Beta
মঙ্গলবার, ৭ মে, ২০২৪
Beta
মঙ্গলবার, ৭ মে, ২০২৪

কোন সমুদ্রবন্দর নিয়ে আগ্রহ কাতারের

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানির উপস্থিতিতে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সই হয়। ছবি : পিআইডি
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানির উপস্থিতিতে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সই হয়। ছবি : পিআইডি

বাংলাদেশের সমুদ্রবন্দর ব্যবস্থাপনায় কাজ করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে কাতার।

মধ্যপ্রাচ্যের ধনী দেশটির আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানি বাংলাদেশ সফরের সময় মঙ্গলবার বাংলাদেশ নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে একটি সমঝোতা স্মারক সই করেছে, যেখানে বন্দর ব্যবস্থাপনা বা বন্দর পরিচালনার কথা বলা হয়েছে।

তবে সমঝোতায় কোনও সুনির্দিষ্ট বন্দর বা টার্মিনালের উল্লেখ নেই।

বন্দর ব্যবহারকারী ও শিপিং সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বন্দর ব্যবস্থাপনা নিয়ে কাতারের যে আগ্রহ. সেটি চট্টগ্রাম বন্দরে করার এখন সুযোগ নেই। কারণ চট্টগ্রাম বন্দরের নতুন নির্মিত পতেঙ্গা কন্টেইনার টার্মিনাল (পিসিটি) ইতোমধ্যে সৌদি আরবের রেড সি গেইটওয়েকে দিয়ে পরিচালনার জন্য চুক্তি স্বাক্ষর করেছে সরকার। মে মাস নাগাদ সেটি চালুর লক্ষ্য রয়েছে।

বন্দরের বাকি দুটি টার্মিনাল নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) ও চট্টগ্রাম কন্টেইনার টার্মিনাল (সিসিটি) ইতোমধ্যে বিদেশি আরেক অপারেটর প্রতিষ্ঠানকে দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে।

একইসঙ্গে কর্ণফুলী নদীর তীরে বন্দরের লালদিয়া এলাকায় ড্যানিশ কোম্পানি মায়ারস্ক লাইন একটি টার্মিনাল নিয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। সেটি দেওয়ার প্রক্রিয়াও চলছে।

এছাড়া বন্দরের অধীনে পতেঙ্গায় সাগরতীরে বে টার্মিনাল এলাকায় দুটি টার্মিনাল নির্মাণের জন্য দুবাইভিত্তিক ডিপি ওয়ার্ল্ড, সিঙ্গাপুরভিত্তিক পিএসএ সিঙ্গাপুরকে সামনে রেখে সরকার  এগোচ্ছে।

বাকি একটি টার্মিনাল বন্দর নিজেই পরিচালনা করবে।

এর বাইরে তেল খালাসের জন্য একটি টার্মিনাল নির্মাণের পরিকল্পনা আছে। সেটি করতে চাইছে বাংলাদেশের ওমেরা ট্যাংক টার্মিনাল।

বাকি থাকে মহেশখালী গভীর সমুদ্রবন্দর। সেই টার্মিনালের অবকাঠামো নির্মাণকাজ এখনও শুরু হয়নি। ২০২৬ সাল নাগাদ সেই সমুদ্রবন্দরের কার্যক্রম শুরুর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত আছে। জাপানের প্রতিষ্ঠান সেই টার্মিনাল নির্মাণ করছে।

চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর।
দেশের আমদানি-রপ্তানির প্রাণবিন্দু চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর।

চট্টগ্রাম বন্দরের এক কর্মকর্তা সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, কাতারের আমিরের বাংলাদেশ সফরের আগে চট্টগ্রাম বন্দরে টার্মিনাল পরিচালনার আর কোনও সুযোগ বাকি আছে কি না, জানতে চিঠি দিয়েছিল নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়। তাতে চট্টগ্রাম বন্দর সাফ জানিয়ে, এই মুহূর্তে সেই সুযোগ নেই। ফলে নির্দিষ্ট কোনও টার্মিনাল ছাড়াই বন্দরের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি করে কাতার।

মঙ্গলবার ‘মাওয়ানি কাতার’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দরের পক্ষে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় চুক্তি সই করে। 

‘মাওয়ানি কাতার’ হচ্ছে কাতারের বন্দর ব্যবস্থাপনা, শিপিং লাইন, লজিস্টিকস পরিচালনাকারী শীর্ষ প্রতিষ্ঠান। কাতারের সবচেয়ে বড় সমুদ্রবন্দর হাম্মাদ পোর্ট, পুরাতন দোহা পোর্ট, আল রুয়াইস পোর্ট পরিচালনা করে আসছে প্রতিষ্ঠানটি।

বন্দর ব্যবস্থাপনায় অভিজ্ঞ এই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানটিই বাংলাদেশে বন্দর ব্যবস্থাপনা করতে চায়। যদিও এই প্রতিষ্ঠানের কাতারের বাইরে বন্দর পরিচালনার অভিজ্ঞতা নেই।

সমুদ্রবন্দর ব্যবস্থাপনা নিয়ে সমঝোতা স্মারক সইয়ের পর কাতারের বাণিজ্য প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বাণিজ্য সম্প্রসারণ বিষয়ে বৈঠক করেন প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু এবং শীর্ষ বাণিজ্য সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি মাহবুবুল আলমসহ প্রতিনিধি দল। সেখানে বাণিজ্য সম্প্রসারণ, মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ), সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহন নিয়ে আলোচনা হয়।

জানতে চাইলে এফবিসিসিআই সভাপতি মাহবুবুল আলম সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “কাতার-বাংলাদেশ বন্দর ব্যবস্থাপনার যে সমঝোতা হয়েছে, সেটি একটি প্রাথমিক প্রক্রিয়া। এখানে সুনির্দিষ্ট কোনও বন্দর বা টার্মিনাল পরিচালনার কথা নেই।

“তবে যেহেতু কাতারের একটা বড় পোর্ট আছে, আর আমাদের গভীর সমুদ্রবন্দর তৈরি হচ্ছে। ফলে ঝোঁকটা ওই দিকেই থাকবে বলে আমাদের ধারণা।”

ট্রেড করিডোর নিয়ে আলোচনা

এফবিসিসিআই সভাপতি মাহবুবুল বলেন, “কাতার-বাংলাদেশ দুদেশের বন্দরের  মধ্যে একটি ‘ট্রেড করিডোর’ বিষয়ে আমরা কথা বলেছি। এই করিডোরে আমরা যেমন তাদের বন্দর ব্যবহারের বাড়তি সুবিধা পাব, তেমনি তারা আমাদের বন্দর ব্যবহার করে বাড়তি সুবিধা পাবে। দুপক্ষই লাভবান হয়ে কীভাবে বাণিজ্য আরও বাড়ানো যায় সেটি নিয়ে আমরা একমত হয়েছি।”

বৈঠক শেষে সালমান এফ রহমান সাংবাদিকদের বলেন, “দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য বৃদ্ধির উপায়গুলো খুঁজে বের করার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। আজকে ট্রেড অ্যান্ড কমার্স, বিনিয়োগ ও ব্যবসা বাণিজ্য নিয়ে কথা বলেছি। তারা বাংলাদেশে একটা ট্রেডিং করিডোর পাওয়ার বিষয়ে চিন্তা করছে। বলেছে, তোমাদের বন্দরটা আমরা দেখতে চাই। এখানে একটা ট্রেডিং করিডোর সৃষ্টি করা যায় কি না সেই সম্ভাবনা দেখব।”

