Beta
বুধবার, ৮ মে, ২০২৪
Beta
বুধবার, ৮ মে, ২০২৪

নীতি-বিতর্ক

শ্রমিকের মজুরি গ্রেডে কারচুপি করছেন মালিকরা

জলি তালুকদার। প্রতিকৃতি অঙ্কন: সব্যসাচী মজুমদার

সম্প্রতি রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাকশিল্পের শ্রমিকদের মজুরি বেড়েছে। ২০১৮ সালে শেষবার মজুরি বৃদ্ধির ৫ বছর পর এই খাতের শ্রমিকদের নতুন মজুরি কাঠামো নির্ধারিত হয়েছে। এই নতুন মজুরি কাঠামোতে নূন্যতম মজুরি নির্ধারিত হয়েছে ১২,৫০০ টাকা। এর ফলে তীব্র শ্রম অসন্তোষের মধ্য দিয়ে নতুন বছর শুরু হয়েছে।

নতুন নির্ধারিত মজুরি শ্রমিকপক্ষের দাবিকৃত মজুরির অর্ধেক। এমনকি শ্রমিক ও মালিকপক্ষের বাইরে যারা তৃতীয় পক্ষ বলে নিজেদের দাবি করেন— এমন অনেক গবেষণা ও নীতি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান বাজার পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে অন্তত যতটুকু মজুরি না হলে শ্রমিকের পক্ষে খেয়েপড়ে বাঁচা সম্ভব নয় বলে জানিয়েছিল তার ধারে কাছেও নূন্যতম মজুরি পৌঁছায়নি। এই অতি অপ্রতুল মজুরিটাও মালিকপক্ষ যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করছে না।

তাই তৈরি পোশাকশিল্পে নতুন বছর শুরু হয়েছে শ্রমিকের হতাশার দীর্ঘশ্বাস নিয়ে। চারজন শ্রমিকের জীবনের বিনিময়েও বাঁচার মতো মজুরি নির্ধারণ হয়নি। পুলিশ ও গুণ্ডাদের নির্যাতনে বহু শ্রমিকের আহত হওয়া, মামলা-হয়রানি, বহু শ্রমিকের চাকরিচ্যুতির মধ্য দিয়ে গেল বছর মজুরি-আন্দোলন দমন করা হয়েছে। রাজনৈতিক ডামাডোলে হারিয়ে গেছে শ্রমিকের চাপা কান্না।

গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন মাধ্যমে মজুরি অনেকটা বৃদ্ধি পাওয়ার যে উড়ো খবর চাউড় হয়েছিল, শ্রমিকরা নতুন মজুরি হাতে পাওয়ার পর আবিষ্কার করেছে যে, সে সব খবর ভুয়া ছিল। উপরন্তু ব্যাপকমাত্রায় ছাঁটাই-বরখাস্ত, গ্রেডে কারচুপির ঘটনা শ্রমিকদের কোনঠাসা অবস্থার মধ্যে ফেলেছে।

‘গ্রেডে কারচুপি’ বললইে মালিকরা ক্ষেপে যান। তারা দাবি করেন এই শব্দের ব্যবহার শিষ্টাচারবহির্ভূত। কিন্তু শ্রমিকদের এই দৈনন্দিন সংকটটি অন্যকোনও উপযুক্ত ও বস্তুনিষ্ঠ শব্দে প্রকাশ করা মুশকিল। দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা দ্বারা শ্রমিকের গ্রেড নির্ধারিত হওয়ার কথা। কিন্তু প্রায় ৪০ বছর হতে চললওে গার্মেন্টসশিল্পে মজুরি কাঠামোর গ্রেড নির্ধারণে কোনও র্সাবজনীন মানদণ্ড অনুসরণ করা হয় না। পদোন্নতির কোনও সার্বজনীন পদ্ধতি নাই। একজন শ্রমিক সাধারণভাবে বিভিন্ন ধরনের কাজের হেলপার কিংবা বিভিন্ন ধরনের মেশিনের অপারটের হয়ে থাকে। সব ধরনের মেশিনের কাজ করতে পারা কিংবা সব ধরনের প্রসেস জানা শ্রমিক বেশি দক্ষতা সম্পন্ন হিসেবে বিবেচিত হয়। এছাড়াও অনেকগুলো বিভাগে আয়রনম্যান, কাটারম্যান, সিজারম্যান, কোয়ালিটি ইন্সপেক্টর, স্যাম্পলম্যান, মার্কার, লাইন লিডার, সুপারভাইজার, ক্লনি এক্সপোজার, ফোল্ডিংম্যান, প্যাকিংম্যানসহ এমন বহু পদে শ্রমিকরা র্কমরত আছে।

