Beta
রবিবার, ১৯ মে, ২০২৪
Beta
রবিবার, ১৯ মে, ২০২৪

চট্টগ্রাম বন্দরে বড় জাহাজ ভেড়ে না কেন

ss-Big-Ship-ctg-port-0605324
Picture of আসিফ সিদ্দিকী

আসিফ সিদ্দিকী

আনুষ্ঠানিক আহ্বানের পর ১৩ মাস পেরুলেও চট্টগ্রাম বন্দরে ভেড়ে না বড় জাহাজ। এর পেছনে রয়েছে অবকাঠামোসহ নানা সংকট, আর কর্তৃপক্ষের জটিল শর্ত। তা মানতে গেলে লোকসান গুনতে হবে বলে দাবি শিপিং লাইনগুলোর।

চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা বাড়ায় জেটি-টার্মিনালে ভিড়তে পারবে ১০ মিটার গভীরতার ও ২০০ মিটার দৈর্ঘ্যের বড় জাহাজ—এমন ঘোষণা এসেছিল ২০২৩ সালের ১৫ জানুয়ারি। এতে আমদানি-রপ্তানিতে সময় ও খরচ  কমপক্ষে ৩০ শতাংশ কমে আসবে বলেছিল চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ।   

সক্ষমতা বাড়ানোর প্রমাণ দিতে জেটিতে সবচেয়ে বড় জাহাজ ভেড়ানোর অনুমতি দিয়েছিল বন্দর কর্তৃপক্ষ। ঘটা করে উদ্বোধন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে গত বছরের জানুয়ারিতে একটি এবং এরপর ফেব্রুয়ারিতে একটি বড় জাহাজ জেটিতে ভেড়ানো হয়েছিল। তবে সেসব জাহাজে ছিল না কোনও পণ্য। জাহাজ ভেড়ানো ছিল শুধুই আনুষ্ঠানিকতা।

উদ্বোধনের আনুষ্ঠানিকতা শেষে দুটি জাহাজই জেটি থেকে বহির্নোঙরে সাগরে পাঠানো হয়। আর সেখানেই আগের নিয়মে পণ্য নামানো বা লাইটারিং করা হয়েছিল।

উদ্বোধনের পর গত বছরের মার্চ মাসে জাহাজ ভেড়ানোর আহ্বানে প্রজ্ঞাপন জারি করেছিল বন্দর কর্তৃপক্ষ। এর একবছর পার হলেও ২০০ মিটার দীর্ঘ এবং ১০ মিটার গভীরতার (ড্রাফট) একটি বড় জাহাজও ভেড়েনি চট্টগ্রাম বন্দরের জেটিতে।  

প্রজ্ঞাপনের পর কেন জেটিতে বড় জাহাজ আসছে না—এমন প্রশ্নের উত্তর জানতে অন্তত ১০ জন বন্দর ব্যবহারকারীর সঙ্গে কথা বলে সকাল সন্ধ্যা। কিন্তু তাদের প্রায় সবাই নাম প্রকাশ না করার শর্তে কথা বলেছেন। তাদের মতে, দুটি কারণে জেটিতে বড় জাহাজ ভিড়ছে না।

প্রথম ও সবচেয়ে বড় কারণটি হচ্ছে, বড় জাহাজ ভেড়ানোর জন্য বন্দর কর্তৃপক্ষের কঠিন শর্ত বেঁধে দেওয়া।

দ্বিতীয়ত, বন্দর কর্তৃপক্ষ জাহাজ ভেড়ানোর জন্য যে ড্রাফট চার্ট (অনুমোদিত গভীরতার তালিকা) দিয়েছে তাতে পতেঙ্গা কন্টেইনার টার্মিনাল (পিসিটি) ছাড়া অন্য কোনও জেটি বা টার্মিনালে এই ধরনের বড় জাহাজ ভেড়ানোর সুযোগ নেই। আর পতেঙ্গা কন্টেইনার টার্মিনালটি গত এক বছরেও চালু হয়নি। ফলে বড় জাহাজ আনতে কেউ উৎসাহিত হয়নি।

যদিও বন্দর কর্তৃপক্ষ বলছে, বড় জাহাজ ভেড়ানোর জন্য তাদের প্রস্তুতি আছে, অনুমতি দেওয়া হয়েছে। কোন আকারের জাহাজ আনবে, সেটি চাহিদার ওপর নির্ভর করেই আনে শিপিং লাইন।

চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব ওমর ফারুক সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “বড় জাহাজ ভেড়ানোর জন্য আমরা প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছি। প্রজ্ঞাপন জারি করা আছে। কোন আকারের জাহাজ আনবে, সেটি দেশের বিদ্যমান আমদানি-রপ্তানি চাহিদার পর নির্ভর করেই শিপিং লাইনগুলো আনে।”

আর মেরিন বিভাগের এক কর্মকর্তা বলছেন, “রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আমদানির গতি কম। অনেক জেটি ফাঁকা যাচ্ছে। ফলে বিদ্যমান জাহাজ মালিকরা একসাথে এত পণ্য না থাকায় বড় জাহাজের বদলে ছোট জাহাজে পণ্য আনতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন। নিশ্চয়ই চাহিদা বাড়লে বড় জাহাজ নিয়ে পণ্য আনবেন।”

১৩ মাসেও ভেড়েনি বড় জাহাজ

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ তাদের জেটি-টার্মিনালে এখন সর্বোচ্চ সাড়ে ৯ মিটার গভীরতার এবং ১৮৬ মিটার দীর্ঘ পণ্যবাহী জাহাজ ভেড়াতে পারে। মূলত কর্ণফুলী নদীতে গুপ্তাবাঁক, জোয়ার-ভাটা ও নাব্য সংকটের কারণে এরচেয়ে বড় গভীরতার জাহাজ জেটিতে ভেড়াতে পারে না।

এখন যে গভীরতার জাহাজ আসছে, সেই জাহাজে সর্বোচ্চ ২২০০ থেকে ২৪০০ একক কন্টেইনার বহন করে আনা যায়। ১০ মিটার গভীরতার জাহাজ আসলে সেই জাহাজে ২৫০০ থেকে ২৮০০ একক কন্টেইনার পর্যন্ত বহনের সুযোগ আছে।

এক জাহাজে বেশি পণ্য পরিবহন করা গেলে পরিবহন বাবদ সময় ও অর্থ দুটোর সাশ্রয় হবে। একইসঙ্গে দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দরের বড় জাহাজ ভেড়ানোর সক্ষমতা প্রমাণ হবে। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়েই লন্ডনভিত্তিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এইচআর ওয়েলিং ফোর্ডকে কর্ণফুলী নদীর ওপর সমীক্ষা চালানোর কাজ দেয় বন্দর কর্তৃপক্ষ।

২০২২ সালে জমা দেওয়া এইচআর ওয়েলিং ফোর্ডের সমীক্ষা রিপোর্ট ২০০ মিটার দীর্ঘ এবং ১০ মিটার গভীরতার জাহাজ বন্দর জেটিতে ভেড়ানোর সুপারিশ করা হয়। আর এই বড় জাহাজ ভেড়াতে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়ারও সুপারিশ ছিল সেই রিপোর্টে।

এর প্রেক্ষিতে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ পরীক্ষামূলকভাবে বড় জাহাজ ভেড়ানোর আনুষ্ঠানিকতা করে।

২০২৩ সালের ১৫ জানুয়ারি ‘এমভি কমন এটলাস’ নামের ২০০ মিটার দীর্ঘ এবং ১০ মিটার গভীরতার জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরের চট্টগ্রাম কন্টেইনার টার্মিনালে (সিসিটি) ভেড়ানো হয়। জাহাজটি বাল্ক বা খোলা জাহাজ, কিন্তু বন্দরের জেটিটি ছিল কন্টেইনার জাহাজ ভেড়ানোর উপযোগি। এই জেটিতে সাধারণত কন্টেইনার ছাড়া বাল্ক বা খোলা পণ্যের জাহাজ ভেড়ানো হয় না।

মূলত উদ্বোধনের জন্যই ব্রাজিল থেকে আসা চিনিবাহী জাহাজটি সিসিটিতে ভেড়ানো হয়। নৌ পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরীর উদ্বোধনের পরই জাহাজটি থেকে পণ্য না নামিয়েই বহির্নোঙরে নিয়ে যাওয়া হয়।

এরপর চট্টগ্রাম বন্দরের নবনির্মিত পতেঙ্গা কন্টেইনার টার্মিনালে (পিসিটি) একইমাপের আরেকটি জাহাজ ‘মেঘনা ভিক্টোরি’ ভেড়ানো হয়। জাহাজটি ছিল বাল্ক বা খোলা, কিন্তু জেটি ছিল কন্টেইনারের। আর জাহাজে ছিল কানাডা থেকে আনা গম। ২৬ ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের পর জাহাজটি একইভাবে বহির্নোঙের ফেরত পাঠিয়ে গম নামানো হয়।

দুটি জাহাজ দিয়ে কার্যক্রম উদ্বোধন হওয়ার পর ২০২৩ সালের ১৯ মার্চ বন্দর কর্তৃপক্ষ বন্দরের এনসিটি, সিসিটিতে বড় কন্টেইনার জাহাজ ভেড়ানোর জন্য প্রজ্ঞাপন দেয়। এরপর থেকে চলতি বছরের মে মাস পর্যন্ত ১৩ মাসে কোনও বড় জাহাজ জেটিতে ভেড়েনি।

কেন ভেড়েনি বড় জাহাজ

জেটি-টার্মিনালে বড় জাহাজ ভেড়ানোর যে প্রজ্ঞাপন বন্দর কর্তৃপক্ষ দিয়েছে তাতে, অনেক কঠিন শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছে। ডাবল টাগ, ডাবল পাইলট, জেটিতে আসার সময় যেকোনও ঝুঁকির জন্য আন্ডারটেকেন দেওয়া এবং ক্ষতির দায় জাহাজ পরিচালনাকারীদের বহন করা। এছাড়া ২০ মিটার জাহাজ প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হলে কত ড্রাফটে কত কন্টেইনার আনা যাবে, তার শর্তও বেঁধে দিয়েছে বন্দর কর্তৃপক্ষ।

এ বিষয়ে বিদেশি শিপিং লাইনের এক শীর্ষ কর্মকর্তা সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “বড় জাহাজ আনতে গেলেই অনেকগুলো শর্ত দিয়ে রেখেছে বন্দর। জাহাজ বহির্নোঙর থেকে চালিয়ে জেটি-টার্মিনালে আনবে বন্দরের নিজস্ব পাইলট। তাহলে ঝুঁকির দায় কেন আমি নেব। আন্ডারটেকেন কেন আমিই দেব। ফলে সেসব শর্ত মেনে বড় জাহাজ আনতে উৎসাহিত হয়নি আমাদের বিদেশের কেন্দ্রীয় অফিস। ফলে বিদ্যমান জাহাজ দিয়েই আমরা জাহাজে পণ্য পরিবহনে স্বাচ্ছন্দ্যে আছি।”

সিঙ্গাপুরভিত্তিক আরেক শিপিং লাইন কর্মকর্তা বলছেন, “আমরা তো সময়-অর্থ সাশ্রয়ের জন্যই বড় জাহাজ আনব। একসাথে বেশি পণ্য এনে পরিবহন খরচ সাশ্রয় করব। কিন্তু যেসব শর্ত দেওয়া হয়েছে, তাতে সাশ্রয় হবে না; উল্টো খরচ বাড়বে এবং আর্থিক ঝুঁকি তৈরি হবে। ফলে এত ঝক্কি-ঝামেলা কে নেবে?

“২০০ মিটার দীর্ঘ জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরের এনসিটি, সিসিটিতে আনলে জটিলতা তৈরি হবে। এনসিটি, সিসিটির সব জেটিই হচ্ছে ২০০ মিটার দীর্ঘ। এখন সরাসরি ২০০ মিটার দীর্ঘ জাহাজ জেটিতে ভেড়াতে গেলে পাশের একটি জেটি ফাঁকা রাখতে হবে। ফলে দেখা যাবে যেখানে আগে চারটি জাহাজ ভেড়ানো যেত এখন সেখানে তিনটি জাহাজ ভেড়াতে হবে। এতে বন্দরেরই রাজস্ব কমবে।”  