তিনি বলেন, “কাতার একটা বিরাট বন্দর অলরেডি করেছে। সেখানে বন্দরকে ঘিরে একটা অর্থনৈতিক অঞ্চলও করেছে। সেই বন্দর এখনও আন্ডার ইউটিলাইজ (পূর্ণ সক্ষমতা কাজে লাগানো যাচ্ছে না)। বিপরীতে সিঙ্গাপুর বন্দরের এখন যে মোট টার্নওভার, সেটা জিসিসি বা আরব দ্বীপ অঞ্চলের রাষ্ট্রগুলোর চার থেকে পাঁচগুণ বেশি। এখন বাংলাদেশের বন্দরের সঙ্গে কাতারের বন্দরের একটা কানেক্টিভিটি করে কিছুটা ট্রেডিং সেদিকে নেওয়া যায় কি না সেটার সম্ভাব্যতা দেখতে হবে।”

বৈঠকে উপস্থিত বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “কাতার মূলত বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের কাতারের বন্দর ব্যবহার করতে বাড়তি সুবিধা দিতে চায়। তারা চায় কাতারের বন্দর দিয়ে বাংলাদেশিরা রপ্তানি পণ্য ইউরোপ-আমেরিকায় পাঠাক। কিন্তু সেটি সুফল মিলবে কিনা, অনেকগুলো সূচক, ব্যবহারকারী প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভরশীল।”

সাগরপথে পণ্য পরিবহন চুক্তির প্রভাব কী

মঙ্গলবার কাতারের সঙ্গে সাগরপথে পণ্য পরিবহনের একটি চুক্তিও হয় বাংলাদেশের। অর্থাৎ জাহাজে পণ্য পরিবহন এবং বন্দর ব্যবস্থাপনা মিলে মেরিটাইম সেক্টরে কাতার একটি বড় অংশীদার হতে চায় বাংলাদেশে। আগে থেকেই জ্বালানি খাতে বাংলাদেশের বড় অংশীদার কাতার।

কাতার থেকে বছরে ২৭৪ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করে বাংলাদেশ। এই আমদানি খরচের বড় অংশই ব্যয় হয় অবশ্য এলএনজি ও সার আমদানি খাতে। দেশটিতে রপ্তানি হয় প্রায় ৯ কোটি ডলারের পণ্য। রপ্তানি পণ্যের মধ্যে প্রাণ, স্কয়ারসহ বিভিন্ন শিল্পগ্রুপের খাদ্যপণ্য আছে। আছে প্রক্রিয়াজাত মাছ।

কিন্তু চট্টগ্রাম বন্দর থেকে সরাসরি কোনও জাহাজ সার্ভিস নেই কাতারে। চট্টগ্রাম থেকে রপ্তানি পণ্য প্রথমে শ্রীলংকার কলম্বো, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়ার পোর্ট কেলাঙ হয়ে জেবেল আলী বন্দরে পৌঁছায়। সেখান থেকে ছোট কন্টেইনার জাহাজে করে কাতারের বন্দরে যেতে হয়। ফলে সময় ও খরচ দুটোই লাগে বেশি। কাতারের সঙ্গে সাগরপথে পণ্য পরিবহন চুক্তি হওয়ায় এখন দেশদুটির মধ্যে সরাসরি জাহাজ সার্ভিস চালু হলে সুযোগটা কাজে লাগাতে পারবে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা।

জানতে চাইলে গ্যালাক্সি বাংলাদেশের হেড অব মার্কেটিং মুনতাসির রুবাইয়াত সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “বাংলাদেশ থেকে কাতারে সবচেয়ে বেশি রপ্তানি হয় তৈরি খাদ্যপণ্য। এসব পণ্যের সেখানে প্রচুর চাহিদা। এখন কাতার থেকে ডিউটি ফ্রি সুবিধা পেলে আমাদের এই বাজারকে অনেক বেশি সম্প্রসারণ করার সুযোগ তৈরি হবে।”

তিনি বলেন, বিশ্বের স্বনামধন্য রিটেইলারদের পণ্য বাংলাদেশ তৈরি হয়। কিন্তু সেগুলো যায় অন্যদেশ থেকে। এখন জাহাজ সার্ভিস চালু হলে সেই পুমা, এডিডাস, নাইকির মতো শপগুলোর শোরুমে বাংলাদেশ থেকে সরাসরি পণ্য পাঠানোর সুযোগ তৈরি হবে।

জয়েন্ট বিজনেস কাউন্সিল গঠন

দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক মজবুত ও জোরদার করার পাশাপাশি ব্যবসায়িক সহযোগিতা বৃদ্ধিতে জয়েন্ট বিজনেস কাউন্সিলের (জেবিসি) প্রতিষ্ঠা করেছে বাংলাদেশ ও কাতার।

মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানির উপস্থিতিতে এ সংক্রান্ত চুক্তিতে সই করে দেশের শীর্ষ বাণিজ্য সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ (এফবিসিসিআই) এবং কাতারের শীর্ষ বাণিজ্য সংগঠন কাতার চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ (কিউসিসিআই)।

এফবিসিসিআই সভাপতি মাহবুবুল আলম এবং কিউসিসিআই চেয়ারম্যান শেখ খলিফা বিন জসিম আল থানি নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের পক্ষে চুক্তিতে সই করেন। মূলত বাংলাদেশ ও কাতারের মধ্যে বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা বাড়াতে দুই দেশের ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের মধ্যে বাণিজ্য জোরদার করতে এই চুক্তি সই হয়।

এফবিসিসিআই সভাপতি মাহবুবুল আলম এই প্রসঙ্গে বলেন, বাংলাদেশ ও কাতারের মধ্যে জেবিসি প্রতিষ্ঠা দুই দেশের ব্যবসায়ীদের জন্য একটি নতুন সম্ভাবনা উন্মোচন করেছে। এ চুক্তির আওতায় কাতারের ব্যবসায়ীরা যেমন উপকৃত হবে তেমনি বাংলাদেশি ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের পক্ষেও কাতারের রপ্তানি বাজার ধরা আরও সহজতর হবে এবং কাতার থেকে জ্বালানিসহ প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি সহজ হবে।”

একইসঙ্গে জেবিসির মাধ্যমে কাতারের বিনিয়োগকারীদের বাংলাদেশে বিনিয়োগে উদ্বুদ্ধ করা হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

এফবিসিসিআই ও কিউবিসিসিআইর মধ্যে সম্পাদিত চুক্তি অনুযায়ী, বাংলাদেশ ও কাতারের ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের বাণিজ্য, বিনিয়োগ, প্রযুক্তি হস্তান্তর, সেবা এবং অন্যান্য শিল্প খাতে বাণিজ্য কার্যক্রম জোরদারের একটি প্ল্যাটফর্ম হয়ে উঠবে জয়েন্ট বিজনেস কাউন্সিল।

এফবিসিসিআই ও কিউসিসিআই উভয়ই দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য, অর্থনৈতিক সহযোগিতা এবং পরিষেবা সম্পর্কিত তথ্য বিনিময়ের মাধ্যমে উপকৃত হবে। পাশাপাশি দুই দেশের ব্যবসায়িক তথ্যের আদান-প্রদান, সংশ্লিষ্ট সরকারের কাছে সুপারিশ জমা দেওয়া, প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করাসহ অন্যান্য কার্যক্রম পরিচালনা করবে জেবিসি।

এছাড়া উভয় পক্ষই বাণিজ্য উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে আলোচনার জন্য যৌথ বৈঠক আয়োজন করতে পারবে। চুক্তি অনুযায়ী প্রয়োজনে এফবিসিসিআই ও কিউসিসিআই সাব-কমিটি ও টাস্কফোর্স গঠন করতে পারবে।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ad

সর্বাধিক পঠিত