সকাল সন্ধ্যা: ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে ৮ শতাংশে নামিয়ে আনতে সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক ১১ দফা কর্মপরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। সুশাসন প্রতিষ্ঠায় নেওয়া হয়েছে আরও ৬ দফা কর্মপরিকল্পনা। এই পরিকল্পনাগুলো কতটা বাস্তবায়নযোগ্য বলে মনে করেন?
সালেহউদ্দিন আহমেদ: খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনতে রোডম্যাপ বড় কোনও ভূমিকা রাখবে বলে মনে হয় না। এগুলো কোনও সুদূরপ্রসারী নীতিমালা নয়। খেলাপি ঋণ কেন বাড়ে, সেই জায়গাতে দৃষ্টি নেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। কেবল আদায়ের জন্য তোড়জোড় করলে কোনও লাভ হবে না। আগেও সহজ শর্তে খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলসহ বেশ কিছু পদক্ষেপ কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিয়েছিল। কিন্তু তাতে খেলাপি ঋণ তো কমেইনি, বরং প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকায় পৌঁছে গেছে মন্দ ঋণ।
ব্যাংক খাতের যে কোনও ধরনের উন্নয়নের জন্য সবার আগে দরকার হবে সুশাসন। সেই সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য যদি আলাদা কর্মপরিকল্পনার দরকার হয়, তাহলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়মিত কাজটা কী, ব্যাংকের সুশাসনের পথে বড় অন্তরায় কারা, এ ক্ষেত্রে ব্যাংকের পরিচালকদের কী ভূমিকা— তা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভালো জানা রয়েছে। কিন্তু তারা ব্যাংকের চেয়ারম্যানসহ অন্যান্য পরিচালকদের কী ধরনের দক্ষতা থাকবে, তা যদি নির্দিষ্ট করে না দেয়, ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ যদি নির্দেশনা সঠিকভাবে না মেনে চলে, তাহলে তো ভালো কিছু করতে পারবে না।
সকাল সন্ধ্যা: কেন্দ্রীয় ব্যাংক কী কারণে এই কাজগুলো ঠিকভাবে করতে পারছে না? সীমাবদ্ধতা কোথায়? ব্যাংকগুলো দুর্বল হয়ে পড়ার পেছনে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কি কোনও দায় রয়েছে?
সালেহউদ্দিন আহমেদ: ব্যাংক খাতের সর্বস্তরে সমস্যা ছড়িয়ে পড়েছে। এখন কেবল পা বা মাথা ব্যথার চিকিৎসা করলে হবে না। গোটা শরীরের চিকিৎসা করাতে হবে। এজন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংককে আরও শক্তিশালী হতে হবে। ব্যাংক খাতের কোথায় কী সমস্যা, তা সঠিকভাবে শনাক্ত করে তার সমাধান করতে যে যে পদক্ষেপ নেওয়া দরকার, তা নিতে হবে।
ব্যাংক খাতে ডজন খানেকের বেশি ব্যাংক দুর্বল হয়ে পড়েছে। এটা কিন্তু একদিনে হয়নি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ বিষয়টি জানত। কিন্তু এতদিন তারা ‘দেখছি-দেখব’ বলে কালক্ষেপণ করে গেছে। আরও আগেভাগে এই ব্যাংকগুলোর দুর্বলতা চিহ্নিত করে মার্জার অ্যান্ড অ্যাকুইজিশনের উদ্যোগ নিলে এখনকার থেকে আরও কম লোকসানে পড়তে হতো ব্যাংকগুলোকে। তবে এখন সেই সময় পার হয়ে গেছে। এর সমাধান কী, তাও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জানা আছে। এখন তারা যদি সমাধান না করতে পারে—তাহলে বলুক যে তারা কী ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন, কেন তারা পারছে না? কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সময়োপযোগী সিদ্ধান্তের অভাবে ব্যাংকগুলো যে লোকসানে পড়ল, সেই লোকসানগুলো কিন্তু মার্জারের পর সবল ব্যাংকগুলোর ঘাড়ে চাপবে।
সকাল সন্ধ্যা: খেলাপি ঋণ কমানোর লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক রোডম্যাপের অংশ হিসেবে ইচ্ছাকৃত খেলাপি গ্রাহকদের শনাক্ত করতে একটি সংজ্ঞা দিয়েছে। তাতে বলা হয়েছে সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও ঋণ পরিশোধ না করলে ইচ্ছাকৃত খেলাপি হিসেবে তাদের চিহ্নিত করা হবে। এদেরকে সামাজিক ও ব্যবসায়িকভাবে অনেক ধরনের সুবিধা খর্ব করা হবে। এই উদ্যোগের ফলে খেলাপি ঋণ কমে আসবে বলে মনে করা হচ্ছে। আপনার কী মনে হয়?
সালেউদ্দিন আহমেদ: এ ধরনের সংজ্ঞা দিয়ে কোনও কাজ হবে বলে মনে হয় না। ফেরত দেবে না— এমন লক্ষ্য নিয়ে যারা ঋণ নিয়েছে, তাদের কাছ থেকে টাকা আদায় করা যায় না। ঋণ দেওয়ার আগেই যথাযথ নিয়ম মানলে খেলাপি হলেও বন্ধকি সম্পত্তি বিক্রি করে টাকা আদায় করা যায়। এখন যারা টাকা ফেরত দেবে না, তাদের জন্য যত আইন করুক না কেন, কোনও লাভ হবে না। এ ধরনের আইন পাকিস্তান আর ভারত ছাড়া আর কোথাও নেই। এ ধরনের আইন করে কোনও লাভ হয়নি। আমাদের দেশেও হবে বলে মনে হয় না।
মোদ্দা কথা হলো, ব্যাংক খাতের অনিয়ম বন্ধে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সদিচ্ছা তো লাগবেই, পাশাপাশি রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতিও লাগবে। আমাদের সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে এভাবে রাজনৈতিক বিবেচনায় ব্যাংকের অনুমোদন দেওয়া হতো না। বর্তমানেও কেন্দ্রীয় ব্যাংককে রাজনীতি থেকে সম্পুর্ণ মুক্ত রেখে, নিজেদের সিদ্ধান্ত নিজেদের নিতে দিতে হবে। কোনও আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্যে তাদের রাখা যাবে না।
সকাল সন্ধ্যা: আপনি ২০০৫ সালের মে থেকে ২০০৯ সালের এপ্রিল পর্যন্ত পাঁচ বছর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ছিলেন। সে সময়ের অভিজ্ঞতার আলোকে কী মনে হয়, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্তাব্যক্তিদের কি দলমতের ঊর্ধ্বে উঠে কাজ করার সুযোগ আছে?
সালেহউদ্দিন আহমেদ: আগের মতো শক্ত অবস্থান নেই বাংলাদেশ ব্যাংকের। বিভিন্ন মহলের চাহিদা অনুযায়ী তারা নীতিমালা করছে। নগদ জমার হার (সিআরআর), বিধিবদ্ধ জমার হার (এসএলআর) কমিয়ে দিচ্ছে। আমাদের সময় আমরা এরকম করিনি। এ ধরনের নতি স্বীকার করা যাবে না।
২০১৯ সালে খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলের জন্য ডাউনপেমেন্ট (এককালীন নগদ জমা) ২ শতাংশ করেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কেন করেছিল, কাদের সুবিধার জন্য করেছিল? এভাবে খেলাপিদের প্রশ্রয় দিয়েও তো কোনও লাভ হয়নি। আমরা সর্বনিম্ন ডাউনপেমেন্ট করেছিলাম ১০ শতাংশ। দ্বিতীয় বার পুনঃতফসিলের সময় ২০ শতাংশ এবং তৃতীয় বার পুনঃতফসিলের সময় ৩০ শতাংশ ডাউনপেমেন্ট দিতে হতো।
আমাদের সময় যে রাজনৈতিক চাপ ছিল না, তা নয়। নতুন ব্যাংকের লাইসেন্স দেওয়ার জন্য অনেক দেন-দরবার হয়েছে। কিন্তু কাউকে লাইসেন্স দেওয়া হয়নি। আমরা তো দেখলাম এভাবে প্রভাবিত হয়ে ব্যাংকের লাইসেন্স দেওয়ার কারণে কী ধরনের অসুস্থ প্রতিযোগিতা সৃষ্টি হয়েছে ব্যাংক খাতে। এখন তার ফল ভোগ করছে গোটা ব্যাংক খাত।
সকাল সন্ধ্যা: আপনার সময় (২০০৬ সালে) ওরিয়েন্টাল ব্যাংকে ৫০০-৮০০ কোটি টাকা আত্মসাত করেছিল ব্যাংকটির শীর্ষ কয়েক কর্মকর্তা। ওই সময়ে ব্যাংকটি অবসায়ন করে নতুন করে পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে কি কোনও প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়েছিলেন?
সালেহউদ্দিন আহমেদ: ওরিয়েন্টাল ব্যাংকে যখন বড় অঙ্কের অর্থ আত্মসাতের ঘটনা ঘটল, আমরা সেটাকে লুকিয়ে রাখতে চেষ্টা করিনি। তখনকার সরকার প্রধানকে আমরা বোঝাতে চেষ্টা করি যে ব্যাংকটি অবসায়ন করানোই প্রকৃত সমাধান। এবং আমরা সফল হই।
সকাল সন্ধ্যা: এখনকার সময়ের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের সরকারের সঙ্গে দরকষাকষি করার সক্ষমতা কি তাহলে কমে গেছে? কমলে তার কারণ কী?
সালেহউদ্দিন আহমেদ: আমার মনে হয় এখনকার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্ণধাররা এক ধরনের ‘মায়োপিক’ অর্থাৎ ক্ষীণদৃষ্টিসম্পন্ন, ভবিষ্যতে ব্যাংক খাতে কী প্রভাব পড়বে, সেদিকে তাদের দৃষ্টি নেই। তারা ভাবে, আমার সময়টা কোনওভাবে এদিক-সেদিক করে কাটিয়ে দিয়ে যাই। একেবারে পুরো দায়িত্ববোধ নিয়ে কাজ করা, সিনসিয়ারলি কাজ করা, ভয়-ভীতির ঊর্ধ্বে উঠে কাজ করার মানসিকতা তাদের মধ্যে নেই।
আবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শীর্ষ পদে দায়িত্ব পালন শেষে তারা বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টে (বিআইবিএম) কাজ করতে চেষ্টা করেন। এ ধরনের সংস্কৃতিও আমাদের সময় ছিল না।
সকাল সন্ধ্যা: আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
সালেহউদ্দিন আহমেদ: আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ।