ধারণা? সমকালীন বিশ্বে এই ধারণাটিকে আমরা কীভাবে গ্রহণ করেছি?

মফিদুল হক: ‘জেনোসাইড’ বা ‘গণহত্যা’ বিষয়ক স্কলার লিও কপার বলেছেন, ‘‘দ্য ওয়ার্ড ইজ নিউ। বাট ক্রাইম ইজ অ্যানসিয়েন্ট।’’ ‘‘শব্দটা নতুন। কিন্তু অপরাধটা প্রাচীন।’’ এই অপরাধটা প্রাচীনকাল থেকেই হয়ে আসছে। এই এক কথাই বুঝিয়ে দেয় যে সংগঠিত নৃশংসতা— যেটা কোনও একটা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়। সেখানে পুরো গোষ্ঠীকে অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করা হয় বা নিশ্চিহ্নকরণের লক্ষ্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। সে সময় নারী, শিশু, বৃদ্ধ— কিংবা বেসামরিক-সামরিক কোনও পার্থক্য থাকে না। এই ধরনের নৃশংসতা প্রাচীন ইতিহাসের সূচনাকাল থেকেই ঘটে আসছে।

এটা একটা বড় সাংগঠিক রূপ নিল দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়। জার্মানরা অত্যন্ত অগ্রসর ও সুসভ্য জাতি। কিন্তু তারাই এরকম একটি নৃশংসতা ঘটাল ইউরোপে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়। আগে থেকেই যেটা নানাভাবে দানা বাঁধছিল— ইহুদি বিদ্বেষ। এর চেয়ে বড় কথা হলো, একটি জাতিকে যদি বিপথে পরিচালিত করতে হয়, তাহলে একটা শত্রু দাঁড় করাতে হয়।

এই শত্রুকে নানাভাবে দাঁড় করানো যায়। সমাজে নানা ধরনের বিভাজন থাকে, বিভেদ থাকে, সংঘাত থাকে। সেটাকে ইহুদি বিদ্বেষের ভিত্তিতে বলা যায়, একটা বড় রকমের সাংগঠনিক রূপ দিল। রাষ্ট্র, সরকার, সেনাবাহিনী, সহযোগী বাহিনী, সহযোগী দল-মানুষ সবাইকে সম্পৃক্ত করে এই নৃশংসতা ঘটানো হলো। যেটা দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়ে সবটা জানাও যায়নি। কিন্তু মহাযুদ্ধ অবসানের পর বোঝা গেল তার মাত্রা। যেটাকে ‘হলোকাস্ট’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। আর বড়ভাবে তখনই এই ‘জেনোসাইড’ শব্দটার উদ্ভব।

পোলিশ-ইহুদি আইনজীবী রাফায়েল লেমকিন ১৯৪৪ সালে ‘জেনোসাইড’ শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন। ১৯৪৮ সালে জেনোসাইড কনভেনশনের মধ্য দিয়ে বিষয়টি বিশ্বজনীন স্বীকৃতি পেল। ফলে শব্দটি নতুন। অপরাধটা প্রাচীন। আর শব্দটা যখন তৈরি করা হলো, তখন এর যে আইনগত ধারা, এর পটভূমি, কীভাবে ঘটে— এতে যুক্ত করা হলো। ত্রিশের দশকের অভিধানে আমরা ‘জেনোসাইড’ শব্দটি পাব না— চল্লিশের দশকেও পাব না। এখনতো এই শব্দটি দুর্ভাগ্যক্রমে আমাদের কাছে সুপরিচিত শব্দ।

সকাল সন্ধ্যা: মুক্তিযুদ্ধ, আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং গণহত্যার অভিজ্ঞতা আমরা বহন করছি। এ অভিজ্ঞতার ৫০ বছরও আমরা অতিক্রম করেছি। আমাদের স্মৃতি ও চর্চায় এই গণহত্যার বিষয়টি কীভাবে আছে বলে মনে করেন?

