Beta
সোমবার, ২০ মে, ২০২৪
Beta
সোমবার, ২০ মে, ২০২৪

কলাম

আমার রেডিওর স্মৃতি এবং বাচ্চুদের রেডিও

সেলিম জাহান। প্রতিকৃতি অঙ্কন: সব্যসাচী মজুমদার।

এক.

আমাদের ছোটবেলায় আমাদের মধ্যবিত্ত জীবনে রেডিওর ভূমিকা ছিল দুটো—প্রথমটি বিনোদন ও আনন্দের এবং দ্বিতীয়টি শিক্ষার। গান, নাটক যাই শুনি না কেন, আমাদেরকে পই পই করে বলা হতো ‘খবর শোন’। এখন  বুঝতে পারি, সেটা যত না আমাদেরকে বৈশ্বিক জ্ঞান দানের জন্যে, তার চেয়ে বেশি শুদ্ধ উচ্চারণ শেখানো, ভাষার শব্দ ভাণ্ডার বাড়ানো এবং সঠিক বাক্য গঠনের তালিম যাতে পাই। আমার বাবা ছিলেন আরো এক কাঠি সরেস— তাঁর দশম বর্ষীয় পুত্রকে তিনি রেডিওর ইংরেজি সংবাদ শুনতেও উদ্বুদ্ধ করতেন।

জনান্তিকে বলে রাখি, আমি অষ্টম শ্রেণির বৃত্তি পরীক্ষায় সারা খুলনা বিভাগে প্রথম স্থান অধিকার করলে আমার পিতা আমাকে সে যুগের একটি ছোট্ট ট্রানজিস্টার রেডিও উপহার দিয়েছিলেন। বাদামী চামড়ার খাপের এই নয়নাভিরাম যন্ত্রটি আমার সারা স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রথম দিক পর্যন্ত আমার শয়নে, স্বপনে, নিশি জাগরণে আমার নিত্য সঙ্গী ছিল। ১৯৭১ সালে আমাদের বাড়িতে এক বিকেলে পাকিস্তানি সেনারা হানা দিলে তারা আমার রেডিওটি নিয়ে যায়।

আকাশবাণী (নামটি রবীন্দ্রনাথ প্রদত্ত) কোলকাতার প্রতি ছিল আমার এক ধরনের মুগ্ধতা, তার একাধিক আকর্ষণীয় অনুষ্ঠানের জন্য। কোনও গানের জন্য কখনও অনুরোধ করিনি, কিন্তু ‘অনুরোধের আসরেই’ আমার শোনা বেশিরভাগ বাংলা গান শুনেছি, শিল্পীদের চিনেছি। ‘অনুরোধের আসরের’ জন্য উদগ্রীব হয়ে বসে থাকতাম। মা শুনতেন দুপুর দু’টো দশে প্রচারিত ‘মহিলা মহল’, বেলা দে’র পরিচালনায়। তখন দু’টো কাজ থাকত আমার জন্যে— এক, কাগজ কলম নিয়ে মায়ের জন্যে নানান খাবারের পাক-প্রণালী লেখা রেডিওতে শুনে শুনে এবং প্রায়শঃই ছাদের ওপরকার এ্যারিয়েল ১০ বার ঠিক করা। এতো বিরক্ত লাগত!

আমাদের ছোটবেলায় আমাদের মধ্যবিত্ত জীবনে রেডিওর ভূমিকা ছিল দুটো—প্রথমটি বিনোদন ও আনন্দের এবং দ্বিতীয়টি শিক্ষার। গান, নাটক যাই শুনি না কেন, আমাদেরকে পই পই করে বলা হতো ‘খবর শোন’। এখন বুঝতে পারি, সেটা যত না আমাদেরকে বৈশ্বিক জ্ঞান দানের জন্যে, তার চেয়ে বেশি শুদ্ধ উচ্চারণ শেখানো, ভাষার শব্দ ভাণ্ডার বাড়ানো এবং সঠিক বাক্য গঠনের তালিম যাতে পাই।

সন্ধ্যেয় শুনতাম ‘শিশুমহল’। এখনো মনে আছে তার প্রারম্ভিকা— ‘তোমাদের ইন্দিরা’দি বলছি। ছোট্ট সোনা বন্ধুরা ভাই, আদর আর ভালেবাসা নাও। কি, ভালো আছো তো সব?’ পার্থ ঘোষের পরিচালনায় হতো ‘গল্প দাদুর আসর’। শিশুদের জন্য এমন অনুষ্ঠান তৎকালীন রেডিও পাকিস্তান ঢাকায় পরিচালনা করতেন নুরুন্নাহার ফয়জুন্নেসা। ফেরদৌসী রহমান গান শেখাতেন বাচ্চাদের। তাঁর শেখানো, ‘ঝড় এলো, এলো ঝড়, আম পড়্, পড়্; কাঁচা আম, পাকা আম, টক্, ঝাল, মিষ্টি; এই যাহ: এলো বুঝি বৃষ্টি!’, এখনো কানে বাজে।

প্রতি রোববারে সকাল সাড়ে ন’টায় আকাশ বাণী কোলকাতায় শোনা যেত ‘সঙ্গীত শিক্ষার আসর’ পঙ্কজ কুমার মল্লিকের পরিচালনায়। না গাইয়ে হয়েও সেখানেই নানান বাংলা বানান শুধরে নিয়েছি। এর পরে এলেন সুচিত্রা মিত্র। তৎকালীন রেডিও পাকিস্তান ঢাকায় অমনটি করতেন আবদুল আহাদ। পরে লায়লা আর্জুমান্দ বানু সম্ভবতঃ।

আকাশবাণী ভবন। ১৯৫৮ সালে ‘আকাশবাণী’ নামকরণের পর ইডেনের পাশে বর্তমান ঠিকানায় আসে তারা। আলোকচিত্র: উইকিমিডিয়া কমন্স।

‘অখিল ভারতীয় কার্যক্রম’-এ রাত দশটায় এক ঘণ্টার অনুষ্ঠানে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত পরিবেশিত হতো দিল্লি থেকে। সম্প্রচারিত হ’তো আকাশবাণীর সকল কেন্দ্র থেকে। ভারতের ডাঁকসাইটে ওস্তাদেরা আসতেন সেখান। সেখানেই প্রথম শুনি বিসমিল্লাহ খাঁয়ের সানাই, শিবকুমার শর্মার সান্তুর। বলা বাহুল্য, পরবর্তী জীবনে ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের প্রতি আমার অনুরাগের জন্ম সেখানেই। ‘বিবিধ ভারতী’তে শুনেছি দেদার হিন্দি গান—শুনেছি রেডিও সিলোন থেকেও।

‘আকাশবাণীর’ ব্যক্তিত্ব হিসেবে আমার খুব প্রিয় ছিলেন বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্র। বিশেষ করে পূজো উপলক্ষে তাঁর ‘মহালয়া’ অনুষ্ঠানটি। তাঁর স্তোত্রপাঠের আমি খুব ভক্ত ছিলাম। তিনি ব্রাহ্মণ নন বিধায় কোনো এক বছর তাঁকে বাদ দিয়ে ‘মহালয়ায়’ উত্তম কুমারকে নিয়ে আসা হয়েছিল। কিন্তু শ্রোতারা সেটা মোটেই পছন্দ করেন নি। তখন পরের বছর আবার বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রকে ফিরিয়ে আনা হয়েছিল, মনে আছে।

‘অখিল ভারতীয় কার্যক্রম’-এ রাত দশটায় এক ঘণ্টার অনুষ্ঠানে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত পরিবেশিত হতো দিল্লি থেকে। সম্প্রচারিত হ’তো আকাশবাণীর সকল কেন্দ্র থেকে। ভারতের ডাঁকসাইটে ওস্তাদেরা আসতেন সেখান। সেখানেই প্রথম শুনি বিসমিল্লাহ খাঁয়ের সানাই, শিবকুমার শর্মার সান্তুর। বলা বাহুল্য, পরবর্তী জীবনে ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের প্রতি আমার অনুরাগের জন্ম সেখানেই। ‘বিবিধ ভারতী’তে শুনেছি দেদার হিন্দি গান—শুনেছি রেডিও সিলোন থেকেও।

তৎকালীন রেডিও পাকিস্তান ঢাকা থেকে প্রচারিত হতো ‘আমার দেশ’ শীর্ষক দেশগঠনমূলক অনুষ্ঠানটি। দৈনিক ইত্তেফাকের নির্বাহী সম্পাদক সাংবাদিক আসফউদ্দোলার পরিচালনায় সে অনুষ্ঠানের ক’টি জনপ্রিয় চরিত্র ছিলেন ‘মজিদের মা’ (আয়েশা আক্তার খানম), মাতবর ভাই ও নসুভাই। আ’য়ুবী আমলে এ অনুষ্ঠানটি  রূপান্তরিত হয় ‘বুনিয়াদী গণতন্ত্রের অনুষ্ঠানে’।