এমন সব শ্রমিকরা যোগ্যতার ভিত্তিতে বিভিন্ন গ্রেডে অন্তর্ভূক্ত হবেন এবং গ্রেড অনুসারে মজুরি পাবেন এটাই স্বাভাবকি। কিন্তু প্রায় চল্লিশ লক্ষ শ্রমিকের এই শিল্পে গ্রেড ও পদোন্নতির কোনও সুনির্দিষ্ট নিয়ম-শৃঙ্খলা নাই। এই শ্রমিকদের পদ-পদোন্নতি একেবারেই নির্ভর করে বিরাট ক্ষমতার অধিকারী কারখানা ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের সাথে একজন ব্যক্তি শ্রমিকের দরকষাকষির ক্ষমতার ওপর।

নূন্যতম মজুরি অর্থাৎ সর্বনিম্ন গ্রেড নিয়ে আলোচনা এত বেশি থাকে যে মালিকরা এই সুযোগে কারখানার নব্বই ভাগ শ্রমিকের অন্য গ্রেডগুলোতে কোনওমতে যৎসামান্য মজুরি বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত পাস করিয়ে নেয়। ফলে শ্রমিকপক্ষের সকল গ্রেডে একই হারে মজুরি বৃদ্ধির দাবি সর্ম্পূণভাবে অগ্রাহ্য হয়ে থাকে।

বর্তমান মজুরি কাঠামোতে শ্রমিকের পাঁচটি গ্রেড আছে। এই পাঁচটি গ্রেডের সবচেয়ে নিচের গ্রেডে শ্রমিকের সর্বমোট মাসিক মজুরি ১২,৫০০ টাকা। সব ধরনের হেলপাররা এই গ্রেডের অন্তর্ভুক্ত। এর চেয়ে উপরের গ্রেডে শ্রমিকের মজুরি নির্ধারিত হয়েছে ১৩,৫৫০ টাকা। একজন সহকারীর সাথে একজন অপারটের, যিনি দক্ষ শ্রমিক তার মজুরির পার্থক্য কোনওভাবেই ন্যায়সঙ্গত হয়নি।

মজুরি র্বোড যখন কার্যক্রম পরিচালনা করে তখন, নূন্যতম মজুরি অর্থাৎ সর্বনিম্ন গ্রেড নিয়ে আলোচনা এত বেশি থাকে যে মালিকরা এই সুযোগে কারখানার নব্বই ভাগ শ্রমিকের অন্য গ্রেডগুলোতে কোনওমতে যৎসামান্য মজুরি বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত পাস করিয়ে নেয়। ফলে শ্রমিকপক্ষের সকল গ্রেডে একই হারে মজুরি বৃদ্ধির দাবি সর্ম্পূণভাবে অগ্রাহ্য হয়ে থাকে। এর ওপরের গ্রেডে শ্রমিকদের মজুরি নির্ধারিত হয়েছে ১৪,২৭৩ টাকা। আর র্সবোচ্চ পদবী সিনিয়র অপারটেরদের গ্রেড ১-এ শ্রমিকের মজুরি ধরা হয়েছে ১৫,০৩৫ টাকা।

কারখানা পর্যায়ের শ্রমিকদের অভিযোগ— কোনও সুনির্দিষ্ট বিধিবিধান না থাকায় মালিকপক্ষ হাতেগোনা কয়েকজনকে সিনিয়র অপারেটরের ১নং গ্রেডে রেখে ঢালাওভাবে শ্রমিকদের ৩-নং গ্রেডে নামিয়ে দিয়েছে। এমন কারখানাও পাওয়া গেছে যেখানে শ্রমিকদের আইডি কার্ডে এতদিন ধরে উল্লখে করা পদবীর চেয়ে কারখানার নথিতে অধস্তন পদবী দেখানো হচ্ছে। পরিকল্পিতভাবে নতুন মজুরি কাঠামো অনুসারে বেতন-ভাতা সমন্বয় করতে গিয়ে মালিকপক্ষ শ্রমিকদের প্রাপ্য গ্রেড থেকে বঞ্চিত করছে। কোথাও বলা হচ্ছে ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইঞ্জিনিয়ার্স বিভাগ দ্বারা শ্রমিকদের পদবী ও গ্রেড পুনঃনির্ধারণ করা হবে। আসলে নতুন মজুরি কাঠামো বাস্তবায়নরে সুযোগে ব্যাপকভাবে গ্রেডে অবনমন করার ঘটনা ঘটছে।

এ সব অনিয়ম দেখার এবং সুরাহা করার জন্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থা হিসেবে শ্রম মন্ত্রণালয়ের একটি অধিদপ্তর দায়িত্বপ্রাপ্ত। কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর সম্প্রতি যে আর্শ্চয গতিতে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কারাদণ্ড র্পযন্ত তদন্তকারী ও বাদী হিসেবে ভূমিকা পালন করেছে শ্রমিকদের সংকট সুরাহা করার ক্ষেত্রে তাদের গতি ও উদ্যম-উদ্যোগ তার উল্টো হয়। আমাদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা হলো বড় বড় সরকারি কর্মকর্তাদের ছোট ছোট মালিকরাও ধমকায়। সরকারের বড় আমলারা এই অধিদপ্তরের প্রধান হয়ে আসেন। তারা কেউ কেউ এই পদায়নকে অবমূল্যায়ন বিবেচনা করেন। তাদের মন খারাপ থাকে। এই দপ্তরটির চকচকে নতুন ২০ তলা ভবন, বিপুল সংখ্যক যানবাহন, ব্যাপক জনবল শ্রমিকের ভরসাস্থল হতে পারছে না। 

নানা ধরনের কারখানার সোয়েটারের শ্রমিকরা, অন্যান্য নিটিং শ্রমিকরা এই পরিস্থিতিতে সবচেয়ে দুরাবস্থায় আছে। জ্যার্কাড মেশিনের শ্রমিক হিসেবে যারা পরিচিত তাদের ‘ফিক্সড স্যালারি’ নামের ফাঁদে ফেলে ওভারটাইম ভাতা না দিয়েই দৈনিক ১২ ঘণ্টা জবরদস্তিমূলক খাটানো হচ্ছে। একজন শ্রমিককে ৬টি মেশিনের দায়িত্ব দিয়ে এক মুর্হূর্তের জন্য বসার অবকাশ র্পযন্ত দেওয়া হচ্ছে না। আরও খারাপ অবস্থা সেই সব শ্রমিকের যারা স্টাফ হিসেবে পরিচিত। ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা না হয়েও তারা শ্রমিকের মর্যাদা ও অধিকার থেকেও বঞ্চিত।

নতুন মজুরি কাঠামোতে যে প্রকৃত অর্থে শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধি পায়নি সেটা হিসাব করে বুঝিয়ে দেওয়া সম্ভব। গার্মেন্টসশিল্পে শিল্প মালিকের আয় হয় ডলারে, শ্রমিক মজুরি পায় টাকায়। বিগত ২০১৮ সালে টাকার বিপরীতে ডলারের দাম এবং এই সময়কালে মূল্যস্ফীতির হার বিচার করলে এটা স্পষ্ট বোঝা যায় যে শ্রমিকের মজুরি বাবদ ব্যয়ে তেমন কোনও উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি হয়নি। একদিকে কোনওভাবে খেয়েপড়ে বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা শ্রমিকের থাকবে না, অন্যদিকে ছাঁটাই-বরখাস্ত ও গ্রেডে কারচুপিসহ নানান হয়রানি নির্যাতন চলতে থাকবে। এ অবস্থার অবসান হওয়া জরুরি।

লেখক: সহ-সভাপতি, গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র।

ad

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত