চৈত্রের শেষ দিনে সৈয়দ বানুর কথা মনে পড়ে। সংক্রান্তির এই দিনে তিনি নিজ হাতে ‘তিতা টুকাতে’ যেতেন।
বাড়ির আশপাশেই তখন কতো ঝোপ-জংলা ছিল! নিজের হাতে তুলে আনা হরেক রকম বুনো ‘তেতো’ তথা শাক-সব্জি নিজ হাতে রান্না করতেন।
তেতো সংগ্রহের অভিযানে কখনো আমি তার সাথী হতাম।
সৈয়দ বানুর ‘মা ফাতেমা’ও ছিল, ‘বিশকরম’ও ( বিশ্বকর্মা) ছিল।
রান্না করতে গেলে চুলায় ভাতের কি তরকারির হাঁড়ি চাপাতে-চাপাতে ‘বিসমিল্লাহ’ বলে পরে ‘মা ফাতেমা’র নাম নিতেন। অন্য কাজের সময় ‘বিসমিল্লাহ’ বলে পরে নিতেন ‘বিশকরমে’র নাম।
মাসপয়লা তথা বছরের প্রথম দিনকে স্বাগত জানানোর জন্য সৈয়দ বানু ছাতু বানাতেন, আগের রাতে ভাত রেঁধে পানি দিয়ে ভিজিয়ে রাখতেন।
মাসপয়লা যা আবার বছরেরও প্রথম দিন, সৈয়দ বানু খুব মান্য করে চলতেন।
বছরের প্রথম দিনে খারাপ কথা, খারাপ কাজ, গাল-মন্দ করতে হয় না। হাসি মুখে, মিলে-ঝিলে থাকতে হয়। ভালো কাপড় পরতে হয়। ভালো-মন্দ খেতে হয়। তাহলে সারাবছর এরকম ‘ভালো’ যায়।
মাসপয়লার আগেই ঘর-দোর ধুয়ে মুছে, ঝুল-টুল ঝেরেঝুরে বাড়ি একেবারে ঝকঝকা তকতকা করে রাখতেন।
সেইসব দিনে আমাদের উদযাপনে জৌলুস বা আড়ম্বর ছিল না। কিন্তু সেই সাধাসিধে গরিবী যাপনে প্রাণ ছিল। হৃদয়ের তন্ত্রীতে কোথায় যেন পড়তো টংকার।
আশেপাশে মাইক বাজতো। মেলা বসতো। বান্নি বসতো। সার্কাস বসতো। যাত্রা বসতো। পুতুল নাচ বসতো। হতো হালখাতা। হতো লাঠি খেলা।
বান্নি থেকে সস্তার খৈ-বাতাসা-চিনির তৈরি হাতি-ঘোড়া- গজা- মাটির পুতুল- বাঁশ আর কাগজ দিয়ে বানানো ভটভটি গাড়ি- বাঁশি- চুলের ব্যান্ড কিনেই খুশীতে ডগমগো হয়ে যেতাম।
সেই জীবনে মফস্বলী ও গ্রামীণ জীবনের ‘ক্ষুদ্রত্ব’ যেমন ছিল, ছিল একটা দ্বার খোলা পুরো আস্ত পাড়া বা পুরো গ্রাম মিলে একাকার হয়ে গিয়ে গোত্রীভুক্ত জীবন-যাপনের আনন্দ।
পরের বাড়ি সারা বছর ‘কামলা-মুনীষ’ খাটেন যে জন, তারও সেই মেলায় ছিল অংশগ্রহণ।
আক্ষরিক অর্থেই তখন যেন সত্য হয়ে উঠতো জসীমউদ্দীনের কবিতা:
‘আমার বাড়ি বাজবে বাঁশি,
সবার বাড়ির সুর,
আমার বাড়ি সবার বাড়ি
রইবে না ক দুর’।
কৃষিপ্রধান এই সমাজে বৈশাখ যে কত বড় আনন্দ নিয়ে আসে তা আশৈশব, নানুবাড়ির কল্যাণে, পরখ করেছি বলে নিজেকে আশীর্বাদপুষ্ট মনে হয়।
ইকোনোমিক লিবারেলিজম বা এই উদার অর্থনীতির সমাজ এক অংশের জন্য এনেছে আড়ম্বর, আরেক অংশকে ঠেলে দিয়েছে তলানিতে।
মিডিয়ার কল্যাণে নাগরিক উৎসবের ছোঁয়া গাঁয়েও পৌঁছে গেছে।
প্রত্যেক এলাকায় উৎসব পালনের নিজ নিজ কৃষ্টি ও রীতি আছে। সেগুলোকে ধর্মের নামে, আইনের নামে, নিরাপত্তার নামে যখন ক্রমশ ছাঁটতে থাকা হয়, সেই সমাজটা ভেতর থেকে একটু একটু করে মরতে থাকে।
বৈচিত্র মুছে ফেললে ভালো সামরিক বাহিনী তৈরি করা যায়, শ্বাস নেবার মতন সমাজ তৈয়ার করা যায় না।
সমাজের অনেক কিছু অর্গ্যানিকভাবে তৈরি হয়।
বাস্তুসংস্থানে যেমন অর্গ্যানিকেলি বৈচিত্র থাকে, আবার সকল বৈচিত্র নিয়েও বাস্তুচক্রের সকলে একে অন্যের সাথে নিজের অস্তিত্ব নিয়ে থাকে নিগুঢ়ভাবে সম্পৃক্ত, একটা সমাজও ঠিক তাই।
অর্গ্যানিক সেই সমাজ থেকে যখন কোনো একটা উপাদান সরিয়ে নেওয়া হয়, তা যত ক্ষুদ্রই সেই উপাদানটা হোক না কেন, দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে এর প্রভাব হবে ইররিভার্সিবল ও ইররিপিয়ারেবল।
রে ব্র্যাডবেরির একটা সাইফাই গল্প আছে।
টাইম মেশিনে চড়ে দূর অতীতের বনে ভ্রমণ করতে যায় এক পর্যটক। সেই সময়, ডাইনোসরের সেই যুগে ভুলক্রমে, সেই পর্যটক মেরে ফেলে একটি প্রজাপতি।
ক্ষুদ্র, তুচ্ছ এ প্রজাপতির মৃত্যু আপাত অর্থে, আপনার কাছে, গোণায় ধরার মতন কিছু না বলে মনে হতে পারে।
আদতে এখান থেকেই হয় বিরাট বদলের সূত্রপাত।
কিন্তু তা হয় ধীরে।
অতি ধীরে।
যত ধীরে রোজ আমরা মৃত্যুর দিকে এগুতে থাকি তার চেয়েও অলক্ষে ঘটে এই বদল।
অতঃপর একটা বড় সময়ের ব্যবধানে সেই প্রজাপতির মৃত্যুর ধাক্কা হাজারগুণ বর্ধিত হয়ে ফিরে আসে।
রে ব্র্যাডবেরির গল্পের পাঠকেরা জানেন, এটিকে বলে বাটারফ্লাই ইফেক্ট।
সমাজের বদলটাও তাই। চোখের সামনেই তা ঘটে।
একটু একটু করে রোজ।
এনভাইরনমেন্টাল জার্নালিজমের ভাষায় এটাকে বলা হয়, এনভায়রনমেন্টাল স্টোরিজ ডু নট ব্রেক, দে উজ।
কিন্তু দৃষ্টিপাত করি না বলে আমরা সেগুলো দেখি না।
আর যারা দেখে এবং অন্যকে দেখাতে চায়, তাদেরকে আমরা রিডিকিউল করি বা হাস্যস্পদ বা বাতুল বলে প্রতিপন্ন করি।
‘কালাপানি’ সিরিজে দেখবেন, আদিবাসী গোত্রের মানুষেরা জলের কারণে হওয়া মহামারী ‘সভ্য’ নাগরিক সমাজের বহু আগেই টের পায়।
এই টের পাওয়াটা দৈব কিছু নয়।
ওতপ্রোতভাবে মিশে থাকা ও চোখ খোলা রাখার ফল।
একটা সমাজ এবং সমাজের সংস্কৃতিও এর ব্যতিক্রম কিছু নয়।
বাংলাদেশের সমাজ গত দুই দশকে সাংস্কৃতিকভাবে ভীষণ মাত্রায় পোলারাইজড বা মেরুকরণকৃত হয়েছে।
ধর্মের ধ্বজা তুলে সমাজের অর্গ্যানিক বাস্তুচক্রকে ইঞ্জিনিয়ারিং করার চেষ্টা হয়েছে এবং চেষ্টায় সাফল্য অনেকাংশেই মিলেছে।
এখনো উৎসব এলেই রাষ্ট্র তথা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো জনতার উৎসবকে ছেঁটে ফেলতে চায়।
এগুলো রাষ্ট্রীয় ব্যার্থতা।
সময়ের গায়ে গায়ে এই ইতিহাসও লেখা থাকবে।
ইতিহাস বুলেটের মতন। তার কাজ বিদ্ধ করা। বুলেটের কাছে নায়ক আর খলনায়কের প্রভেদ নেই। যে যতখানি করে, ততখানি লেখা থাকে।
সৈয়দ বানু ছিলেন আমার দাদু।
সৈয়দ বানুর মা ফাতেমাও ছিল, বিশকরমও ছিল।
সৈয়দ বানুর তিরিশ রোজা ছিল, ছয়াল (ছয় রোজা) ছিল, তাহাজ্জুদ ছিল, আবার তার সংক্রান্তিও ছিল।
সৈয়দ বানু সকাল-দুপুর-বিকাল-সন্ধ্যা-রাত হুক্কা টানতেন, তার সাথে এলাকায় তার বয়সী দুই চারজন নারী-পুরুষও এসে সময়ে-সময়ে হুক্কা টানতেন, আবার তার মাথার উপরে ঘোমটাও থাকতো।
সৈয়দ বানু ঝড়-তুফানের রাতে ‘লা ইলাহা ইল্লাহ আন্তা সুবহানাকা ইন্নি কুন্তু মিনাজ জোয়ালিমিন’ পড়তেন, আবার উঁচু গলায় গভীর বিশ্বাসে জপের মতন বলতে থাকতেন, দোহাই আলী! দোহাই আলী! দোহাই আলী!
সৈয়দ বানু একা নন। তার প্রজন্মের সকলেই না হলেও প্রায় অধিকাংশই ছিল কাছাকাছি জীবন দর্শনের মানুষ।
লোকায়ত দর্শন। লোকায়ত দর্শন প্রভাবিত জীবন।
লোক বিশ্বাস তথা মারেফতের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে সামনে খাড়া করা হয়েছে শরিয়তকে।
শ্যাম আর কূলকে করা হয়েছে মুখোমুখি।
মাওলানা রুমি বলেছিলেন, ঠিক-বেঠিকের বাইরেও এক জগৎ আছে।
সমাজও শুধু রিজিড বাইনারি দিয়ে চলে না।
মরুর আরবের ঠিক-বেঠিক দিয়ে ‘তেরোশত নদী সুধায় আমাকে কোথা থেকে তুমি এলে’র এই বাংলার ঠিক-বেঠিককে বোঝা যাবে না।
একটা রাষ্ট্রকে ভেতর থেকে চিরতরে পালটে দিতে চাইলে, সবসময়, উপর থেকে তার মসনদ দখলের দরকার নেই। তার সংস্কৃতির ইকোসিস্টেমটা পালটে দিলেই বড় কাজটা হয়ে যায়।
এই ইকোসিস্টেম পাল্টাতে বিরাট প্রলয় ঘটানোর প্রয়োজন হয় না। একটা প্রজাপতি মেরে ফেললেই যথেষ্ট।
আমাদের সংস্কৃতির অনেক ‘প্রজাপতি’ ইতোমধ্যেই নিহত হয়েছে।
যদি আমরা দরদী হই, যদি আমরা যত্ন নিই, এখনো ড্যামেজ কন্ট্রোল করা সম্ভব।
সংস্কৃতির বিপরীতে রাজনৈতিক ইসলাম, দুনিয়াবী রাজনীতির ফায়দা লুটতে আখিরাতি ধর্মকে টেনে আনার রাজনীতি আখেরে কারো জন্যই কল্যাণকর নয়।
অধুনা পৃথিবীর কোথাও এর কল্যাণ আনার কোনো দৃষ্টান্ত নেই।
বৈশাখ এসেছে। বৈশাখ এলেই আজকাল শুরু হয় আলাপ: এটা হিন্দুর না বাঙালির? এটা পারস্য প্রভাবিত না ভারত প্রভাবিত?
এইসব আলাপ দিয়ে যদি কেউ উৎসবের ঠিকুজি-কুলুজি সন্ধ্যান করতে চায়, করুক, ক্ষতি নেই।
কিন্তু সংস্কৃতিকে ইঞ্জিনিয়ারিং করার উদ্দেশ্যে কেউ যদি জল ঘোলা করে এবং প্রজাপতি মারতে উদ্যত হয় সেই চেষ্টা তাদেরকে চালাতে দেবেন কিনা সেটা আপনার সিদ্ধান্ত।
এই দেশের প্রধান অসাম্প্রদায়িক উৎসব হচ্ছে বাংলা নববর্ষ কেন্দ্রিক উৎসব।
জাতিগোষ্ঠীর দিক থেকে বাঙালি তথা ‘বৃহৎ গোষ্ঠী’ বা মেজোরিটি, অবাঙালি তথা পাহাড়ি ও সমতলের আদিবাসী সম্প্রদায়– সকল গোত্রেরই প্রাণের পরব শুরু হয় পয়লা বৈশাখকে ঘিরে।
আবার নিজেদের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের বাইরে বাংলার হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ও নাস্তিক সকলেই পালন করে এই উৎসব।
দেশের বৃহৎ গোষ্ঠী বাঙালি সম্প্রদায়ের জনজীবনে ক্রমে হিন্দু ও ‘হিন্দুয়ানী সংস্কৃতি’র প্রতি বিদ্বেষ বাড়ছে এবং জনজীবনে ও রাষ্ট্রে বাড়ছে রাজনৈতিক ইসলামের ব্যবহার।
এই বিপজ্জনক পরিস্থিতি সামাল দিতে রাষ্ট্রের কৌশল হওয়া উচিত অসাম্প্রদায়িক উৎসব নববর্ষ উদযাপনকে আরো প্যাট্রোনাইজ করা।
অর্ধশতক আগে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। কথা সত্য।
কিন্তু সময়ের সাথে বাস্তবতা পালটায়, নয়া সত্য সামনে হাজির হয়।
বাংলাদেশের সত্য হলো এই যে, এই দেশ শুধু বাঙালির বা শুধু মুসলমানের দেশ নয়।
উগ্র বাঙালি জাতীয়তাবাদকে আঁকড়ে রাখা এবং উগ্র ইসলামী জাতীয়তাবাদের পুনঃ জাগরণ — দুটোই ভয়ানক ক্ষতিকর।
এই দেশ যতটা বাঙালির ততটাই চাকমা, মারমা, ত্রিপুরাসহ অন্য নৃগোষ্ঠীর।
এই দেশ যতটা মুসলমানের ততটাই হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্ঠান ও নাস্তিকের।
এই দেশের ভাষাভিত্তিক বৈচিত্র, বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর জীবনাচার ও সংস্কৃতির বৈচিত্র, বিভিন্ন ধর্মের মানুষের আচার-অনুষ্ঠানের বৈচিত্র এই দেশের শক্তি ও সম্পদ।
বৈচিত্রপূর্ণ এদেশে আমাদের বিনি সুতোর মালার মতন বেঁধে রাখতে পারে বৈশাখের মতন অসাম্প্রদায়িক উৎসব। এই উৎসবকে নির্বিঘ্ন রাখতে আপনি জাগরুক থাকবেন কিনা সেটা আপনার সিদ্ধান্ত।
লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক।
ইমেইল: afroja.shoma@gmail.com