আশির দশকে বাংলাদেশ বেতারে ‘আমার দেশ’-এর মতো এ রকম একটি অনুষ্ঠান আমি পরিচালনা করতাম। অংশ নিতেন অভিনেত্রী সেতারা আহমেদ, কৌতুক অভিনেতা আনিস আহমদ ও হুসনা আহমেদ। অনুষ্ঠান-ভিন্ন কত যে আড্ডা হতো আমাদের। বয়োকনিষ্ঠ হলেও দু’জনেই আমাকে ‘সেলিম ভাই’ বলতেন। সেতারা আপা প্রায়ই আমাদের জন্যে নিজের হাতে বানানো পিঠা, পায়েস আর ফলমাখা নিয়ে আসতেন। আজ আনিস ভাই, সেতারা আপা কেউই নেই, কিন্তু তাঁদের কথা প্রায়ই মনে হয়। কালে-ভদ্রে সেতারা আপার পুত্র মিঠুনের সঙ্গে দেখা হলে তাঁর কথা ওঠে। ভারী ভালোবাসতেন সেতারা আপা আমাকে।

রেডিওর একটি অন্যতম আকর্ষণ ছিল নাটক। পরিবারের সবার জন্যে। খাওয়া-দাওয়া সব সেরে সবাই আমরা গোল হয়ে বসতাম রেডিওর চারপাশে। কয়েকটি রেডিও নাটকের স্মৃতি হৃদয়ে অম্লান। কোলকাতা বেতারের  ‘এবং ইন্দ্রজিত’ (বাদল সরকারের লেখা), ‘তাহার নামটি রঞ্জনা’। শম্ভু মিত্র এবং তৃপ্তি মিত্রের অভিনয়ের সঙ্গেও পরিচয় রেডিও নাটকের মাধ্যমে। শাঁওলী মিত্রের অভিনয়ের সঙ্গেও। অনেক পরে অবশ্য আমাদের স্বাধীনতা-উত্তরকালে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গনে ‘চাক ভাঙ্গা মধু’ নাটকটি দেখে অভিভূত হয়ে পড়েছিলাম।

তৎকালীন রেডিও পাকিস্তান ঢাকার নাটক ‘পুতুলের ঘর’, ‘বুনো হাঁস’ শুনতে খুব ভালো লেগেছিল। ‘পুতুলের ঘর’ ইবসেনের ‘The Doll’s House’ এর অনুবাদ । আর বুনোহাঁস’ ইবসেনের ‘Wild Duck’এর— খুব সম্ভবতঃ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর অনুবাদ। তবে  ঢাকা রেডিওর একটি নাটকের কথা খুব মনে আছে। শহীদ মুনীর চৌধুরীর লেখা— ‘সারেং’। নোয়াখালীর আঞ্চলিক ভাষায় লিখিত নাটকটিতে মুনীর কাকা নিজে অভিনয় করেছিলেন। লিলি চাচী (শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর স্ত্রী লিলি চৌধুরী) ছিলেন কিনা সে নাটকে, তা মনে করতে পারছিনা। তবে সে যুগে লিলি চৌধুরী ও প্রয়াত বিচারক সৈয়দ মোহাম্মদ হোসেন বেতার নাটক শিল্পী হিসেবে খুব জননন্দিত ছিলেন।

রেডিওর একটি অন্যতম আকর্ষণ ছিল নাটক। পরিবারের সবার জন্যে। খাওয়া-দাওয়া সব সেরে সবাই আমরা গোল হয়ে বসতাম রেডিওর চারপাশে। কয়েকটি রেডিও নাটকের স্মৃতি হৃদয়ে অম্লান। কোলকাতা বেতারের ‘এবং ইন্দ্রজিত’ (বাদল সরকারের লেখা), ‘তাহার নামটি রঞ্জনা’। শম্ভু মিত্র এবং তৃপ্তি মিত্রের অভিনয়ের সঙ্গেও পরিচয় রেডিও নাটকের মাধ্যমে। শাঁওলী মিত্রের অভিনয়ের সঙ্গেও।