মফিদুল হক: আমরা এই গণহত্যার শিকার। যেটা ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ শুরু হয়েছে। একটা সেনাবাহিনী সংগঠিতভাবে গোটা জাতির বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করল। এটা যে গণহত্যা হচ্ছিল সেটা শুরু থেকেই বোঝা যাচ্ছিল। ক্রমে ক্রমে সেটা আরও পরিষ্কার হয়েছে বিভিন্ন প্রতিবেদন-লেখায়। সাংবাদিকদের কথায়, শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেওয়া মানুষদের কথায় গণহত্যার বিষয়টি উঠে এসেছিল।

বলা যায় যে, নিগৃহীত হওয়া, লাঞ্ছিত হওয়ার যে বিবরণগুলো তারা দেশ থেকে নিয়ে গেছে, নিকটজনকে যে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে সেসব অভিজ্ঞতা এবং বধ্যভূমির কথাও ধামাচাপা থাকেনি। বিশ্ববাসীও জেনেছে এ কথা। শরণার্থী শিবিরে বা প্রবাসে যারা বাংলাদেশি ছিলেন কিংবা বাংলাদেশ সরকারও এই কথা নানাভাবে বলেছে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও এই কথা নানাভাবে উচ্চারিত হয়েছে।

এই অভিজ্ঞতা আমরা বহন করি। এই অভিজ্ঞতা নিয়েই মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী আমাদের যে যাত্রা সেখানে ১৯৭৩ সালে আমরা আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত প্রতিষ্ঠা করি। এ সময় এই গণহত্যার বিচার করা, গণহত্যার স্বীকৃতি— এই কথাগুলো তো ছিল। তবে, বিচার দাবিটাই সেখানে খুব বড় করে উঠে এসেছিল।

বাংলাদেশই এই বিচারের পদক্ষেপ নিয়েছিল। পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর জাতির  উল্টোপথে যাত্রা আমাদেরকে অনেকটা বিস্মৃতিতে ঠেলে দিয়েছিল। এখন আবার আমরা সেখান থেকে ফিরে আসছি। আমাদের জাতীয় অভিজ্ঞতা গণহত্যাকে কেন্দ্র করেই চলছে। অনেক বাধাবিঘ্নের সম্মুখীন আমরা হয়েছি, আবার এটাকে আমরা সামনে নিয়ে এসেছি।

২৫শে মার্চ কারও স্বীকৃতির জন্য অপেক্ষা করেনি। জাতি দিনটিকে স্মরণ করেছে। ২৫শে মার্চের পিঠেপিঠেই ২৬শে মার্চ আমরা উদযাপন করি। আমাদের অভিজ্ঞতায় এটা রয়েছে— নৃশংসতার সঙ্গে প্রতিরোধ। ১৪ই ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস সেটাতো আমরা সূচনা থেকেই বিশেষভাবে স্মরণ করি। এটাও গণহত্যার একটা নৃশংস দিক। এরপরেই রয়েছে ১৬ই ডিসেম্বর— আমরা বিজয় দিবস উদযাপন করি।

সকাল সন্ধ্যা: এই প্রক্রিয়াকে আমরা ‘জাতীয় অভিজ্ঞতা’ বলব নাকি ‘জাতীয় স্মৃতি’ বলব?

মফিদুল হক: অভিজ্ঞতা ও স্মৃতি দুটোই পরিপূরক। দুটোই বলা যায়। এমন নির্মম ঘটনা থেকে শিক্ষা নেওয়া স্মৃতির একটা অংশ। স্মৃতি এবং অভিজ্ঞতা দুটোই আমি ব্যবহার করতে পারি।

সকাল সন্ধ্যা: এই অভিজ্ঞতা বা স্মৃতি বহন করা— বিস্মৃতি থেকে স্মৃতির কাছে ফেরা সেখানে ২৫শে মার্চ ‘গণহত্যা দিবস’ পালন করছে বাংলাদেশ। এ অবস্থায় পৌঁছানোর বিষয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ জানতে চাই।

মফিদুল হক: ২০১৭ সালে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ সর্বসম্মতভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, ২৫শে মার্চ বাংলাদেশে ‘জাতীয় গণহত্যা দিবস’ হিসেবে পালিত হবে। এমন দিবস বিশ্বের আরও অনেক দেশেই আছে। অনেক দেশেই দেখা গেছে, গণহত্যা একটা বিশেষ দিনে শুরু হয়েছিল— একটা বিশেষ দিনে গিয়ে এটা শেষ হয়েছে। কম্বোডিয়ার গণহত্যার ক্ষেত্রে আমরা বলি ১৭ এপ্রিল। কিংবা রুয়ান্ডার গণহত্যার কথার ক্ষেত্রেও এরকম। অনেক ক্ষেত্রে যেমন ইউরোপে ‘হলোকাস্ট’ কবে শুরু হয়েছিল— এ বিষয়ে একটি দিনক্ষণ বলা যাবে না। কিন্তু তারাও একটি দিনকে বেছে নিয়েছে। যখন ইহুদিদের বাড়ি-ঘর থেকে তুলে নিয়ে ট্রেনে করে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে পাঠানো হয়েছিল— সেইদিনটিকিই তারা স্মরণ করে।

আমরাও স্মরণ করে যাচ্ছি। ২৫শে মার্চ কারও স্বীকৃতির জন্য অপেক্ষা করেনি। জাতি দিনটিকে স্মরণ করেছে। ২৫শে মার্চের পিঠেপিঠেই ২৬শে মার্চ আমরা উদযাপন করি। আমাদের অভিজ্ঞতায় এটা রয়েছে— নৃশংসতার সঙ্গে প্রতিরোধ। ১৪ই ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস সেটা তো আমরা সূচনা থেকেই বিশেষভাবে স্মরণ করি। এটাও গণহত্যার একটা নৃশংস দিক। এরপরেই রয়েছে ১৬ই ডিসেম্বর— আমরা বিজয় দিবস উদযাপন করি।

আমরা অনেক উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে গিয়েছি। ২০১০ সালে গণহত্যার বিচারের জন্য আমরা আবার ট্রাইবুনাল প্রতিষ্ঠা করেছি। ২০১৭ সালে জাতীয় সংসদ গণহত্যা শুরুর দিনটির স্বীকৃতি দিয়েছে। এভাবেই বহু বাধাবিঘ্ন মোকাবেলা করে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি।

সকাল সন্ধ্যা: এই দিনটির কর্মশক্তি তাহলে কী হওয়া উচিত? রাষ্ট্র থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এই দিনটি নানাভাবে উদযাপন করছে। কেউ কেউ বলছেন, এ দিবসটির নাম ‘জাতীয় গণহত্যা দিবস’ না হয়ে ‘জাতীয় গণহত্যা স্মরণ দিবস’ হওয়া উচিত। এ দিনটির মধ্য দিয়ে আমরা স্মরণ করব সেই গণহত্যার কথা। যার মধ্য দিয়ে বিশ্ববাসী জানবে, প্রাচীন এই অপরাধের শিকার হয়েছে বাংলাদেশের মানুষ…

মফিদুল হক: এটা গণহত্যা দিবস— ‘বাংলাদেশ গণহত্যা দিবস’। তার অর্থটাই হচ্ছে— স্মরণ। আমরাতো স্মরণটা করেই আসছি। ২৫শে মার্চ আমরা বহুরকম উদযোগের মধ্য দিয়ে স্মরণ করেছি। এখন এটা একটা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেয়েছে। রাষ্ট্রের স্বীকৃতির মানে হচ্ছে, রাষ্ট্রের একটা দায়িত্ব রয়েছে আর সমাজেরও একটা দায়িত্ব রয়েছে। সমাজই কিন্তু এটাকে সম্ভব করে তুলেছে।

