Beta
বৃহস্পতিবার, ৯ মে, ২০২৪
Beta
বৃহস্পতিবার, ৯ মে, ২০২৪

গণমাধ্যম এখন

সম্পাদকীয় প্রতিষ্ঠান কি বিলীয়মান

আতিকুর রহমান। প্রতিকৃতি অঙ্কন: সব্যসাচী মজুমদার

সম্পাদকীয় প্রতিষ্ঠান বিলীন হয়ে যাচ্ছে কিনা এই প্রশ্নটি গত কয়েক বছর যাবৎ চোরাস্রোতের মতো ভেসে বেড়াচ্ছে। লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো সংবাদ, সাংবাদিকতা, সম্পাদকীয়— এই ধারণাগুলোরই গত তিন দশকে যথেষ্ট বিবর্তন হয়েছে।

যেমন ধরা যাক, অডিট ব্যুরো রিপোর্ট অনুসারে দেশে বর্তমানে দৈনিক-সাপ্তাহিক মিলিয়ে হাজারের বেশি পত্রিকা রয়েছে। আর অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলোকে যদি এই তালিকায় যোগ করি তাহলে সংখ্যাটা দাঁড়ায় পাঁচ হাজারের আশপাশে! অন্যদিকে পত্রিকার পাঠকের সংখ্যা হচ্ছে অনধিক পনের লক্ষ; আর ডিজিটাল পত্রিকার পাঠকদের বিবেচনায় নিলে এটা দাঁড়ায় সত্তর থেকে আশি লক্ষ। এই পাঠকদের একটা বিরাট অংশেরই প্রথাগত সংবাদে খুব একটা আস্থা নাই। তথাকথিত কোমল সংবাদ বা ঊনসংবাদে তাদের বিপুল আগ্রহ; আর বিনোদন পাতা হচ্ছে তাদের প্রিয় পাতা। মজার বিষয় হলো, বিনোদন পাতা আগেও ছিল। কিন্তু, ১৯৯০-এর দশকের শেষ পর্যন্ত এই বিনোদন পাতা এবং এর কর্মীরা পত্রিকা অফিসে খুব একটা গুরুত্ব পেতেন না। বিনোদন পাতাটি থাকত ভিতরের অংশে; আর বিনোদন সাংবাদিকরাও প্রতিবেদক নন, বরং প্রদায়ক হিসেবেই বেশি বিবেচিত হতেন। দীর্ঘদিনের এই ধারায় ব্যাপক পরিবর্তন আসে এই শতকের গোড়া থেকে। শুরুটা হয়েছিল প্রধানত ক্রীড়া সাংবাদিকতার হাত ধরে, ক্রমে সিনে-সাংবাদিকতাও তার খুঁটি পোক্ত করে। ক্রমান্বয়ে সংবাদ এবং সাংবাদিকতা দুটোই নিজের বানানো ঊনসংবাদের আশ্রিত হয়ে উঠল।

উত্তর-নব্বই সময়ে বেশ কয়েকজন বাঘা বাঘা সম্পাদকের সচেতন প্রশ্রয়েই সংবাদের প্রচলিত সংজ্ঞাকে ভেঙ্গে দিয়ে বিনোদনকাহিনি সম্পূর্ণ নিজগুণে সংবাদের মর্যাদা অর্জন (?) করেছিল। স্বল্পকালীন সাংবাদিক জীবনে শুনতে পেতাম এক বিখ্যাত সম্পাদক বিকেলে অফিসে এসেই কীর্তিমান (?) নারীদের যুৎসই ছবি খুঁজতেন পরের দিনের পত্রিকায় ছাপানোর উদ্দেশ্যে; আর পাঠককে তা গেলানোর জন্য ঐ ছবির মিনিয়েচার ‘ইয়ার প্যানেলে’ (পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠার সর্বোচ্চে দুই পাশে) বসিয়ে দিতেন। তো এ কাজটি করার জন্য কি সম্পাদক বা সম্পাদকীয় প্রতিষ্ঠান খুব শক্তিশালী হওয়ার দরকার আছে?

এরপর তো এলো অনলাইন যুগ। এখানে সংবাদ আর ঊনসংবাদের ভেদ লুপ্ত হয়েছে; তাৎক্ষণিকতার আবরণে কিশোরগঞ্জ স্টেশনে ট্রেন দুর্ঘটনায় বাইশ জন নিহত হওয়ার ছ’মিনিট পরই হয়ত নায়িকা শ্রাবন্তীর পঞ্চম বিয়ের আশু সম্ভাবনার সংবাদ ভেসে উঠছে। ফলে বিরাট সংখ্যক পাঠক শ্রেণি তাদের, আমাদের এবং সম্পাদককুলের অজান্তেই সংবাদের পাঠক হওয়ার পরিবর্তে ঊনসংবাদের গ্রাহক হয়ে উঠেছে। বিনোদনধর্মী এবং ফিচারাইজ্ড সংবাদের রমরমা অবস্থা সেই বাস্তবতারই ইঙ্গিত দেয়। ফলে শক্তিশালী সম্পাদকীয়েরও আর খুব একটা প্রয়োজন হচ্ছে না।

তাছাড়া সম্পাদকীয় তো শুধু সংবাদের ট্রিটমেন্ট নির্ধারণ নয়, এটা এক ধরনের রাজনীতিও বটে। এই রাজনীতি হচ্ছে ক্ষমতা বা কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করার স্পর্ধা। আমাদের দেশের যেসব সম্পাদকের গুণে সম্পাদকীয় একটি প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠেছিল তাদের সবাই-ই এই স্পর্ধার বিপুল সম্ভার। দুঃখজনকভাবে গত দুই দশকে এই রাজনীতি দারুণ ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছে। এখন সম্পাদকীয় রাজনীতি বলতে আর ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করা বোঝায় না, বরং ক্ষমতার মাঝে লীন হয়ে যাওয়ার মধ্যেই চরম স্বার্থকতা।

একটা উদাহরণের মাধ্যমে বিষয়টি বেশ স্পষ্ট হয়ে যাবে। গত দুই দশক যাবতই দেশে নিয়মিত বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড চালু আছে। প্রশ্ন হচ্ছে ক’জন সম্পাদক তাদের সম্পাদকীয়তে এটা তুলে ধরেছেন? কিংবা ক’জন সম্পাদক এই বিষয়ে তাদের পত্রিকায় দারুণ অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ছাপিয়েছেন? রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের কথা বাদ দিলাম— এ সময়ে প্রায় তিরিশ জন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন। একদিন কালো ব্যাজ পড়ে মানব বন্ধন করা ছাড়া ক’জন এ বিষয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ছাপানোর স্পর্ধা দেখিয়েছেন? শুধু সাংবাদিক সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের অভিযোগপত্র প্রদানে দীর্ঘসূত্রিতা আর এক্ষেত্রে সম্পাদকদের ভূমিকা থেকেই বিষয়টি বেশ অনুমেয়। অনেকেই এক্ষেত্রে রাজনৈতিক অচলাবস্থার দোহাই দেন। কিন্তু এই অচল রাজনীতিকে চ্যালেঞ্জ করাই সম্পাদকীয় রাজনীতি।

অন্য দেশের কথা বাদই দিলাম। পাশের দেশ ভারতেই এর অজস্র উদাহরণ রয়েছে। ইন্দিরা গান্ধীর প্রধানমন্ত্রিত্বের সময় জরুরি অবস্থা জারির পর ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকা রাজনৈতিক অচলাবস্থাকে ব্যঙ্গ করে অসংখ্য সাহসী কার্টুন ছাপিয়েছিল। শুধু ভারত নয়, পাকিস্তানেও এমন দৃষ্টান্ত রয়েছে। প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হকের সামরিক শাসনের সময় সামরিক কর্তৃপক্ষ কোনও প্রতিবেদনের ক্ষেত্রে সেন্সরশিপ আরোপ করলে প্রধান দৈনিকগুলো ঐ সংবাদের জন্য বরাদ্দ করা স্থানে গাধা বা অন্য কোনও প্রাণির ছবি ছাপাত যেখানে ক্যাপশনে লেখা থাকত কর্তৃপক্ষের নির্দেশে এই সংবাদটি ছাপানো গেল না। বাংলাদেশে এ ধরনের প্রতিবাদী সম্পাদকীয় অবস্থান সাম্প্রতিক সময়তো নয়ই, দূর-অতীতেও খুব একটা দেখা যায় না।

শুধু রাজনীতি নয়, গণমাধ্যমের অতি বাণিজ্যিকীকরণের কারণেও সাম্প্রতিক দশকগুলোতে গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলোতে সম্পাদকদের নিয়ন্ত্রণ বা কর্তৃত্ব অনেকটুকুই সংকুচিত হয়েছে। এক্ষেত্রে খুবই লক্ষ্যণীয় একটি প্রবণতা হচ্ছে গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানসমূহে বিভিন্ন ধরনের নির্বাহী বিশেষ করে প্রধান নির্বাহী পদটির গুরুত্বের অতি বৃদ্ধি। দুনিয়াজুড়ে গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলোতে গত শতকের সাতের দশক থেকেই প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা উৎকর্ষের নামে ব্যবসা প্রশাসন ডিগ্রিধারী লোকজনের গুরুত্ব বেড়েছে। পাশ্চাত্যের উদার গণতান্ত্রিক বাজার ব্যবস্থায় এই শ্রেণিটি বহু আগেই গণমাধ্যম দুনিয়ায় জায়গা করে নিলেও নব্য পুঁজিবাদী ও অবিকশিত গণতন্ত্রের দেশগুলোতে এই প্রবণতা কিছুটা বিলম্বে শুরু হয়েছিল। তবে এই শতকের গোড়ার দিক থেকে শেষোক্ত দেশগুলোর গণমাধ্যম জগতেও এমবিএ ডিগ্রিধারীদের বিজয় কেতন উড়তে শুরু করেছে। গণমাধ্যমে কর্মরত এই শ্রেণিটি যতটা না সংবাদের প্রতি দায়বদ্ধ তার চেয়ে অনেক বেশি মালিক তথা প্রতিষ্ঠানের মুনাফা বৃদ্ধির জন্য উৎসর্গীকৃত। এনারা গণমাধ্যমকে আর পাঁচটা শিল্প প্রতিষ্ঠানের সাথে একই নিক্তিতে মূল্যায়ন করেন। ফলে সংবাদের সাথে বাজারের আর পাঁচটা পণ্যের যে গুণগত পার্থক্য রয়েছে সেটা অনুধাবন করতে পারেন না।

কিন্তু গণমাধ্যমের ব্যাপারটা হচ্ছে পাঠক অর্থের বিনিময়ে সংবাদ কিনলেও এটা ঠিক পণ্য নয়; এর বিনিময় মূল্যের পাশাপাশি আরেকটা মাত্রা রয়েছে— যেটাকে অর্থনীতির ভাষায় ইকোনমিক এক্সটার্নালিটি বলে। যেমন ধরা যাক, সুন্দর কোনও বাগান বাড়ির পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় আমাদের চমৎকার অনুভূতি হয়; একইভাবে ট্যনারির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় এর কটু গন্ধে বিরক্ত হই। দুই ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে প্রত্যক্ষ আর্থিক সম্পর্ক না থাকার পরও একটি আমাদেরকে আনন্দ দিচ্ছে অন্যটি বিরক্ত করছে; এটাই হচ্ছে ইকোনমিক এক্সটার্নালিটি।

গণমাধ্যমগুরু রবার্ট ম্যাকচেজনির মতে, গণমাধ্যম এবং শিক্ষার মতো বিষয়গুলোকে বাজারের আর পাঁচটা পণ্যের মতো শুধু অর্থের মানদণ্ডে বিচার না করে এর ইকোনমিক এক্সটার্নালিটির মাত্রাটিকেও সমান গুরুত্ব দেওয়া উচিৎ; এতে আখেরে রাষ্ট্র এবং সমাজ উপকৃত হয়। কিন্তু, আমাদের দেশসহ বিভিন্ন দেশের গণমাধ্যম নির্বাহীদের নিকট ইকোনমিক এক্সটার্নালিটির প্রসঙ্গটি একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক। তাদের ব্যালান্স শিটসর্বস্ব প্রতিষ্ঠান পরিচালনা কৌশলে শেষ কথা হলো মুনাফা। আর মালিক পক্ষও তাদের বিশাল লগ্নির কারণে একজন সংবেদনশীল সম্পাদকের পরিবর্তে এমবিএ ডিগ্রিধারী মুনাফাপ্রেমী নির্বাহীকেই বেশি গুরুত্ব দেয়। কিন্তু, আমরা যদি গণমাধ্যমের ধ্রুপদী চার মাত্রা তথা অবহিতকরণ, শিক্ষিতকরণ, বিনোদিতকরণ ও প্রভাবিতকরণের ধারণাকে বিবেচনায় নিই তাহলে মুনাফার প্রসঙ্গটি এখানে অনেক দূরবর্তী বিষয়। অথচ, সর্বগ্রাসী মুনাফাচেতনার কারণেই সমকালীন গণমাধ্যম মালিকদের নিকট সম্পাদকের চেয়ে প্রিয় হচ্ছে প্রধান নির্বাহী। এর ধারাবাহিকতায় সংবাদ প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরেই ক্ষমতার দুটি বলয় গড়ে উঠছে। ফলে, প্রতিষ্ঠান হিসেবে সম্পাদকীয়ের দীর্ঘ দিনের কর্তৃত্ব আজ ক্রমক্ষয়িষ্ণু।     

এর পাশাপাশি উপসম্পাদকীয় বিভাগের ব্যর্থতা সম্পাদকীয় প্রতিষ্ঠানের দুর্বলতাকে ত্বরান্বিত করেছে। সম্পাদকীয় প্রতিষ্ঠানের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান হচ্ছে উপসম্পাদকীয়। সম্পাদকীয় অবস্থান পত্রিকার সার্বিক বিষয়াদির উপর খবরদারি করলেও উপসম্পাদকীয়র ক্ষেত্রে এটা যথেষ্ট শিথিল। গণমাধ্যমের আদর্শিক অবস্থানের সাথে তীব্র সাংঘর্ষিক না হলে এখানে বিপরীত মত, পন্থা ও বিতর্ককে স্থান করে দেওয়া হয় যাতে করে রাষ্ট্রের বিভিন্ন অংশীজন বিশেষত: ক্ষমতাকাঙ্খী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে সুস্থ প্রতিযোগিতা নিশ্চিত হয় এবং ক্ষমতাকেন্দ্রের যে কোনও পরিবর্তনের পরও সামাজিক ভারসাম্যমূলক অবস্থার যেন চুড়ান্ত পতন না হয়। এদিক থেকে বিবেচনা করলে আমাদের গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলো এধরনের ব্যবস্থা তৈরি করতে ভীষণভাবে ব্যর্থ হয়েছে।

গণমাধ্যমের অংশীজন বলতে শুধু সরকার, বিজ্ঞাপনদাতা, মালিক আর সাংবাদিক নেতাদের সমষ্টিকে নির্দেশ না করে দর্শক-পাঠককেও গুরুত্বের সাথে বিবেচনায় নিতে হবে।

টেলিভিশনের টক শো কিংবা পত্রিকার উপসম্পাদকীয় অংশ— সবটাই কার্যত সহমতবার্তা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। এমনকি স্যাটায়ার কিংবা ব্যঙ্গচিত্রও চিরন্তন সত্ত্বা বিসর্জন দিয়ে নির্দোষ ছবি কিংবা স্তুতিমূলক আলোচনায় পর্যবসিত হয়েছে। এ অবস্থার জন্য সম্পাদকীয় কর্তৃপক্ষের পাশাপাশি এদেশের সুশীল সমাজও কম দায়ী নয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সুশীল সমাজের নেতৃবৃন্দ ক্ষমতা বা কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ না করে বরং স্তুতি বা প্রশংসাকেই দায়িত্ব মনে করছে। তাই সম্পাদকীয় প্রতিষ্ঠানের সাম্প্রতিক দুর্দশার দায় আমাদের সুশীল সমাজ নেতৃবৃন্দ বা বুদ্ধিজীবীরাও এড়াতে পারেন না।

সম্পাদকীয় প্রতিষ্ঠান ক্ষয় প্রাপ্তির অন্য আরেকটি কারণ হচ্ছে যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে সামাজিক মাধ্যমের অভূতপূর্ব বিকাশ। বস্তুতপক্ষে গত দেড় দশকে সামাজিক যোগাযোগ প্ল্যাটফর্ম বিশেষ করে ফেইসবুক এবং টুইটার (এখন ‘এক্স’) এতটাই জনপ্রিয়তা পেয়েছে যে এর ফলে বেশ কিছু প্রচলিত গণমাধ্যমই প্রাসঙ্গিকতা হারিয়ে বসেছে; আর এর বিপরীতে সামাজিক প্ল্যাটফর্মগুলো বিকল্প জনপরিসর হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এর একটা কারণ হলো, এই প্ল্যাটফর্মগুলো একই সাথে তথ্য উৎপাদনকারী আবার ব্যবহারকারীও বটে। এই বৈশিষ্ট্যের কারণে প্ল্যাটফর্মগুলো ব্যক্তির মধ্যে এক ধরনের স্বয়ংসম্পূর্ণতা বা সেল্ফ সাফিশিয়েন্সির বোধ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে যেখানে সে প্রচলিত গণমাধ্যমগুলোর কর্তৃত্বের প্রতি অনেক ক্ষেত্রেই চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিতে পারে। প্রচলিত গণমাধ্যমগুলোর ভুল-ত্রুটি কিংবা কোনও নীতিগত অবস্থান পছন্দ বা অপছন্দ হলে সামাজিক যোগাযোগ প্ল্যাটফর্মের সাহায্যে ব্যক্তি সরাসরি নিজের বক্তব্য তুলে ধরতে পারছে এবং তার মতামতের পক্ষে-বিপক্ষে কম-বেশি জনমতও সংগঠিত হচ্ছে। এই সামাজিক মাধ্যমগুলো হয়ে উঠেছে ব্যক্তির যেমন ইচ্ছা লিখবার কবিতার খাতা। এক্ষেত্রে আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটটি যদি বিবেচনা করি তাহলে দেখা যাবে অনেক ইউটিউবার বা ফেইসবুক ব্যবহারকারীর ফ্রেন্ড/ফলোয়ারের সংখ্যা বহু গণমাধ্যমের সার্কুলেশনের চেয়ে বেশি। সামাজিক প্ল্যাটফর্মের এই প্রবৃদ্ধি গণমাধ্যমের সার্বিক উপযোগিতাকেই অনেকাংশে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। ফলে, গণমাধ্যম ও এর সম্পাদকীয় প্রতিষ্ঠান দুটোই দুর্বল হয়ে পড়েছে এবং সেটাই স্বাভাবিক।

তাহলে কি ধরে নেব সংবাদ, সংবাদপত্র আর সম্পাদকীয়ের যেদিন গেছে একেবারেই গেছে? কিছুই কি নেই বাকি? এই প্রশ্নের উত্তরও এক বাক্যে দেওয়া সম্ভব নয়। কারণ সাদা চোখে সংবাদ এবং সম্পাদকীয় ক্রমক্ষয়িষ্ণু হলেও এর কোনও সম্ভাবনা নাই এমনটি ভাবা নেহায়েৎ অর্বাচীনের কাজ।

পাশ্চাত্যে যখন সংবাদপত্র বলতে মুনাফাসর্বস্ব বাণিজ্যিক পত্রিকাকে বোঝানো হতো তখনও সত্য প্রকাশের চ্যালেঞ্জ নিয়ে বিকল্প পত্রিকা প্রকাশিত হতো। কোনও প্রাচীন গল্প-গাথা থেকে বলছি না। এই সেদিন, মানে ১৯৯০-এর দশকেও প্রকাশিত হতো ‘লাইজ অব আওয়ার টাইম্স’ যেখানে ‘নিউ ইয়র্ক টাইম্স’-এ প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদনের ভুল, মিথ্যা তথ্য এবং অতিরঞ্জন নিয়মিতভাবে ধরিয়ে দেওয়া হতো। এধরনের সাহসী উদ্যোগ শুধু পাশ্চাত্যে নয়, বরং অনেক দেশেই দেখা গেছে। যেমন, ১৯৮০-এর দশকে বাণিজ্যিক এবং রাজনৈতিক চাপের কারণে তাইওয়ানের মূলধারার মিডিয়াগুলো যখন অনেক সংবাদ চেপে যেতে শুরু করল তখন ‘দাওয়াং’ নামে একটি পত্রিকা বের হলো। পত্রিকাটির অন্যতম সম্পাদকীয় নীতি ছিল বিভিন্ন পত্রিকার যেসব রিপোর্ট নানা ধরনের চাপের কারণে ছাপা হতো না সেগুলো সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদকদের নিকট থেকে সংগ্রহ করে প্রকাশ করা। অবশ্য অপরাপর পত্রিকায় কর্মরত সাংবাদিকদের সম্মিলিত সহযোগিতাও এধরনের সম্পাদকীয় নীতি অনুসরণের ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা রেখেছিল।

সাংবাদিকদের এধরনের প্রতিবাদী এবং বিকল্প উদ্যোগ সাম্প্রতিক সময়ে একেবারেই অনুপস্থিত ব্যাপারটা সেরকম নয়। এ সময়েও গণমাধ্যমের ধ্রুপদী সম্পাদকীয় নীতি মেনে পত্রিকা প্রকাশিত হচ্ছে। পশ্চিম ইউরোপে, বিশেষ করে স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোতে, বাণিজ্যিক চাপ মোকাবেলা করতে গিয়ে অনেক সাংবাদিকই গণচাঁদা বা ক্রাউড-ফান্ডেড পত্রিকা প্রকাশের দিকে ঝুঁকছে যাদের সম্পাদকীয় নীতিই হচ্ছে লগ্নিপুঁজির দায় হতে মুক্ত থেকে সর্বোচ্চ স্বাধীনভাবে সাংবাদিকতা চর্চা করা। শুধু পাশ্চাত্যেই নয়, দক্ষিণ এশিয়াতেও স্বাধীন সম্পাদকীয় চর্চার লক্ষ্যে ক্রাউড-ফান্ডেড পত্রিকা প্রকাশিত হচ্ছে। পাশের দেশ ভারতেরই বিখ্যাত ‘দ্য হিন্দু’ পত্রিকার একদল উচ্চাভিলাষী সাংবাদিক স্বাধীন সাংবাদিকতার স্বপ্ন নিয়ে প্রকাশ করেছে ‘দ্য ওয়্যার ইন্ডিয়া’। গত ক’বছর ধরে পত্রিকাটি বেশ সাফল্যের সাথেই এগিয়ে যাচ্ছে; তাদেরও আয়ের অন্যতম উৎস হচ্ছে গণচাঁদা।        

বাংলাদেশেও এ ধরনের উদ্যোগ যথেষ্ট টেকসই হতে পারে। স্বাধীন সম্পাদকীয় চর্চার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের যোগান দেওয়ার মতো আর্থিক সামর্থ্য এবং আকাঙ্খা  বিশাল সংখ্যক পাঠকেরই রয়েছে। এখানকার মধ্যবিত্ত শ্রেণিটি  নেহায়েৎ ছোট নয়; তাছাড়া তাদের তথ্যক্ষুধাও রয়েছে। এর পাশাপাশি এখানকার ইন্টারনেট সংস্কৃতি, বিশেষ করে ডিভাইস ব্যবহারের বিবেচনায়, যথেষ্টই বিকশিত হয়েছে। মোটা দাগে বললে, বাণিজ্যিক চাপ হতে মুক্ত থেকে স্বাধীন সম্পাদকীয় চর্চার অর্থনৈতিক এবং সামাজিক পূর্বশর্তসমূহের অধিকাংশই উপস্থিত রয়েছে। তবে অনেকটুকুই অনুপস্থিত রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক  সহযোগিতা।

মত প্রকাশের স্বাধীনতা সূচকে বাংলাদেশের ক্রমাবনতিশীল অবস্থান, কিংবা উত্তর-নব্বই নির্বাচনসর্বস্ব গণতন্ত্রের যুগে সংসদে পাস হওয়া তথ্য ও গণমাধ্যম আইনগুলো, অথবা দলীয় মাস্তানদের হাতে সাংবাদিক নিগ্রহের ক্রমবর্ধনশীল প্রবণতার দিকে তাকালেই বিষয়টা অনেকটুকু স্পষ্ট হয়ে যায়। তবে এরও নিদান আছে। আর সেটা হচ্ছে সম্মিলিত প্রতিরোধ। এক্ষেত্রে প্রাথমিক উদ্যোগ সংবাদকর্মীদেরই নিতে হবে। ঐকমত্যের ভিত্তিতে রাষ্ট্র বা ক্ষমতার সাথে দেনদরবার বাংলাদেশের গণমাধ্যম ইতিহাসে খুব নতুন নয়। এই সেদিনও প্রাইভেট চ্যানেলের কর্তাব্যক্তিরা দেশি টেলিভিশনে বিদেশীয় বিজ্ঞাপন প্রদর্শনের বিরুদ্ধে দল-মতের উর্ধ্বে উঠে প্রতিবাদ করেছিল এবং সফলও হয়েছিল। কিংবা ১৯৯০-এর দশকে সরকার যখন নিউজপ্রিন্ট আমদানির ক্ষেত্রে অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করল তখনও পত্রিকার প্রকাশক-সম্পাদকরা এর বিরুদ্ধে সফল প্রতিবাদ করেছিল। কিন্তু, অত্যন্ত দুঃখজনকভাবে তারা আইসিটি এ্যাক্ট-২০০৬, কিংবা ডিজিটাল সিকিউরিটি এ্যাক্ট-২০১৮, অথবা বিভিন্ন সময়ে রাষ্ট্র কর্তৃক সাংবাদিক নিগ্রহের বিরুদ্ধে সম্মিলিত প্রতিরোধ গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছে। উপরন্তু, গুটিকয় সম্পাদক ও সাংবাদিক নেতা রাষ্ট্রের এ ধরনের উদ্যোগের সমর্থনে হাত তুলেছিল।

মোদ্দা কথা হচ্ছে, গণমাধ্যমের স্বার্থ, সাংবাদিকতায় পেশাদারিত্ব প্রভৃতি বিষয়গুলোকে সুবিধাবাদী অবস্থান থেকে না দেখে সততা ও আন্তরিকতার সাথে বিশ্লেষণ এবং সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নিতে হবে। এর পাশাপাশি গণমাধ্যমের অংশীজন বলতে শুধু সরকার, বিজ্ঞাপনদাতা, মালিক আর সাংবাদিক নেতাদের সমষ্টিকে নির্দেশ না করে দর্শক-পাঠককেও গুরুত্বের সাথে বিবেচনায় নিতে হবে। এক কথায়, সম্পাদকীয় প্রতিষ্ঠানের ধারণাকে উল্লম্বভাবে না দেখে বরং আনুভূমিকভাবে দেখতে হবে। এতে করে গণমাধ্যম এবং এর ভোক্তাশ্রেণী—দুই পক্ষই উপকৃত হবে যা আখেরে সম্পাদকীয় প্রতিষ্ঠানের ভিত্তিকেই শক্তিশালী করবে।       

লেখক: শিক্ষক, যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।