আমাদের কৈশোরে ঢাকা বেতারের অনুষ্ঠান ঘোষকদের মধ্যে সৈয়দ রশীদুন্নবীর কণ্ঠের ভক্ত ছিলাম আমি। একবার রেডিও পাকিস্তান ঢাকার পত্রিকা ‘এলানে’ প্রচ্ছদ পাতায় অনুষ্ঠান ঘোষকদের ছবি ঘড়ির মুখায়ববের মতো করে ছাপা হয়েছিল। সেখানে খুব গুরুত্বপূর্ণভাবে রশীদ ভাইয়ের ছবি ছাপা হয়েছিল— একটি বিস্কুট/বাদামী ধরনের টুইড কোট পরিহিত টগবগে যুবক। বহু বছর পরে আশির দশকে আমি তখন বাংলাদেশ অবজার্ভারে উপ-সম্পাদকীয় লিখি। তৎকালীন রেডিও পাকিস্তান ঢাকা কেন্দ্রের এক সময়ের পরিচালক সৈয়দ জিল্লুর রহমান আমার সহকর্মী তখন সেখানে।

একদিন বাংলাদেশ অবজার্ভার দপ্তরে জিল্লুর ভাইয়ের কাছ এলেন সৈয়দ রশীদুন্নবী। সেখানে তাঁর সঙ্গে পরিচিত হলে আমি আদ্যোপান্ত সব বর্ণনা করেছিলাম। রশীদ ভাই আবেগে আমাকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। সে ছবিতে সেরাজুল মজিদ মামুনও ছিলেন। তখন তিনি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। অনুষ্ঠান ঘোষক হিসেবে তিনিও ছিলেন খ্যাতিমান। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে আমরা তাঁকে জনপ্রিয় টেলিভিশন সংবাদ পাঠক ও একজন সফল ব্যবসায়ী হিসেবে দেখেছি।

আগেই বলেছি যে আমার বাবা চাইতেন যে আমরা রেডিওর সংবাদ পাঠ শুনি— বিশ্বে কি হচ্ছে তা জানার জন্যে এবং সেই সঙ্গে শুদ্ধ উচ্চারণ শেখার জন্যে। তৎকালীন রেডিও পাকিস্তানের বাংলা সংবাদ পাঠক হিসেবে নূরুল ইসলাম সরকার, মুজিবর রহমান খাঁ, নেয়ামল বশির, ইমরুল চৌধুরী ও সরকার কবীরউদ্দীনের কথা পরিস্কার মনে আছে। বহু বছর পরে কবীর ভাইয়ের সঙ্গে ভয়েস অব আমেরিকার বাংলা অনুষ্ঠানে নিয়মিত অংশগ্রহণ করেছি সাক্ষাৎকারে, আলোচনায়, আলাপচারিতায়। বর্তমান সময়ে কবীর ভাই আমার লেখার এক মুগ্ধ পাঠক।

ইংরেজি সংবাদ পাঠকদের মধ্যে এরিক বোনার, রিজওয়ান ওয়াস্তি (অভিনয়ও করতেন), জাহানারা সাইদ (উনি নিজের নাম উচ্চারণ করতেন জাহাঁরা সাঈদ), এ্যানিটা গুলাম আলী। আকাশবাণীর বাংলা সংবাদ পাঠ করা হতো দিল্লি থেকে। খবর পড়তেন বিজন বোস, নীলিমা স্যান্নাল, ইভা নাগ। বিজন বোসের মতো অমন গমগমে গলা বড় একটা শুনিনি।

আরও কত রেডিও অনুষ্ঠানের কথা মনে আসছে, বিশেষতঃ আমাদের মুক্তিযুদ্ধ সময়কার বিভিন্ন রেডিওর কথা— স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র, বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা, রেডিও অস্ট্রেলিয়া।

স্বাধীনতা-উত্তর কালে বিশেষতঃ আশির দশকে রেডিওর প্রেক্ষিতে আমার ভূমিকা বদলে গেল। শ্রোতার বদলে উপস্থাপক ও অংশগ্রহণকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হলাম। কত যে অনুষ্ঠান করেছি— ধারাবাহিকভাবে প্রতি সপ্তাহে! কত যে স্মৃতি তার! তবে সে এক অন্য গল্প।

১৯৬৩ সালের ছবিতে শাহবাগে রেডিও পাকিস্তান, ঢাকা কেন্দ্র। আলোকচিত্র: বাংলাদেশ ওল্ড ফটো আর্কাইভ।

দুই.

