Beta
বৃহস্পতিবার, ৯ মে, ২০২৪
Beta
বৃহস্পতিবার, ৯ মে, ২০২৪

ডলার কেন এত শক্তিশালী, দাম কেন বাড়ে কমে

১৯৭৬ সালের অক্টোবরে ডলারের মান নির্ধারণের ক্ষেত্র সোনার যুক্ততার বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে আইন থেকে বাদ দেওয়া হয়।
১৯৭৬ সালের অক্টোবরে ডলারের মান নির্ধারণের ক্ষেত্র সোনার যুক্ততার বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে আইন থেকে বাদ দেওয়া হয়।

বাংলাদেশে টাকায় সবই কেনা যায়, কিন্তু দেশের বাইরে গেলে? তখন আর টাকা চলে না। অথচ প্রতিটি দেশেই চলে যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রা ডলার। এর কারণ, মার্কিন ডলার প্রধান বৈশ্বিক মুদ্রা। বিশ্বের যেখানেই যাওয়া হোক, বিনিময় বা ব্যবহারের ক্ষেত্রে ডলার গ্রহণ করা হয়।

যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও এর পাঁচটি অঞ্চল ও ১১টি দেশের সরকারি বা আনুষ্ঠানিক মুদ্রা মার্কিন ডলার। অন্য কোনও মুদ্রার এমন আনুষ্ঠানিক ব্যবহার নেই।   

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হালনাগাদ তথ্য মতে, এখন ১০৫ ট্রিলিয়ন ডলারের বিশ্ব অর্থনীতির মধ্য শীর্ষে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, আকার প্রায় ২৮ ট্রিলিয়ন ডলার। এক্ষেত্রে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে প্রবল হলেও আকারে এখনও অনেক পিছিয়ে, অর্থনীতি সাড়ে ১৮ ট্রিলিয়ন ডলারের।

বিশ্বে যত লেনদেন হয়, তার ৮০ ভাগেরও বেশি হয় মার্কিন ডলারের মাধ্যমে। ব্যাপক ব্যবহারের কারণে ডলারের চাহিদা বেশি থাকে, যা এর মূল্য বাড়ায়।

১৯৬০ সাল থেকে টানা শীর্ষ অর্থনীতি যুক্তরাষ্ট্র, যার মুদ্রা ডলারের ব্যবহারও বিশ্বে সবচেয়ে বেশি। এ কারণেই বেশিরভাগ দেশই আন্তর্জাতিক পরিসরে পণ্য কেনা-বেচার জন্য এই মুদ্রা ব্যবহার করতে বাধ্য হয়।

বাংলাদেশ যত পণ্য আমদানি করে, তার প্রায় সবই কিনতে হয় ডলারের মাধ্যমে। আর যা কিছু রপ্তানি করা হয়, তার মূল্যও দেওয়া হয় ডলারে।

যেকোনো দেশের অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ সূচক হচ্ছে বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ। যে দেশের রিজার্ভ পরিস্থিতি ভালো, সে দেশের অর্থনীতির স্বাস্থ্যও ভালো বলে গণ্য হয়। ফলে শক্তিশালী মুদ্রাকেই রিজার্ভ করা হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে মার্কিন ডলার, ইউরো, চীনের ইউয়ান, জাপানের ইয়েন ও ব্রিটিশ পাউন্ড রিজার্ভ করা হয়ে থাকে। 

তবে বিশ্বের ৬৫টিরও বেশি দেশ অর্থনৈতিক কার্যক্রম পরিচালিত করতে তাদের মুদ্রাকে মার্কিন ডলারের সঙ্গে রূপান্তরযোগ্য হিসেবে যুক্ত (পেগড) করেছে।

বাংলাদেশও ডলারই রিজার্ভ করে আসছে। আর রিজার্ভের প্রধান দুই উৎস প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স ও রপ্তানি আয়, তা ডালারে পাওয়া যায়।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বিশ্ব বাণিজ্যে কত দিন আধিপত্য ধরে রেখেছে মার্কিন ডলার? কেন ডলারের এত প্রভাব? এর কি বিকল্প নেই?

কেনইবা ডলারের দাম বাড়ে-কমে? আর এতে কেন টালমাটাল হয় বিশ্ব অর্থনীতি? 

আসুন এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজি।

ডলারের ইতিহাস

যুক্তরাষ্ট্রে কাগজের মুদ্রা প্রথম ব্যবহারের নথি মিলেছে ১৬৯০ সালের। ওই সময় ম্যাসাচুসেটস বে কলোনি তাদের ঔপনিবেশিক নোট জারি করে। এই নোটগুলো সামরিক অভিযানের জন্য অর্থায়ন করতে ব্যবহৃত হতো। ১৭৭৬ সাল পর্যন্ত প্রথম ২ ডলারের বিল আসেনি। এর ৯ বছর পর ১৭৮৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র সরকারিভাবে ডলার চিহ্ন- $ ব্যবহার শুরু করে। স্প্যানিশ-আমেরিকান পেসোর প্রতীকের ধারণা থেকে এটি গ্রহণ করা হয়। ১৭৯২ সালের কয়েনেজ অ্যাক্ট করে মার্কিন ডলারকে স্প্যানিশ সিলভার ডলারের সঙ্গে সমান বলে প্রচলন শুরু হয়। তখন থেকে মার্কিন ডলার ১০০ সেন্টে বিভাজিত বলে হিসাবে নেওয়া শুরু হয়।

১৮৬৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র অফিস অব দ্য কম্পট্রোলার অব দ্য কারেন্সি (ওসিসি) এবং ন্যাশনাল কারেন্সি ব্যুরো প্রতিষ্ঠা করে। এই দুটি সংস্থা নতুন কাগজের মুদ্রা পরিচালনা করত। কেন্দ্রীয়ভাবে মুদ্রণ শুরু হয় ১৮৬৯ সালে ব্যুরো অব এনগ্রেভিং অ্যান্ড প্রিন্টিংয়ে। এর আগে ব্যক্তিমালিকানাধীন কোম্পানিগুলো অর্থ মুদ্রণ করতো।

ফেডারেল রিজার্ভ প্রতিষ্ঠার এক দশকেরও বেশি আগে, ১৮৯০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি দেশটির বৈধ মুদ্রা ছাড়তে শুরু করে।

স্বর্ণমানে মুদ্রাব্যবস্থা

গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড বা স্বর্ণমানে মুদ্রাব্যবস্থা হলো এমন এক ধরনের ব্যবস্থা যেখানে কোনও দেশের মুদ্রা বা কাগজের নোটের মূল্য সরাসরি স্বর্ণ মজুতের সঙ্গে সম্পর্কিত। এ মুদ্রাব্যবস্থায় দেশগুলো কাগুজে মুদ্রা একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ স্বর্ণে রূপান্তর বা বিনিময় করতে সম্মত হতো। 

১৯১৩ সালের ২৩ ডিসেম্বর প্রতিষ্ঠিত হয় যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ। এর আগে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ছাড়া কাগজের নোটগুলোর অনির্ভরযোগ্যতা ও অস্থিতিশীলতা মুদ্রাব্যবস্থায় সমস্যা সৃষ্টি করছিল, তার সমাধানেই আইন করে ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়। যদিও বিশ্ব বাণিজ্য তখনও যুক্তরাজ্যের নিয়ন্ত্রণে ছিল এবং লেনদেন নিষ্পত্তি হতো ব্রিটিশ পাউন্ডে; তবুও সে সময় যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি যুক্তরাজ্যকে ছাড়িয়ে যায়।

সে সময় অধিকাংশ উন্নত দেশ মুদ্রা বিনিময়ে স্থিতিশীলতা আনতে তাদের মুদ্রাকে স্বর্ণমানে বিনিময় ব্যবস্থা গ্রহণ করে। এরপর ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে অনেক দেশ যুদ্ধের খরচ মেটাতে স্বর্ণভিত্তিক ব্যবস্থা ছেড়ে কাগুজে মুদ্রা ব্যবহার শুরু করে। ফলে দেশগুলোর মুদ্রার দরপতন ঘটে। যদিও বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় মুদ্রা হিসেবে নিজেদের অবস্থান ধরে রাখতে ব্রিটেন স্বর্ণমানে মুদ্রাব্যবস্থা আঁকড়ে থাকে; তবে যুদ্ধের তৃতীয় বছর তারা প্রথমবারের মতো অর্থ ধার নিতে বাধ্য হয়। তখন অনেক দেশের জন্য ঋণদাতা হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র হয়ে ওঠে প্রথম পছন্দ। দেশগুলো ডলারে বিক্রি হওয়া মার্কিন বন্ড কিনতে শুরু করে। ১৯৩১ সালে ব্রিটেন স্বর্ণমানে বিনিময় ব্যবস্থা ছেড়ে দেয়, এতে পাউন্ডে লেনদেন করা আন্তর্জাতিক ব্যবসায়ীদের ব্যাংক হিসাবগুলো নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। এর ফলেই পাউন্ডের পরিবর্তে ডলার বিশ্বের শীর্ষ রিজার্ভ মুদ্রায় পরিণত হয়।

মার্কিন ডলার ও সোনা

মার্কিন ডলার ও সোনার মধ্যে সম্পর্ক এবং এটির শেষ পর্যন্ত বিচ্ছেদ হওয়ার একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া ছিল। ১৯৩৩ সালে যখন মার্কিন সরকার মুদ্রাকে সোনায় রূপান্তরের সুযোগ বন্ধ করে দেয়, তখন প্রতি ট্রয় আউন্স সোনার বিপরীতে ২০.৬৭ ডলার দিতে হতো। ১৯৩৪ সালের জানুয়ারিতে তা দাম বাড়িয়ে ৩৫ ডলার করা হয়। ডলারের মূল্য কমিয়ে দেওয়া হয় সোনা মজুতের সঙ্গে তুলনা করে এবং কেবল আন্তর্জাতিক লেনদেনের ক্ষেত্রেই এটি করার অনুমতি দেওয়া হয়। ১৯৬০-এর দশকে এই আংশিকভাবে সোনাভিত্তিক মুদ্রাব্যবস্থা বজায় রাখা কঠিন হয়ে পড়ে।

১৯৬৮ সালে ফেডারেল রিজার্ভের নোটগুলোর বিপরীতে সোনার মজুত রাখার প্রয়োজনীয়তা বিলুপ্ত হয়। 

১৯৭১ সালে যুক্তরাষ্ট্র ঘোষণা করে সোনার সঙ্গে বিনিময়ের হারে ডলার মুক্তভাবে রূপান্তর করা যাবে না।

১৯৭২ ও ১৯৭৩ সালে সোনার বিপরীতে ডলারের মূল্য একদম পড়ে যায়।

১৯৭৬ সালের অক্টোবরে ডলারের মান নির্ধারণের ক্ষেত্র সোনার যুক্ততার বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে আইন থেকে বাদ দেওয়া হয়।

ব্রেটন উডস চুক্তি

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর আগে, যুক্তরাষ্ট্র ছিল মিত্রদের অস্ত্র ও অন্যান্য পণ্য সরবরাহকারী। অধিকাংশ দেশ সোনায় মূল্য পরিশোধ করত, যার ফলে যুদ্ধ শেষে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের সবচেয়ে বেশি সোনার মালিক হয়ে ওঠে। যুদ্ধের সময় বিভিন্ন দেশ তাদের সোনার মজুত শেষ করে ফেলায় আবারও সোনার মানে মুদ্রাব্যবস্থায় ফিরে যাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে।

১৯৪৪ সালে বিশ্বের ৪৪টি মিত্র দেশের প্রতিনিধি যুক্তরাষ্ট্রের নিউ হাম্পশায়ারের ব্রেটন উডসে মিলিত হয়ে এমন একটি বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি গড়ে তোলার জন্য আলোচনা করে, যা কোনও দেশের জন্যই ক্ষতিকর হবে না। দেশগুলো সিদ্ধান্ত নেয় বিশ্বের মুদ্রাগুলো আর সোনার মানে বিনিময় হবে না, বরং মার্কিন ডলারের সঙ্গে রূপান্তরযোগ্য বলে গণ্য হবে। ‘ব্রেটন উডস চুক্তি’ নামে পরিচিত এই চুক্তিটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর ক্ষমতাকে প্রতিষ্ঠিত করে, তা দেশগুলোর মুদ্রা ও ডলারের মধ্যে স্থির বিনিময় হার বজায় রাখার কথা বলে। শর্ত দেওয়া হয, চাহিদা অনুযায়ী সোনার বিনিময়ে ডলার দেবে যুক্তরাষ্ট্র। তবে যেসব পরিস্থিতিতে কোনও দেশের মুদ্রার মূল্য ডলারের তুলনায় খুব বেশি দুর্বল বা খুব বেশি শক্তিশালী হয়ে যায়, সেসব ক্ষেত্রে যেন দেশগুলোর তাদের মুদ্রার নিয়ন্ত্রণ থাকে। অর্থের জোগান নিয়ন্ত্রণ করতে তারা তাদের মুদ্রা কিনতে বা বিক্রি করতে পারবে।

বিশ্বের রিজার্ভ মুদ্রা

ব্রেটন উডস চুক্তির ফলে বিশ্বের বৃহত্তম স্বর্ণের মজুতদার দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের ডলারকে বিশ্বের রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। অন্য দেশগুলো স্বর্ণের রিজার্ভের বদলে মার্কিন ডলারের রিজার্ভ জমা করতে শুরু করে। তখন দেশগুলো মার্কিন ট্রেজারি সিকিউরিটিজ কিনতে শুরু করে, যা তারা নিরাপদে অর্থ রাখার জায়গা হিসেবে বিবেচনা করে।

ট্রেজারি সিকিউরিটিজের চাহিদা, ভিয়েতনাম যুদ্ধ এবং ‘গ্রেট সোসাইটি ডমেস্টিক প্রোগ্রাম’ এর জন্য অর্থায়ন করতে বাজারে ব্যাপক পরিমাণ কাগুজে ডলার ছাড়ে যুক্তরাষ্ট্র। তখন মুদ্রা বাজারের স্থিতিশীলতা নিয়ে উদ্বেগ বাড়তে থাকলে দেশগুলো ডলারের রিজার্ভ স্বর্ণে রূপান্তরিত করে। সোনার চাহিদা এতটাই বেড়ে যায় যে, প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন সরাসরি হস্তক্ষেপ করতে বাধ্য করা হয় এবং ডলারকে স্বর্ণ থেকে আলাদা করতে হয়, যা ফলে ফ্লোটিং এক্সচেঞ্জ রেটের সৃষ্টি হয়।

ফ্লোটিং এক্সচেঞ্জ রেট হলো একটি এক্সচেঞ্জ রেট সিস্টেম যেখানে কোনও দেশের মুদ্রার দাম বিদেশি মুদ্রার বাজার দ্বারা নির্ধারিত হয়, যা নির্ভর করে অন্যান্য মুদ্রার আপেক্ষিক সরবরাহ ও চাহিদার উপর।

আইএমএফের ২০২২ সালের হিসাব বলছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো তাদের রিজার্ভের প্রায় ৫৯ শতাংশ মার্কিন ডলারে রাখে। রিজার্ভের অনেকই নগদ অর্থে বা মার্কিন বন্ড, যেমন মার্কিন ট্রেজারি আকারে থাকে।

আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, একটি দেশের কাছে অন্তত তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সমপরিমাণ বিদেশি মুদ্রা মজুত থাকতে হয়।

এই মানদণ্ডই বলছে, বাংলাদেশের রিজার্ভ পরিস্থিতি মোটেই ভালো অবস্থায় নেই, অর্থনীতিও সংকটের মধ্যে রয়েছে।

গত ২৮ মার্চ আইএমএফের হিসাব পদ্ধতি বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ ছিল ১৯ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘গ্রস’ হিসাবে রিজার্ভ নেমেছে ২৪ দশমিক ৮১ বিলিয়ন ডলারে।

রিজার্ভ ধরে রাখতে ডলার সঞ্চয়ে আমদানি ব্যয় কমানো, রপ্তানি আয় ও রেমিটেন্স বাড়ানো, আর্থিক খাতের ঋণপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণসহ নানা উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপরও হিমশিম খেতে হচ্ছে।

পেট্রোডলারে ক্ষমতায়ন

বিশ্ব বাণিজ্যে যুক্তরাষ্ট্রের দাপটের আরেক গুরুত্বপূর্ণ একটি উৎস হচ্ছে পেট্রোডলার ব্যবস্থা। পেট্রোডলার হলো পেট্রোলিয়াম ডলারের সংক্ষিপ্ত রূপ।

জ্বালানি তেল, গ্যাস থেকে শুরু করে অসংখ্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের কাঁচামাল হচ্ছে পেট্রোলিয়াম বা খনিজ তেল, যা ভূ-গর্ভ থেকে উত্তোলন করা হয়।

সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময় তেলের আকাশচুম্বী দামের কারণে তখন তেল রপ্তানিকারক দেশগুলোর জন্য বিরাট বাণিজ্য ও চলতি হিসাবের (কারেন্ট অ্যাকাউন্ট) উদ্বৃত্ত তৈরি হয়েছিল।

যুগান্তকারী পেট্রোডলার চুক্তির পর ১৯৭৪ সালের ১৫ জুন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন সৌদি আরবের জেদ্দায় সৌদি বাদশাহ ফয়সাল বিন আব্দুল-আজিজ আল সৌদের সঙ্গে দেখা করেন।

এখনকার মতো তখনও মার্কিন ডলার ছিল সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত মুদ্রা। বৃহত্তম অর্থনীতি যুক্তরাষ্ট্রের পণ্য আমদানিকারক দেশ হিসেবেও ছিল প্রভাব; আর গভীর, সঞ্চালনশীল পুঁজি বাজারের পাশাপাশি আইনের শাসন ও সামরিক শক্তির জন্য ছিল দাপট।

এদিকে সোনার মানদণ্ডে মুদ্রাব্যবস্থা উঠে যাওয়ায় ডলারের দাম ও চাহিদা বজায় রাখতে সেনার বিকল্প খোঁজা হচ্ছিল। তখন খনিজ তেলকে সামনে আনা হয়, যা ‘কালো সোনা’ নামে আবির্ভূত হয়।

১৯৭৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন সৌদি আরবকে তাদের সব পেট্রোলিয়াম পণ্য, অর্থাৎ শোধিত তেল, খনিজ তেল ও গ্যাস একমাত্র মার্কিন ডলারে বিক্রি করার প্রস্তাব দেন। এর বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী সৌদি আরবকে পূর্ণ সামরিক নিরাপত্তা দেবে এবং শিক্ষা ও প্রযুক্তিগত সহায়তা করবে।

চুক্তিতে স্বাক্ষর না করা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধিতার শামিল।

সেই সময় প্রথমে সৌদি আরব এবং পরে অন্যান্য তেলসমৃদ্ধ উপসাগরীয় দেশ চুক্তিটি স্বাক্ষর করে। এর মধ্যে দিয়ে পেট্রোডলারের যাত্রা শুরু হয়।

তেলসমৃদ্ধ দেশগুলো একমাত্র মার্কিন ডলারে তেল বিক্রি করায় জ্বালানি আমদানিকারক সব রাষ্ট্রকেই ডলার আয় করতে হয়। এতে আন্তর্জাতিক বাজারে ডলারের ক্রমাগত চাহিদা বিদ্যমান থাকবে। আর এই চুক্তির ফলে তেলসমৃদ্ধ দেশগুলো ডলারের ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের জ্বালানি সরবরাহও নিরাপদ হয়।

তেলের দাম কেবল মার্কিন ডলারে বিক্রির বড় সমস্যা হচ্ছে, তেলের দাম যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রানীতির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। ডলার শক্তিশালী হয়ে উঠলে তেল আমদানিকারক দেশগুলোকে বেশি মূল্য পরিশোধ করতে হয়, আর লাভবান হয় রপ্তানিকারক দেশগুলো। আর যখন ডলার দুর্বল হয়, তখন আমদানিকারক দেশগুলো লাভবান হয়, ক্ষতিগ্রস্ত হয় রপ্তানিকারক দেশগুলো। এ কারণে তেল ও গ্যাস আমদানিনির্ভর দেশগুলো অর্থনৈতিক ঝুঁকি এড়াতে সব সময় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের মুদ্রানীতি সামঞ্জস্য রেখে চলে।

২০২০ সালে বিশ্বব্যাপী অপরিশোধিত তেল রপ্তানি গড়ে প্রতিদিন প্রায় ৮৮.৪ মিলিয়ন ব্যারেল ছিল। প্রতি ব্যারেলের গড় দাম ১০০ ডলার ধরলে এই হারে ওই বছর বিশ্বে পেট্রোডলার সরবরাহ হয় ৩.২ ট্রিলিয়নেরও বেশি।

পেট্রোলিয়াম রপ্তানিকারক দেশগুলোর সংস্থা- ওপেকের সদস্য ছাড়াও এর বাইরের তেল-গ্যাস রপ্তানিকারক দেশ রাশিয়া, কাতার ও নরওয়ের আয়ের প্রধান উৎস পেট্রোডলার।

পেট্রোডলারের যাত্রার কারণে তেলসমৃদ্ধ দেশগুলোর অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।

পেট্রোডলার-বলয় ভাঙার প্রচেষ্টা ছিল ইরাকের সাদ্দাম হোসেনের। তিনি তেল রপ্তানিতে স্বর্ণভিত্তিক মুদ্রাব্যবস্থা চালু করতে চেয়েছিলেন। ২০০৩ সালে মার্কিন নেতৃত্বাধীন বাহিনীর আগ্রাসনে সাদ্দাম ক্ষমতাচ্যুত হন।

ডলারের আঁটুনি থেকে কিছুটা ছুটতে চেষ্টা দেখা গেছে সৌদি আরবেরও। দেশটি ইউয়ানেও তেল বিক্রি করছে, তবে তা কেবল চীনের কাছেই।

বিশ্ব বাণিজ্যে ডলারের আধিপত্য

সুইস সংস্থা ব্যাংক অব ইন্টারন্যাশাল সেটেলমেন্টের (বিআইএস) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালেও বিশ্বের মুদ্রা বাজারে মার্কিন ডলার আধিপত্য ধরে রেখেছিল।

গত বছর ৮৮ শাতাংশ বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনে মার্কিন ডলার ব্যবহার হয়। এছাড়া স্পট, ফরওয়ার্ড ও সোয়াপ মার্কেটে লেনদেনের ৮৫ শতাংশই ছিল মার্কিন ডলার।

২০ বছর আগে অনেকেই আশা করেছিল মার্কিন ডলার ইউরোর কাছে বাজারের বড় অংশ হারাবে, কিন্তু তা হয়নি।

২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর প্রকাশিত বিআইএসের ত্রি-বার্ষিক জরিপ বলছে, বিশ্বব্যাপী মুদ্রা বাজারের লেনদেনে ডলার স্থিতাবস্থা ধরে রেখেছে। অন্যদিকে ইউরোর পতন হয়েছে।

বিশ্ব মুদ্রা বাজারে ২০০১ সালে ইউরোর মার্কেট শেয়ার ছিল ৩৮ শতাংশ, তা থেকে কমে ২০২২ সালে দাঁড়িয়েছে ৩১ শতাংশ।

এদিকে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দ্রুত উত্থানের পরও চীনের ইউয়ান বিশ্ববাজরের মাত্র ৭ শতাংশ দখলে নিতে পেরেছে।

আন্তর্জাতিক ব্যাংকিংয়েও মার্কিন ডলার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মুদ্রা। গত দুই দশকে ব্যাংকিং ব্যবস্থার বিদেশি মুদ্রার সম্পদ ও দায়ের পরিমাণ অনেক বেড়েছে, যা মধ্যে মার্কিন ডলার উল্লেখযোগ্যভাবে প্রায় ৬০ শতাংশ অংশ ধরে রেখেছে। ঋণ সিকিউরিটি ইস্যু ও বাণিজ্যিক চালানেও ডলারের আধিপত্য রয়েছে, যদিও এক্ষেত্রে বিভিন্ন অঞ্চলে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য রয়েছে।

ডলার কেন গুরুত্বপূর্ণ

যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির আকার স্পষ্টতই এর মুদ্রার প্রভাবের একটি বড় কারণ। তবে এটি অবশ্যই একমাত্র কারণ নয়। যুক্তরাষ্ট্রের অবদান বিশ্ব জিডিপিতে মাত্র ২০ শতাংশের কিছু বেশি এবং বিশ্ব বাণিজ্যে তা মাত্র ১০ শতাংশের বেশি।

যদি আকারই প্রভাবের ক্ষেত্রে প্রধান নির্ধারক হতো, তাহলে ইউরো ও ইউয়ান মার্কিন ডলারের সমান বা এমনকি এগিয়ে থাকত।

মার্কিন অর্থনীতির গুরুত্ব ছাড়াও দেশটির বাজারের গভীরতা ও সহজলভ্যতা ডলারের গুরুত্বকে প্রভাবিত করেছে। এখানে আরও একটি বড় বিষয় কাজ করে সেটি হলো বিভিন্ন দেশের ‘নির্ভরশীলতা’। অতীতের বিভিন্ন সিদ্ধান্তের উপর বর্তমানের প্রভাবও একটি বড় বিষয়।

রিজার্ভ ও ব্যাংকিং কার্যক্রম- দুই ক্ষেত্রেই স্বল্প ও মধ্য মেয়াদে ডলারের কোনও বিকল্প নেই। বিভিন্ন দেশের রিজার্ভ ব্যবস্থাপকরা মূলত নিরাপত্তা, তারল্য ও লাভ- এর প্রত্যাবর্তনই চায়। এক্ষেত্রে মার্কিন ট্রেজারিকে কমপক্ষে প্রথম দুটি মানদণ্ডে হারানো প্রায় অসম্ভব। ফলে বিভিন্ন সূচকের উত্থান-পতনের পরও যুক্তরাষ্ট্রে বিনিয়োগ এখনও সবচেয়ে নিরাপদ বলে বিবেচিত হয়ে থাকে।

যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি এখনও বিশ্বের সবচেয়ে নগদীকরণযোগ্য সুদসংক্রান্ত সম্পদ। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে দেশটির ট্রেজারি মার্কেটে তারল্যপ্রবাহ কমেছে, তবে বেশিরভাগ মার্কেটের দশাও তাই। এরপরও আন্তর্জাতিক রিজার্ভের প্রায় ৬০ শতাংশ এখনও মার্কিন ডলারের দখলে, যা অবাক হওয়ার কিছু নয়।

