শিক্ষা উপবৃত্তির টাকা দেওয়ার নাম করে বিভিন্ন ক্রেডিট কার্ড, ডেবিট কার্ড ও মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে প্রতারণা ও অর্থ আত্মসাতে জড়িত একটি চক্রের প্রধানসহ আটজনকে গ্রেপ্তারের কথা জানিয়েছে র্যাব।
সংস্থাটি বলছে, সাধারণ মানুষের এনআইডির অনুলিপি ও ফিঙ্গার প্রিন্ট দিয়ে নিবন্ধনকৃত সিম ৫০০ থেকে দুই হাজার টাকায় সংগ্রহ করে এ প্রতারণার কাজে ব্যবহার করে আসছে চক্রটি। প্রতারণার টাকা মূল চক্রের সদস্যের মধ্যে বণ্টন করা হয়। কমিশন বাবদ এজেন্টদের দেওয়া হয় নির্দিষ্ট একটা অংশ।
সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ও গোয়েন্দা কার্যক্রমের ভিত্তিতে ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, জামালপুর, কুমিল্লা ও ফরিদপুরসহ বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করেছে র্যাব-৫, ৪, ৮, ১০, ১১ ও ১৪ এর যৌথ দল।
সোমবার ঢাকার কারওয়ান বাজারে র্যাবের মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র্যাব-৫ এর অধিনায়ক (সিও) লে. কর্নেল মো. মুনীম ফেরদৌস।
গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন- চক্রটির প্রধান জাকির হোসেন হাওলাদার (৪৭) এবং সদস্য শামীম হোসেন (২৯), মোহাম্মদ জিহাদ (৩৪), আমির হামজা (২৬), আহাদ গাজী (২৪), মোস্তাফিজুর রহমান ওরফে জয় (২৬), বাপ্পি মোল্লা (২০) ও উসমান গনি মোল্লা (৩৩)।
র্যাব-৫ এর অধিনায়ক মুনীম ফেরদৌস জানান, সারা দেশে চক্রটির দুই হাজারের বেশি সক্রিয় এজেন্ট বা সদস্য রয়েছে। এক রকম শেয়ারবাজারের মতো দরকষাকষি করে তাদের হাজারে ৩০-৪০ টাকা কমিশনে প্রতারণার এই কাজ দেওয়া হয়। এজেন্ট হতে অগ্রিম দিতে হয় ৫০ হাজার টাকা। চক্রটির সঙ্গে জড়িত একটি মোবাইল অপারেটর কোম্পানির সিম কার্ড বিক্রেতারাও। তারা অন্যের নামে নিবন্ধনকৃত সিম বা বিক্রি করা সিম সংগ্রহ করে মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্ট খোলে।
তিনি বলেন, চক্রটি সম্প্রতি শিক্ষা উপবৃত্তির টাকা দেওয়ার নাম করে ক্রেডিট কার্ড, ডেবিট কার্ড ও মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে বিভিন্ন শিক্ষার্থীর অভিভাবকের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নেয়।
এ প্রসঙ্গে রাজশাহীর একটি ঘটনা তুলে ধরেন র্যাবের এই কর্মকর্তা। তিনি জানান, গত ২৪ মার্চ বোয়ালিয়া মডেল থানাধীন শালবাগান রাজশাহীর বিএনসিসি অফিসে অবস্থানকালে এক ভুক্তভোগীর মোবাইল নম্বরে অপরিচিত নম্বর থেকে ফোন আসে। তাকে মেয়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অ্যাকাউন্টের শাখায় কর্মরত মিজানুর রহমান পরিচয় দিয়ে বলা হয়, তার মেয়ে এসএসসি পরীক্ষায় গোল্ডেন এ প্লাস পাওয়ায় শিক্ষা উপবৃত্তির ২২ হাজার ৫০০ টাকা এসেছে।
ওই টাকা তার অ্যাকাউন্টে চলে যাবে মর্মে একটি ব্যাংকের এটিএম কার্ডের ষোল ডিজিটের নম্বর চাওয়া হয়। এরপর তিনি তার ১৬ ডিজিটের নম্বর দেন। তখন ফোনের অপর প্রান্ত থেকে ওটিপি যাওয়ার কথা বলা হয়। কিছু সময় পর ওই ব্যক্তির মোবাইলে তার অ্যাকাউন্ট থেকে চার বারে এক লাখ ৫০ হাজার ৫০০ টাকা তুলে নিয়ে যাওয়ার ম্যাসেজ আসে।
ওই ঘটনায় তিনি অজ্ঞাতপরিচয় কয়েকজনের বিরুদ্ধে আরএমপির বোয়ালিয়া মডেল থানায় মামলা করেন। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা জড়িতদের গ্রেপ্তারে র্যাব-৫ এর সহায়তা চান। পরে র্যাব-৫ জড়িতদের গ্রেপ্তারে নজরদারি বাড়ায়।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, চক্রের অন্যতম সমস্য শামীম হোসেন শুধু মাঠ পর্যায়ের মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা তুলে চক্রটির বিভিন্ন ব্যাংক অ্যাকাউন্টে পাঠাতেন। তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে র্যাব ঢাকার আশুলিয়ার এক বাড়িতে অভিযান চালায়। অভিযানে বিভিন্ন কোম্পানির সিম কার্ডসহ বেশ কয়েকটি মোবাইল সেট উদ্ধার করা হয়।
এরপর একে একে চক্রের প্রধান জাকিরসহ বাকিদের গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের কাছে থেকে ২৩টি মোবাইল সেট, ৩১০টি সিম কার্ড, নগদ ৩ লাখ ১২৭০ টাকা ও নয়টি ব্যাংক লেনদেনের স্লিপ উদ্ধার করা হয়। উদ্ধারকৃত প্রত্যেকটি সিম কার্ডে বিভিন্ন মোবাইল ব্যাংকিংয়ের অ্যাকাউন্ট রয়েছে।
এক প্রশ্নের জবাবে র্যাব-৫ এর অধিনায়ক বলেন, এই চক্রটি স্থানীয়ভাবে ওয়েলকাম বা হ্যালো গ্রুপ নামে পরিচিত। সারাদেশে চক্রটির ২ হাজারের বেশি এজেন্ট রয়েছে। এজেন্ট হতে ৫০ হাজার টাকা দিতে হয়। চক্রটির সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের ১৮৬১টি মোবাইল নম্বর শনাক্ত করা হয়েছে। এসব নম্বরে টাকা লেনদেন ও যোগাযোগ হয়েছে।
তিনি জানান, চক্রে যারা এজেন্ট হিসেবে নিয়োগ পান তারা প্রতি হাজারে ৩০ বা ৪০ টাকা কমিশন পান। চুক্তি অনুযায়ী এজেন্টের মোবাইল অ্যাকাউন্টে এই টাকা যায়। তবে ক্রেডিট কার্ড থাকে চক্রের প্রধানদের হাতে। টাকা ঢোকা মাত্রই তারা তুলে নেয়।
প্রতারণায় অন্যের সিম
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, চক্রটির সঙ্গে জড়িত একটি মোবাইল অপারেটর কোম্পানির সিম কার্ড বিক্রেতারা। তারা অন্যের নামে নিবন্ধনকৃত সিম বা বিক্রি করা সিম সংগ্রহ করে প্রতারণামূলক কাজে ব্যবহারের জন্য মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্ট খুলে দেয়।
একটি মোবাইল অপারেটর কোম্পানির সিম বিক্রেতা গ্রেপ্তারকৃত আহাদ গাজী।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আহাদ গাজী জানিয়েছেন, কোম্পানির টার্গেট দেওয়া থাকে দিনে ১০-১৫ সিম বিক্রির। না পারলে চাপে থাকতে হয়। এজন্য বিভিন্ন লোক আসলেই তারা ৫০-১০০ টাকায় সিম বিক্রি করেন। এই সিম বিনামূল্যেই দেওয়ার কথা।
সাধারণ মানুষের সংগৃহীত এনআইডির অনুলিপি ও ফিঙ্গার প্রিন্ট দিয়ে নিবন্ধন করে এসব সিম বিক্রি করে তারা। আবার কেউ সিম ফেরত দিলে সেটি এই প্রতারক চক্রের কাছে বিক্রি করে দেয়। ৫০০ থেকে দুই হাজার টাকায় এসব সিম সংগ্রহ করে প্রতারণার কাজে ব্যবহার করে আসছে চক্রটি।