Beta
বৃহস্পতিবার, ৯ মে, ২০২৪
Beta
বৃহস্পতিবার, ৯ মে, ২০২৪

গণমাধ্যম এখন

ভাইরালে ভারাক্রান্ত মিডিয়া ও জনস্বার্থ সাংবাদিকতা

নূর সিদ্দিকী। প্রতিকৃতি অঙ্কন: সব্যসাচী মজুমদার

হলুদ বাটো-মেহেন্দি বাটো:

সামাজিক যোগাযোগ মাধ‌্যমে বিয়ের ধুম শেষ হতে না হতেই সংসার ভাঙার খবর পড়তে বা দেখতে হলো। আগে বিয়ের আলাপ শেষ করি পরে বিয়ে ভাঙার গল্প করা যাবে।

সামাজিক যোগাযাগ মাধ‌্যমে চলছিল বিয়ের ধুম। না, সামাজিক যোগাযোগ মাধ‌্যমে এসে বর বা কনে পরস্পরকে কবুল বলছিল না, বা সাতপাকে বাঁধা পড়ছিল না। তাহলে কিভাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ‌্যমে বিয়ের ধুম পড়েছিল?

আয়মান সাদিক এবং মুনজেরিন শহীদ বিয়ে করলেন। তাদের পরিচয় নতুন করে দেবার প্রয়োজন বোধ করছি না। তারপরও এই লেখার মাধ‌্যমে তাদের নামের সঙ্গে পরিচিত হলেন এমন দুয়েকজনও যদি থেকে থাকেন, তাদের জন‌্য বলছি— আয়মান সাদিক একজন উদ‌্যোক্তা, ‘টেন মিনিটস স্কুল’-এর প্রতিষ্ঠাতা তিনি। আর মুনজেরিন শহীদ ওই স্কুলের ইংরেজির শিক্ষক এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ‌্যমে তিনিও ইংরেজি শিক্ষার বিস্তারে কাজ করে যাচ্ছেন। আয়মান ও মুনজেরিন তরুণদের কাছে খুব পরিচিত নাম। শিশুদের অভিভাবকরাও তাদের ভালোই চেনেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ‌্যমের কল‌্যাণে তারা সেলিব্রেটিও বটে।

ফলে তাদের বিয়ের কার্ড থেকে শুরু করে মসজিদে গিয়ে আকদ্ সম্পন্ন করা, গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান এবং বিবাহোত্তর সংবর্ধণার কোনও পর্বই সামাজিক যোগাযোগ মাধ‌্যমের বাইরে ছিল না। তাদের বিয়ের এই ঘটনা রীতিমত ভাইরাল। আর তাই প্রিন্ট, অনলাইন কিংবা টেলিভিশন এই তিনটি মাধ‌্যমেই তাদের বিয়ের খবর প্রচার বা প্রকাশ হয়েছে গুরুত্বসহই।

এবার বিয়ে ভাঙার খবরটি দিয়ে অন‌্য আলাপে যাই। গেল ২০শে সেপ্টেম্বর দুপুরে ব্রেকিং নিউজটা চোখে পড়ল প্রথম সারির একটি সংবাদভিত্তিক টেলিভিশন চ‌্যানেলে। এরপর রিমোট হাতে নিয়ে আরও কয়েকটি টেলিভিশন ঘুরে এলাম। অনেকেই ‘ব্রেকিং’ চালাচ্ছে। কোনো কোনো টিভি ‘সদ‌্যপ্রাপ্ত’, ‘এইমাত্র পাওয়া’ ইত‌্যাদি বিশেষ মর্যাদায় একটি বিবাহ বিচ্ছেদের করুণ খবরটি প্রচার করছে। কোনও চিন্তা ভাবনা না করেই ঢু মারলাম প্রথম সারির সব পত্রিকার অনলাইন পোর্টালে। সেখানেও একইদশা দেখলাম। বিবাহ বিচ্ছেদের খবরটিই ঝুলছে সবার ওপরে। এবার ওয়েব পোর্টালে ঢুকে মনে হলো বিচ্ছেদের করুণ সুর বাজছে এখানে।

এতক্ষণে নিশ্চয়ই আপনারা ধরে ফেলেছেন কোন দম্পতির বিবাহ বিচ্ছেদের কথা বলছি এতক্ষণ আড়েঠারে। জ্বি, পরীমনি-রাজ দম্পতি বহু নাটকীয়তা শেষে বিচ্ছেদের পথ বেছে নিয়েছেন। পরীমনিই বিবাহ বিচ্ছেদের নোটিশ পাঠিয়েছেন।

তারা সেলিব্রেটি। তারা যা করেন তাই খবর হয়। খবর তো খবর রীতিমতো ভাইরাল হয়। সেলিব্রেটিদের বিয়েই শুধু নয় আরও বহু কিছুই ভাইরাল হয়। এই ভাইরাল করার কাজটি কখনো সামাজিক যোগাযোগ মাধ‌্যমে শুরু হয়, আবার কখনো গণমাধ‌্যমও ভাইরাল করে।

খবরটিতে যদি শিশুদের দাঁত ওঠার সময় কি কি সমস‌্যা হয়, শিশুদের আচরণ বদলে যায় কি না, শিশুর দাঁতের যত্নে করণীয় কী এমন ছোট ছোট কিছু তথ‌্য থাকত তাহলেই পরীমনির ছেলের দাঁত ওঠার খবরেও জনস্বার্থ মেটাতে পারত।

দাঁতাল খবর:

মাস কয়েক আগের ঘটনা। চিত্র নায়িকা পরীমনির ছেলের দাঁত উঠল। খবরটি পরীমনি তার ফেইসবুক পেইজে জানালেন। তিনি জানাতেই পারেন। কিন্তু গণমাধ‌্যমগুলোও সেই খবর ফলাও করে প্রচার করল। পরীমনির ছেলের দাঁত উঠল, শিশুদের দাঁত উঠবে এটাই স্বাভাবিক। তাই বলে এটি গণমাধ‌্যমে খবর হিসেবে প্রকাশ করা কতটা গুরুত্ববহন করে আমার মতো হয়তো অনেকেরই জানতে ইচ্ছে করছে। দাঁত উঠার মধ‌্যে নতুন কী এমন আছে? যদি এমন হতো পরীমনির ছেলের দাঁত উঠার কথা ছিল না, বা স্বর্ণের দাঁত উঠেছে তাহলে গণমাধ‌্যমে খবর হতে পারত। দাঁত কি আপনার আমার সন্তানের ওঠেনি? আপনি আমি পরীমনির মতো সেলিব্রেটি নই বলে হয়তো গণমাধ‌্যম বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ‌্যমে আমাদের সন্তানদের দাঁতের খবরটি পাত্তাই পায়নি।

প্রতিদিন হাজার শিশুর দাঁত উঠছে। সব দাঁতের খবর প্রকাশ করতে গেলে গণমাধ‌্যমগুলোকে দাঁতাল হতে হবে। অথবা একটি নতুন দৈনিক প্রকাশ করতে হবে যার নাম হতে পারে ‘দৈনিক দাঁতাল’।

আটকে গেছে:

কিছুদিন আগের ভাইরাল টপিক ছিল ‘কিসে আটকায়’। নারী কিসে আটকায়, পুরুষ কিসে আটকায় থেকে শুরু করে গরু-ছাগল হাঁস-মুরগি, কুকুর-বিড়াল কিসে আটকায় তাও সামাজিক যোগাযোগ মাধ‌্যমসহ গণমাধ‌্যমেও ভাইরাইল হয়েছে।

ভাইরাল হয়েছেন ক্রিকেটার তানজিম হাসান সাকিবও। এশিয়া কাপে বাংলাদেশ দলের শেষ খেলায় ভারতের বিপক্ষের ম‌্যাচেই যার অভিষেক ঘটেছিল। ওই ম‌্যাচে তিনি দুটি উইকেট নিয়ে দেশের জয়ে বড় ভূমিকা রেখেছেন। তার এই অর্জন যখন আলোচনার তুঙ্গে ঠিক তখন সামনে আসে তারই কিছু স্ট‌্যাটাস। তাতে তিনি নারীদের নিয়ে মন্তব‌্য করেছিলেন যা সমালোচনার জন্ম দেয়।

এই সেলব্রেটিদের খবরই কেবল ভাইরাল হয় তাও কিন্তু নয়। একেবারে সাদামাটা অনেক কিছুও ভাইরাল হতে দেখেছি। এই যেমন সেই নারিকেল গাছের কথা বলি।

শেরপুরে পুকুরপাড়ের নারিকেল গাছ হঠাৎ করে পুকুরের মাঝখানে সরে যাওয়ার ঘটনায় তোলপাড় শুরু হয়েছিল। উৎসুক মানুষ এটাকে অলৌকিক ঘটনা মনে করে দলে দলে পুকুরের মাঝে সরে যাওয়া ওই নারিকেল গাছ দেখতে ভিড় করেছেন। অনেকেই রোগবালাই সারানোর জন্য বোতলে ওই পুকুরের পানি সংগ্রহ করেছিলেন। এই ঘটনা আমি বানিয়ে বলছি না। পুকুরে নারিকেল গাছ লিখে সার্চ দিলেই খবরটি চলে আসবে। শুধু খবরই নয় পাবেন বহু ভিডিও। ওই নিতান্ত গোবেচারা তালগাছও এই দেশে ভাইরাল হয়। শুধু সামাজিক যোগাযোগ মাধ‌্যমেই নয়, তালগাছটি শেকড় গেড়েছিল মূলধারার গণমাধ‌্যমেও হোক তা প্রিন্ট, অনলাইন বা টেলিভিশন।

এই যে এত এত ভাইরালের কথা বলছি এসব ভাইরাল খবরে লাভ কী? প্রশ্নটি বোকাবোকা মনে হতে পারে। কারণ উত্তর আপনাদের জানা। যত ভাইরাল তত ডলার। গলির ছোকরা থেকে শুরু করে বাজারের সেরা পত্রিকার সেরা মালিকও সেই ডলারের পেছনে ছুটছেন। ফলে যে করেই হোক প্রতিদিন কিছু না কিছু কারও না কারও ভাইরাল হতেই হবে, ভাইরাল করতেই হবে। ভাইরাল প্রতিযোগিতা চলছে এখন সব দিকে। আপনার টেলিভিশন-পোর্টাল-পত্রিকার বা ব‌্যক্তিগত পেইজের কোনো কিছুই এখনও ভাইরাল হয়নি? তাহলে আপনার ইজ্জত থাকল কোথায়। ভাইরাল হওয়া বা করাতে পারাকে আমি মন্দের তালিকায় ফেলতে চাই না।

তাহলে এতো আলাপ কেন? আলাপ এই জন‌্য যে আমরা কন্টেন্টকে ভাইরাল করার জন‌্য যে পদ্ধতি অনুসরণ করি তা কি গ্রহণযোগ‌্য? কনটেন্টকে ভাইরাল করার জন‌্য আমরা ‘ক্লিকবেইট’র আশ্রয় নিই। ক্লিকবেইট শব্দটি নতুন নয়। এরমানেও সহজ— দর্শক পাঠকের ক্লিক পাওয়ার জন‌্য টোপ দেওয়া। যেমন— ‘বড় কলা দেখে অজ্ঞান নায়িকা জারিতন’। এই শিরোনাম দর্শক টানবেই। আর এই কাজটি এখন প্রায় সব গণমাধ‌্যমই করছে। একটা কনটেন্ট যত ক্লিক পাবে তত বেশি মানুষের কাছে পৌঁছে যাবে। আয়ও তত বেশি হবে। ভাইরালই বলি আর ক্লিকবেইটই বলি সব কিছুর মূলে আসলে ডলার। মানি ম‌্যাটার্স।

আমাদের সবারই টাকা দরকার। অনলাইনে টাকা কামানোর এখন অনেকটাই সহজ মাধ‌্যম হলো ভাইরাল করে দেওয়া। আর এই ভাইরাল বস্তুও এখন খুব সহজ। যে যেমন বস্তুই পাচ্ছে সেটা ভাইরাল হোক তাই চাচ্ছে। যাদেরটা নিজে থেকে ভাইরাল হচ্ছে না বা ভাইরাল হওয়ার মতো বস্তু হাতে নেই, তারা যা খুশি তাই বুস্ট করছে পয়সা খরচ করে। যদিও বুস্ট করে বেশি দর্শক-পাঠকের কাছে পৌঁছানো গেলেও ভাইরাল হবেই এমনটা নিশ্চিত নয়।

ফলে আমাদের গণমাধ‌্যম বা সাংবাদিকতা ভাইরালের লোভে পড়েছে বললে বাড়িয়ে বলা হবে কী? প্রশ্নটা রইল আপনার কাছেই।

জনস্বার্থ সাংবাদিকতা বোঝায় গণ্ডগোল:

যখন সব গণমাধ‌্যম একযোগে এই ভাইরাল রোগে আক্রান্ত হয় তখন বিষয়টা মানা কঠিন হয়ে পড়ে। আপনি প্রশ্ন করতে পারেন গণমাধ‌্যমগুলো ভাইরাল হবে এমন খবর বা কনটেন্টের সন্ধানে নামলে ক্ষতি কি? লাভ ক্ষতির হিসেব করার আগে আমার একটা প্রশ্ন আছে। ধরা যাক আপনি একজন গণমাধ‌্যম কর্মী। আপনাকে যদি প্রশ্ন করি আপনি কেন সাংবাদিকতা করেন?

উত্তরে আপনি নিশ্চয়ই বলবেন— মানুষের কথা বলতে চাই, শোষণ বঞ্চনার কথা বলতে চাই। মানুষের অধিকারের কথা বলতে চাই। কণ্ঠহীনের কণ্ঠ হতে চাই। সত‌্য তুলে ধরতে চাই। ভালো-মন্দ খবর দিতে চাই। দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষায় কাজ করতে চাই।

এসব উত্তরের বাইরেও হাজার উত্তর আছে। যার সার কথা হলো আপনি আপনার পাঠক দর্শকের স্বার্থকে সামনে রেখে সাংবাদিকতা করছেন। কিন্তু সত‌্যিই কি পাঠক-দর্শকের স্বার্থ-অধিকার আপনার সাংবাদিকতায় নিশ্চিত হচ্ছে?

এই লেখার শুরুতে যেসব উদাহরণ দেওয়া হয়েছে সেসবের কোন খবরে জনগণের স্বার্থ আছে? আয়মান-মুনজেরিনের বিয়েতে জনগণের স্বার্থ কোথায়? পরীমনির সংসার ভাঙলে জনগণের লাভ হলো কিভাবে? পরীমনির ছেলের দাঁতের খবরে আপনার মাধ‌্যমে জনগণের দাঁত কপাটি লাগা ছাড়া লাভ কোথায়?

আসলে এসব খবরে জনগণের আগ্রহ আছে। আগ্রহ আর স্বার্থের মধ‌্যে যদি আপনি আমি সাংবাদিক হয়ে পার্থক‌্য ধরতে না পারি তাহলে তো মুশকিল। গণমাধ‌্যমগুলো স্বার্থ আর আগ্রহকে গুলিয়ে ফেলে বলেই বারবার ভাইরাল খবরের পেছনে ছোটে, ভাইরাল হবে এমন নিউজ খুঁজে বেড়ায়।

এখন আপনি আবার প্রশ্ন তুলতে পারেন— জনগণের আগ্রহ থাকলে নিউজ করতে দোষ কোথায়? মানুষের তো অনেক কিছুতেই আগ্রহ আছে। সেই আগ্রহ মেটানোর বহুপথও আছে। কিন্তু আপনি গণমাধ‌্যম, আপনার নিশ্চয়ই আছে চমৎকার সম্পাদকীয় নীতিমালা, পেশাদারিত্ব-দ্বায়িত্ববোধ বা সর্বোপরি সাংবাদিকতার মূলনীতি। যা পাঠক দর্শকের আস্থা তৈরি করে।

আপনি তো সামাজিক যোগাযোগ মাধ‌্যমের মতো চটুল হতে পারেন না। আপনার কাছ থেকে পাঠক-দর্শক জানতে চায় সত‌্য। পাঠকের রুচি বা রুচিশীল পাঠকও অনেক সময় আপনার মাধ‌্যমে তৈরি হতে পারে। জাতিগঠনেও ভূমিকা রাখতে পারেন আপনি। আপনার কাছে মানুষের প্রত‌্যাশাও তো তাই।

কিন্তু আপনি এসবের কোনও কিছু না করে ভাইরালের পেছনে ছুটছেন, ক্লিকবেইটের আশ্রয় নিচ্ছেন। আপনি জন-আগ্রহের খবর দিতে দিতে নিজেকে গুরুত্বহীন করে ফেলছেন, এটা মানা কঠিন হলেও স্বীকার করবেন নিশ্চয়ই।

গণমাধ‌্যম ভাইরালের পেছনে ছুটে কি দোষ করছে? এই প্রশ্নটিকে নিরীহ বিবেচনা করে এড়িয়ে গেলে অন‌্যায় হবে। ছোট ছোট কিছু উদাহরণ দিই তাহলে। কলেজ শিক্ষক এক নারী বিয়ে করেছিলেন তার এক ছাত্রকে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ‌্যম হয়ে সেই ঘটনা মূলধারার গণমাধ‌্যমও ভাইরাল করেছিল। ওই দম্পতি শেষ পর্যন্ত জীবন দিয়েছিলেন। এর দায় এড়াতে পারবে ভাইরাল জ্বরে ভোগা গণমাধ‌্যম?

দাদি-নাতির বিয়ের খবরের কথা মনে আছে? না তারা আত্মহণন করেনি, কিন্তু সামাজিকভাবে তারা কোনঠাসা হননি? ডজনখানেক ফাঁসি কার্যকর করা এক যাবজ্জীবন সাজাখাটা ব‌্যক্তির মুক্তির পর তাকে ভাইরাল করা হয়েছিল। তিনি কি সুন্দর জীবন পাচ্ছেন এখন? তাকে ‘জল্লাদ’ হিসেবে সারাদেশের মানুষের কাছে তুলে ধরা হয়েছিল মনে আছে?

এমন হাজারো উদাহরণ দেওয়া যাবে। এসব ঘটনাকে ভাইরাল করে বা ‘সংবাদমূল‌্য’ দিয়ে প্রচার প্রকাশ করায় দেশ ও জনগণের কোনও লাভ হয়েছে? তাহলে আপনি সাংবাদিকতা করার পেছনে যে মহৎ উদ্দেশ‌্যগুলোর কথা বলেছেন বা ভাবছেন সেগুলোর সঙ্গে এই ভাইরাল সংস্কৃতির অংশ হয়ে কোন ‘মহৎ’ দৃষ্টান্ত তৈরি করছেন?

গণমাধ‌্যমগুলো জনস্বার্থ সাংবাদিকতা একেবারেই করেনি বা করে না তা কিন্তু নয়। করে, হাল আমলে সেই সংখ‌্যাটা কিছুটা বেড়েছেও। তবে জনস্বার্থ সাংবাদিকতার ধারণাটি সব গণমাধ‌্যমের কাছে পরিষ্কার কী না তা নিয়েও সন্দেহ আছে। আমি নিজে প্রায় ২২ বছর সাংবাদিকতা করেছি। সেই অভিজ্ঞতাই আমাকে গণমাধ‌্যমের জনস্বার্থ সাংবাদিকতার ধারণা নিয়ে সন্দেহ তৈরিতে সাহায‌্য করেছে। বা বলা যায় সন্দেহটা বেড়েছে একটু একটু করে।

আমি নিজেই বছর দেড়েক আগ পর্যন্ত এই ধারণাই রাখতাম যে, জনস্বার্থ সাংবাদিকতা মানেই হচ্ছে, ভাঙাচোরা রাস্তাঘাটের নিউজ করা, ঈদের ঘরমুখো মানুষের ভিড়ে তৈরি হওয়ার দুর্ভোগ-দুর্দশার নিউজ করা বা নিত্তনৈমিত‌্যিক জনভোগান্তির নিউজ করা। কিন্তু জনস্বার্থ সাংবাদিকতা এসব নয়। তাহলে জনস্বার্থ সাংবাদিকতা কী? জনস্বার্থ সাংবাদিকতার বৈশিষ্ট্য কী বা কিভাবে জনগণের স্বার্থ রক্ষা হয় সেই আলোচনাতেই তা পরিষ্কার হয়ে যাবে আশা করি।

একটু সচেতন হলেই ভাইরাল খবরগুলোকেও জনস্বার্থ সাংবাদিকতায় পরিণত করা যায় কারণ জনস্বার্থ সাংবাদিকতা মানেই অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা নয়। একটি পত্রিকা খবর প্রকাশ করেছিল ‘জনৈক অভিনেত্রী এক বসায় চারটি আম খেয়েছেন’। খবরটি নিয়ে ট্রল হয়েছে। আর ভাইরাল তো হয়েছেই। কিন্তু একজন প্রাপ্ত বয়স্ক নারী/পুরুষ একেবারে কতটুকু আম খেতে পারেন, কতটুকু খেলে স্বাস্থ‌্যঝুঁকি তৈরি হতে পারে এই তথ‌্যটুকু ওই সংবাদে জুড়ে দিলেই কিন্তু জনস্বার্থ সাংবাদিকতা করা যেত। অভিনেত্রীর আম খাওয়ার খবরে জন আগ্রহ থাকলে তাও যেমন মিটত আবার জনস্বার্থও নিশ্চিত হতো।

জনস্বার্থ সাংবাদিকতা দর্শক-পাঠককে বাস্তবতা বুঝতে ও সিদ্ধান্ত নিতে সাহায‌্য করে, খেলাধুলা বা বিনোদনের সংবাদও জনস্বার্থমূলক হতে পারে। কঠিন মনে হচ্ছে? তাহলে একটি উদাহরণ দিচ্ছি। পরীমনির ছেলের দাঁত উঠেছে। এই খবরটিতে যদি শিশুদের দাঁত ওঠার সময় কি কি সমস‌্যা হয়, শিশুদের আচরণ বদলে যায় কি না, শিশুর দাঁতের যত্নে করণীয় কী এমন ছোট ছোট কিছু তথ‌্য থাকত তাহলেই পরীমনির ছেলের দাঁত ওঠার খবরেও জনস্বার্থ মেটাতে পারত। কারণ আপনার আমার ঘরেও শিশু আছে, আমরা তাদের দাঁত নিয়েও চিন্তা করি। অথচ শুধু গণমাধ‌্যম পড়ে রইল পরীমনির ছেলে দাঁত নিয়ে।

জনস্বার্থ সাংবাদিকতা বিভ্রান্তি থেকে বাঁচায়। করোনাকালে করোনা থেকে বাঁচতে হাজার রকম টোটকার খবর ভাইরাল হয়েছে। একটু খোঁজ নিয়ে সেসব বিষয়ে প্রকৃত তথ‌্য তুলে দিলেই মানুষ বিভ্রান্তি থেকে রক্ষা পেত।

অপরাধ ও সমাজ বিরোধী কার্যক্রম শনাক্ত করতে সাহায‌্য করে, দুর্নীতি, অবিচার, অদক্ষতা ও অবহেলা তুলে আনে, মানুষের স্বাস্থ‌্য ও নিরাপত্তা রক্ষায় কাজ করে এবং মানুষকে ঐক‌্যবদ্ধ করে। আপনি গণমাধ‌্যমকর্মী হলে আর ব‌্যাখ‌্যা করার প্রয়োজন হবে না আশা করি।

জনস্বার্থ সাংবাদিকতায় আর্থিক লাভেরও সম্ভাবনা আছে। কোনও একটি গণমাধ‌্যম যদি নিয়মিত জনস্বার্থ সাংবাদিকতা করে আর তার পাঠকরা বুঝে ফেলে এই গণমাধ‌্যমটি তার বা তাদের স্বার্থ ও অধিকার নিয়ে কাজ করে, তাহলে তিনি বা তারা কি ওই গণমাধ‌্যম থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে? নিশ্চয়ই না। ওই গণমাধ‌্যমে আরও বেশি নতুন পাঠক-দর্শক যুক্ত হবে। ফলে বিজ্ঞাপণও বাড়বে। তাহলে জনস্বার্থ সাংবাদিকতা কি লাভজনক নয়?

ভাইরাল কি পিছু ডাকে?

আপনার গণমাধ‌্যমে একটি প্রতিবেদন বা সংবাদ বা ভিডিও আজ ভাইরাল হলো। তিনদিনের মধ‌্যে ওই ভাইরাল খবর-ভিডিও আর কেউ দেখবে না। কারণ ওই সময়ের মধ‌্যে আরও অনেক ভাইরাল ইস‌্যু চলে আসবে। মাস বা বছর শেষে ওই ভাইরাল ইস‌্যুটির আর কেউ খোঁজও নেবে না।

আপনি যদি একটি জনস্বার্থ প্রতিবেদন হোক তা প্রিন্ট, অনলাইন বা ইলেকট্রনিক মাধ‌্যমে প্রকাশ বা প্রচার করেন তার ভবিষ‌্যত কী হতে পারে বলে মনে হয়? ধরা যাক আপনি পরীমনির ছেলের দাঁতের প্রতিবেদনটিই করলেন জনস্বার্থ নিশ্চিত করে। তাহলে হবু বাবা অথবা তাদের পরিজন ওই খবরটি সংগ্রহ করে রাখবে। কারণ এই খবরটি তার বা তাদের কাজে লাগবে। এবার ভাবুন আপনি দর্শক/পাঠক হলে কোন খবরটি আপনার প্রয়োজন, আর তা কোন গণমাধ‌্যম তা আপনাকে দিচ্ছে।

ধরা যাক একটি গণমাধ‌্যমের প্রতিটি কনটেন্ট প্রায় ৫ লাখ দর্শক পড়ে বা দেখে। কিন্তু একটি কনটেন্ট হঠাৎ ২০ লাখ মানুষ দেখল। মানে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি মানুষের কাছে পৌঁছে গেল। অর্থাৎ কনটেন্টটি ভাইরাল হলো। এটি স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু আপনি সেই গণমাধ‌্যম যার কোনও কনটেন্টই ১ হাজারের বেশি পাঠক বা দর্শক টানতে পারে না, কিন্তু হঠাৎ একটি কনটেন্ট ১০ লাখ দর্শক-পাঠক পাওয়ায় আপনি বগল বাজাতে শুরু করলেন আর দর্শক পাঠক ধরে রাখতে গুরুত্বহীন কেবল জনআগ্রহের বিষয় মাথায় রেখে কনটেন্ট তৈরি করছেন, মানে ভাইরালের পেছনে ছুটছেন, ক্লিকবেইটের আশ্রয় নিচ্ছেন। আপনি আদর্শ গণমাধ‌্যম বলে আর কিভাবে দাবি করবেন নিজেকে?

স্তম্ভে স্তম্ভিত!

স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ বলা হতো। থমাস জেফারসন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতাদের একজন। যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের মূল রচনাটিও তিনি করেছিলেন। জেফারসন ছিলেন গণতান্ত্রিকব্যবস্থাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে একজন প্রবাদপুরুষ।

তিনি একবার বলেছিলেন, ‘আমাকে যদি এই বিকল্পটি দেওয়া হয় যে তুমি কি সংবাদপত্রবিহীন সরকার চাও, না সরকারবিহীন সংবাদপত্র চাও? তখন আমি পরেরটা বেছে নেব।’ জেফারসন বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ ও সংবাদপত্রের কথা বলেছিলেন। ঠিক তার প্রায় ৫০ বছর পর ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ন বোনাপার্ট সংবাদপত্র সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘চারটি আক্রমণাত্মক সংবাদপত্র হাজারটা বেয়নেটের চেয়েও ক্ষতিকর।’ অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের মতে, কোনও দেশে স্বাধীন গণমাধ্যম থাকলে সে দেশে দুর্ভিক্ষ হানা দিতে পারে না।

সংবাদপত্র বা গণমাধ‌্যমকে যেখানে এত গুরুত্ব দিয়ে রাষ্ট্রের চতুর্থস্তম্ভের মর্যাদা দেওয়া হচ্ছে সেখানে গণমাধ‌্যম দৌঁড়াচ্ছে ভাইরালের পেছনে। ক্লিকবেইটই যার একমাত্র ভরসা। গণমাধ‌্যমে চলছে ভাইরাল আসলে জরুরি জনস্বার্থ সাংবাদিকতার বিকাশ। তবে আর কেউ এই স্তম্ভ ধরে নাড়াচাড়া করতে পারত না, স্তম্ভিতও হতো না কেউ।

লেখক: মিডিয়া ডেভেলাপমেন্ট অফিসার, বিবিসি মিডিয়া অ‌্যাকশন।

ইমেইল: nursi31@gmail.com