রাষ্ট্র যখন এটাকে বিস্মৃতির দিকে ঠেলে দিচ্ছিল, তখন জাহানারা ইমামের আন্দোলনই বলি বা নানারকম স্মৃতি রক্ষার প্রয়াসই বলি— নানারকম লেখা-স্মৃতিকথা কিংবা শৈল্পিকভাবে উপস্থাপনের কথাই বলি— এটাকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে। ফলে আমাদের একটা বিশাল জাতীয় উদযোগ এখানে যুক্ত আছে।

এখন এই দিনটি রাষ্ট্রীয়ভাবে পালিত হয়। যেসব দেশে বাংলাদেশের দূতাবাস সেখানেও এই দিনটি পালিত হচ্ছে। প্রবাসী বাংলাদেশিদের এখানে যুক্ত হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে। এই দিনটাকে আমরা যতভাবে ব্যবহার করতে পারব, ততই দিনটির গুরুত্ব আমরা বুঝতে পারব। আমাদের এই দিনটি কেবল স্মরণ নয়— স্মরণ থেকে শিক্ষা নেওয়া। এই দিনে কী ঘটেছিল— কীভাবে ঘটেছিল— কেন ঘটেছিল— এটাও আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ।

এই শিক্ষাটাও গুরুত্বপূর্ণ যে, ধর্মকে ব্যবহার করে, বিকৃত করে এই গণহত্যার পরিবেশটা তৈরি করা হয়েছিল। মানুষকে অমানবিক করে তোলা হয়েছিল। তাই এই দিনটির শিক্ষা আজকের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এই দিনে স্মরণটাই আমাদের ভিত্তি— আমরা কিছুই ভুলব না।

সকাল সন্ধ্যা: এই দিনটিকে নিয়ে বাংলাদেশ গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি নিয়ে বিভিন্নভাবে লেখালেখি ও আলাপ-আলোচনা হচ্ছে। এ কাজটির কতটা অগ্রগতি হলো?

মফিদুল হক: নানাভাবেই হচ্ছে। আরও অনেকভাবে হওয়ার আছে। যতবেশি মানুষকে আমাদের গণহত্যার কথা জানাতে পারব— এই যে হলোকাস্ট নিয়ে এখনও কথা হচ্ছে নানাভাবে। স্টিভেন স্পিলবার্গ যে ‘শিন্ডলার্স লিস্ট’ নামে যে চলচ্চিত্রে নির্মাণ করলেন— কত বছর পর করলেন? এই ছবি থেকে যে আয় হলো, সেটা দিয়ে তিনি ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ায় একটি আর্কাইভ তৈরি করলেন, সেখানে স্মৃতিভাষ্য সংরক্ষণ করা হবে— যেটা মানুষদের কাছে উপস্থাপন করা হবে। আমাদেরও এমন বহু উদযোগ নিতে হবে। বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মও এটা নানাভাবে ধারণ করবে— বহন করবে।

সকাল সন্ধ্যা: রাষ্ট্রীয় পরিসরে গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়ার প্রচেষ্টাকে কি আপনি যথেষ্ট মনে করছেন?

মফিদুল হক: গণহত্যার ক্ষেত্রে যথেষ্ট কথাটি কোনওভাবে প্রযোজ্য নয়। কিন্তু নানাভাবে তো বাংলাদেশ গণহত্যা এখন সামনে আসছে। ২৫শে মার্চ আমাদের সামনে এই সুযোগ এনে দিয়েছে। বাংলাদেশ গণহত্যা নিয়ে রাষ্ট্রীয় উদযোগ আছে। এর সঙ্গে সামাজিক উদযোগগুলোকে সম্পৃক্ত করা দরকার। সামাজিক এই উদযোগগুলোকে রাষ্ট্রীয়ভাবে সমর্থন করা প্রয়োজন। গণহত্যার স্বীকৃতি নিয়ে আমাদের একটি সম্মিলিত সাধনা দরকার। আমার মনে হয়েছে যে, সুযোগটা তৈরি হয়েছে। কিন্তু সুযোগটা আমরা পরিপূর্ণভাবে ব্যবহার করছি না।

সকাল সন্ধ্যা: সুযোগ যে তৈরি হয়েছে সেটি কি আমরা আসলেই ব্যবহার করছি না— নাকি করতে পারছি না…

মফিদুল হক: করছি না এই অর্থে যে, করার জন্য নানারকম আয়োজন দরকার। আমরা বিষয়টিকে শুধু একটি দিবস পালনের জন্য পর্যবসিত করলে হবে না। আয়োজনটা কিন্তু সমাজে নানাভাবে আছে। আমাদের দেশে নানা জায়গায় অসংখ্য বধ্যভূমি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এর অনেকগুলো এখন সংরক্ষিত হচ্ছে। সরকার সেখানে একটা স্থাপনা করে দিয়েছে। কিন্তু আমরা দেখব যে, সারা বছর সেই বধ্যভূমি অপরিচ্ছন্ন-পরিত্যক্ত স্থান হয়ে আছে। বিষয়টি খুব দুর্ভাগ্যজনক। এ বিষয়ে সমাজেরও ভূমিকা আছে।

সারা দেশে আমাদের অসংখ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে। নতুন পাঠ্যক্রমে এখন অনেক বিষয় নিয়ে আসা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে, শেখার জন্য শিক্ষার্থীকে শ্রেণিকক্ষের বাইরে যেতে হবে। এলাকা অনুযায়ী বধ্যভূমির কথা পাঠ্যবইয়ে আছে। এর ফলে কিন্তু একটি সুযোগ তৈরি হয়েছে। এতে ছাত্র-ছাত্রীদের তার এলাকার বধ্যভূমিকে শনাক্ত করতে উৎসাহিত করা হচ্ছে। ফলে সুযোগটা আরও প্রসারিত হয়েছে।

আমি বিষয়টি দেখি এভাবে, বধ্যভূমি রক্ষা ও গণহত্যা বিষয়ে আরও বড় সম্মিলিত সামাজিক উদযোগের প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে। এক্ষেত্রে অবশ্যই সরকারের ভূমিকা আছে। তবে আমরা কেউ কাউকে দোষারোপ করে কোনও কিছু করতে পারব না। বরং আমাদের আত্মজিজ্ঞাসাটা অনেক বড়। এর মধ্য দিয়ে প্রত্যেকের করণীয় অনেক কিছু আছে। গণমাধ্যমেরও করণীয় আছে। ২৫শে আসলে তারা সক্রিয় হয়ে ওঠে। এ দিনটি চলে গেলে বিষয়টি পেছনে পড়ে যায়। তবে এটা কিন্তু একটা প্রবাহের মতো। একটা টেউ এসে আরেকটা ঢেউকে নিয়ে যায়। কিন্তু অন্তঃসলিলা একটা প্রবাহ আছে। গণহত্যা স্মরণ ও অভিজ্ঞতা হচ্ছে একটা অন্তঃসলিলা প্রভাব। এটাকে আমরা যতটা পরিপুষ্ট করতে পারব ততই এটা বহমান থাকবে।

সকাল সন্ধ্যা: মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের গণহত্যা চর্চা কেন্দ্র নিয়ে আলাদা আয়োজন আছে। এ কাজটি সম্পর্কে জানতে চাই।

মফিদুল হক: মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর শুরু হয়েছিল খুব ছোটভাবে— মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণ। এই কাজটি করতে গিয়ে সমাজের সম্পৃক্ততা নানাভাবে যুক্ত হলো— বাড়তে লাগল। এর ফলে অনেক দায়বদ্ধতাও চলে আসে। ইতিহাসের কাছে আমাদের বড় দায়বদ্ধতা হলো— এই গণহত্যার বিচার— ন্যায় প্রতিষ্ঠা। এ বিচারের জন্য ২০১০ সালে আমরা একটা পরিবর্তন দেখলাম। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল গঠিত হলো।

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের স্মৃতি সংরক্ষণের কাজের সঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই গণহত্যার বিষয়টি চলে আসে। তখন আমরা ছোট পরিসরে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজন করলাম। এ পর্যন্ত আমরা নয়টি এমন সম্মেলনের আয়োজন করেছি। এরই অংশ হিসেবে আমরা ‘সেন্টার ফর দ্য স্টাডি অব জেনোসাইড অ্যান্ড জাস্টিস’ প্রতিষ্ঠা করলাম। তরুণদেরকে এ বিষয়ে অবহিত এবং দক্ষ করে তুলতে আমাদের এই প্রয়াস।

২০১৭ সালে যখন রোহিঙ্গা সংকট যুক্ত হলো, আমরাও এই গণহত্যাকে বিশ্বের সামনে উপস্থাপন করলাম। প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের সীমানা খুলে দিয়েছিলেন তাদের আশ্রয় দিতে, মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারত যেভাবে তাদের সীমানা খুলে দিয়েছিল। এখন বাংলাদেশে ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থী হিসেবে আছে। এটা নিয়ে কাজ করতে গিয়ে বাংলাদেশ গণহত্যার কথা আমরা জোর গলায় বিশ্বের কাছে তুলে ধরি। এরই মধ্যেই গাজায় পরাশক্তিগুলো যা করছে— চলমান গণহত্যা। এ ঘটনায় বিশ্বের মানুষ প্রতিবাদ জানাচ্ছে। বাংলাদেশে গণহত্যা বিচারের কাজটি হচ্ছে। এ নিয়ে আমাদের আরও সরব হতে হবে।

জল্লাদখানা একটা বধ্যভূমি। কিন্তু এই বধ্যভূমি সারাদেশের আরও বধ্যভূমির সঙ্গে যুক্ত, একইসঙ্গে আন্তর্জাতিকভাবেও যুক্ত। ফলে সারাদেশে থাকা বধ্যভূমিগুলোর নাম জল্লাদাখানায় থাকা সমাধি ফলকে লেখা আছে। এছাড়া বিশ শতকে বিশ্বে ঘটে যাওয়া গণহত্যার নামগুলো লেখা হয়েছে দেয়ালে। সেখানে সবশেষে খোদিত আছে— চলমান।

সকাল সন্ধ্যা: মুক্তিযুদ্ধের জাদুঘরের তত্ত্বাবধানে ও প্রচেষ্টায় মিরপুরে নির্মিত হয়েছে ‘জল্লাদখানা বধ্যভূমি স্মৃতিপীঠ’। স্মৃতি কিভাবে সংরক্ষণ করা যায়— সেটি এই স্থানটিতে উপস্থাপন করা হয়েছে নানাভাবে। শৈল্পিক দৃষ্টিকোণ থেকে এই উপস্থাপনাকে আপনি কীভাবে বিশ্লেষণ করবেন?

মফিদুল হক: কবি ও স্থপতি রবিউল হুসাইনের সঙ্গে আমি জল্লাদখানা বধ্যভূমি স্মৃতিপীঠ-এ কাজ করেছিলাম। আমরা একত্রে এই স্মৃতিপীঠের ধারণাটি তৈরি করেছি। রবিউল হুসাইন স্থাপত্যের কাজগুলো চমৎকারভাবে করেছেন। এছাড়াও এ কাজের সঙ্গে আরও অনেকে যুক্ত আছেন। শিল্পী রফিকুন নবী ম্যুরাল করেছেন— সেটাও খুবই অসাধারণ একটা কাজ।

জল্লাদখানা একটা বধ্যভূমি। কিন্তু এই বধ্যভূমি সারাদেশের আরও বধ্যভূমির সঙ্গে যুক্ত, একইসঙ্গে আন্তর্জাতিকভাবেও যুক্ত। ফলে সারাদেশে থাকা বধ্যভূমিগুলোর নাম জল্লাদখানায় থাকা সমাধি ফলকে লেখা আছে। এছাড়া বিশ শতকে বিশ্বে ঘটে যাওয়া গণহত্যার নামগুলো লেখা হয়েছে দেয়ালে। সেখানে সবশেষে খোদিত আছে— চলমান। এই স্থানে একটি পরিত্যক্ত জলাধার ছিল। সেই জায়গাটা রবিউল ভাই দারুণভাবে পুর্নগঠন করেছেন।

এই স্মৃতিপীঠকে ঘিরে মিরপুরবাসী সম্পৃক্ত হয়েছেন। এ কাজের সঙ্গে শুরু থেকেই যুক্ত ছিলেন বাবলু ভাই, যিনি গণহত্যার একজন প্রত্যক্ষদর্শী। তিনি প্রয়াত হয়েছেন। গণহত্যায় যারা স্বজনদের হারিয়েছেন, তাদের পরিবারও যুক্ত হয়েছেন। যার ফলে এটা এখন একটা সজীব স্মৃতিপীঠ।

এই স্থানকে ঘিরে এখন নানারকম কার্যক্রম হয়। এটাকে ঘিরে আমরা গণহত্যায় স্বজন হারানো পরিবার ও মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের তৃতীয় প্রজন্মদের দিয়ে একটি গানের দল করেছিলাম— ‘বধ্যভূমির সন্তান দল’। এখন একটা নাটকের দল তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশে শিল্পকলা একাডেমির সঙ্গে এটা নিয়ে আমরা কাজ করেছি। এই প্রতিষ্ঠানটিও সারাদেশ বধ্যভূমি নিয়ে নাটক করেছে। খুবই দারুণ ছিল এই আয়োজন— স্থানীয়দের এটা আলোড়িত করেছে। এখন এসব কাজ আরও বেশি করে তরুণ প্রজন্মকে করতে হবে।

সকাল সন্ধ্যা: সজীব স্মৃতিপীঠ— ‘সজীব স্মৃতি’। গণহত্যার স্মৃতি ও অভিজ্ঞতা কীভাবে সজীবভাবে আমাদের এগিয়ে নিতে পারে বলে আপনি মনে করেন?

মফিদুল হক: অবশ্যই গণহত্যা একটা সজীব স্মৃতি। বাংলাদেশে একটা পরিবারও পাওয়া যাবে না, যারা এই অভিজ্ঞতার কারণে কোনও না কোনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়েছে। মানুষদের স্থানচ্যুত হতে হয়েছে। এক কোটি মানুষকে সীমান্ত পার হয়ে শরণার্থী হতে হয়েছে। মানুষ কখন তার ভিটে-মাটি ছেড়ে— দেশ ছেড়ে সীমান্ত পাড়ি দেয়? যখন সে চরম বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়— নানারকম হত্যালীলার শিকার হয়। এই স্মৃতি আমরা কখনও ভুলে যেতে পারি না।

এই স্মৃতি যেমন আমাদের অতীতকে স্মরণ করিয়ে দেয়, তেমনি একটা শক্তিও দেয়। আমরা এইসব প্রতিরোধ করে, মুক্তিযুদ্ধ করে বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছি। ফলে আমাদের অনেক দায়বদ্ধতা রয়েছে এই স্মৃতির কাছে। এই দায়বদ্ধতার মূল দিক হচ্ছে ওই মূল্যবোধটা— সম্প্রীতির সমাজ, মানবিক সমাজ এবং সব মানুষের বিকাশের অধিকার দিতে হবে।

আজকে আমরা দেখি, এটাও নানাভাবে বিপর্যস্ত হচ্ছে। অনেক অর্জন আছে, অনেক পশ্চাৎগামীতা আছে, অনেক নেতিবাচকতাও আছে। তাই তরুণ প্রজন্ম যত বেশি এই স্মৃতির সঙ্গে যুক্ত হবে, ততবেশি শক্তিটা ও মূল্যবোধটা ধারণ করতে পারবে। ফলে অতীতটা আমাদের কাছে অতি জরুরি একটি বিষয়। যেটা আমাদের বর্তমানের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক, ভবিষ্যতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তাই ইতিহাসের এই শক্তি নিয়েই আমাদের মোকাবেলা করতে হবে।

সকাল সন্ধ্যা: আপনাকে ধন্যবাদ।
মফিদুল হক: আপনাকেও ধন্যবাদ।

ad

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত