Beta
সোমবার, ২০ মে, ২০২৪
Beta
সোমবার, ২০ মে, ২০২৪

কলাম

ছাত্ররাজনীতি চাপিয়ে না দিয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচন দিন

শরীফ নুরুল আম্বিয়া। প্রতিকৃতি অঙ্কন: সব্যসাচী মজুমদার।

সম্প্রতি সরকার সমর্থক বাংলাদেশ ছাত্রলীগ বলেছে, বুয়েটে জঙ্গি সন্ত্রাসীরা আস্তানা গেড়েছে। তাদের নির্মূল করার জন্য বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) ছাত্ররাজনীতি করতে দিতে হবে। তাদের তথ্যের যথার্থতা আমার অজানা। এই তথ্য সরকারি গোয়েন্দাদের, নাকি সরকার সমর্থক ছাত্রদের থেকে এসেছে তা স্পষ্ট করা হয়নি। তবে তারা খুব আগ্রাসী মনোভাবে অগ্রসর হয়েছে। ইতিমধ্যে তারা হাইকোর্ট থেকে স্বপক্ষে এ মর্মে  রায় পেয়েছে।

বুয়েটে মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদকে লোহমর্ষকভাবে হত্যা করার পর প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ রয়েছে। তারপর থেকে বিশ্ববিদ্যালয় শান্ত রয়েছে, একাডেমিক লেখাপড়া স্বাভাবিকভাবে চলছে। ইতিমধ্যে আবরার হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়েছে এবং দোষীদের শাস্তি দেওয়া হয়েছে। এই হত্যাকাণ্ডে ছাত্রলীগের স্থানীয় নেতা-কর্মীরা নেতৃত্ব দিয়েছে।

এর আগে বুয়েটে সাবেকুন নাহার সনি এবং আরিফ রায়হান দীপ নামে দুইজন ছাত্র হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে পৃথক দুই ঘটনায়। যতদূর মনে পড়ে, ছাত্রদলের সশস্ত্র দুই গ্রুপের ক্রস ফায়ারে সনির মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। দ্বীপের মৃত্যু হয় মৌলবাদীদের হাতে। মৌলবাদী রাজনীতি, সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় দখলবাজি ইত্যাদি কারণে মেধাবী প্রতিশ্রুতিশীল ছাত্র-ছাত্রীর দুঃখজনক মৃত্যু হয়েছে।

আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ড যেভাবে হয়েছে তার বিবরণ শুনে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবেকবান শিক্ষক-ছাত্র-কর্মচারী সকলেই একরকম ট্রমাতে চলে গিয়েছে। ছাত্রলীগের ঘোষণা এবং আগ্রাসী তৎপরতায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ছাত্রলীগের এই ভূমিকার বিরুদ্ধে একতাবদ্ধভাবে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই বিদ্যমান পরিস্থিতিতে ছাত্রলীগ রাজনীতি করতে চায় বলে যে ইচ্ছা ব্যক্ত করেছে তা শুনে ক্যাম্পাস ও শিক্ষার্থীরা আতঙ্কিত হয়েছে।

আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ড যেভাবে হয়েছে তার বিবরণ শুনে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবেকবান শিক্ষক-ছাত্র-কর্মচারী সকলেই একরকম ট্রমাতে চলে গিয়েছে। ছাত্রলীগের ঘোষণা এবং আগ্রাসী তৎপরতায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ছাত্রলীগের এই ভূমিকার বিরুদ্ধে একতাবদ্ধভাবে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই বিদ্যমান পরিস্থিতিতে ছাত্রলীগ রাজনীতি করতে চায় বলে যে ইচ্ছা ব্যক্ত করেছে তা শুনে ক্যাম্পাস ও শিক্ষার্থীরা আতঙ্কিত হয়েছে।

ইতিমধ্যে বুয়েট অ্যালামনাই অপরাজনীতি থেকে বিশ্ববিদ্যালয়কে মুক্ত রাখার আহ্বান জানিয়ে বলেছে, চলমান শান্তিপূর্ণ পরিবেশ অব্যাহত থাকলে বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়ার মান আরও উন্নত হবে এবং বিশ্ববিদ্যালয় আন্তর্জাতিক সুখ্যাতি অর্জন করবে। এলামনাইয়ের এই বিবৃতি যুক্তিযুক্তভাবেই সর্বত্র প্রভাব বিস্তার করবে।

প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাধীনতা বিরোধীরা শক্ত আস্তানা গেড়েছে— ছাত্রলীগের নেতাদের আকস্মিক এমন বক্তব্য রাজনীতির অঙ্গনে বেশ কৌতুহলের জন্ম দিয়েছে। দেশে সম্প্রতি একটি ‘ডামি জাতীয় নির্বাচন’ হয়েছে। সরকারবিরোধী দলসমূহ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি, মানুষ খুব কমই নির্বাচনে ভোট দিতে গিয়েছে। নির্বাচন জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে এখনও সবার কাছে যথাযথভাবে গ্রহণযোগ্য হয়নি। সরকারের গ্রহণযোগ্যতা একটা বড় রকমের সমস্যার মধ্যে আছে।

দীর্ঘদিনের শাসনের ফলে লুন্ঠন, অনাচার, হত্যা-নির্যাতন ও দুর্নীতির কেচ্ছাকাহিনী যেভাবে প্রকাশিত হচ্ছে— তা থেকে দৃষ্টি অন্যদিকে সরানোর জন্য পরিস্থিতি তৈরি করা দরকার হয়ে পড়েছে। সেই অভিপ্রায়ে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়কে ব্যবহার করা হতে পারে। ছাত্রলীগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেভাবে অবস্থান করছে তাতে সেখানে মুক্তবুদ্ধির চর্চা হচ্ছে, তেমন কথা শুনিনি।

ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ড নিয়ে বিগত কয়েক বছরে আওয়ামী লীগও স্বস্তিতে ছিল না। আওয়ামী লীগ নেতাদের মন্তব্য স্মরণ করলে তেমনই মনে হয়। আওয়ামী রাজনীতির সমস্যা আড়াল করার জন্য অথবা পরাজিত রাজনীতিকে নতুনভাবে রাজনীতির উপসর্গ তৈরি করতে এখন আওয়ামী লীগ তাদের ছাত্রসংগঠনকে ব্যবহার করছে না তা বলা যায় না।

প্রাসঙ্গিকভাবে বলতে হয়, স্বাধীনতার পূর্বকালে ছাত্ররা রাজনীতি করেছে ছাত্র আন্দোলনের সূত্র ধরে। ’৬২ সালের ছাত্র আন্দোলন ছিল শরীফ কমিশনের শিক্ষা সংকোচন নীতির বিরুদ্ধে। যে সংগ্রামে শহীদ হয়েছিল ওয়াজিউল্লাহ, গোলাম মোস্তফা, বাবুল প্রমুখ। আজও ’৬২-র শিক্ষা আন্দোলনের কথা মনে করে শহীদদের স্মরণ ১৭ সেপ্টেম্বর শিক্ষা দিবস পালন করা হয়। পরবর্তী সময়ে গঠিত হামুদুর রহমান শিক্ষা কমিশন ছাত্রদের কাছে কোনও গ্রহণযোগ্যতা পায়নি।

জেনারেল ইয়াহিয়ার সময় গঠিত নূর খান শিক্ষা কমিশন নিয়ে ছাত্র আন্দোলন দানা বেঁধে উঠছিল মাত্র, যা বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের জোয়ারে চাপা পড়ে যায়। ’৬৯-এর ১১ দফা কর্মসূচিতে বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা যুক্ত করে নতুন রাজনৈতিক চরিত্র দান করা হয়েছিল, যা পরে সফল জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে রূপ লাভ করে।

স্বাধীনতার পূর্বকালে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকারি ছাত্র ফেডারেশনের কোনও দাপট ছিল না, যেমন ছিল না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও। অনেকে তবলীগ জামাতে অংশগ্রহণ করতো, তবে সামাজিকতা ছিল সবার সঙ্গে। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে কখনও ইসলামী ছাত্র সংঘ ছিল না, কিন্তু ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।

ছাত্র আন্দোলন বলতে সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলন হয়েছে ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের ছত্রছায়ায়। সাম্প্রদায়িক-জঙ্গিবাদ বিরোধী আন্দোলন হয়েছে ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের ছত্রছায়ায়। দেশময় এখন এমন পরিস্থিতি আছে বলে মনে হয় না। তবে সমাজে, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা মতের মানুষ থাকতেই পারে। তাদের যুক্তি- বুদ্ধির বলেই তা মোকাবিলা করা যায়।

আমি ব্যক্তিগতভাবে ছাত্ররাজনীতি ও ছাত্রআন্দোলন আলাদাভাবে দেখি। ছাত্ররা আন্দোলন করতেই পারে— তাদের নিজস্ব শিক্ষা ও ক্যাম্পাস বিষয়ক সমস্যা ও চাহিদা নিয়ে। তা কখনো জাতীয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হতে পারে এক পর্যায়ে। আগেও এমনই হয়েছে। শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক দলের লেজুড় বা অঙ্গসংগঠন হওয়া ঠিক না।

কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, ছাত্রসংগঠন রাজনৈতিক দলের সহযোগী সংগঠন বলা হলেও তারা অঙ্গসংগঠন হিসেবে লেজুড়বৃত্তি করে। নানারকম লোভে পড়ে ক্যাম্পাসে কর্তৃত্ব রক্ষা করতে তারা এটা করে থাকে সরকারি দলের প্রশ্রয়ে। শিক্ষাঙ্গনে সিভিল কন্সট্রাকশন সম্বলিত উন্নয়ন কর্মসূচি থাকলে তারা দুর্দমনীয় হয়ে ওঠে। ছাত্রলীগের বুয়েটে আলোচিত এই ভূমিকার সঙ্গে এমন কিছুর সংশ্লিষ্টতা আছে কিনা তা খতিয়ে দেখা যেতে পারে।

১৯৭২ সালে জাসদ গঠনে ছাত্রলীগের যে ভূমিকা ছিল, তা শুধু ওই সময়ের জন্য যুক্তিযুক্ত ছিল। রাজনীতিতে ছাত্রদের অগ্রগামী ভূমিকা সাধারণ অর্থে স্বাধীন দেশে হওয়ার কথা না। আমার জানা মতে, ১৯৮০ সালের পরে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সরকার সমর্থক ছাত্রসংগঠনের দখলচেষ্টার ফলশ্রুতিতে অবাঞ্ছিত ও রক্তাক্ত সংঘাত হয়েছে।

প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে কখনও ইসলামী ছাত্র সংঘ ছিল না, যেমন ছিল না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও। ছাত্র আন্দোলন বলতে সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলন হয়েছে ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের ছত্রছায়ায়। সাম্প্রদায়িক-জঙ্গিবাদ বিরোধী আন্দোলন হয়েছে ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের ছত্রছায়ায়। দেশময় এখন এমন পরিস্থিতি আছে বলে মনে হয় না।

সাধারণ ছাত্র ও তাদের অভিভাবকদের ইচ্ছা, ক্যাম্পাসে লেখাপড়ার সুষ্ঠু পরিবেশ থাকুক এবং ভালোভাবে পাস করার পর তারা পেশাগত জীবনে যোগ দিক। যদিও সামগ্রিক সার্থকতা ও সাফল্যের সঙ্গে সমাজ-আইনকানুন ও রাজনীতির সম্পৃক্ততা রয়েছে। এমনকি বৈশ্বিক পরিবেশ ও চাহিদা থেকেও তা মুক্ত না।

তাই আমি বলতে চাই, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় অ্যালামনাই প্রাসঙ্গিকভাবে যে বিবৃতি দিয়েছে তার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া উচিত। খুনিদের অভিভাবকত্ব প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা গ্রহণ করবে না। তবে আমি মনে করি, ল্যাবভিত্তিক গবেষণা যারা করে তারা ছাড়া সব ডিসিপ্লিনের প্রকৌশলীদের সমাজের সঙ্গে, সহকর্মীদের সঙ্গে সংযোগ দক্ষতা অর্জনের প্রয়োজন রয়েছে। বিশ্ববাজারে চাকরির জন্য এই সামর্থ্য আরও গুরুত্বপূর্ণ।

সামগ্রিক দিক বিবেচনায় নিলে মনে হয়, সব বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পর্যায়ক্রমে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। শক্তিপ্রয়োগ করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দখল করে রাখার চাইতে নির্বাচনের জন্য উম্মুক্ত করে দেওয়া দেশের ভবিষ্যতের জন্য কল্যাণকর হবে—বিভিন্ন পর্যায়ে নেতৃত্ব গড়ে উঠবে।

পরিস্থিতি স্বাভাবিক ও প্রাণবন্ত রাখতে সকল ছাত্রসংগঠনের উচিত হবে রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তি থেকে দূরে থাকা। দেশের ভবিষ্যতের কথা বিবেচনায় নিয়ে রাজনৈতিক দলের দায়িত্ব রয়েছে, যা উপেক্ষিত হলে সমগ্র জাতিকে ভুগতে হবে। আশা করি, ছাত্রসমাজ নিজেদের ও দেশের কল্যাণে উপযুক্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ থেকে পিছপা হবে না।

জয় বাংলা। জয় বাংলাদেশ।

লেখক: সভাপতি, বাংলাদেশ জাসদ এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী।
ইমেইল: sharifambia@yahoo.com

ad

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত