Beta
বৃহস্পতিবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০২৪
Beta
বৃহস্পতিবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০২৪

শক্তিশালী ডলারের বিপদ কোথায়

Stronger_Dollar
[publishpress_authors_box]

আন্তর্জাতিক মুদ্রা বাজারে ডলার আরও শক্তিশালী হয়ে উঠেছে, বলা যায় ভয়ানক শক্তিশালী। জিডিপি প্রবৃদ্ধির গতি বাড়তে থাকায় যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক এখনই নীতি সুদ হার কমানোর সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে। এতে ব্যাংকগুলোর ঋণ নেওয়া কমলেও বিনিয়োগকারীরা শঙ্কামুক্ত হয়েছেন। ফলে বাজারে অর্থের বন্যা হয়েছে, বেড়েছে ডলারের বিনিময় হার। এবছর ডলারের দাম ৪ শতাংশ বেড়েছে।

মুদ্রার ট্রেড-ওয়েটেড বাস্কেট তথা ইউএস ডলার ইনডেক্স বা ছয়টি মুদ্রার বিপরীতে ডলারের যে মান নির্ধারণ করা হয়, সেই সূচকে এই পরিমাপ করা হয়েছে। সম্প্রতি এই সুচকে ডলার গত পাঁচ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ ১০৬ দশমিক ৩ পয়েন্টে পৌঁছেছে।

ফেডারেল রিজার্ভ গত দুই বছর ধরে ব্যাপকহারে নীতি সুদহার বাড়ানোর কারণে তা এখন গত ২৩ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে। তা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্রে বেকারত্বের হার এখন কম। দেশটির পুঁজিবাজারও ঊর্ধমুখী। একের পর এক রেকর্ড গড়ছে। আমেরিকান অর্থনীতিতেও মন্দার কোনও লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না। সুদহার বেশি থাকার পরও যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি বেশ শক্তিশালী, তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে ডলারও হচ্ছে শক্তিশালী।

অর্থনীতির নিয়ম অনুযায়ী, বিশ্বের যে কোনও দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতি সুদহার বাড়ালে দেশটির অর্থনীতি মন্দার ঝুঁকিতে পড়ে। এর আগে যতবার নীতি সুদহার বাড়ানো হয়েছে, ততবারই যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি চাপে পড়েছিল। কিন্তু এবার বিস্ময়করভাবে তেমন পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে না।

জো বাইডেন ও ডোনাল্ড ট্রাম্প।

অন্যদিকে আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে সামনে রেখে ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান পার্টি উভয়ই যুক্তরাষ্ট্রের উৎপাদন বাড়ানোর জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। ফলে বিশ্ব শক্তিশালী ডলারের ভূ-রাজনীতির একটি কঠিন সময়ের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের ডলার শক্তিশালী হওয়া মানে অন্যদের মুদ্রা দূর্বল হওয়া, যা এই পরিস্থিতিটিকে আরও কঠিন করে তুলেছে। ২০২৩ সালের শেষ নাগাদ যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি ২০১৯ সালের শেষের তুলনায় ৮ শতাংশ বড় ছিল। একই সময়ে যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি ও জাপানের প্রত্যেকের অর্থনীতি ২ শতাংশও বাড়েনি।

ডলারের বিপরীতে ইয়েন ৩৪ বছরের সর্বনিম্ন অবস্থানে রয়েছে। ইউরোর দাম বছরের শুরুতে ১.১০ ডলার থেকে ১.০৭ ডলারে নেমে এসেছে। কিছু ব্যবসায়ী এখন বাজি ধরছেন যে, আগামী বছরের শুরুতে ডলার ও ইউরোর মান সমান হয়ে যাবে।

এমন পরিস্থিতিতে নভেম্বরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প জিতলে যুক্তরাষ্ট্র-চীন সংঘর্ষের পটভুমি তৈরি হবে।

শক্তিশালী ডলার আমেরিকান রপ্তানির দাম বাড়ায় এবং আমদানির দাম কমিয়ে দেয়, যা দেশের ক্রমাগত বাণিজ্য ঘাটতির পথকে প্রশস্ত করে তোলে, যা বহু দশক ধরে ট্রাম্পের একটি জুজুবুড়ি। ট্রাম্পের সময় চীনের ওপর শুল্ক আরোপের স্থপতি ছিলেন রবার্ট লাইটহাইজার। পলিটিকোর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তিনি ডলারকে দুর্বল করতে চান। বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন মুদ্রার বিষয়ে কোনও প্রকাশ্য ঘোষণা দেননি, তবে শক্তিশালী ডলার তার উৎপাদন বাড়ানোর কর্মসূচিকে জটিল করে তুলবে।

শক্তিশালী ডলার অন্য দেশের রপ্তানিকারকদের জন্যও ভালো যাদের খরচ অন্যান্য মুদ্রায় নির্ধারিত হয়। কিন্তু উচ্চ আমেরিকান সুদের হার এবং শক্তিশালী ডলার আমদানিকৃত মুদ্রাস্ফীতি তৈরি করে, যা এখন তুলনামূলকভাবে তেলের উচ্চ দামের কারণে বেড়েছে।

উপরন্তু, যে কোম্পানিগুলো ডলারে ঋণ করেছে, তাদেরও আরও বেশি অর্থ পরিশোধ করতে হচ্ছে। ১৮ এপ্রিল আইএমএফ প্রধান ক্রিস্টালিনা জর্জিভা বিশ্বব্যাপী আর্থিক স্থিতিশীলতার ওপর এই পরিস্থিতিগুলোর প্রভাব সম্পর্কে সতর্ক করেছিলেন।

অনেক দেশেরই পর্যাপ্ত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রয়েছে, যা তারা তাদের নিজেদের মুদ্রাকে শক্তিশালী করার জন্য বিক্রি করতে পারে। যেমন, জাপানের কাছে ১.৩ ট্রিলিয়ন ডলার, ভারতের কাছে ৬৪৩ বিলিয়ন ডলার, ও দক্ষিণ কোরিয়ার কাছে ৪১৯ বিলিয়ন ডলার আছে। তবে তাদের মুদ্রার এই শক্তিবৃদ্ধি স্থায়ী হবে না।

২০২২ সালে বিক্রি বাড়ায় ডলারের শক্তিশালীকরণ প্রক্রিয়া ধীর হয়ে গেলে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ সুদের হার বাড়াতে শুরু করে, তারা এটি বন্ধ করেনি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং অর্থ মন্ত্রণালয়গুলো নিস্ফল মারামারি করে তাদের হোল্ডিং নষ্ট করার জন্য আগ্রহী নয়।

ডলারের মূল্যবৃদ্ধি ঠেকানোর জন্য আরেকটি বিকল্প হল আন্তর্জাতিক সমন্বয়। গত ১৬ এপ্রিল এর সূচনা দেখা গিয়েছিল, যখন আমেরিকা, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার অর্থমন্ত্রীরা ইয়েন ও ওয়ানের দরপতন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। এরপর হয়ত মুদ্রা দুটির আরও দুর্বল হওয়া ঠেকাতে সরাসরি হস্তক্ষেপ করা হতে পারে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের যৌথ বিক্রির মাধ্যমে।

তবে এই দেশগুলো যতটা একই পৃষ্ঠায় থাকতে চায় না কেন, ততটাই অর্থনীতি অনিবার্যভাবে তাদের আলাদা করে তুলছে। সর্বোপরি, ইয়েন ও ওনের দুর্বলতা যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য দেশের মধ্যে নীতি সুদের হারের ব্যবধানের কারণেই বাড়ছে।

মার্কিন ডলার

দক্ষিণ কোরিয়ার দুই বছরের সরকারি বন্ডে নীতি সুদের হার প্রায় ৩.৫ শতাংশ এবং জাপানের মাত্র ০.৩ শতাংশ। অথচ যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি বন্ডে এখন সুদের হার ৫ শতাংশের বেশি। যদি সুদের হার আমেরিকাতে লক্ষণীয়ভাবে বেশি থাকে, তাহলে মুনাফা চাওয়া বিনিয়োগকারীরা একটি সরল পছন্দের মুখোমুখি হন এবং তাদের সিদ্ধান্তগুলো ডলারকে শক্তিশালী করে।

তারপরে এমন দেশ রয়েছে যাদের সঙ্গে আমেরিকার সহযোগিতা করার সম্ভাবনা কম।

গোল্ডম্যান স্যাকসের মতে, চীন মার্চ মাসে ৩৯ বিলিয়ন ডলার বা তার বেশি বৈদেশিক মুদ্রার বহিঃপ্রবাহ দেখেছে, কারণ বিনিয়োগকারীরা দেশটির ক্ষয়িষ্ণু অর্থনীতি দেখে পালিয়ে যাচ্ছে। ২০১৬ সাল থেকে শুরু করে এক মাসে সর্বোচ্চ বৈদেশিক মুদ্রা হারানোর হিসেবে মার্চ মাস ছিল চতুর্থতম।

এবছরের শুরু থেকেই ডলারের বিপরীতে চীনের মুদ্রা ইউয়ান ক্রমাগত দুর্বল হয়েছে এবং গত মার্চের মাঝামাঝি থেকে আরও দ্রুত দুর্বল হয়েছে। চীনের মুদ্রায় ডলারের দাম বেড়ে ৭.১৮ ইউয়ান থেকে বেড়ে ৭.২৫ ইউয়ান হয়েছে।

ব্যাংক অব আমেরিকার আশা, সেপ্টেম্বরের মধ্যে এক ডলারের দাম ৭.৪৫ ইউয়ানে পৌঁছাবে, যখন আমেরিকার নির্বাচনী প্রচার তুঙ্গে থাকবে। এটি ২০০৭ সালের পর ইউয়ানকে সবচেয়ে দুর্বল করে দেবে, যা চীন সরকারের রপ্তানি বৃদ্ধির প্রচেষ্টাকে আরও উৎসাহিত করবে। সস্তা চীনা বৈদ্যুতিক যানবাহন আরও সস্তা হতে পারে, যা আমেরিকান রাজনীতিবিদদের ক্ষুব্ধ করবে।

এমনকি আমেরিকার সুরক্ষাবাদীরাও অন্তত কিছু সময়ের জন্য মিত্রদের দুর্বল মুদ্রা উপেক্ষা করতে ইচ্ছুক হতে পারে। কিন্তু চীনের জন্য তাদের সেই সম্ভাবনা কম। এতে চীনের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের আরও শুল্ক ও নিষেধাজ্ঞার ঝুঁকি বাড়বে এবং এমনকি আমেরিকার মুদ্রা নিয়ে কারসাজি করাদের তালিকায়ও ফের চীনের নাম উঠতে পারে।

চীনও এরইমধ্যে ফেডারেল রিজার্ভের ট্রেজারি বিল কেনা কমিয়ে দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে তার বিনিয়োগ কমিয়ে আনতে শুরু করেছে।

যতদিন আমেরিকার অর্থনীতি ভালো থাকবে, ততদিন ডলার শক্তিশালী থাকবে। যতক্ষণ না আমেরিকান রাজনীতিকরা এটিকে উদ্বেগের কারণ হিসাবে দেখবেন, বাণিজ্য উত্তেজনা বাড়বে।

তথ্যসূত্র : দ্য ইকোনমিস্ট

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত