Beta
বৃহস্পতিবার, ৯ মে, ২০২৪
Beta
বৃহস্পতিবার, ৯ মে, ২০২৪

গণমাধ্যম এখন

কলমে শিরোনাম মাথায় ফেইসবুক

জাহিদ নেওয়াজ খান। প্রতিকৃতি অঙ্কন: সব্যসাচী মজুমদার

‘একদা এক দেশে ছিল এক রাজা’— এরকম করে একদিন হয়তো আমাদের বলতে হতে পারে, একসময় সংবাদ প্রতিবেদনে ‘সংবাদ সূচনা’ বলে একটা বিষয় ছিল। ঠিক এ মুহূর্তে ছোট থেকে বড় অথবা প্রতিষ্ঠিত কিংবা অপ্রতিষ্ঠিত দশটি গণমাধ্যমের অনলাইনে প্রকাশিত দশটি আলাদা প্রতিবেদনে ঢুকলে আপনি বড়জোর তিনটিতে সংবাদ সূচনা বলে যে বিষয়টি আছে, মানে যেখানে খবরের প্রধান বা মূল কথা বলার কথা, সেরকম সূচনা পাবেন। বাকি সাতটিতেই আপনি দেখবেন হয় প্রেক্ষাপট বর্ণনা করে অনেক পরে মূল তথ্যটি দেওয়া হয়েছে, অথবা ধানাই-পানাই নানা কথা বলে শেষ পরিচ্ছদে এসে তথ্যটি জানানো হয়েছে।

এর কারণ আমাদের সকলের জানা। সংবাদ মাধ্যম যেহেতু অনলাইনে তার পাঠককে ধরে রাখতে চায়; আধেয়র মান যাই হোক— চায় যে পাঠক তার সাইটে আরও বেশি সময় থাকুক, তাই সহজ কথা সহজে না বলে অনেক গল্প-গুজব করে তারপর মূল তথ্য দেয়, কোনও কোনও ক্ষেত্রে দেয়ই না।

এভাবে সংবাদ প্রতিবেদন থেকে শুধু যে সংবাদ সূচনাই হারিয়ে যাচ্ছে এমন নয়। দর্শক-পাঠককে আকর্ষণ করার জন্য এমন চটকদার শিরোনাম করা হচ্ছে যার সাথে মূল সংবাদের কোনও সম্পর্ক নেই, সম্পর্ক থাকলেও শিরোনামে যে তথ্য থাকার কথা সেটা সেখানে নেই।

কেউ কেউ বলবেন যে সাংবাদিকতার মূল লক্ষ্য যখন মানুষকে তথ্য জানানো, যত বেশি সম্ভব তত বেশি মানুষকে তথ্য জানানো, যত বেশি সম্ভব তত বেশিক্ষণ মানুষকে তার আধেয়র মধ্যে রাখা, তাই সংবাদ মাধ্যম নানা কৌশল নিতেই পারে। কথা সত্য। কিন্তু সেই কৌশল যখন সত্যের অপলাপ, অপকৌশলে অসৎ পথে ধাবমান; তখন সেটাকে আর যাই বলা হোক, সাংবাদিকতা বলা সম্ভব না, উচিতও না।

এসব কারণে, আগেও অনেকবার বলেছি এবং লিখেছি যে এখন গণমাধ্যমের সমার্থক শব্দ তাই সংকট। সংকট থাকলে সমাধানের পথও থাকে; কিন্তু গণমাধ্যমের এখনকার সংকটের বিস্তৃতি এতটাই ব্যাপক এবং বহুমুখী যে উত্তরণের পথ খুবই জটিল— এক বিশাল বুদ্ধিবৃত্তিক ও প্রযুক্তির লড়াই। মোবাইল ফোনের যুগে এসে স্টিল ক্যামেরা যেমন হারিয়ে গেছে, ভিডিও ক্যামেরাকে টিকে থাকার জন্য লড়াই করতে হচ্ছে, তেমনি প্রচলিত গণমাধ্যম— সংবাদপত্র, রেডিও এবং টেলিভিশনকে লড়তে হচ্ছে নানা ফ্রন্টে। মোবাইল, ইন্টারনেট এবং সর্বশেষ ফেইসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এভাবে গণমাধ্যমকে যে বিশাল চ্যালেঞ্জের মধ্যে ফেলে দিয়েছে—তা এক বৈশ্বিক সমস্যা। বাংলাদেশের মতো দেশে সংকট আরও বহুমুখী। 

