Beta
বৃহস্পতিবার, ৯ মে, ২০২৪
Beta
বৃহস্পতিবার, ৯ মে, ২০২৪

ধনীদের শীর্ষে মুকেশ আম্বানি, ভাই অনিল কোথায় হারালেন

বাবার মৃত্যুর পর রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান হন মুকেশ আম্বানি আর ছোট ভাই অনিল আম্বানি ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব নেন।
বাবার মৃত্যুর পর রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান হন মুকেশ আম্বানি আর ছোট ভাই অনিল আম্বানি ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব নেন।

ষোল বছর আগেও বিশ্বে শীর্ষ ধনীর তালিকায় ছিল অনিল আম্বানির নাম। ২০০৮ সালে ফোর্বসের তালিকায় ৬ নম্বরে ছিল তার নাম। তার তখন ৪২ বিলিয়ন ডলারের সম্পদ। সেবার ৪৩ বিলিয়ন ডলারের সম্পদ নিয়ে তার বড় ভাই মুকেশ ছিলেন তালিকায় ৫ নম্বরে। অর্থাৎ দুই ভাই ছিলেন পাশাপাশি।

২০২৪ সালে সেই ফোর্বসের শীর্ষ তালিকায় অনিলের নামই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বিশ্ব তো বটেই ভারতের শীর্ষ ধনীর তালিকায়ও নেই তার নাম। ভারতীয়দের মধ্যে ১০০ নম্বরে যে রামস্বামী পরিবারের নাম, তাদের সম্পদমূল্য ২ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ অনিলের সম্পদ তার চেয়েও কম।

আর ভারতের ধনকুবেরের তালিকায় ১ নম্বরে মুকেশ আম্বানির নাম, তার সম্পদের মূল্য ৯২ বিলিয়ন ডলার। ভারতের শীর্ষ ধনী মুকেশ বিশ্বের ধনকুবেরদের তালিকায়ও এবার আছেন ৯ নম্বরে।

মুকেশের ধনের বাড়-বাড়ন্ত এখন বিশ্বজুড়েই আলোচিত। গত মাসেই ছোট ছেলের প্রাক-বিয়ের অনুষ্ঠানে ১ হাজার ২০০ কোটি রুপির বেশি খরচ করে তাক লাগিয়ে দেন তিনি।

পেট্রোকেমিক্যাল, জ্বালানি, বস্ত্র ও টেলিকম খাতে বিনিয়োগ করে ১১ হাজার ৬০০ কোটি ডলার সম্পদের মালিক প্রতিষ্ঠান রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক এখন মুকেশ।

অথচ এই শতকের গোড়াতে অনিলকেই সাফল্যের বাতিঘর হিসেবে দেখা হতো। আলোচনাও হতো তাকে নিয়ে। কিন্তু ধনকুবেরদের নিয়ে আলোচনায় এখন আর খুঁজেই পাওয়া যাচ্ছে না তাকে।

কোথায় হারালেন তিনি? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে যেতে হবে ২০০২ সালে।

আম্বানি সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা হয় ধীরুভাই আম্বানির হাত ধরে। ১৯৫৮ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন রিলায়েন্স গ্রুপ, তাই কালে মহীরুহের রূপ নেয়। এই ধীরুভাইয়ের দুই ছেলে, বড়জন মুকেশ, ছোটজন অনিল।

১৯৮৬ সালে প্রথম স্ট্রোকের পর দুই ছেলের হাতে রিলায়েন্সের দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছিলেন ধীরুভাই। দুই ভাই একসঙ্গে ব্যবসা চালিয়েও যাচ্ছিলেন। কিন্তু ২০০২ সালে ধীরুভাইয়ের মৃত্যুর পর বাধে গোল।

মৃত্যুর আগে কোনও উইল করে যাননি ধীরুভাই। তার মৃত্যুর পর রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান হন বড় ছেলে মুকেশ, অনিল হন ব্যবস্থাপনা পরিচালক।

তবে দুই ভাইয়ের মধ্যে ব্যবসা পরিচালনা নিয়ে তীব্র মতবিরোধ শুরু হয়। একপর্যায়ে ২০০৫ সালের ডিসেম্বরে রিলায়েন্স গ্রুপই ভেঙে যায়।

মুকেশ তখন রিলায়েন্সের তেল, গ্যাস, পেট্রোকেমিক্যাল, রিফাইনিং ও ম্যানুফ্যাকচারিংয়ের নিয়ন্ত্রণ নেন। অন্যদিকে রিলায়েন্স কমিউনিকেশন্স, রিলায়েন্স পাওয়ার, রিলায়েন্স ক্যাপিটাল, রিলায়েন্স নেভাল, রিলায়েন্স হোম ফিন্যান্স, রিলায়েন্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার পড়ে অনিলের ভাগে।

রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান হওয়ার পর এটির টেলিকম ব্যবসা মুকেশ নিজের হাতে দাঁড় করিয়েছিলেন। কিন্তু অনিল তা নিয়ে নেন।

তখন মুকেশের চেয়ে অনিলের নিয়ন্ত্রণে থাকা ব্যবসায়িক খাতগুলোরই ছিল রমরমা অবস্থা। অনিল টেলিকম ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিতে চেয়েছিলেন, কারণ সে সময় টেলিকম ছিল ব্যাপক সম্ভাবনাময়। তার প্রতিফলনও দ্রুতই দেখা যায়।

ব্যবসায় বাড় বাড়ন্ত, সত্তর ও আশির দশকের পর্দা কাঁপানো অভিনেত্রী টিনা মুনিম স্ত্রী, সব মিলিয়ে অনিল থাকতেন প্রচারের আলোয়। সেই অনিল এখন সবার আড়ালে।

বাবা ধীরুভাই আম্বানির সঙ্গে মুকেশ আম্বানি ও অনিল আম্বানি।

অনিলের পতনের নেপথ্যে

বড় ভাই মুকেশকে টেক্কা দিয়ে কয়েক বছরের মধ্যে ব্যবসা ও মুনাফার পরিধি বিস্তৃত করেছিলেন অনিল। কিন্তু সমৃদ্ধির চূড়ায় থাকা অনিলের ব্যবসা ২০০৮ সালের মন্দায় প্রথম বড় ধরনের ধাক্কা খায়। এই মন্দা তাকে ৩ হাজার ১০০ কোটি ডলার ক্ষতির মুখে ফেলে।

এছাড়া উচ্চাকাঙ্ক্ষী অনিল কোনও কৌশল ঠিক না করেই প্রতিযোগিতায় নামতে পছন্দ করতেন, যা ছিল তার পতনের অন্যতম কারণ।

২০০৮ সালের মন্দার আগে অনিলের টেলিকম কোম্পানি রিলায়েন্স কমিউনিকেশন্স ছিল ভারতের প্রধান মোবাইল সার্ভিস প্রোভাইডার। মন্দায় ব্যাপক আর্থিক ক্ষতির ধাক্কা সামাল দিতে এবং দেনা মেটাতে দক্ষিণ আফ্রিকাভিত্তিক টেলিকম কোম্পানি এমটিএনের সঙ্গে রিলায়েন্স কমিউনিকেশন্সকে একীভূত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন অনিল।

এছাড়া কোনও উপায়ও ছিল না তার। ঋণের বোঝা তখন এতটাই ভারী ছিল। আইনি নানা জটিলতার কারণে দক্ষিণ আফ্রিকার কোম্পানিটির সঙ্গে চুক্তি করতে ব্যর্থ হন অনিল।

দুর্ভাগ্য যেন সে সময় অনিলের ‍পিছু ছাড়ছিল না। মন্দা, এরপর আইনি জটিলতার কারণে বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করতে না পারার ধাক্কা হজম করতে না করতে ২০১১ সালে আরেক বিপদ তার দরজায় কড়া নাড়ে।

টুজি কেলেঙ্কারির জেরে অনিলের টেলিকম কোম্পানির শীর্ষ কর্মকর্তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। একসময়ের ধনকুবেরকেও জিজ্ঞাসাবাদের মুখে পড়তে হয়। এসবের গুরুতর প্রভাব পড়ে অনিলের কোম্পানিগুলোর শেয়ারমূল্যে।

ঋণের বোঝা আর কেলেঙ্কারিতে জেরবার অনিল ব্যবসাকে দাঁড় করানোর চেষ্টা হিসেবে ২০১২ সালে চীনের তিনটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক থেকে ব্যক্তিগত জামানতের ভিত্তিতে ১২০ কোটি ডলার ঋণ নেন। শেষ রক্ষা হয়নি। কেবল পাওনাদারদের তালিকাই দীর্ঘ হয়।

২০১৬ সালে বড় ভাই মুকেশ যখন নতুন কোম্পানি জিও গঠন করে তার মাধ্যমে টেলিকম খাতে প্রবেশ করেন, তখন অনিলের টেলিকম ব্যবসা আরও ধরাশায়ী হয়। রিলায়েন্স কমিউনিকেশন্স একপর্যায়ে নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করে।  

অনিলের পরিস্থিতি কতটা শোচনীয় পর্যায়ে চলে যায়, তা বোঝা যায় ২০২০ সালের একটি ঘটনা। সে বছর লন্ডনের এক আদালতের শুনানিতে তাকে হাজির হতে হয়েছিল। কারণ ২০১২ সালে চীনের সেই তিন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণ তিনি পরিশোধ করতে না পারায় তার বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দেয় ব্যাংকগুলো। শুনানিতে অনিল দাবি করেন, গয়নাগাটি বেচে আইনজীবী নিয়োগ করেছেন তিনি।

গত মার্চে অনিলের রিলায়েন্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার কোম্পানিকে সম্পদ বিক্রি করতে নিষেধ করে দিল্লি হাইকোর্ট। এই কোম্পানির সম্পদের পরিমাণ ১১০০ কোটি টাকার বেশি।

হাইকোর্ট বলেছে, এই সম্পদ কোনোভাবেই অনিল বিক্রি করতে পারবেন না বা অন্য কোথাও স্থানান্তর করতে পারবেন না।

চীনের সাংহাই ইলেকট্রিক গ্রুপের সঙ্গে রিলায়েন্স ইনফ্রাস্ট্রাকচারের সালিশি বিরোধের জন্য নিরাপত্তা অর্থ হিসেবে এই ১১০০ কোটি টাকার সম্পদ জমা রাখার নির্দেশ দেয় দিল্লি হাইাকোর্ট।

সব মিলিয়ে বড় ভাই মুকেশ ও তার পরিবার যেখানে তাদের সম্পদ-প্রতিপত্তির জন্য দুদিন পরপর খবরের শিরোনাম হচ্ছেন, সেখানে এখন ছোট ভাই অনিলকে নিয়ে মাথাই ঘামায় না সংবাদমাধ্যমগুলো।

ছোট ছেলে অনন্ত আম্বানির প্রাক-বিয়ে অনুষ্ঠানে পুরো মুকেশ আম্বানি পরিবার।

অনিলের পরিবার

মুকেশের স্ত্রী নীতা আম্বানি এবং তাদের তিন ছেলে-মেয়ে আকাশ, ইশা আর অনন্তকে নিয়ে পত্রপত্রিকা থেকে সোশাল মিডিয়ায় ব্যাপক আলোচনা হলেও অনিল-টিনা দম্পতির দুই ছেলে জয় আনমোল আম্বানি ও জয় আনশুল আম্বানিকে নিয়ে খুব একটা আলোচনা হয় না।

অনন্তর প্রাক-বিয়ে অনুষ্ঠানে অনিলের দুই ছেলে আনমোল ও আনশুলকে নিজেদের মালপত্র নিজেদের বহন করতে দেখা যায়। এনিয়ে সেসময় সরব ছিল সোশাল মিডিয়া।

অনিলের বড় ছেলে আনমোল বর্তমানে তার কোম্পানি রিলায়েন্স ক্যাপিটালের নির্বাহী পরিচালক। ২০১৮ সালে তিনি রিলায়েন্স নিপ্পন ও রিলায়েন্স হোমের বোর্ডে যোগ দেন। তার সম্পদের পরিমাণ ২০ হাজার কোটি টাকা।

দুই ছেলে আনমোল ও আনশুল, স্ত্রী টিনা আম্বানির সঙ্গে অনিল আম্বানি।

২০২২ সালে নিকুঞ্জ এন্টারপ্রাইজেস লিমিটেডের সাবেক চেয়ারম্যান প্রয়াত নিকুঞ্জ শাহের মেয়ে ক্রিশা শাহর সঙ্গে বিয়ে হয় আনমোলের।

আনমোলের ছোট ভাই আনশুল ২০১৭ সালে রিলায়েন্স ক্যাপিটলের নির্বাহী পরিচালক পদে নিয়োগ পান। খুড়ো মুকেশ আর জ্যাঠতুতো ভাই-বোন আকাশ, অনন্ত ও ইশার সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে বলে শোনা যায়।

তথ্যসূত্র: ডিএনএ ইন্ডিয়া, বিবিসি বাংলা, নিউজ মিনিট    

   

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ad

সর্বাধিক পঠিত