Beta
সোমবার, ৬ মে, ২০২৪
Beta
সোমবার, ৬ মে, ২০২৪

কলাম

ডলারের জোগান না বাড়লে বড় ঘাটতি তৈরি হবে

জাহিদ হোসেন। প্রতিকৃতি অঙ্কন: সব্যসাচী মজুমদার।

আমদানি কমছেই। রপ্তানি আয় ও প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স বাড়ছে। আর এতে বাজারে ডলারের সরবরাহ বেড়েছে, দামও কমতে শুরু করেছে। চাহিদা বাড়ায় কয়েক দিন আগেও ১২৪ টাকা পর্যন্ত দরে রেমিটেন্সের ডলার কিনেছে ব্যাংকগুলো; এখন কিনছে ১১৪ টাকায়। কার্ব মার্কেটেও ডলারের দর ১২০ টাকার নিচে নেমে এসেছে।

মাস খানেক আগেও ১২৬/১২৭ টাকায় বিক্রি হতো। সব মিলিয়ে ডলারের বাজারে অস্বস্তি কিছুটা কমেছে। এই ধারা ধরে রাখতে পারলে দুই বছর ধরে চলা ডলারের অস্থির বাজারে স্বস্তি ফিরে আসবে। যার ইতিবাচক ধারা অর্থনীতিতেও পড়বে।

২০২২ সালের মার্চ পর্যন্ত প্রায় এক দশক ধরে দেশে মুদ্রার বিনিময় দর একটি স্থিতিশীল অবস্থানে ছিল, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো যার সুবিধা পেয়েছে। কিন্তু, রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে বিশ্ববাজারে পণ্য ও কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়ায় মার্কিন ডলারের বিপরীতে দ্রুত টাকার অবমূল্যায়ন ঘটতে থাকে। ফলে মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই প্রতি ডলারের দাম ৮৫/৮৬ টাকা থেকে বেড়ে ১০০ টাকা ছাড়িয়ে যায়। রপ্তানিকারক, আমদানিকারক এবং রেমিটেন্স প্রেরকদের মতো বিভিন্ন খাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একাধিক বিনিময় হার বাস্তবায়ন সত্ত্বেও ডলারের বিপরীতে টাকার পতন অব্যাহত থাকে। এত দিনে এসে মনে হচ্ছে শঙ্কার কালো মেঘ কেটে গেছে; আশার আলো উঁকি দিচ্ছে।

এখন সার্বিকভাবে চাহিদা হ্রাস পাওয়ায় অনেক ব্যাংকই আর চড়া দামে ডলার কিনছে না। দাম আরও বাড়বে, এই আশায় প্রবাসী বাংলাদেশিসহ যারা ডলার সঞ্চয় করে রেখেছিলেন, টাকার মূল্য বাড়তে থাকায় তারাও সেসব ডলার বাজারে ছাড়তে শুরু করেছেন। চাহিদার তুলনায় দেশে ডলার আসছে বেশি। দেশের অর্থনীতির জন্য এটা শুভ সংকেত।

২০২৩ সালের শেষ প্রান্তিকে দেশের মুদ্রাবাজারের বিনিময় দরে নজিরবিহীন অস্থিতিশীলতা দেখা দেয়, ৭ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচনের পরে বাজারে কিছুটা স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসে, তখন সংশ্লিষ্টরাও কিছুটা আত্মবিশ্বাস ফিরে পান। এখন সার্বিকভাবে চাহিদা হ্রাস পাওয়ায় অনেক ব্যাংকই আর চড়া দামে ডলার কিনছে না। দাম আরও বাড়বে, এই আশায় প্রবাসী বাংলাদেশিসহ যারা ডলার সঞ্চয় করে রেখেছিলেন, টাকার মূল্য বাড়তে থাকায় তারাও সেসব ডলার বাজারে ছাড়তে শুরু করেছেন। চাহিদার তুলনায় দেশে ডলার আসছে বেশি। দেশের অর্থনীতির জন্য এটা শুভ সংকেত।

দেশে আসা রেমিটেন্স প্রবাহ বাড়ছে। গত পাঁচ মাসে (অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি) গড়ে ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিটেন্স এসেছে। ফেব্রুয়ারি মাসে ১ দশমিক ১৭ বিলিয়ন ডলার এসেছে; আগের মাস জানুয়ারিতে এসেছিল ২ দশমিক ১১ বিলিয়ন ডলার। মার্চ মাসের প্রথম ১৫ দিনে ১ বিলিয়ন ডলারের বেশি এসেছে। রোজা ও ঈদকে সামনে রেখে রেমিটেন্স প্রবাহ আরও বাড়ার আশা করা হয়েছিল। কিন্তু মার্চ মাস শেষে দেখা গেল ১.৯৯ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স দেশে এসেছে। সে হিসাবে এটা চলতি বছরের প্রথম তিন মাসের মধ্যে সবচেয়ে কম।

রপ্তানি আয়ও ঊর্ধ্বমুখী, ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত টানা তিন মাস ৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি রপ্তানি আয় দেশে এসেছে। অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই দুই সূচকের উত্থান দেশের মুদ্রা বিনিময়ের বাজারে আস্থা ফেরাতে সহায়ক ভূমিকা রেখেছে। আর এতে বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভের যে পতনের ধারা ছিল, সেটাও ঠেকানো যাবে বলে মনে হচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের কিছু পদক্ষেপও মুদ্রা বাজারে আস্থা ফেরাতে অবদান রেখেছে। সম্প্রতি মুদ্রা অদলবদল বা সোয়াপ ব্যবস্থা চালু করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর মাধ্যমে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে ডলারের বিনিময়ে টাকার অদলবদল করতে পারছে। কারেন্সি সোয়াপের আওতায় ডলারের স্পট রেট অনুযায়ী ডলার নিয়ে ব্যাংকগুলোকে টাকা ধার দিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ পুনর্গঠন এবং স্থানীয় মুদ্রার ওপর তারল্যের চাপ কমানো— মূলত এই দুই উদ্দেশ্যে এই উদ্যোগ নেওয়া হয়। দেশের বৈদেশিক মুদ্রা বাজার (ফরেক্স মার্কেট) স্থিতিশীল করতে এটি গুরুত্বপূর্ণ একটি উদ্যোগ বলে আমি মনে করি।

রপ্তানি আয়ও ঊর্ধ্বমুখী, ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত টানা তিন মাস ৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি রপ্তানি আয় দেশে এসেছে। অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই দুই সূচকের উত্থান দেশের মুদ্রা বিনিময়ের বাজারে আস্থা ফেরাতে সহায়ক ভূমিকা রেখেছে। আর এতে বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভের যে পতনের ধারা ছিল, সেটাও ঠেকানো যাবে বলে মনে হচ্ছে।

তবে এটাও মনে রাখতে হবে, ডলারের বাজার অস্থির হওয়ার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের কিছু ভুলও ছিল। সংকটের মধ্যে দাম নির্ধারণের যেসব নীতিগত পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল, তা পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করেছে। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরের পর থেকে ডলার সংকটের ক্ষেত্রে আমরা যেসব নীতিগত পদক্ষেপ দেখেছি, আমি বলব এটা ছিল ভুল দিকের পদক্ষেপ, যা সংকটকে আরও গভীর করেছে। উৎস অনুযায়ী ডলারের একেক রকম দাম নির্ধারণ করা হয়। রপ্তানি আয়, রেমিটেন্সে আলাদা দর, বাংলাদেশ ব্যাংকের দর আবার আলাদা।

লেনদেনে ভারসাম্য (ব্যালান্স অব পেমেন্ট) বর্তমানে ভালো অবস্থায় থাকলেও বিদেশি ঋণ-সহায়তার (ফরেন এইড) পরিমাণ কিন্তু কমে গেছে। ঋণ পরিশোধের পরিমাণ বাড়ায় চাপটা বাড়ছে। রপ্তানি আয় ও রেমিটেন্সের পাশাপাশি কম সুদের বিদেশি ঋণ বাড়ানোর দিকেও এখন নজর দিতে হবে। ট্রেড ক্রেডিট ও বায়ার ক্রেডিটের ক্ষেত্রে ফারাকটা আগের চেয়ে বড় হওয়ায় এবং অজ্ঞাতে ডলার বাইরে যাওয়ার পরিমাণ বাড়ায় ডলার সংকট থেকে গেছে। অনেক সময় মানি লন্ডারিং চিহ্নিত করা কঠিন হলেও পদক্ষেপ নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। আমরা অনেক কথা শুনি, কিন্তু সেভাবে পদক্ষেপ দেখি না।

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, মেট্রোরেল, কর্ণফুলী টানেলসহ বিভিন্ন প্রকল্পের বিদেশি ঋণের রেয়াতি সময় (গ্রেস পিরিয়ড) শেষ হয়ে যাচ্ছে। ঋণ পরিশোধের সময় চলে আসছে। কোনও কোনও প্রকল্পের গ্রেস পিরিয়ড শেষ হয়ে গেছে। এসব কারণে বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপ আরও বাড়বে। ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে বিদেশি ঋণ পরিশোধে টাকার অঙ্কেও খরচ বেড়ে যাচ্ছে, যা বাজেটের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করছে। সে অনুযায়ী, রাজস্ব আদায় হচ্ছে না। ডলারের জোগান না বাড়লে বৈদেশিক লেনদেনে বড় ঘাটতি তৈরি হবে।

তড়িঘড়ি করেই ব্যাংক একীভূতকরণের কাজটা শুরু হয়ে গেল। পদ্মা-এক্সিম দিয়ে শুরু হলো। এখন ভালোয় ভালোয় এই কাজটা সুন্দর-পরিচ্ছন্নভাবে সম্পন্ন হলেই হয়। এক্ষেত্রে কিন্তু অনেক প্রশ্ন রয়ে গেছে— পদ্মা ব্যাংকের বড় অঙ্কের খেলাপি ঋণের কী হবে? কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চাকরি থাকবে তো? আমানতকারীদের কোনও ক্ষতি হবে না তো? এ সব প্রশ্ন বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংককে পদ্মা-এক্সিমসহ অন্য ব্যাংকগুলোর মার্জারের কাজটা ভালোভাবে সম্পন্ন করতে হবে।

এবার ব্যাংকিং খাতের অন্য কয়েকটি বিষয় নিয়ে আলোকপাত করা প্রয়োজন বলে মনে করছি। এখন আর্থিক খাতের সবচেয়ে বড় আলোচনার বিষয় হচ্ছে, দুর্বল ব্যাংকগুলোকে সবল ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হওয়া। বলা হচ্ছে, ৮/১০টি খারাপ ব্যাংককে ভালো ব্যাংকের সঙ্গে মার্জার করা হবে। ইতোমধ্যে সে প্রক্রিয়াও শুরু হয়ে গেছে। ১৮ মার্চ পদ্মা ব্যাংক ও এক্সিম ব্যাংকের একীভূত হওয়ার বিষয়ে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই হয়েছে। চুক্তি সই শেষে এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার সাংবাদিকদের বলেছেন, পদ্মা ব্যাংক নামে আর কোনও ব্যাংক থাকছে না। একীভূত হয়ে এক্সিম ব্যাংক নামে চলবে। ব্যাংক একীভূত করা হলেও কোনও কর্মকর্তা-কর্মচারী চাকরি হারাবেন না। তবে পদ্মা ব্যাংকের কোনও পরিচালক এক্সিম ব্যাংকের পরিচলনা পর্ষদে থাকবেন না।

তড়িঘড়ি করেই ব্যাংক একীভূতকরণের কাজটা শুরু হয়ে গেল। পদ্মা-এক্সিম দিয়ে শুরু হলো। এখন ভালোয় ভালোয় এই কাজটা সুন্দর-পরিচ্ছন্নভাবে সম্পন্ন হলেই হয়। এক্ষেত্রে কিন্তু অনেক প্রশ্ন রয়ে গেছে— পদ্মা ব্যাংকের বড় অঙ্কের খেলাপি ঋণের কী হবে? কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চাকরি থাকবে তো? আমানতকারীদের কোনও ক্ষতি হবে না তো? এ সব প্রশ্ন বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংককে পদ্মা-এক্সিমসহ অন্য ব্যাংকগুলোর মার্জারের কাজটা ভালোভাবে সম্পন্ন করতে হবে। আর সেটা সম্ভব হলেই কেবল দীর্ঘদিন ধরে ভঙ্গুর অবস্থায় থাকা দেশের ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলার মধ্যে নিয়ে আসা সম্ভব হবে।

ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে ১৭ দফার রোডম্যাপ ঘোষণা করেছে তাতে এই ব্যাংক একীভূতকরণের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করা হয়েছে। একইসঙ্গে বিশাল খেলাপি ঋণ কমানোরও ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু একটা বিষয় মনে রাখতে হবে, বিদেশ ভ্রমণ বন্ধের মতো হালকা পদক্ষেপের ভয় দেখিয়ে ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের কাছ থেকে ঋণ আদায় করা যাবে না। সত্যিকার অর্থেই খেলাপি ঋণ কমাতে হলে, ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপিদের কাছ থেকে ঋণ আদায় করতে হলে, বাংলাদেশ ব্যাংককে আরও কঠোর হতে হবে। সরকারকে সেক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিবেচনার উর্দ্ধে উঠে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সহায়তা করতে হবে।

লেখক: বিশ্ব ব্যাংক, ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ।
ইমেইল: zhdhaka54@gmail.com

ad

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত