Beta
বৃহস্পতিবার, ৯ মে, ২০২৪
Beta
বৃহস্পতিবার, ৯ মে, ২০২৪

সত্যিই কি ঘুষ নিয়েছিলেন সাংবাদিকরা

শিল্পী : আনিসুর রহমান লিটন
শিল্পী : আনিসুর রহমান লিটন

সনদ জালিয়াতির অভিযোগে গ্রেপ্তার কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের এক কর্মীর ভিডিও নিয়ে আলোচনা চলছে দেশের সংবাদ জগতে। ওই ভিডিওতে ওই কর্মী দাবি করেন, জালিয়াতির তথ্য গোপন রাখতে কয়েকজন সাংবাদিককে ঘুষ দিয়েছিলেন তিনি।

কারিগরি শিক্ষাবোর্ডের সিস্টেম অ্যানালিস্ট এ কে এম শামসুজ্জামান নামে ওই কর্মীকে গত ৩১ মার্চ গ্রেপ্তার করে গোয়েন্দা পুলিশ। জাল সার্টিফিকেট ছাপানো ও বিক্রির অভিযোগে পরদিন তাকে সাময়িক বরখাস্তও করে কারিগরি শিক্ষা বোর্ড।

শামসুজ্জামানকে গ্রেপ্তার এবং জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্য জানাতে রবিবার ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) হারুন-অর রশীদ আসেন সাংবাদিকদের সামনে।তখনই একটি ভিডিও আসে ঢাকা মহানগর পুলিশের মাধ্যমে।

সেই ভিডিওতে শামসুজ্জামানকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে দেখা যায় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) লালবাগ জোনের উপকমিশনার মশিউর রহমানকে।

জিজ্ঞাসাবাদের মুখে শামসুজ্জামান বলেন, তিনি কারিগরি সনদ জালিয়াতি ও অবৈধ সনদ বাণিজ্যের সংবাদ ধামাচাপা দিতে বেশ কয়েকজন সাংবাদিককে ঘুষ দিয়েছিলেন।

ভিডিওতে শামসুজ্জামানকে বলতে শোনা যায়, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের একাংশের সাবেক সভাপতি আবু জাফর সূর্যকে তিনি ১০ লাখ টাকা ঘুষ দিয়েছিলেন। কালের কণ্ঠের শিক্ষা বিটের রিপোর্টার শরীফুল আলম সুমনকে দেন ৮ লাখ টাকা, ইত্তেফাকের শিক্ষা বিটের সাংবাদিক নিজাম উদ্দিনকে (প্রকৃত নাম নিজামুল হক) দেন ৬ লাখ টাকা, সমকালের শিক্ষাবিষয়ক প্রতিবেদক সাব্বির নেওয়াজকে দেন ৫ লাখ টাকা।

শামসুজ্জামান বলেন, আবু জাফর সূর্যকে তিনি ১০ লাখ টাকা দিয়েছিলেন, কারণ তিনি এই সাংবাদিকদের নিয়ন্ত্রণ করতেন।  

টাইমস অব বাংলাদেশের ডেপুটি এডিটর আবু জাফর সূর্য ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করে সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমি ওই কর্মকর্তাকে চিনিও না। কখনও দেখিনি। ঘুষ নেওয়ার তো প্রশ্নই আসে না।”

তিনি দাবি করেন, এটা পরিকল্পিত মিথ্যাচার।

বিশেষ প্রতিনিধি হিসাবে সম্প্রতি কালের কণ্ঠে কাজ শুরু করেন শরীফুল আলম সুমন।

তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমি এর আগে যখন দেশ রূপান্তর পত্রিকায় ছিলাম, তখন কারিগরি বোর্ডের চেয়ারম্যানের দুর্নীতি নিয়ে প্রতিবেদন করেছিলাম। সম্ভবত ওই নিউজের জের ধরে আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। আমি ওই লোকের (শামসুজ্জামান) কাছ থেকে কোনো ঘুষ নেইনি। এটা মিথ্যা অভিযোগ।”

দৈনিক ইত্তেফাকের সিনিয়র রিপোর্টার নিজামুল হকও দাবি করেন, তিনি শামসুজ্জামানকে চেনেন না।

তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমি ওই সিস্টেম অ্যানালিস্টকে চিনিও না। আমি তো তার কাছ থেকে কোনও টাকা নিইনি। এখন দেখি আমার অফিসের সঙ্গে কথা বলে এর কোনও প্রতিবাদ করা যায় কি না।”

তবে ভিডিওটি দেখেছেন জানিয়ে ইত্তেফাক সম্পাদক তাসমীমা হোসেন সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “এই অভিযোগ সঠিক কি না, তা আমরা তদন্ত করে দেখব। অভিযোগ সত্য হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

সমকালের বিশেষ প্রতিনিধি সাব্বির নেওয়াজের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা চালিয়েও তার বক্তব্য পেতে ব্যর্থ হয়েছে সকাল সন্ধ্যা।

তবে সমকালের প্রধান প্রতিবেদক লোটন একরামের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সাব্বির নেওয়াজের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ তদন্তে নেমেছে সমকাল কর্তৃপক্ষ।

লোটন সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “সাব্বির নেওয়াজের বিরুদ্ধে ওঠা ঘুষের অভিযোগ তদন্তে একটি কমিটি করা হয়েছে। একই সঙ্গে সাব্বির নেওয়াজকে একটি কারণ দর্শানোর (শোকজ) নোটিস দেওয়া হয়েছে এ বিষয়ে তার বক্তব্য নেওয়ার জন্য।”

ইলেকট্রনিক মিডিয়ার দুজন সাংবাদিকের নামও এসেছে ওই ভিডিওতে। শামসুজ্জামান বলেন, টিভি সাংবাদিকদের মধ্যে মাহমুদ সোহেল নামে একজনকে সাড়ে ৪ লাখ টাকা এবং এশিয়ান টিভির জাকির হোসেন পাটোয়ারীকে ২ লাখ টাকা ঘুষ দিয়েছিলেন তিনি।

মাহমুদ সোহেল নামে এক সাংবাদিকের সন্ধান পাওয়া যায় মাছরাঙা টেলিভিশনে। ওই টেলিভিশনে ওই সাংবাদিকের পরিচয় মাহমুদুল হাসান হলেও তার ফেইসবুক আইডিতে নাম মাহমুদ সোহেল।

শামসুজ্জামানের সনদ জালিয়াতি নিয়ে ২০২৩ সালের ৩১ আগস্ট মাহমুদুল হাসানের করা একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রচার করেছিল মাছরাঙা টেলিভিশন। সেখানে কারিগরি বোর্ডের ওই কর্মকর্তার অনিয়ম ও দুর্নীতির তথ্য তুলে ধরা হয়।

মাছরাঙা টেলিভিশনের সিনিয়র রিপোর্টার মাহমুদুল হাসানের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।

এশিয়ান টেলিভিশনের প্রধান প্রতিবেদক বাতেন বিপ্লব সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, জাকির হোসেন পাটোয়ারী নামে তাদের কোনও সংবাদকর্মী নেই।

“গত দুই বছরের বেশি সময় ধরে আমি এই টেলিভিশনের প্রধান প্রতিবেদকের দায়িত্বে আছি। এই নামে আমাদের কোনও প্রতিবেদক থাকলে প্রধান কার্যালয়ে তার নথি অবশ্যই থাকত এবং আমিও তাকে চিনতাম। ওই ভিডিও আমিও দেখেছি। খোঁজও নিয়েছি। কিন্তু এই নামে কাউকে পাইনি।”

ওই ভিডিওতে শামসুজ্জামান দাবি করেন, হাসমত নামে এক সাংবাদিককে বিভিন্ন সময়ে মোট ২ লাখ টাকা দিয়েছেন তিনি। রুবেল নামে আরও এক সাংবাদিক বিভিন্ন সময়ে বিজ্ঞাপন দেওয়ার কথা বলে তার কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন।

তবে এই নামে কোনও সাংবাদিকের খোঁজ সক্রিয় সংবাদ মাধ্যমে পাওয়া যায়নি।

গ্রেপ্তারের পর পুলিশ হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদে কারিগরি শিক্ষাবোর্ডের সিস্টেম অ্যানালিস্ট এ কে এম শামসুজ্জামান।

ভিডিওটি এল কোত্থেকে?

শামসুজ্জামানের যে ভিডিওটি ছড়িয়েছে, তা রবিবার ডিএমপির পক্ষ থেকে সাংবাদিকদের সঙ্গে তথ্য শেয়ারের জন্য খোলা হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে শেয়ার করা হয়। এরপর কয়েকটি সংবাদমাধ্যমে তা আসে।

ভিডিওতে শামসুজ্জামানকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে দেখা যাওয়া ডিএমপি-ডিবির লালবাগ জোনের ডিসি মশিউর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করে সকাল সন্ধ্যা

তিনি এ বিষয়ে ডিএমপির মিডিয়া সেলের সঙ্গে কথা বলতে পরামর্শ দিয়ে বলেন, “ভাই, আমার এত ফুসরত নাই।”

ডিএমপির মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার কে এন রায় নিয়তি সাংবাদিকদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে ভিডিওটি শেয়ার করেছিলেন। এ বিষয়ে জানতে তার মোবাইল ফোনে সোমবার একাধিকবার কল করা হলেও তিনি সাড়া দেননি।

ডিএমপির এই বিভাগের উপকমিশনার মো. ফারুক হোসেন সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, তার সহকর্মীদের ‘ভুলের কারণে’ এই ভিডিও প্রকাশ হয়ে গেছে।

“আমি গতকাল (রবিবার) অফিসে ছিলাম না। জুনিয়াররা ভুল করে এই ভিডিওগুলো সাংবাদিকদের সঙ্গে শেয়ার করেছে। আমি থাকলে তাদেরকে গাইড করি, কোন তথ্য শেয়ার করা যাবে বা কোন তথ্য শেয়ার করা যাবে না। গতকাল আমি অফিসে না থাকায় এমন ভুল হয়েছে।”

এদিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদের তথ্য এভাবে প্রকাশ করা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

এটা পুলিশ সংরক্ষণ করলেও প্রকাশ করা বেআইনি হয়েছে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক তৌহিদুল হক।

তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আইনশৃঙ্খলা রক্ষার স্বার্থে বিভিন্ন বাহিনী অনেককে গ্রেপ্তার করে থাকে। গ্রেপ্তারের সূত্র ধরে আসামির সঙ্গে পুলিশ কিংবা সংশ্লিষ্ট তদন্ত কর্মকর্তার কথোপকথন রেকর্ড রাখার প্রয়োজন হয়। কখনও এই রেকর্ড লিখিত আকারে সংরক্ষণ করা হয়, আবার কখনও ডিভাইসের মাধ্যমে সংরক্ষণ করা হয়।

“যে প্রক্রিয়ায়ই তা সংরক্ষণ করা হোক না কেন, অপরাধ চূড়ান্তভাবে প্রমাণ না হওয়া পর্যন্ত কারও কোনও বক্তব্য প্রকাশ করার সুযোগ নেই। এটা আইনগতভাবেই নিষিদ্ধ।”

অধ্যাপক তৌহিদুল বলেন, “আইন শৃঙ্খলা বাহিনী গ্রেপ্তার করলেও অপরাধ চূড়ান্তভাবে প্রমাণ হবে বিচারালয়ে। রায় হওয়ার আগে বা পরেও কোনও অবস্থাতেই কোনও গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তির ধারণ করা বক্তব্য জনসম্মুখে প্রকাশের কোনও সুযোগ নেই।”

বাংলাদেশে এমনটা ঘটে থাকলেও তা অপরাধ হিসাবে দেখার কথা জানিয়ে এই অধ্যাপক বলেন, “এটা যেই করুক না কেন, সেটা আইনবহির্ভূত কাজ। দেশের চলমান আইনে এটাও একটি অপরাধ।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সাইফুল আলম চৌধুরী সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “এটা একটি ম্যালপ্র্যাকটিসে পরিণত হয়েছে। এর জন্য পুলিশও দায়ী, সাংবাদিকরাও দায়ী। পুলিশ দেখছে যে সাংবাদিকদের এধরনের তথ্য দিলেই তারা সংবাদ পরিবেশন করে। তাই তারা দিয়ে থাকে। সাংবাদিকরাই পুলিশদের এধরনের ম্যালপ্রাকটিস করার জন্য উৎসাহিত করছে।

“কারণ আদালতের নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তির নাম-ঠিকানা প্রকাশ করে দিচ্ছি। এই নির্দেশনা পুলিশও মানছে না, সাংবাদিকরাও মানছে না। যদি এ ধরনের প্র্যাকটিস না থাকত মিডিয়াতে, তাহলে পুলিশ এ ধরনের তথ্য সরবরাহ করতো না।”

চেয়ারম্যান অপসারিত, দুদকও তদন্তে

সনদ বাণিজ্য চক্রের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে শামসুজ্জামানের পাশাপাশি বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান আলী আকবর খানের স্ত্রী সেহেলা পারভীনকেও শনিবার গ্রেপ্তার করে ডিবি। সোমবার আলী আকবর খানকেও দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়।

আকবর খান রংপুর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে ২০২১ সালের অক্টোবরে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যানের পদে এসেছিলেন।

ডিবি বলছে, কারিগরি বোর্ডের জাল সনদ তৈরিতে জড়িত চক্রের সঙ্গে সেহেলা পারভীনের অর্থ লেনদেনের প্রমাণ তারা পেয়েছে।

সেহেলা ও শামসুজ্জামান ছাড়াও আরও চারজন ডিবির হাতে ধরা পড়েছেন। তারা হলেন- বোর্ডের চাকরিচ্যুত কর্মচারী ফয়সাল হোসেন, গড়াই সার্ভে ইনস্টিটিউটের পরিচালক সানজিদা আক্তার কলি, ঢাকার কামরাঙ্গীরচরের হিলফুল ফুযুল টেকনিক্যাল অ্যান্ড বিএম কলেজের অধ্যক্ষ গোলাম মোস্তফা এবং যাত্রাবাড়ীর ঢাকা টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজের পরিচালক মাকসুদুর রহমান।

শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী সম্প্রতি এ বিষয়ে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, “এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে আরও অনেকে জড়িত আছে বলে আমাদের ধারণা। জড়িতদের শাস্তি নিশ্চিত করা হবে।”

এদিকে শামসুজ্জামানকে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দিতে দুর্নীতি দমন কমিশনের দুজন কর্মকর্তা সক্রিয় ছিলেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

সেই অভিযোগের সত্যতা পরীক্ষা করতে দুদক একটি কমিটি করেছে বলে সোমবারই জানিয়েছেন দুদক সচিব খোরশেদা ইয়াসমিন। এছাড়া শামসুজ্জামানের বিরুদ্ধে মামলাটি তদন্তে ভিন্ন তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি।

কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান ও অন্যান্য কর্মচারীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধান চলছে বলে দুদকের পক্ষ থেকে জানানো হয়।   

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ad

সর্বাধিক পঠিত