চট্টগ্রাম বন্দরের এক অপারেটর সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “এনসিটির প্রতিটি জেটির দৈর্ঘ্য ২০০ মিটার। আর এখন সেখানে থাকা চারটি জেটিতে ১৮৬ মিটার দীর্ঘ হিসেবে মোট চারটি জাহাজ ভেড়ানো যাচ্ছে। প্রতিটি জাহাজের মাঝখানে ৮ মিটারের মতো গ্যাপ থাকায় ৪টি জাহাজ অনায়াসেই ভেড়ানো যায়।

“এখন ২০ মিটার একটি জাহাজ ভেড়াতে গেলে জাহাজের গ্যাপ রাখতে গিয়ে পাশের জেটিতে একটি জাহাজ কম ভেড়ানো যাবে, অথবা একটি ছোট জাহাজ ভেড়াতে হবে। অর্থাৎ টেকনিক্যাল কারণেই চারটির বদলে তখন তিনটি জাহাজ জেটিতে ভিড়বে। ফলে বড় জাহাজ ভেড়াতে গিয়ে আমরা কম জাহাজ ভেড়াতে পারব। এতে আর্থিক লস হবে।”

বড় জাহাজ ভেড়ানোর বাড়তি সুবিধা পিসিটিতে

জোয়ার-ভাটার পর পুরোপুরি নির্ভরশীল চট্টগ্রাম বন্দরের জাহাজ চলাচল। ফলে বছরের কোন সময় কত গভীরতার জাহাজ জেটি-টার্মিনালে ভিড়বে- তার একটি ড্রাফট (গভীরতা) চার্ট বা তালিকা প্রকাশ করে বন্দরের মেরিন বিভাগ। বন্দর ব্যবহারকারী জাহাজ মালিক, পরিচালনাকারী, শিপিং লাইনগুলো সেই চার্ট ধরেই জাহাজ জেটিতে নিয়ে আসে। ছয়মাস পর পর এই তালিকা প্রকাশ করা হয়।

প্রকাশিত সর্বশেষ তালিকা অনুযায়ী, ২০০ মিটার দীর্ঘ ও ১০ মিটার গভীরতার জাহাজ ভেড়ানো যাবে কেবল পতেঙ্গা কন্টেইনার টার্মিনালে (পিসিটি)। নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) ও চিটাগাং কন্টেইনার টার্মিনালে (সিসিটি) ১০ মিটার গভীরতার জাহাজ ভেড়ানোর সুযোগ রাখা হলে জাহাজটির দৈর্ঘ্য হতে হবে ১৯০ মিটার। এর বেশি জাহাজ এনসিটি, সিসিটি এমনকি বন্দরের প্রধান জেটি জেনারেল কার্গো বার্থে (জিসিবি) ভেড়ানো যাবে না।

২০২৩ সালে ২০ মিটার দীর্ঘ ও ১০ মিটার গভীরতার জাহাজ ভেড়ানোর জন্য এনসিটি, সিসিটিতে সুবিধা দেওয়া ছিল। এই কারণেই ২০০ মিটার দীর্ঘ কমন এটলাস জাহাজ ভেড়ানো গিয়েছিল। কিন্তু পরে দেওয়া প্রজ্ঞাপনে সেই সুবিধা রাখা হয়নি।  

ফলে কৌশলে বড় জাহাজ ভেড়ানোর সুবিধা রাখা আছে কেবল পিসিটিতেই। আর এই সুবিধা প্রচার করে বড় জাহাজ পিসিটিতে আনবে পিসিটি পরিচালনার জন্য নিয়োজিত সৌদি আরবভিত্তিক অপারেটর প্রতিষ্ঠান রেড সি গেইটওয়ে।

বিদেশি শিপিং লাইনের এক শীর্ষ কর্মকর্তা সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “বহির্নোঙরের কাছাকাছি হওয়ায় পিসিটি এমনিতেই বাড়তি সুবিধা পাবে। এখন ড্রাফট চার্ট অনুযায়ী আনুষ্ঠানিকভাবেই বড় জাহাজ ভেড়ার সুযোগ পেল পিসিটি। ফলে জাহাজ ভেড়ানো নিয়ে আগে জিসিবি-এনসিটির যেমন বৈষম্য ছিল। এখন পিসিটির সাথে এনসিটি-সিসিটির বৈষম্য তৈরি হবে।”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ad

সর্বাধিক পঠিত