‘‘ পতৌদি ফিল্ড সাজিয়েছেন বেশ আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে— তিনটে স্লিপ, একটা গালী, শর্ট লেগে একজন, শর্ট থার্ডম্যান বেশ কিছুটা আগিয়ে। ময়দান প্রান্ত থেকে বল করবেন এরাপল্লী প্রসন্ন, প্যাভেলিয়ন প্রান্ত থেকে ব্যাট করবেন গ্যারি সোবার্স। অন্য প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছেন রোহান কানহাই। চলেছেন প্রসন্ন, দৌড় শুরু করেছেন ময়দান প্রান্ত থেকে। বল করলেন একটু ঝুলিয়ে। তেড়ে ব্যাট চালিয়েছিলেন সোবার্স। ব্যাটে-বলে হয় নি। বল লুফে নিলেন উইকেট রক্ষক ফারুক ইঞ্জিনিয়ার। ফিল্ডারদের হাত ঘুরে বল চলে গেল বোলার প্রসন্নর কাছে।’’

গলির রাস্তার ওপারে বাচ্চুদের বাড়ির দোতলায় বিরাট রেডিওতে ক্রিকেটের ধারাভাষ্য ভেসে আসছে আকাশবাণী কোলকাতা কেন্দ্র থেকে। ইডেন উদ্যান থেকে ধারাভাষ্য দিচ্ছেন কমল ভট্টাচার্য্য, অজয় বসু ও পুষ্পেন সরকার। পাঁচদিনের টেষ্ট ক্রিকেট চলছে কোলকাতায় ভারত আর ওয়েস্ট ইন্ডিজের মধ্যে। আর বাচ্চুদের বাড়ির দোতলার সেই ঢাউস রেডিও থেকে ভেসে আসা সেই ভাষ্য শুনছি আমাদের পাড়ার আর্ধেক পাড়া-পড়শী। মনে আছে, দু’জন পাকিস্তানি ভাষ্যকারের কথা— ওমর কোরায়েশী এবং জামশেদ মার্কার। এঁরা ধারাভাষ্য দিতেন ইংরেজিতে। জামশেদ মার্কারের সঙ্গে বহু পরে জাতিসংঘে দেখা হয়েছিল— তখন তিনি জাতিসংঘে পাকিস্তানের স্থায়ী প্রতিনিধি।

বাচ্চুদের রেডিও মানে এই নয় যে, পাড়ার আর কোনও ঘরে রেডিও নেই। আমাদের বাড়িতে রেডিও আছে, মাঠের ওপারে কাজল-কামালদের বাড়িতে আছে, আমাদের বাড়ির কোনাকুনি পান্নাদের ঘরেও রেডিও আছে। কিন্তু সে সব রেডিও আকারে ছোট— শব্দেও ম্রিয়মান— বাচ্চুদের সেই বিরাট রেডিওর অমন মেঘমন্দ্র স্বর আমাদের রেডিওগুলো পাবে কোথায়? অতএব, পাড়ায় অলিখিত নিয়মই আছে যে কোলকাতায় টেস্টম্যাচ হলে বাচ্চুরা পূর্ণাঙ্গ শব্দ-জোরে ওদের বিরাটাকায় রেডিওটা ছেড়ে দেবে আর পাড়ার অন্য সব ক’টি রেডিও বন্ধ করে দিতে হবে। উদ্দেশ্য একটাই— ইডেন উদ্যান থেকে ভেসে আসা ক্রিকেটের বাংলা ধারাভাষ্য আমরা সবাই  যাতে পাড়ার সর্বোৎকৃষ্ট রেডিও থেকে শুনতে পাই। বাচ্চুদের রেডিওটি ছিল আমাদের পাড়ার গর্ব। এমনই তার খ্যাতি যে ভিন পাড়ার ছেলেরাও ভিড় জমাতো আমাদের বাড়ির পাশের মাঠে।

অতি শৈশবে আমার দৃঢ় ধারণা ছিল যে, ঐ রেডিওর ভেতরে অতি ছোট ছোট মানুষ আছে, যাঁরা রেডিওর খোলের ভেতর থেকে কথা বলে। বহুবার রেডিওর বাক্সের পেছন থেকে উঁকিঝুঁকি দিয়েছি— কোনও লাভ হয়নি। তবে, এ ব্যাপারে কাজ একটি করেছিল বটে আমার পরম বন্ধু টুলু (শ্রীমতী শ্রাবণী এন্দ চৌধুরী)। রেডিওর ভেতরের লোকেরা বহুদিন স্নান করে না, এটা ভেবে, তিনি ছোটবোলায় রেডিওর ভেতরে জল ঢেলে দিয়েছিলেন।

সত্যি কথা বলি, আমরা কিন্তু মনে মনে বাচ্চুদের ঈর্ষা করতাম ওদের ঐ অমূল্য রতনটির জন্যে। আমাদের রেডিওটি ছিল তুলনামূলকভাবে ছোট—ফিলিপস্ এর। তার মূল খোলটা বাদামী প্লাস্টিকের, সামনেরটিও সাদা ঢেউ খেলানো প্লাস্টিকের। বাচ্চুদের রেডিওটি ছিল মারফি। তার সামনেরটি ছিল বেশ সিল্কের কাপড়ের আচ্ছাদন। কিন্তু আকৃতি আর শব্দ ভিন্ন ওদের রেডিওর যে জিনিসটি আমাকে আকর্ষণ করতো, তা হচ্ছে সামনের আচ্ছাদনের ডানে কোনার দিকে একটি সবুজ বাতি জ্বলত। একটি— ঐ একটি কারণেই আমার প্রবল টান ছিল মারফি রেডিওর প্রতি। ফিলিপস্ই হোক, আর মারফিই হোক, সে কালের এই সব রেডিওরই পাঁচটি জিনিস ছিল অভিন্ন।

এক, রেডিও গুলোতে দু’টো তরঙ্গের অনুষ্ঠানই কেবল শোনা যেত—মধ্য তরঙ্গ ও হ্রস্ব তরঙ্গ। রেডিওর সামনের দিকে নিচে একটি কাচবদ্ধ জানালায় ঐ দু’টো তরঙ্গেরই বিভিন্ন বেতার কেন্দ্রের ব্যান্ড নম্বর দেয়া থাকতো। তার ঠিক নিচেই ছোট্ট একটি বাতি থাকতো, যেটা রেডিও খুললেই জ্বলে উঠতো। ঐ বাতিটি কাচবদ্ধ জানালাটিকে আলোকিত করতে এবং ব্যান্ড নম্বরগুলো পড়তে সাহায্য করতো।

দুই, ঐ কাচবদ্ধ জানালার ঠিক পেছনে সরু একটি রক্তিমাভ দণ্ড সরিয়ে সরিয়ে কাঙ্খিত বেতার স্টেশনটি ধরা যেত। দু’টো বেতার কেন্দ্রের মাঝখানে দণ্ডটি পড়লে ভয়ঙ্কর এক ঘরঘর আওয়াজ উঠতো। উপরোক্ত রক্তিম দণ্ডটি সরানো হতো তার সঙ্গে সম্পৃক্ত একটি সুতোর সাহায্যে, যাকে নিয়ন্ত্রণ করতো একটি বর্তুল, বেশিরভাগ রেডিওতেই ওটা থাকত ডানদিকে। বাঁদিকে থাকতো শব্দ-জোর বাড়ানো কমানোর বর্তুল। এটা দিয়ে রেডিও ছাড়া ও বন্ধ করা হোত। এ ছাড়াও বর্তুল বা অন্য ব্যবস্থায় বদলানো যেত মধ্য ও হ্রস্ব তরঙ্গ।

১৯৫০-এর দশকের একটি মারফি রেডিও।

তিন, সম্ভবতঃ সে সময়কার রেডিওর সবচেয়ে রহস্যময় দিক ছিল তার পেছনের অংশটি। পিচবোর্ডের ঢাকনায় বরফির মতো কাটা ফুটো দিয়ে দেখ যেত রেডিওর ভেতরটা। ভেতরে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অংশ ছিল কতগুলো স্বচ্ছ কাচের ছোট  বিজলিবাতির মতো ট্রান্সফর্মার— নানান আকারের। এগুলোর ভেতরে সম্ভবতঃ টাঙ্গস্টেন তার দেওয়া থাকত। রেডিও খুললেই ওই তারগুলো ধীরে ধীরে লাল হয়ে উঠতো। ওর যে কোনও একটি নষ্ট হলে বি.এম. কলেজের আরজ আলী ভাইয়ের দ্বারস্থ হওয়া ছাড়া গতি ছিল না।

চার, সে সময়কার রেডিওর অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল একটি বস্তু, যার নাম ছিল এ্যরিয়াল। বিষযটি আর কিছুই নয়। যাদের বাসায় রেডিও থাকত, তাদের বাড়ির ছাদে বা চালে মোটামুটি দশ-পনের ফিট ফারাকে স্থাপিত দু’টো বংশদণ্ডের মাথায়  আড়াআড়িভাবে একটা তার বাঁধা হোত। তারপর রেডিও থেকে নির্দ্দিষ্ট তারটি নিয়ে জানালা গলিয়ে ঐ বংশদণ্ডদ্বয়ের তারটির মাঝামাঝি জায়গায় আটকে দেওয়া হোত। রেডিওর শব্দ যাতে পরিস্কার হয়, তার জন্যে এই ব্যবস্থা। কাঙ্ক্ষিত রেডিও অনুষ্ঠানের আগে এই এ্যারিয়াল ঠিকঠাক করার জন্য সে যে কি এক হাঁচড়-পাঁচড়।

পাঁচ, সে সময়কার এ সব রেডিওই চলত বিদ্যুতে। অবশ্য আরো ছোট শহর বা গ্রামে এ জাতীয় রেডিও চলত ঢাউস এক ব্যাটারিতে। কালো রঙ্গের খুব সম্ভবত: Exide ব্যাটারি ছিল সেগুলো— মূলতঃ বাসে ব্যবহারের জন্য। পরিশোধিত জল খাওয়ানো হতো সে ব্যাটারিকে। ব্যাটারির ওপর দিকে  ধনাত্মক ও ঋণাত্মক বিদ্যুতের দুটো নীচু দণ্ডের সঙ্গে তারের সাহায্যে রেডিওতে বিদ্যুতপ্রবাহ নিশ্চিত করা হতো।

১৯৫০-এর দশকের একটি ফিলিপস রেডিও।

অতি শৈশবে আমার দৃঢ় ধারণা ছিল যে, ঐ রেডিওর ভেতরে অতি ছোট ছোট মানুষ আছে, যাঁরা রেডিওর খোলের ভেতর থেকে কথা বলে। বহুবার রেডিওর বাক্সের পেছন থেকে উঁকিঝুঁকি দিয়েছি— কোনও লাভ হয়নি। তবে, এ ব্যাপারে কাজ একটি করেছিল বটে আমার পরম বন্ধু টুলু (শ্রীমতী শ্রাবণী এন্দ চৌধুরী)। রেডিওর ভেতরের লোকেরা বহুদিন স্নান করে না, এটা ভেবে, তিনি ছোটবোলায় রেডিওর ভেতরে জল ঢেলে দিয়েছিলেন। বলা বাহুল্য, রেডিও নষ্ট হয়েছিল এবং টুলুর কপালে কি জুটেছিল, এখন সে সম্পর্কে উচ্চবাচ্য না করাই ভালো।

শেষের কথা বলি। যে বাচ্চুদের রেডিওর কথা বলছিলাম, সে বাচ্চু হলো আমার প্রয়াত বন্ধু বরেণ্য শিল্পী হাসি চক্রবর্তী— চট্টগ্রাম চারুকলা ইনস্টিটিউটের এক সময়কার অধ্যক্ষ। আজ থেকে প্রায় ৫০ বছর আগে বরিশাল ছাড়ার পরে বাচ্চুর সঙ্গে আর আমার দেখা হয় নি। কিন্তু এখনও যখন কোথাও ক্রিকেট খেলার কথা ওঠে, হৃদয়ের কোনও এক গহীন কোণ থেকে ভেসে একটা জলদগম্ভীর স্বর, ‘‘বাচ্চু, খেলা শুরু হয়েছে। রেডিওটা ছেড়ে দে।’’ ‘‘‘যাই বাবা,’’ শুনতে পাই একটি কিশোরের কণ্ঠস্বর। প্রথমটি কণ্ঠটি নীহার কাকার— নীহাররঞ্জন চক্রবর্তীর আর দ্বিতীয়টি বাচ্চুর—হাসি চক্রবর্তীর।

লেখক: অর্থনীতিবিদ, অধ্যাপক ও লেখক। ভূতপূর্ব পরিচালক, মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তর এবং দারিদ্র্য দূরীকরণ বিভাগ, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র।

ad

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত