কোক স্টুডিওর তৃতীয় সিজনের প্রথম গানে কণ্ঠ নিয়ে হাজির হয়েছেন তারকা অভিনেত্রী জয়া আহসান। যদিও গানটিতে তার উপস্থিতি খুব কম সময়ের, তবু এ নিয়েই শুরু হয়েছে বিতর্ক। কেউ বলছেন জয়া ওই গানে কণ্ঠ দেননি, কেউ বলছেন দিয়েছেন। আবার কেউ বলছেন গানে জয়াকে হাজির করা হয়েছে কেবলই তার তারকা ইমেজের সুবিধা পাওয়ার জন্য।
অভিনয়ের পাশাপাশি সঙ্গীত শিল্পী হিসেবেও প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন এমন তারকা বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তানের বিনোদন দুনিয়ায় নেহায়েত কম নয়। কিশোর কুমারের নাম তো না চাইতেই মুখে চলে আসে। সামনেই মুক্তি পেতে যাওয়া সুপার-ডুপার হিট জোকার সিনেমার সিকুয়েল ‘ফলি আ দ্যুঁ’-তে গায়িকা লেডি গাগাকেও দেখা যাবে অভিনয়ে।
বাংলাদেশের প্রয়াত ‘চিরসবুজ’ নায়ক জাফর ইকবালের কথাই ধরা যাক। খ্যাতিমান সঙ্গীত পরিচালক আনোয়ার পারভেজের ছোট ভাই ছিলেন তিনি। তার বড় বোন দেশবরেণ্য কণ্ঠশিল্পী শাহনাজ রহমতুল্লাহ। জাফর ইকবালের উল্লেখযোগ্য দুটি গান ‘সুখে থাকো ও আমার নন্দিনী’ ও ‘হয় যদি বদনাম হোক আরও’। তবে গানের জগতে তার এ উপস্থিতি স্বল্পস্থায়ীই ছিল।
হালের বলিউডের জনপ্রিয় অভিনেত্রী প্রিয়াঙ্কা চোপড়া সঙ্গীত শিল্পী হিসেবেও পেয়েছেন ভালোই খ্যাতি। আরেক বলিউড অভিনেত্রী শ্রুতি হাসান তো সঙ্গীতে তার প্রতিভার দ্যুতি ছড়িয়ে যাচ্ছেন শুরু থেকেই। অভিনয়ের পাশাপাশি তার আছে সঙ্গীতের স্বতন্ত্র ক্যারিয়ার।
প্রিয়াঙ্কা এবং শ্রুতির মতো তারকাদের মাঝেই মাঝেই তাই দেখা যায় বলিউডের নানান শো-তে গান গাইতে। রিয়েলিটি শো-গুলোও দাওয়াত দিয়ে কৌশলে তাদের দিয়ে গাইয়ে নেয় দু-এক কলি। সম্ভব হলে পুরো গান।পাকিস্তানে যেমন রাহমা আলী ক্যারিয়ার শুরু করেন অভিনেত্রী হিসেবে। যদিও সঙ্গীত শিল্পী হিসেবেও পরে যথেষ্ট সুনাম কুড়িয়েছেন তিনি। ২০১৪ সালে কোক স্টুডিও পাকিস্তান এর সিজন সেভেনে তাকে গাইতে দেখা গেছে।
আলি জাফরের নাম ভুলে গেলে তো একেবারেই চলবে না! পাকিস্তানের এই তারকা একাধারে একজন অভিনেতা এবং গায়ক। অভিনয়ে যেমন বলিউড মাতিয়েছেন, তেমনি মাতিয়েছেন কোক স্টুডিও। এখনও নিয়মিত গান করে যাচ্ছেন এই শিল্পী।
কোক স্টুডিওতে জয়া
কোক স্টুডিওর ‘তাঁতি’ গানটিতে জয়া আহসানের তার উপস্থিতি গায়িকা হিসেবে? নাকি নিছক গানটির মডেল হিসেবে- তা একটু ঘোলাটে অনেকের কাছে।
এ নিয়ে কথা হয় জনপ্রিয় ব্যান্ড ‘ব্ল্যাক’-এর লিড গিটারিস্ট ও রেকর্ড লেবেল জি-সিরিজের সিইও খাদেমুল জাহানের সাথে। জয়াকে কখনো গান গাইতে শোনেননি বলে জানান তিনি। তবে নানা ধরনের ফিউশনের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে জাহান বলেন, “হয়তো এখনই বোঝা যাবে না আসলে কী হচ্ছে। নতুন কিছু হলেই আমরা বলি এটা ঠিক কি না, ওটার দরকার ছিল কি না। কিছু বিষয় আসলে সময় গেলে বোঝা যাবে।”
জয়ার উপস্থিতি নিয়ে কোক স্টুডিওর ক্রিয়েটিভ প্রডিউসার সৈয়দ গাউসুল আলম শাওনকে প্রশ্ন করা হয়েছিল। তিনি বলেন, “কোরাস অংশে একটু মনোযোগ দিলেই জয়া আহসানের কণ্ঠ শুনতে পাওয়া যাবে। উনি কিন্তু গান গেয়েছেন। গান গাননি এমন কিন্তু নয়।”
নায়িকা জয়াকে গানের দৃশ্যায়নে রাখার নেপথ্যে কারণ হিসেবে তিনি বলেন, “জামদানি শাড়িকে সারাবিশ্বে তুলে ধরছেন বাংলাদেশের দুইজন তারকা। বাঁধন ও জয়া আহসান। এই জায়গা থেকেই আমরা জয়া আহসানকে যুক্ত করি। তবে শর্ত ছিল উনি যদি থাকেন, তবে অবশ্যই গান গেয়েই থাকতে হবে, নতুবা নয়।”
তবে আরেক সঙ্গীত প্রযোজক শুভ্র রাহার মনে হয়েছে জয়ার উপস্থিতি ‘মার্কেটিং স্টান্ট’। রাহা ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনে জনপ্রিয়তা পাওয়া আওয়ামী লীগের নির্বাচনী গান ‘জিতবে আবার নৌকা’র সঙ্গীত প্রযোজক। তিনি এলএমজি বিটসের সত্ত্বাধিকারীও।
‘তাঁতি’ গানটি কেন
সিরাজগঞ্জের তাঁতি সম্প্রদায়ের শিল্পী মোহাম্মদ গঞ্জের আলীর লেখা ‘গাঁয়ের বধু’ গানটি একটি মৌলিক লোকগান। এখান থেকেই কোক স্টুডিওর ‘তাঁতি’ গানটির ফিউশন করা হয়েছে। আমাদের দেশে গ্রামীণ জনপদে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা লোকগানগুলো তার নিজ নিজ অঞ্চলের জীবন-যাপন, সংগ্রাম এবং দুঃখ-বেদনার কথা বলে।
লোক মানুষের এই গান নিজেই যখন একটি স্বতন্ত্র গল্প বলছে তখন তাতে ‘আধুনিক’ লিরিক যুক্ত করলে মূল গানের আবেদন খর্ব হয় কি না- এই প্রশ্নটি করা হয়েছিল শাওনকে।
তিনি জানালেন, কোক স্টুডিও বাংলা আয়োজনের সময় তাদের মাথায় ছিল কী করে বাংলা গানকে তরুণ প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায়। বর্তমান সময়ের তরুণরা সারা বিশ্বের গান শুনছেন। তারা গ্লোবাল সিটিজেন।
শাওন বলেন, “বিশ্বের কাছে একজন পাঞ্জাবি তরুণ পাঞ্জাবি গান নিয়ে হাজির হন। একজন ইন্ডিয়ান তরুণ অরিজিৎ সিং এর গান নিয়ে হাজির হন। কিন্তু একজন বাঙালি তরুণ কী নিয়ে হাজির হন? বাংলা গানের আবেদন তাদের কাছে কমে যাচ্ছিল। সেখানে আমাদের কাজ ছিল বাংলা গানের প্রাইড আবার ফিরিয়ে আনা। ওই তরুণদের জানানো যে পালাগান আসলেই ছিল বা তাঁতি গান বলে আসলেই কিছু আছে।
“কিন্তু এখন তাকে (তরুণদের) যদি ভাওয়াইয়া শোনাই তারা কিন্তু নেবেন না। কিন্তু যখন আমরা ‘চিলতে রোদ’ গানটির সাথে বগাকে দিয়ে (রিপন কুমার সরকার) ভাওয়াইয়ার ফিউশন করলাম, তখন এটা তরুণদের কাছে ভীষণ পপুলার হলো। তার আগ পর্যন্ত তো ইয়াং ছেলেপেলে বলতেই পারতো না ভাওয়াইয়া কী জিনিস।”
কোক স্টুডিও ফিউশনই করবে জানিয়ে শাওন বলেন, “আমাদের জনরাই হলো এটা। কেউ যদি বিশুদ্ধ লোক সঙ্গীতের চর্চা করতে চান, তার তো সে সুযোগ আছেই।”
‘তাঁতি’ ফিউশন কেমন হলো
‘তাঁতি’ গানের কম্পোজিশনে তিনটি ভিন্ন গানের সমাবেশ ঘটানো হয়েছে। নাইজেরিয়ান শিল্পী অলি বয়ের ‘টাইম টু গিগার’ এবং শতরূপা ঠাকুরতার লেখা ‘হানা দি রেশমের বনে’ গান দুটো আবর্তিত হয়েছে গঞ্জের আলীর লেখা ‘গাঁয়ের বধূ’ গানটিকে কেন্দ্র করে। ‘হানা দি রেশমের বনে’ গানটি গেয়েছেন অর্ণব, যিনি নিজেই কোক স্টুডিওর কিউরেটর এবং প্রডিউসার।
গানটিতে বাংলাদেশি লোকসঙ্গীত এবং পাশ্চাত্য সঙ্গীতের সংমিশ্রণ ঘটানো হয়েছে। আফ্রোবিটের সঙ্গে সারেঙ্গি এবং দোতারার মতো ঐতিহ্যবাহী বাদ্যযন্ত্রগুলোর হয়েছে ব্যবহার। একদিকে গঞ্জের আলীর ভাষায় তাঁতি সম্প্রদায়ের গান, অন্যদিকে অর্ণবের কণ্ঠে আধুনিক লিরিক, এই দুইয়ের মাঝে নাইজেরিয়ান অলি বয়ের আফ্রিকান উচ্চারণে ইংরেজি গান- সব মিলিয়ে একটি সফল এবং অভিনব ফিউশন বলা যায় একে।
তবে এই গানের শব্দ প্রকৌশল নিয়ে কেউ কেউ সমালোচনা করছেন। তাদের দাবি, গানের মিক্সিং ‘দুর্বল’।
এ বিষয়ে স্টুডিও বাকশের স্বত্বাধিকারী আইনাস তাজওয়ার হক বলেন, “এই গানের মিক্সিং ইন্ডিয়া কিংবা পাকিস্তানে করিয়ে আনলে ভালো হতো।”
এ প্রসঙ্গে মিউজিক প্রডিউসার আইনাস জনপ্রিয় ব্যান্ড ‘ইন্দালো’র কথা স্মরণ করিয়ে তিনি বলেন, “একই সময়ে ‘ইন্দালো’ ব্যান্ডের গান রিলিজ হয়েছে হয়তো দেখেছেন। ওটার সাউন্ড কিন্তু টপ নচ। খুবই ভালো। কারণ উনারা এই ধরনের গানের সাউন্ড কেমন হবে সেটা ভালো করেই বোঝেন। কিন্তু কোকের এই গানের যে জনরা… সে অনুযায়ী সাউন্ড কেমন হবে এটা হয়তো সংশ্লিষ্টরা খুব ভালো বোঝেন না।”
অবশ্য এলএমজি বিটসের রাহার মত ভিন্ন। তার মতে, “এই গানের শব্দ প্রকৌশল যথেষ্ট ভালো।” বিশেষত ভিন্ন ভিন্ন ধরনের পার্কিউশন এর শব্দ খুব ভালোভাবে ‘ম্যানেজ’ করা গেছে বলে তিন মনে করেন।
কোক স্টুডিওর ক্রিয়েটিভ প্রডিউসার গাউসুল আলম শাওনের কাছ থেকে পাওয়া গেল এবারের সিজন নিয়ে আগাম কিছু তথ্য। তিনি জানান, শায়ান চৌধুরী অর্ণব এবারের সিজনটি কিউরেট করলেও মিউজিক প্রডিউসার হিসেবে কাজ করেছেন ইমন চৌধুরী,প্রীতম হাসানসহ আরও বেশ কিছু বড় নাম।
বড় নামগুলো জানতে অবশ্য অপেক্ষা করতে হবে আরও বেশ কিছুদিন। চোখ রাখতে হবে কোক স্টুডিওর ইউটিউব চ্যানেলে।