আরও গভীরভাবে বললে, ডলার মার্কেটের গভীরতা এমন কয়েকটি কারণের একত্র হওয়ার ফল, যা অন্য কোথাও এমনটি পাওয়া কঠিন।

প্রথমত, ইস্যুর পরিমাণ। ইউরো এলাকার মোট ঋণও অনেক বেশি। তবে সেই তারল্য রয়েছে সীমিত পরিমাণে বিভাজিত অবস্থায়। তা যেকোনো সময়ে লেনদেন করা যেতে পারে এমন।

দ্বিতীয়ত, ডলার স্বাধীনভাবে রূপান্তরযোগ্য।

তৃতীয়ত, বৈচিত্রপূর্ণ বিনিয়োগকারীর ভিত্তি। 

চতুর্থত, সহায়ক ক্রীড়নক সমৃদ্ধ বাস্তুতন্ত্র, ঋণমাণ নির্ধারণকারী সংস্থা থেকে শুরু করে জিম্মাদার (কাস্টোডিয়ান) ও বাজার কাঠামো।

এবং সবশেষ যুক্তি হলো, যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃপক্ষ, বিশেষ করে ফেডারেল রিজার্ভ, তারা ট্রেজারি মার্কেট এবং অন্যান্য আর্থিক মার্কেটের সাবলীল কার্যকারিতা সম্পর্কে গভীরভাবে যত্নশীল বলে প্রমাণ করে আসছে। তারা এই মার্কেটগুলো উন্মুক্ত রাখতে যুগোপযোগী বিভিন্ন ব্যবস্থা নিয়েছে। ফলে নিউ ইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুল তাদের ট্রেজারি সিকিউরিটিজগুলো নগদে বিনিময় করতে পারে।

লেনদেন নিষ্পত্তিতে নেই বিকল্প ব্যবস্থা

আন্তর্জাতিক লেনদেনে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য বার্তা প্রেরণের মাধ্যম সোসাইটি ফর ওয়ার্ল্ডওয়াইড ইন্টারব্যাংক ফিন্যান্সিয়াল টেলিকমিউনিকেশন (সুইফট)।

সুইফটের মতো লেনদেন নিষ্পত্তির প্ল্যাটফর্ম গড়ে তুলতে রাশিয়া ফিন্যান্সিয়াল মেসেজিং সিস্টেম (এসপিএফএস) করেছে। এই প্ল্যাটফর্মে ৩৫টির মতো দেশ যুক্ত আছে।

একইভাবে বিশ্ব বাণিজ্যে চীনা মুদ্রা ইউয়ানের ব্যবহার বাড়াতে ক্রস-বর্ডার ইন্টারব্যাংক পেমেন্ট সিস্টেম (সিআইপিএস বা চিপস) চালু করেছে।

এর মানে, ডলারের বিকল্প মুদ্রায় লেনদেনে বড় অর্থনীতির দেশগুলোর চেষ্টা আছে।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর এই চেষ্টা আরও জোরাল হয়েছে।

রাশিয়ার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার কারণে বিকল্প ব্যবস্থায় লেনদেন নিষ্পত্তির চেষ্টার কোনও কমতি ছিল না।

এখন ভারত তাদের মুদ্রা রুপি ব্যবহার করার জন্য বাংলাদেশ, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ কয়েকটি দেশের সঙ্গে চুক্তি করেছে।

তবে ডলারের বিকল্প একটি মুদ্রাও সেভাবে বিস্তৃতি লাভ করতে পারেনি।

কারণ, ডলারের বাইরে অন্য মুদ্রার আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্যতা, বিনিময়যোগ্যতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা গড়ে ওঠেনি।

কেন বাড়ে কমে ডলারের দাম

যখন কোনও কিছুর চাহিদা বেশি থাকে, জোগান কমে তখন এর দাম বেশি হবে এটাই স্বাভাবিক।

আন্তর্জাতিক বাজারে ডলারের চাহিদা বেশি থাকায় ডলারের দামও বাড়ছে।

যেসব দেশের রপ্তানির চেয়ে আমদানির পরিমাণ বেশি, তারা রপ্তানি আয়ের চেয়ে আমদানি বাবদ বেশি খরচ করে। ডলারের দাম বেশি হলে সেসব দেশের আমদানি খরচ বাড়ে।

ডলারের দাম বেড়ে গেলে বেশি খরচে জ্বালানি তেল-গ্যাস আমদানি করতে হয়।

এতে শাকসবজি, ভোজ্য তেল ও খাদ্যশস্যসহ প্রয়োজনীয় পণ্যের পরিবহন খরচও বেড়ে যায়। ফলে অন্য পণ্য ও সেবার দামও বাড়ে। ক্রয়ক্ষমতা কমলে কমে ভোগব্যয়, কমে দেশের উৎপাদন।

জ্বালানির জন্য বাড়তি ডলার খরচ করতে হয় বলে অন্যান্য প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানির সক্ষমতা কমতে থাকে। এ কারণে আমদানিনির্ভর দেশগুলোয় বিদেশি পণ্য ব্যয়বহুল হয়।

উদ্ভূত পরিস্থিতি একটি দেশকে মূল্যস্ফীতির দিকে ঠেলে দেয়। বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ কমে যায়।

২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর বিশ্ব বাজারে পণ্য ও কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়ায় মার্কিন ডলারের বিপরীতে বিশ্বের অনেক দেশের মুদ্রার মতো দ্রুত টাকারও অবমূল্যায়ন ঘটতে থাকে। ফলে মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই প্রতি ডলারের দাম ৮৫ বা ৮৬ টাকা থেকে বেড়ে ১০০ টাকা ছাড়িয়ে যায়। গত ২১ মার্চ প্রতি ডলার ১১৮ টাকা ৪০ পয়সায় বিক্রি হয়েছে। মাস খানেক আগেও তা ১২৬ বা ১২৭ টাকায় বিক্রি হতো।

রাশিয়া বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অপরিশোধিত তেল রপ্তানিকারক দেশ। যুদ্ধের কারণে সরবরাহ বিঘ্নিত হওয়ায় তেলের দামও বেড়েছে।

যুদ্ধ ছাড়াও কিছু কারণ ডলারের বিপরীতে বিভিন্ন দেশের মুদ্রাকে দুর্বল করেছে।

কোভিড-১৯ মহামারীর কারণেও এটি হয়েছে। সেসময় লকডাউনের কারণে চীনসহ বড় অর্থনীতির দেশগুলোতে প্রভাব ফেলেছে। কলকারখানা বন্ধ থেকেছে। আমদানি-রপ্তানি ব্যহত হয়েছে। শ্রমবাজার, পর্যটনশিল্প, সেবাখাত মুখ থুবড়ে পড়েছে। এতে রপ্তানি ও আমদানির ক্ষেত্রে প্রভাব পড়ে।

তবে কোভিড-১৯ পরিস্থিতির তীব্রতা কমার পরপরই বিভিন্ন দেশে ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা শিথিল হয়, যে কারণে মানুষ বিদেশ ভ্রমণে বেশি যেতে শুরু করে। সেসময় বৈদেশিক মুদ্রা বিশেষ করে ডলারের চাহিদা বাড়তে শুরু করে, বাড়ে দামও।

এছাড়া বিদেশি বিনিয়োগকারীরা যখন স্টক ও বন্ড বাজার থেকে অর্থ তুলে নেন তখনো বিভিন্ন মুদ্রার দরপতন হয় এবং ডলারের দাম বেড়ে যায়।

তবে রিজার্ভ ভালো বা সন্তোষজনক থাকলে ডলারের বিনিময় হার খুব একটা উঠানামা করে না। কিন্তু রিজার্ভ কমলে ডলারের দাম বেড়ে যায়, কমে অন্য মু্দ্রার মান।

এখনও অধিকাংশ দেশই তাদের রিজার্ভে সোনা সংরক্ষণ করছে। সোনা রাখলে তার দাম উঠানামা করতে পারে। এটার বিনিয়োগেও প্রভাব ফেলতে পারে। এজন্য ডলারকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়।

যখন আমদানি ব্যয় বেড়ে যায় তখন বাজারে ডলারের চাহিদা বেড়ে যায়। অন্যদিকে যখন রপ্তানি আয় ও প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স কমে, বিদেশি ঋণ থেকে আসা অর্থ এবং সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ বা এফডিআইও কমে যায়, তখন বাজারে ডলারের চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে বড় ঘাটতি দেখা দেয়। স্বাভাবিকভাবেই তখন ডলারের দাম বেড়ে যায়।

ঠিক একইভাবে যখন আমদানি ব্যয় কমে আসে তখন বাজারে ডলারের চাহিদা কমে যায়। অন্যদিকে যখন রপ্তানি আয় ও প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স বাড়ে, বিদেশি ঋণ থেকে আসা অর্থ এবং সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ বা এফডিআইও বাড়ে, তখন বাজারে ডলারের চাহিদার চেয়ে সরবরাহ বেড়ে যায়। তখন আবার স্বাভাবিক গতিতেই ডলারের দাম কমে যায় বা পড়ে যায়।

যেভাবে ডলারের বিনিময়মূল্য নির্ধারণ

মুদ্রা বিনিময় একটি দেশের অর্থনৈতিক কার্যক্রমের খুবই গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বিনিময় মূল্য হলো অন্য মুদ্রার সঙ্গে তুলনা করে মুদ্রার মূল্যায়ন। কিছু মুদ্রার মূল্য স্বাধীন-চলমান (ফ্লোটিং)- এর মানে হলো বাজারে সরবরাহ ও চাহিদার উপর ভিত্তি করে তারা উঠানামা করে। অন্যদিকে কিছু মুদ্রা নির্ধারিত (ফিক্সড) থাকে- এর মানে হলো সেগুলো আরেকটি মুদ্রার সঙ্গে রূপান্তরযোগ্য হিসেবে যুক্ত থাকে।

মার্কিন ডলার ও অন্যান্য প্রধান মুদ্রাগুলো ফ্লোটিং মুদ্রা – ফরেক্স মার্কেটে মুদ্রা কীভাবে ব্যবসা করে তার উপর ভিত্তি করে এর মূল্য পরিবর্তিত হয়। এতে বাজার ও অর্থনীতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে ডলারের দাম ওঠানামা করে।

নির্ধারিত মুদ্রাগুলো অন্য মুদ্রার সঙ্গে স্থির বা রূপান্তরযোগ্য হিসেবে যুক্ত থাকার মাধ্যমে মূল্য নির্ধারিত হয়।

বিশ্বব্যাংকের তথ্যমতে, দীর্ঘ সময় ধরে মোট ১৩টি দেশের মুদ্রা নির্ধারিত দামে বিনিময় হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে সৌদি রিয়াল,কাতারের রিয়াল, সংযুক্ত আরব আমিরাতের দিরহাম, বাহরাইনের দিনার, কিউবার পেসো ও হংকংয়ের ডলার।

এসব পদ্ধতির বাইরে অর্থনীতিতে নিজ দেশের মুদ্রার অবমূল্যায়ন প্রকট আকার ধারণ করলে ক্রলিং পেগ পদ্ধতিতে বৈদেশিক মুদ্রার মান নির্ণয় করা হয়। এই পদ্ধতিতে ডলারের একটি সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ দাম ধরে দেওয়া হয়। এর ফলে ডলারের দাম একেবারে তলানিতে গিয়ে ঠেকে না বা আকাশচুম্বীও হতে পারে না। মূলত অস্থিতিশীল মুদ্রাবাজারে সমতা আনতে আপদকালীন পদ্ধতি হিসেবে এটিকে ব্যবহার করা হয়। ডলারের বিপরীতে সবচেয়ে দুর্বল মুদ্রা ইরানের রিয়াল। এক ডলার কিনতে খরচ হবে ৩ লাখ ৭২ হাজার রিয়াল। আর সবচেয়ে শক্তিশালী কুয়েতি দিনার। এক দিনারে পাওয়া যাবে ৩.২৬ মার্কিন ডলার।

ডলারে বিশ্ব অর্থনীতি টালমাটাল

বাংলাদেশে ডলারের বাজার বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গত দুই বছর ধরে বাজারে এক রকমের অস্থিরতা বিরাজ করছে।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর বিশ্ব বাজারে পণ্য ও কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়ায় মার্কিন ডলারের বিপরীতে দ্রুত টাকার অবমূল্যায়ন ঘটতে থাকে। ফলে মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই প্রতি ডলারের দাম ৮৫ থেকে ৮৬ টাকা থেকে বেড়ে ১০০ টাকা ছাড়িয়ে যায়। কার্ব মার্কেট বা খোলাবাজারে মাস খানেক আগেও যে ডলার ১২৬ থেকে ১২৭ টাকায় বিক্রি হতো, তা এখন ১১৮ টাকার কাছাকাছি বিক্রি হচ্ছে। আর কয়েক দিন আগে যেখানে ১২৪ টাকা পর্যন্ত দরে রেমিটেন্সের ডলার কিনছিল ব্যাংকগুলো, এখন তা ১১৪ টাকায় কিনছে। আমদানি বিল নিষ্পত্তিতে ডলারের দাম নেওয়া হচ্ছে ১১৮ থেকে ১১৯ টাকা, যা দুই সপ্তাহ আগেও ছিল ১২২ থেকে ১২৪ টাকা। 

বাংলাদেশের আমদানি ব্যয় কমায় এবং রপ্তানি আয় ও রেমিটেন্স বাড়ায় বাজারে ডলারের সরবরাহ বেড়েছে বলেই ডলারের দাম পড়ছে বলে মনে করা হচ্ছে।

২০২২ সালের আগস্টে যুক্তরাষ্ট্রে মূল্যস্ফীতি কমাতে সুদের হার বাড়ানোর ইঙ্গিত দেওয়ায় বিশ্ববাজারে ডলারের দাম গত ২০ বছরে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে যায়। তখন জাপানে প্রতি ডলার বিক্রি হয় ১৩৮ দশমিক ৮৮ ইয়েনে। চীনের বাইরে দেশটির মুদ্রার দরপতন হয়, ডলারপ্রতি কিনতে খরচ হয় ৬ দশমিক ৯৩ ইউয়ান, যা ছিল ২ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। ডলারের বিপরীতে ব্রিটিশ মুদ্রা পাউন্ড স্টার্লিংও ২ বছরে সর্বনিম্ন অবস্থানে নামে। এক ডলার কিনতে খরচ করতে হয় ১ দশমিক ১৬ পাউন্ড। ওই সময় ইউরোর দরপতন হয় শূন্য দশমিক ৪৯ শতাংশ।

ফরেক্স মার্কেটে মার্কিন ডলার সর্বোচ্চ ১৬৪.৭২ মূল্যে লেনদেন হয় ১৯৮৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। আর সর্বনিম্ন ৭০,৭০ মূল্যে বিনিময় হয় ২০০৮ সালে।

মার্কিন মুলুকে ১৯৩০–এর দশকে ‘দ্য গ্রেট ডিপ্রেশন’ নামের যে ভয়াবহ আর্থিক সংকট সৃষ্টি হয়, ভয়াবহতার দিক থেকে ২০০৮–এর বিশ্বব্যাপী এ সংকটের অবস্থান ঠিক তার পরেই। ফলে ২০০৮ সালে ডলারমূল্যে ধস নামে।

ডলার সূচক (ডিএক্সওয়াই) ইউরো, পাউন্ড ও ইয়েনসহ আরও ছয়টি প্রধান মুদ্রার গড়ের বিপরীতে মার্কিন ডলারের মূল্য পরিমাপ করে। এই সূচক ২০২২ সালে ১৫ শতাংশ বেড়েছে। গত ২৯ মার্চ ডলার আগের দিনের চেয়ে দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ কমে প্রধান বাস্কেট মুদ্রার বিপরীতে ১০৪.৪৮ মূল্যে লেনদেন হয়। তবে ১ এপ্রিল ডিএক্সওয়াই সূচকের ঊর্ধ্বগামী প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। গত এক বছরে এই সূচক বেড়েছে ২ দশমিক ২৯ শতাংশ।  

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ad

সর্বাধিক পঠিত