ডিভাইসভিত্তিক টার্গেট অডিয়েন্সের কারণে  সাংবাদিকতায় আমরা একটা ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছি। এই আমরা মানে গণমাধ্যম, যে গণমাধ্যমে আমরা কাজ করি আর আমাদের টার্গেট অডিয়েন্স যে মাধ্যমের দর্শক, শ্রোতা এবং পাঠক।

বাংলাদেশে সংকটের যে অন্য দিকগুলো আছে সেগুলো নিয়ে কথা বলার আগে বৈশ্বিক সংকট নিয়ে কথা বলা উচিৎ। শুরুতে অবশ্য এ কথাও মনে রাখা উচিৎ যে মানুষ কোন মাধ্যমে সংবাদ গ্রহণ করবে সেটা নিয়ে তার অভ্যাসে পরিবর্তন ঘটলেও সংবাদ হচ্ছে এমন একটা বিষয় যা জানার আগ্রহ মানুষের জীবনেও শেষ হবে না। সংবাদ অর্থাৎ সংবাদ আধেয় (কনটেন্ট) কোনও দিনই তাই হারিয়ে যাবে না, মানুষ কোন মাধ্যমে বা প্ল্যাটফর্মে গ্রহণ করবে সেটা হচ্ছে বিষয়। এক্ষেত্রে এটা সবাই স্বীকার করবেন যে মোবাইল ফোন এখন বিশ্বের এক নম্বর ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম। কিন্তু, এটাও ঠিক, যে পরিমাণে সম্ভাবনা এবং সুযোগ আছে মানুষ মোবাইলে এখনো সেই পরিমাণ সংবাদ হজম করে না। এর প্রধান কারণ যারা সবকিছুর জন্যই এখন মোবাইল ফোনের ওপর নির্ভর করে অনেক সময়ই তাদের অগ্রাধিকারের মধ্যে সংবাদ থাকে না। গান শোনা কিংবা গেইম খেলা বা ছবি তোলা অথবা ভিডিও দেখা থেকে শুরু করে অনলাইনে কেনাকাটা বা অফিসের কনফারেন্সে যোগ দেওয়ার মতো বিষয়-আশয়গুলো ছাপিয়ে অনেক সময়ই তাদের কাছে প্রধান অগ্রাধিকার হিসেবে আসতে পারে না সংবাদ।

ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাসের সাংবাদিকতার অধ্যাপক পলা পয়েনডেক্সচার তার ‘নিউজ ফর অ্যা মোবাইল-ফার্স্ট কনজ্যুমার’ বইয়ে লিখেছেন: মোবাইল ফোনে এতসব প্রয়োজন মেটানোর পর সংবাদ আসলেই খুব নিচের দিকের অগ্রাধিকার। অন্যদিকে, একজন সম্পাদকও সংবাদ নিয়ে সেই টার্গেট অডিয়েন্সের কাছে পৌঁছানোর জন্য নিরবচ্ছিন্ন মনোযোগ দিতে পারেন না। এ কারণে মোবাইলে আরও বেশি পাঠক-দর্শক-শ্রোতার কাছে পৌঁছানোর জন্য গণমাধ্যমের মোবাইল খাতে বিনিয়োগ খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। পয়েনডেক্সচারের ভাষায়, ‘স্মার্টফোন এখন আর শুধু যে কোনো একটি ডিভাইস না, হাতেরই বর্ধিত অংশ’। 

‘নিউজ ফর অ্যা মোবাইল-ফার্স্ট কনজ্যুমার’ বইয়ে দুটি মার্কিন জরিপের বরাতে বলা হয়েছে, মোবাইল ব্যবহারকারীরা তিন ধরনের : ১. ‘মোবাইল ফার্স্ট’ অর্থাৎ যাদের কাছে সবকিছু ছাপিয়ে মোবাইল ফোন এক নম্বরে, যারা সবকিছুর জন্য মোবাইল ফোন ব্যবহার করেন; ২. ‘মোবাইল স্পেশালিস্টস’ অর্থাৎ যারা বিশেষ কিছু কাজে মোবাইল ব্যবহার করেন, যেমন: সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার (১৯%), ইন্টারনেট সার্চ (১৮%), গেইমিং (১২%), বিনোদন (৯%), সংবাদ (৮%), অন্যান্য (৩৩%); এবং ৩. মোবাইলে পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠী যারা মোবাইল ফোনের আসল যে কাজ ছিল ‘কথার যোগাযোগ’ শুধু সে পর্যন্তই সীমাবদ্ধ। এরা সংবাদের জন্য কোনও নির্দিষ্ট সময়ে টেলিভিশন সেটের সামনে বসেন কিংবা কাগজের পত্রিকা পড়েন। কোনও সন্দেহ নেই যে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাদের সংখ্যা কমছে এবং কমতেই থাকবে।  

বাংলাদেশে এরকম সুনির্দিষ্ট বিষয়ে গবেষণার কথা জানা নেই। গবেষণা না থাকাটা এ বিষয়ে আমাদের কম মনোযোগ থাকাটাকেও ইঙ্গিত করে। বিভিন্ন পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বাংলাদেশে এখন মোবাইল সংযোগের সংখ্যা প্রায় ১৮ কোটির বেশি, আর প্রায় ১৩ কোটির বেশি গ্রাহকের ডেটা অর্থাৎ ইন্টারনেট সংযোগ আছে। আর ফেইসবুক অ্যাকাউন্ট আছে প্রায় পাঁচ কোটি মানুষের।

এখন ছাপা পত্রিকার পরিসংখ্যানের দিকে চোখ দিই। এক্ষেত্রে সংবাদপত্রগুলো সরকারি বিজ্ঞাপনের জন্য সত্য-মিথ্যা যে পরিসংখ্যান দেয় এবং সরকার সেটা মেনেও নেয়— সেই হিসাব বিবেচনায় নেওয়ার দরকার নেই। বাস্তবতা হচ্ছে বাংলাদেশের সবগুলো দৈনিক পত্রিকার মোট বিক্রি ১০ লাখের একটু বেশি। পাঠক নিশ্চয়ই এর কয়েকগুণ। তারপরও তা ফেইসবুকে সক্রিয় মানুষদের ধারে কাছেও না। তার ওপর ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর বড় অংশ তরুণ প্রজন্ম, যাদের অনেকে আবার কাগজের পত্রিকা পড়তে অভ্যস্ত নয়। এরা যে টেলিভিশনও খুব দেখে এমন নয়, কারণ তাদের আছে ফেইসবুক-ইউটিউব-ইন্সটাগ্রাম-টিকটকসহ অন্যান্য সামাজিক মাধ্যম। হাতে থাকা মোবাইল ফোন নামক ডিভাইসটিই তাদের নানা ধরনের যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম।

আমরা যদি আমাদের ফেইসবুক ইউজারদের পলা পয়েনডেক্সচারের ভাষায় ‘মোবাইল স্পেশালিস্ট’ ধরি, তাহলে তার বক্তব্যর দিকেও নজর দিতে পারি। তিনি বলছেন: ‘মোবাইল স্পেশালিস্ট’রা কোনও না কোনওভাবে মোবাইলের মাধ্যমে আপনার প্রকাশিত সংবাদের পাঠক বা শ্রোতা কিংবা দর্শক হবেন কারণ সেই মানসিকতা নিয়েই তারা মোবাইল ব্যবহার করছেন। কিন্তু, ‘মোবাইল ফার্স্ট’রাই সংখ্যাগুরু হবেন, তারাই হওয়া উচিত নতুন টার্গেট অডিয়েন্স। এ জন্য সেই বিনিয়োগ এবং জনশক্তি গড়ে তোলার কথা বলেছেন তিনি। 

এখানেও তা শুরু হয়েছে। তাই এখনকার সাংবাদিকরাই হয়তো শেষ প্রজন্ম যারা হয় শুধু পত্রিকা অথবা শুধু রেডিও-টেলিভিশনের সাংবাদিক হিসেবে তাদের সাংবাদিকতা জীবন শুরু করেছিলেন। মূলত মোবাইল অডিয়েন্সকে সামনে রেখে আগামীর যে বার্তাকক্ষ গড়ে উঠছে তার সবই একেকটি মাল্টিমিডিয়া স্টুডিও।

তাই বলে কি সাংবাদিকতার মূল দর্শন হারিয়ে যাবে? না, সেটা কখনোই হবে না। বরং প্রতিদিনই আরও বেশি মানুষের মোবাইল এবং ইন্টারনেট সংযোগে যুক্ত হওয়ার মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম শক্তিশালী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এর মৌলিক দিকটা আরও শক্তিশালী হবে। ফেইসবুক দিয়ে বিষয়টা আরও স্পষ্ট করা যায়। 

মূলধারার গণমাধ্যম এতদিন শুধু বার্তা দিয়ে গেছে। অন্যপক্ষ থেকে শোনার বা জানার তেমন কোনো ব্যবস্থা ছিল না। এখন একটি সংবাদ যেমন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, বিশেষ করে ফেইসবুকের মাধ্যমে আরও বেশি অডিয়েন্সের কাছে পৌঁছে দেওয়া যাচ্ছে তেমনি গণমাধ্যম ফেইসবুক থেকে পাওয়া কমেন্টের মাধ্যমে পাঠকের চাওয়া, চিন্তা এবং আকাঙ্খার কথা জানতে পারছে। এভাবে পাওয়া ফিডব্যাকের ভিত্তিতে এজেন্ডা সেটিংয়েও ভিন্নভাবে চিন্তা করতে পারছে গণমাধ্যম।

এভাবে প্রযুক্তির বিকাশে একদিকে অনলাইন এবং অন্যদিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রভাবে গণমাধ্যমে বছরের পর বছর যে চর্চা প্রচলিত ছিল সেখানে গুরুত্বপূর্ণ বাঁক যেমন আসছে তেমনি প্রচলিত গণমাধ্যম সামাজিক মাধ্যম হয়ে মানুষের চিন্তা-চেতনায় আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি প্রভাব ফেলছে। পরস্পরের এরকম পরিপূরক অবস্থায় একদিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম মূলধারার গণমাধ্যমকে নতুন নতুন বিষয়-আশয় এবং ঘটনার সন্ধান দিচ্ছে।

অন্যদিকে, গণমাধ্যমের খবর ফেইসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে বিতর্কের বিষয় হিসেবে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায় ভূমিকা রাখছে। এসবেই সবচেয়ে বড় মাধ্যম বা ডিভাইস হয়ে গেছে মোবাইল।

নিশ্চিতভাবেই তাই বলা যায়, ডিভাইসভিত্তিক টার্গেট অডিয়েন্সের কারণে  সাংবাদিকতায় আমরা একটা ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছি। এই আমরা মানে গণমাধ্যম, যে গণমাধ্যমে আমরা কাজ করি আর আমাদের টার্গেট অডিয়েন্স যে মাধ্যমের দর্শক, শ্রোতা এবং পাঠক। গত কয়েক বছরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এক ধরনের বিপ্লবে এর উত্তাপটা আমরা টের পাচ্ছি। তাই বলে সাংবাদিকতার নামে কনটেন্টের যে ‘বলাৎকার’ কিংবা মানুষকে বিভ্রান্ত করার যে টেক্সট, সেটা কখনো সাংবাদিকতা হবে না।

লেখক: সাংবাদিক ও লেখক। সাংবাদিকতার শিক্ষক ও প্রশিক্ষক।

ইমেইল: znewaz@gmail.com