Beta
সোমবার, ৬ মে, ২০২৪
Beta
সোমবার, ৬ মে, ২০২৪

সাক্ষাৎকার

খেলাপি ঋণ আদায়ে চাই সম্মিলিত প্রচেষ্টা

সৈয়দ মাহবুবুর রহমান

উচ্চ খেলাপি ঋণের কারণে ব্যাংক খাতে তারল্য সংকট তীব্রতর হয়েছে এবং এ খাতের উন্নয়ন হচ্ছে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে নিয়মিত নগদ অর্থ ধার করতে হচ্ছে ব্যাংকগুলোকে। অতীতে খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনতে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হলেও কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া যায়নি। এ অবস্থায় সম্প্রতি একটা রোডম্যাপ হাতে নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে এটা কতটা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। এসব বিষয় নিয়ে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী সৈয়দ মাহবুবুর রহমানের সঙ্গে কথা বলেছে সকাল সন্ধ্যা। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আশফাকুর রহমান

খেলাপি ঋণ আদায়ে চাই সম্মিলিত প্রচেষ্টা

সৈয়দ মাহবুবুর রহমান

উচ্চ খেলাপি ঋণের কারণে ব্যাংক খাতে তারল্য সংকট তীব্রতর হয়েছে এবং এ খাতের উন্নয়ন হচ্ছে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে নিয়মিত নগদ অর্থ ধার করতে হচ্ছে ব্যাংকগুলোকে। অতীতে খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনতে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হলেও কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া যায়নি। এ অবস্থায় সম্প্রতি একটা রোডম্যাপ হাতে নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে এটা কতটা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। এসব বিষয় নিয়ে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী সৈয়দ মাহবুবুর রহমানের সঙ্গে কথা বলেছে সকাল সন্ধ্যা। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আশফাকুর রহমান

সকাল সন্ধ্যা: কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গৃহীত রোডম্যাপ বা কর্মপরিকল্পনায় ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে সামগ্রিকভাবে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ আট শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এই রোডম্যাপ নিয়ে আপনি কতটা আশাবাদী?

সৈয়দ মাহবুবুর রহমান: বাংলাদেশ ব্যাংক সবসময় কিছু না কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। এটা অবশ্যই ভালো বিষয়। এর ফলে কিন্তু কাজও হয়েছে। যদিও খোলাপি ঋণের পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, আমাদের ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং অর্থনৈতিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সবকিছুতেই এক ধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। এছাড়া রাজনৈতিক সদিচ্ছার বিষয়ও আছে। আমরা ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করছি একভাবে, কিন্তু হচ্ছে আরেকভাবে। যার ফলে অনেক ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ থাকছে না।

একটি বিষয় নিয়ে আমরা অনেকদিন ধরে কাজ করছিলাম, আমাদের কাছেও যেটি খুব গুরুত্বপূর্ণ— আমাদের বিচার ব্যবস্থা নিয়ে। আমরা দেখতে চেয়েছিলাম, ঋণ খেলাপি হওয়ার কারণে শাস্তি হচ্ছে, বিচার বিভাগ ঠিকভাবে তার কাজ করতে পারছে। টাকা নিয়ে সেটা ফেরত দিতে হয়— এই বিষয়টি প্রতিষ্ঠিত হতে হবে।

অনেকে বিচার ব্যবস্থার ত্রুটির কথা বলেন। তবে আমাদের যে মামলা চলমান আছে, সেটা পরিচালনা করতে পর্যাপ্ত বিচারক নেই। এছাড়া আমরা অর্থ ঋণ মামলা পরিচালনা করতে অনেকদিন ধরে উচ্চ আদালতে আলাদা বেঞ্চ দাবি করে আসছি। একইসঙ্গে বিভিন্ন জেলা শহরে অর্থ ঋণ আদালতের জন্য দাবি জানিয়ে এসেছি। এসব হলে রায় পাওয়াটা ত্বরান্বিত হতো। এছাড়া এ ধরনের মামলায় রায় পেতে অনেক সময় লেগে যায়, সাজা সম্পাদন করতেও আরও অনেক সময় লাগে।

আরেকটি বিষয় হচ্ছে, আমরা যখন ঋণগুলো অনুমোদন দিয়েছিলাম, তখন জামানতের বিষয়গুলো ঠিকমতো খেয়াল করা হয়নি। অথবা প্রয়োজনীয় দলিলাদি সংগ্রহ করা হয়নি, যথাযথভাবে নিরীক্ষণ করা হয়নি। কিংবা মূল্যায়নও করা হয়নি। ব্যাংকার-গ্রাহক নানা রকমভাবে অসঙ্গতিমূলক কাজও করেছে ঋণ অনুমোদনের বিষয়ে। এমন অবস্থায় আমরা ঋণ পুনরুদ্ধার করতে চাপ প্রয়োগ করতে পারছি না। যার ফলে আমরা সাফল্যও পাচ্ছি না। 

কেন্দ্রীয় ব্যাংক উদ্যোগ নিয়েছে যে, দুই বছরের মধ্যে আমাদের খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনতে হবে। এটা অবশ্যই একটি ভালো পদক্ষেপ। এতে যদি খেলাপি ঋণের হার কমিয়ে আনা যায়, সেটাও আমাদের জন্য ভালো হবে। তবে এই কাজটি নিয়মিত করতে হবে। তাহলেও এর সুফল আমরা পাব।

আমরা যখন ঋণগুলো অনুমোদন দিয়েছিলাম, তখন জামানতের বিষয়গুলো ঠিকমতো খেয়াল করা হয়নি। অথবা প্রয়োজনীয় দলিলাদি সংগ্রহ করা হয়নি, যথাযথভাবে নিরীক্ষণ করা হয়নি। কিংবা মূল্যায়নও করা হয়নি। ব্যাংকার-গ্রাহক নানা রকমভাবে অসঙ্গতিমূলক কাজও করেছে ঋণ অনুমোদনের বিষয়ে। এমন অবস্থায় আমরা ঋণ পুনরুদ্ধার করতে চাপ প্রয়োগ করতে পারছি না। যার ফলে আমরা সাফল্যও পাচ্ছি না।

সকাল সন্ধ্যা: বাংলাদেশ ব্যাংকের রোডম্যাপের কোন বিশেষ দিকগুলো খেলাপি ঋণ কমাতে সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা রাখবে বলে আপনি মনে করেন?

সৈয়দ মাহবুবুর রহমান : আমরা তো আশাবাদী। আসলে রোডম্যাপগুলো যখন হয়, তখন তো কিছু ধারণার ওপর ভিত্তি করে হয়। কিন্তু বাস্তবে প্রয়োগ করতে গিয়ে দেখা যায়, আরও অনেক বিষয় চলে এসেছে। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, আমাদের সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টাই বাংলাদেশ ব্যাংকের খেলাপি ঋণ আদায়ের রোডম্যাপের লক্ষ্য অর্জনে ভূমিকা রাখবে।

সকাল সন্ধ্যা: এই রোডম্যাপ ঘোষণার আগে থেকেই ব্যাংকগুলো খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনতে কী কী উদ্যোগ নিয়েছে?

সৈয়দ মাহবুবুর রহমান: আমরা কিন্তু অনেক উদ্যোগ নিয়েছি। আমরা এসব নিয়ে বিভিন্ন মামলা করেছি সবসময়। আমরা এ কাজের জন্য ‘অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট’ নামে একটি আলাদা বিভাগ করেছি। একই সঙ্গে আমরা আমাদের আইন বিভাগকেও অনেক শক্তিশালী করেছি। বোর্ডের পরিচালনা পর্ষদ থেকে শুরু করে ব্যাংকের সবাই সম্মিলিতভাবে খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনার চেষ্টা করে যাচ্ছি।

এখনও আমরা এই কাজটি নিয়মিত করছি। খেলাপি ঋণের বিপরীতে যেসব সম্পদ আমাদের কাছে বন্ধক ছিল সেগুলো আমরা নিলাম করেছি, নোটিস করেছি। কিন্তু এক্ষেত্রে যেটা হয়, ঋণগ্রহীতা আদালত থেকে নিলামের স্থগিতাদেশ নিয়ে আসে। ফলে বিষয়টি দীর্ঘসূত্রতার মধ্যে পড়ে যাচ্ছে। সহজে এসব মামলার নিষ্পত্তি হচ্ছে না। এই পুরো প্রক্রিয়াটি আমাদের কাছে খুব সন্তোষজনক নয়।

বাংলাদেশ ব্যাংক যেগুলোকে ‘ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপি’ বলছে— সেখানেও আমরা দেখেছি, যে কাজে ঋণগুলো নিয়েছে সেগুলো ঠিকভাবে সেখানে কাজে লাগানো হয়েছে কি না— সেটাও আমরা ঠিকমতো পর্যবেক্ষণ করিনি। মূলত ব্যাংকগুলোর মধ্যে একটা প্রতিযোগিতা ছিল, কে বেশি বেশি ঋণ দিয়ে তার ব্যালেন্স শিটে মুনাফা বেশি দেখাবে। এই যে স্বল্পমেয়াদী একটা লক্ষ্য ছিল, সেটা ব্যাংকিং খাতের জন্য সুখকর কিছু ছিল না।  

সকাল সন্ধ্যা: ঋণ মওকুফের কঠোর অবস্থানসহ কর্পোরেট সুশাসনের কথা বাংলাদেশ ব্যাংকের রোডম্যাপে উল্লেখ করা হয়েছে। ওইসব শর্ত বা নির্দেশনা ব্যাংকিং কার্যক্রম এবং ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে কীভাবে প্রভাব ফেলবে বলে মনে করেন?

সৈয়দ মাহবুবুর রহমান: অবশ্যই প্রভাব পড়া উচিৎ। এটাই আমাদের কাছে প্রত্যাশিত। বাংলাদেশ ব্যাংক ১১ আর ছয় দফা মিলিয়ে যে ১৭ দফা দিয়েছে, সেখানে এসব বিষয় আছে। এই ১১ দফা কর্পোরেট সুশাসন বা গভর্নেন্স নিশ্চিতের জন্যই করা হয়েছে। ফলে কর্পোরেট সুশাসন সবসময় ব্যাংকের বোর্ড এবং ব্যবস্থাপনা পরিষদ থেকে নিশ্চিত হতে হবে। তাই এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ যে, আমাদের যেমন দায়িত্বশীল হতে হবে, জবাবদিহিও করতে হবে। তাহলে আমাদের সুশাসন চর্চার বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যাবে।

খেলাপি ঋণের বিপরীতে যেসব সম্পদ আমাদের কাছে বন্ধক ছিল সেগুলো আমরা নিলাম করেছি, নোটিস করেছি। কিন্তু এক্ষেত্রে যেটা হয়, ঋণগ্রহীতা আদালত থেকে নিলামের স্থগিতাদেশ নিয়ে আসে। ফলে বিষয়টি দীর্ঘসূত্রতার মধ্যে পড়ে যাচ্ছে। সহজে এসব মামলার নিষ্পত্তি হচ্ছে না। এই পুরো প্রক্রিয়াটি আমাদের কাছে খুব সন্তোষজনক নয়।

সকাল সন্ধ্যা: ব্যাংকে সুশাসন বাস্তবায়নে সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জগুলো কী কী?

সৈয়দ মাহবুবুর রহমান: মূল বিষয়টি যা খুব গুরুত্বপূর্ণ যে, ভালো উদ্দেশ্য থাকতে হবে। যেমন আমি আমার ব্যাংকের কথা বলি। কিংবা যে ব্যাংকগুলো ভালো করছে, সেই ব্যাংকের বোর্ড কোনও ঋণ প্রস্তাব বা কর্মী নিয়োগ বিষয়ে কোনও হস্তক্ষেপ করে না। ব্যাংকে ভালো কাজ করতে হলে ভালো লোকের প্রয়োজন আছে।

ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রেও কিন্তু সততার বিষয়টি খুব জরুরি। আমাদের যদি এই কাজ করতে গিয়ে ব্যাংকের কোনও পরিচালকের সম্পর্কের বিষয়টি এসে যায়, তাহলে কিন্তু কাজ করা কঠিন হয়ে পড়ে। এই সময় যদি ঠিকমতো কাজটি করা যায়, তাহলেও অনেক সমস্যা আমরা এড়িয়ে যেতে পারব। যদিও মানুষ হিসেবে ভুলবশত কিছু আমরা করতে পারি। তবে অন্তত এই সময় কেউ কোনও অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করব না— সেটাও আমাদের নিশ্চিত করতে হবে। ফলে কর্পোরেট গভর্নেন্সটা একদম আমরা উচ্চ পর্যায় থেকে শুরু করি। বাংলাদেশ ব্যাংক, ব্যাংকগুলোর বিভিন্ন নিয়ন্ত্রক সংস্থা এবং আমাদের গ্রাহকদের ক্ষেত্রেও এই একই বিষয় সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

সকাল সন্ধ্যা: নতুন এই নীতিমালা বিদ্যমান সমস্যা মোকাবেলার জন্য কি পর্যাপ্ত বলে আপনি মনে করেন?

সৈয়দ মাহবুবুর রহমান: আমার যেটা মনে হয়, আগে আমরা শুরুটা করি। এই নীতিমালায় এটা নেই, ওটা নেই— না বলে, এটা আমরা দেখি যে, এখানে অনেক ভালো জিনিস আছে। এটা আমরা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে আরও অনেক বিষয় সম্পর্কে জেনে এই প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিয়ে যাব। ফলে আমাদের শুরু করতে হবে। কোনও কিছুর প্রত্যাশা করে বসে থাকলে চলবে না। ধীরে ধীরেই আমাদের সবকিছুর উন্নতি হবে।

সকাল সন্ধ্যা: আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
সৈয়দ মাহবুবুর রহমান: আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ।

ad

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত