Beta
বুধবার, ৮ মে, ২০২৪
Beta
বুধবার, ৮ মে, ২০২৪

বিস্তার

মার্কেজকে হারানোর দশ বছর

গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ এবং তাঁর যাদু বাস্তবতার ব্র্যান্ড ল্যাতিন আমেরিকা ও আন্তর্জাতিক পরিসরের বহু লেখকের ওপর বিপুল প্রভাব বিস্তার করেছে। আলোকচিত্র: থটকো ডট কম।

গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ দশ বছর আগে এই এপ্রিলে চলে গেছেন (১৭ এপ্রিল, ২০১৪)। কিন্তু সারা বিশ্বের মানুষ তার লেখার সৌন্দর্য আর বাঁধভাঙা কল্পনায় বিহ্বল হয়ে চলেছে। তিনি এই বিগত শতাব্দীর সবচেয়ে বেশি অনূদিত স্প্যানিশ-ভাষার লেখক। আর ঠিক বেঠিক যাই হোক, অনেকভাবেই তার ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ার্স অব সলিচিউড-এর কাল্পনিক শহর মাকন্দোই ল্যাটিন আমেরিকার প্রতিচ্ছবি। বিশেষ করে আমাদের মতো কলম্বিয়ান ক্যারিবিয়ানদের কাছে।

আমি গাবো সম্পর্কে লিখছি সেই ১৯৯৫ সাল থেকে। সে বছরই গাবোর পরিচালিত তিন দিনের এক সাংবাদিকতার কর্মশালায় তার সাথে দেখা হয়েছিল আমার। তখনই সিদ্ধান্তে এসেছিলাম তিনি নিজেই কাজ করার জন্য এক আকর্ষণীয় বিষয় হবেন। কলম্বিয়ার জাদু বাস্তবতার রাজা আমাকে আমার দাদার কথা মনে করিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর সম্পর্কে আমার প্রথম লেখায় বলেছিলাম কথাটা। লেখাটা ছাপা হয় ‘দ্য প্যারিস রিভিউ’-এর ১৯৯৬ এর শীত সংখ্যায়।

গাবোর একটি মৌখিক ভাষ্যভিত্তিক জীবনী লেখার জন্য আমি ২০০০-এর দশকের গোড়ার দিকে তার বন্ধু, পরিবারের সদস্য, অনুরাগী এবং নিন্দুক সবার সাক্ষাৎকার নিতে শুরু করি। প্যারিস রিভিউয়ের ২০০৩ সালের গ্রীষ্মকালীন সংখ্যায় ছাপা হয় এর প্রাথমিক সংস্করণ। পরে সেটাকে বইয়ের রূপ দেই। মার্কেজ ২০১৪ সালে মারা যাওয়ার সময় আমি ‘সলিচিউড অ্যান্ড কোম্পানি’ নামে বইটার চূড়ান্ত ঘষামাজা করছিলাম। বইটা ছিল প্রদেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে নোবেলজয়ীদের কাতারে নাম লেখানো এই ‘প্র্যাংকস্টার’ সম্পর্কে নানাজনের মন্তব্যের সংগ্রহ।

মার্কেজের এজেন্ট কারমেন বালসেল্স তার খুব কাছের মানুষ। লেখকের মৃত্যুর কয়েকদিন পর প্রায় কান্নায় ভেঙে পড়ে কারমেন আমাকে বলেছিলেন, বিশ্ব এখন একটি নতুন ধর্মের উত্থান দেখতে পাবে, আর তা হচ্ছে: গাবো তরিকা (গাবিসমো)।

কারমেন বালসেল্সের ভবিষ্যদ্বাণী আমাকে একজন সাংবাদিক হিসাবে আগ্রহী করে তুলেছিল। আমি গাবোর মৃত্যুর পরেও তার জীবনকাহিনী এবং সাহিত্যকৃতী ও অবদানের বিষয়ে খোঁজখবর রাখতে থাকি। যুক্তরাষ্ট্রের অস্টিনের টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ে রাখা হয়েছিল তার কাজের বিভিন্ন নমুনা। ২০২০ সালে গাবোর স্ত্রী মের্সেদেস বার্চা মারা যান, লেখক যাকে তার ‘পবিত্র কুমির’ বলে ডাকতেন! কলম্বিয়াতে তার হাতে প্রতিষ্ঠিত সাংবাদিকতার স্কুলটিই (যেখানে আমি তার কর্মশালায় অংশ নিয়েছিলাম) পরে গাবো ফাউন্ডেশনে রূপান্তরিত হয়। তারপরে ঘটে কিছু অপ্রত্যাশিত ঘটনা।

২০১৯ সালে নেটফ্লিক্স ‘ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ার্স অব সলিচিউড’-অবলম্বনে একটি সিরিজ করার ঘোষণা দেয়। যে রূপান্তরটি তিনি কোনোভাবেই মানতেন না। কলম্বিয়ার কোনো এক প্রত্যন্ত এলাকায় সেট বানিয়ে ‘মাকন্দো’-কে পুনণির্মাণ করেছিলেন সিরিজটির শিল্প পরিচালকরা। ২০২২ সালে একজন সাংবাদিক লেখেন, মার্কেসের একটি মেয়ে সন্তান ছিল যার কথা তিনি জনসমক্ষে প্রকাশ করেননি। ১৯৯০ সালে মেক্সিকো সিটিতে জন্ম হয়েছিল মেয়েটির। অতিসম্প্রতি মরণোত্তরভাবে প্রকাশিত হয়েছে তার একটি উপন্যাস ‘আনটিল অগাস্ট’। স্প্যানিশ ও ইংরেজিসহ বাইশটি ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে বইটি। এটি ছেচল্লিশ বছর বয়সী এক বিবাহিত নারীর গল্প যিনি প্রতিবছরের ঠিক ১৬ আগস্ট তারিখে ‘ওয়ান-নাইট স্ট্যান্ড’ করার সিদ্ধান্ত নেন। ওইদিনটিতে তিনি একাকী রাতের বেলা অনামী এক ক্যারিবিয়ান দ্বীপে যাত্রা করেন। উদ্দেশ্য, সেখানে থাকা তার মায়ের কবরে একগুচ্ছ গ্লাডিওলি ফুল দেওয়া।

তো, গত বছর আমি সিদ্ধান্ত নিই রেকর্ডারটা আবার চালু করার। ঠিক করি, সবার কাছে জানতে চাইব গাবো মারা যাওয়ার পরের গত দশটি বছর সম্পর্কে। এ অভিযাত্রায় দেখছি ‘চির প্র্যাংকস্টার’ গাবো আমাকে বিস্মিত করেই চলেছেন।

২০২২ সালে একজন সাংবাদিক লেখেন, মার্কেসের একটি মেয়ে সন্তান ছিল যার কথা তিনি জনসমক্ষে প্রকাশ করেননি। ১৯৯০ সালে মেক্সিকো সিটিতে জন্ম হয়েছিল মেয়েটির। অতিসম্প্রতি মরণোত্তরভাবে প্রকাশিত হয়েছে তার একটি উপন্যাস ‘আনটিল অগাস্ট’। স্প্যানিশ ও ইংরেজিসহ বাইশটি ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে বইটি। এটি ছেচল্লিশ বছর বয়সী এক বিবাহিত নারীর গল্প যিনি প্রতিবছরের ঠিক ১৬ আগস্ট তারিখে ‘ওয়ান-নাইট স্ট্যান্ড’ করার সিদ্ধান্ত নেন।

গ্যাব্রিয়েল এলিজিও তরেস গার্সিয়া (মার্কেজের ভাগ্নে):
শেষবার যখন আমরা তাকে দেখি ততদিনে ক্যান্সার তার শরীরের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়েছে। স্মৃতিশক্তিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। তবে তিনি তখনও আলাপচারিতা চালাতে পারতেন। একদিন তিনি এসে আশ্চর্য হওয়ার ভঙ্গিতে বললেন, ‘‘এই অ্যাতো লোকের জন্ম হয়েছে কখন?’’

গুস্তাভো তাতিস গেরা (কবি ও সাংবাদিক):
তাকে বহুদিন পর ফিরে আসা এক ঠাকুর্দার মতো লাগছিল। বোন, ভাগ্নে, পরিবারের অন্যদের জড়িয়ে ধরে ছিলেন। কিন্তু তার পরও যেন কারো মাঝেই ছিলেন না।

গ্যাব্রিয়েল এলিজিও তরেস গার্সিয়া:
তিনি কেবলই নানা সাহিত্যিক আর কাব্যিক কথার তুবড়ি ফোটাচ্ছিলেন। কিন্তু একই সাথে আচরণ করছিলেন প্র্যাঙ্কস্টারের মতো!

মিলাগ্রোস মালদোনাদো (আর্ট প্রোমোটার ও মার্কেজের বন্ধু):
মার্কেজ বলেছিলেন, তিনি সবচেয়ে বেশি ভয় পান বয়স বাড়ার সাথে সাথে স্মৃতিশক্তি হারিয়ে ফেলাকে। আমি জানতাম না তার পরিবারে এ ধারাটা ছিল।

গুস্তাভো তাতিস গেরা:
তিনি অবশ্য পুরো বিস্মৃতির ব্যাপারটার সমাধান করেছিলেন একে স্মিতহেসে বুকে টেনে নিয়ে। তিনি বলেছিলেন, ‘‘আমি তো জানি যে আমি তোমাকে ভালোবাসি। তোমাকে ভালোইবাসি আমি।’’

খালি পায়ে নিমগ্ন গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ স্পেনের বার্সেলোনায় নিজের স্টুডিয়োতে কাজ করছেন। সেসময় তিনি ‘দ্যা অটাম অব দ্যা প্যাট্রিয়ার্ক’ লিখছিলেন। সত্তরের দশকে ছবিটা তুলেছিলেন তাঁর ছেলে রড্রিগো গার্সিয়া বার্চা। আলোকচিত্র সৌজন্য: গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ পেপার্স, হ্যারি র‌্যানসম সেন্টার।

ক্যারোলিনা সানিন (লেখক):
গার্সিয়া মার্কেজ সম্পর্কে সবারই একটা না একটা গল্প রয়েছে। আমরা সকলেই কলম্বিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী মানুষটির সাথে পরিচিতি আছে—এই অনুভূতিটার কাঙাল। তিনি এক যাদুকর, আমাদের একমাত্র রাজা, এমনকি হয়তো একজন পিতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্বও। তবে আমাদের তাকে একজন সাধারণ মানুষ হিসেবেও দেখা দরকার। গাবো বাস্তবিকই দেহ রাখলেও সাধারণ মোটেই ছিলেন না। মহান প্রতিভার এই ধারণাটা আমাদের আত্মস্থ করতে হবে। রদ্রিগো এবং গঞ্জালোর বাবা ‘ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ার্স অব সলিচিউড’ লেখেননি। হোমার এবং কাফকাও এটি লিখেছিলেন এবং লিখেছেন যারা এটি পড়েছেন তাদের সবাই। এই বইয়ের লেখক আর খোদ বইটি কোনোভাবেই কাকতালীয় নয়।

মিগেল ইরিয়ার্তে (কবি এবং সাংস্কৃতিক কেন্দ্র লা কেভার পরিচালক):
গাবো’স গ্যাবিংস হলো আমার ‘গাবাদা’র তালিকায় প্রথম ভুক্তি। সমানভাবে হাস্যকর আর মজার এক ‘গাবাদা’ বা শব্দকোষ যা আমার কাছে দুঃখের সময়ে মন ভালো করার এক উপায়। তালিকাটা বেশ দীর্ঘ। এখানে আমি শুধু কয়েকটি স্মৃতি থেকে বলছি— গাবেরিয়া, গাবিসমো, গাবিতিস, গাবোতা, ডি গাবো এ রাবো। আমার তালিকায় এখন এরকম পঞ্চাশটির বেশি ‘গাবাদা’ রয়েছে। এর সবগুলো কিন্তু এসেছে একই ছোট্ট মূল থেকে—গাবো’স গাবিংস-১। একটি মজার ক্যারিবিয়ান গুণ যার সম্পর্কে মর্যাদাবানরা খুব কমই জানেন এবং যা জড়িয়ে আছে গার্সিয়া মার্কেজের জীবন ও কাজের সাথে। (প্রসঙ্গত, সাংস্কৃতিক কেন্দ্র লা কেভা নামটি এসেছে বারানকিয়ায় অবস্থিত গাবোর বন্ধুদের প্রিয় ডাইভ বারের নামানুসারে)

মিলাগ্রোস মালদনাদো:
ভেনেজুয়েলার ছোট্ট শহর চিচিরিবিচেতে ‘সলিচিউড’ পড়ার মুহুর্ত থেকেই আমি গার্সিয়া মার্কেজের প্রেমে পড়ি। নিজের বাস্তবতার সঙ্গে এহেন মিল দেখে সাগর সৈকতে উচ্ছ্বাসে ছুটোছুটি করেছিলাম আমি। অনুভূতিটা নিছক ব্যক্তিক অর্থে না, সার্বিকভাবে ক্যারিবিয়ান অঞ্চল সম্পর্কে আমাদের সম্মিলিত ভাষ্যের দিক থেকেও।

জেইমি আবেলো বানফি (গাবো ফাউন্ডেশনের পরিচালক):
কেউ যদি বলে, ‘গাবো মারা গেছে’ আর ভাবে লোকে ধীরে ধীরে তাকে পড়া বন্ধ করে দেবে সে ভুলের রাজ্যে আছে।

গুস্তাভো তাতিস গেরা:
আমি তাকে দুদিন স্বপ্নে দেখেছি। এর মধ্যে একটি স্বপ্নে তাকে দেখলাম শ্বেতশুভ্র পোশাকে। যেন তখনও তার মৃত্যু হয়নি। খোশমেজাজে কথা বলছিলেন। ঠিক যখন তার সাথে স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে পারতাম সেভাবে। যখন কিনা আমরা মাঝে মাঝেই দেখাসাক্ষাতের আয়োজন করতাম। এমনসব সময়ে তিনি আমাদের বন্ধুদের কারো না কারো শিশুসন্তানকে ব্যাপ্টিস্ট করানোর প্রস্তাব দিতেন। আসলে আমরা ছিলাম সাতজোড়া ধর্মবাপের মতো।

গুস্তাভো আরাঙ্গো (গার্সিয়া মার্কেজকে নিয়ে দুটি বইয়ের লেখক):
সত্যিই এ আমার এক ব্যক্তিগত ক্ষতি। প্রিয় লেখকরা আপনার পরিবারের মতো। সেই নীরবতা এবং বিস্মৃতির বছরগুলোর কথা ভাবি আমি। বিচ্ছিন্ন থাকার সেই বছরগুলো আমাকে তাড়িত করে। চলচ্চিত্র শিল্পে যাকে তারা বলে কিনা ‘ফেইড-আউট’।

দাসো সালদিবার (গার্সিয়া মার্কেজের কলাম্বিয়ান জীবনীকার):
আমি ইতিমধ্যে অনুভব করছিলাম, হ্যাঁ, গাবো চলে গেছেন। কিন্তু তারপরও তিনি রয়ে গেছেন। বরং মৃত্যুর পরে তিনি আরও বেশি করে উপস্থিত কারণ তিনি এক প্রকৃত কিংবদন্তীতে পরিণত হওয়ার পথে। কারণ আমরা শিগগিরই গাবোর কাজকে ক্লাসিক হিসেবে পড়ব।

গুস্তাভো আরাঙ্গো:
তিনি কিন্তু খ্যাতির বিষয়টি নিয়ে় উদ্বিগ্ন ছিলেন।

দাসো সালদিবার:
গাবোর মা লুইসা ছেলের খ্যাতির খুব কদর করেননি। তার প্রিয় ছিলেন মেয়ে আইদা রোসা যিনি কিনা একজন নান।

তবে আমাদের তাকে একজন সাধারণ মানুষ হিসেবেও দেখা দরকার। গাবো বাস্তবিকই দেহ রাখলেও সাধারণ মোটেই ছিলেন না। মহান প্রতিভার এই ধারণাটা আমাদের আত্মস্থ করতে হবে। রদ্রিগো এবং গঞ্জালোর বাবা ‘ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ার্স অব সলিচিউড’ লেখেননি। হোমার এবং কাফকাও এটি লিখেছিলেন এবং লিখেছেন যারা এটি পড়েছেন তাদের সবাই। এই বইয়ের লেখক আর খোদ বইটি কোনোভাবেই কাকতালীয় নয়।

গ্যাব্রিয়ে়ল এলিজিও তরেস গার্সিয়া:
তিনি ডাউনটাউনে (শহরের ব্যস্ত কেন্দ্রস্থল) যাওয়া উপভোগ করতেন যেখানে লোকে তাকে চিনবে। মার্কেস বলেছিলেন, খ্যাতি যদি বাল্বের মতো হতো তাহলে খুশি হতেন—যাতে তা ইচ্ছামত চালু ও বন্ধ করা যায়!

গুস্তাভো তাতিস গেরা:
তিনি সবসময় নিজের জন্মদিন ৬ মার্চ উদযাপন করতেন। কোনো অ্যাকর্ডিয়ন বাদন দলের সঙ্গে ভালেনাটোস শুনতেন। কার্তাহেনায় সেই শেষ জন্মদিনে তিনি কয়েকটি অ্যাকর্ডিয়ন দলকে আমন্ত্রণ জানিয়ে়ছিলেন, যার মধ্যে একটি দলে ছিলেন লিয়ান্দ্রো দিয়াস। হঠাৎ করেই লিয়ান্দ্রো আর গাবো উঠে পড়ে ‘দ্য ক্রাউনড গডেস’ টিভি সিরিয়ালের বাজনার তালে নাচতে শুরু করলেন! তার মৃত্যুর মাত্র এক বছর আগের ঘটনা এটা।

দাসো সালদিবার:
প্রত্যেকেরই তিনটি জীবন আছে। একটি প্রকাশ্য জনজীবন, একটি ব্যক্তিগত জীবন এবং একটি গোপন জীবন। গাবো তার ইংরেজি ভাষার জীবনীকার জেরাল্ড মার্টিনকে বলেছিলেন কথাটা। এ যেন খুব সূক্ষ্মভাবে বলা, ‘বুঝে শুনে চলো, বাপু।’

গুস্তাভো আরাঙ্গো:
তার এই তিন জীবনের কথাটা আমার কাছে খুব কৌতুহলকর মনে হয়। নব্বইয়ের দশকে এ নিয়ে কথা বলা শুরু করেছিলেন তিনি।

গুস্তাভো তাতিস গেরা:
আর এই তিন জীবনের প্রতিটিতে নারীরাই ছিলেন মূল চরিত্র।

মিলাগ্রোস মালদনাদো:
আমি কিন্তু তাকে কখনও তিন জীবন সম্পর্কে কথা বলতে শুনিনি। তবে এ নিয়ে আমি সন্দেহও করি না। কারণ স্মৃতিকথা ‘লিভিং টু টেল দ্য টেল’ লেখার সময় তিনি আমাকে বেশ স্বস্তির সঙ্গে বলেছিলেন, ‘তুমি এতে নেই।’ আমি নিশ্চয়ই তার গোপন জীবনের অন্তর্ভুক্ত ছিলাম।

গুস্তাভো তাতিস গেরা:
এটা সবসময়ই ছিল চকিত মাথা ঝোকানো এবং চোখ টিপে বলা। ১৯৯৭ সালে গার্সিয়া মার্কেজ যখন ফরাসি টেলিভিশনে গোপন জীবনের কথা উল্লেখ করেন, ব্যাপারটা জেনে অবাক হয়েছিলাম। সেই চোখ টেপা। তার গোপন জীবনের বিষয়ে সেই প্রথম ইঙ্গিত যা হয়তো আমাদের খতিয়ে দেখা উচিত।

গুস্তাভো আরাঙ্গো:
১৯৯০ সালে ঠিক তার মেয়েটির জন্মের কাছাকাছি সময়ই গাবো নিজের গোপন জীবন সম্পর্কে বলতে শুরু করেন। ইতিমধ্যেই এক গোপন জীবনের অস্তিত্ব থাকলেও তিনি আগে কখনোই এ সম্পর্কে কথা বলেননি।

গুস্তাভো তাতিস গেরা:
সেই দিনটায় (১৭ এপ্রিল, ২০১৪) আমি স্যান আন্তেরোতে আরও কয়েকজনের সঙ্গে লাঞ্চ করছিলাম। হঠাৎ খবর এল গার্সিয়া মার্কেজ মারা গেছেন। সেদিন আমরা তিনজন সেখানে বসে তার একটি গোপন মেয়ে থাকার গুঞ্জন নিয়ে কথা বলেছিলাম।

মেক্সিকোতে নিজর বাড়ির সামনে গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ এবং মের্সেদেস বার্চা। আলোকচিত্র সৌজন্য: গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ ফ্যামিলি আর্কাইভ।

মিলাগ্রোস মালদনাদো:
মের্সেদেস বার্চা খুব আত্মবিশ্বাসী ধরনের ছিলেন। সত্যিই খুব শক্ত মানুষ ছিলেন তিনি। তাই আমি মনে করি না যে এটা নিয়ে ঝগড়ায় জড়াতেন। আমি নিশ্চিত করে জানি না, তবে আমার মন বলে না মের্সেদেস এই ধরনের কিছু করতেন। তিনি এমনই একজন দারুণ মানুষ ছিলেন! সত্যিই অসাধারণ। আত্মবিশ্বাসে ভরপুর।

দাসো সালদিবার:
মের্সেদেস সবসময়ই সেই ভালোবাসার ব্যাপারে আর তার প্রতি গাবোর ভালোবাসার ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলেন। তাদের ভালোবাসা সত্যিই ছিল খুব গভীর। এমন কিছু যা শ্রদ্ধার চেয়েও বেশি কিছু। এমনকি তা ছাপিয়ে গিয়েছিল সময়কেও। তাদের সবচেয়ে সুন্দর জিনিসটি বিশ্বস্ততা নয়, সেটা ছিল তাদের পরস্পরের প্রতি আনুগত্য। বিশ্বস্ততা ভাঙা খুব সহজ। কিন্তু প্রেমের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো আনুগত্য। তাদের দুজনের মধ্যে তা ছিল।

নাদিয়া সেলিস (ক্যারিবিয়ান সাহিত্যের লেখক এবং পণ্ডিত):
আমি এ সম্পর্কে জানতাম। এটি কার্টাহেনায় মার্কেজের বড়সর সার্কেলের মধ্যে ছিল ‘সবার জানা গোপন বিষয়’। কেউ কোনো রায় দিত না এ নিয়ে। কারণ বিবাহবহির্ভূত সন্তান ধারণ করা ওই সমাজে খুব সাধারণ ব্যাপার ছিল, বিশেষ করে প্রভাবশালী পুরুষদের মধ্যে। তাই এটি প্রকাশ্যে আলোচনা না করার ব্যাপারে এক ধরনের অলিখিত চুক্তি ছিল, মূলত মের্সেদেসের প্রতি সম্মান দেখাতে।

গুস্তাভো আরাঙ্গো:
তা, একটি অজানা মেয়ে আছে কি নাই তা কীভাবে গার্সিয়া মার্কেজের সাহিত্যকর্মকে কোনোভাবে প্রভাবিত করতে পারে? ব্যাপারটা অবশ্যই তার জন্য ব্যক্তিগতভাবে তাৎপর্যপূর্ণ ছিল— একটা মেয়ে সন্তান থাকা— মানে নারীত্বের বিষয়ে তার তীব্র সংবেদনশীলতার কথা বিবেচনা করলে।

আমি তাকে দুদিন স্বপ্নে দেখেছি। এর মধ্যে একটি স্বপ্নে তাকে দেখলাম শ্বেতশুভ্র পোশাকে। যেন তখনও তার মৃত্যু হয়নি। খোশমেজাজে কথা বলছিলেন। ঠিক যখন তার সাথে স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে পারতাম সেভাবে। যখন কিনা আমরা মাঝে মাঝেই দেখাসাক্ষাতের আয়োজন করতাম। এমনসব সময়ে তিনি আমাদের বন্ধুদের কারো না কারো শিশুসন্তানকে ব্যাপ্টিস্ট করানোর প্রস্তাব দিতেন। আসলে আমরা ছিলাম সাতজোড়া ধর্মবাপের মতো।

গুস্তাভো তাতিস গেরা:
এ ধরনের ঘটনা আগেও তার বাবার পরিবারের দিকে ঘটেছিল। এছাড়া গাবোর গোপন কন্যার কাহিনীর সঙ্গে গার্সিয়া মার্কেজ এবং তার পূর্বপুরুষদের সাহিত্যজগতের অনেক মিল ছিল।

কাতালিনা রুইস-নাভারো (সাংবাদিক এবং নারীবাদী আন্দোলনকর্মী):
বিষয়টি কখনোই উল্লেখ না করার ব্যাপারে সবার মতৈক্যটা আমাকে অবাক করে। তারপরও গ্যাবিটো সম্পর্কে এমনভাবে কথা বলা চলছেই যেন তিনি ছিলেন খুব ভালো, দয়ালু, খাঁটি, সুন্দর, অনুকরণীয়, এমনকি ঐশ্বরিক মানব।

তেরেসিতা গোয়েনেচে (সাংবাদিক ও লেখক):
লেখক বলতে কী বোঝায় তা নিয়ে কিন্তু বিতর্ক রয়েছে। কেউ কি লেখক এজন্য যে তিনি কোনো সাহিত্যকর্ম সৃষ্টি করেছেন? নাকি তারা একজন বিশেষ মানুষ বলেই লেখক, নাকি ক্রিয়াকলাপের ধরন বা জনসাধারণের চোখে বিদ্যমান ভাবমূর্তির জন্য? জনসমক্ষে তাদের পরিচিতির অংশ হয়ে ওঠে তাদের কাজ। এই মানুষটি সাম্প্রতিক ইতিহাসের একটি পর্যায়ে আমাদের কার্টাহেনার লেখকদের দেখিয়েছিলেন, এ দেশে আরও কিছু মুখ রয়েছে যা দিয়ে আমরা নিজেদেরকে চেনাতে পারি। তারও স্পটলাইটের বাইরে থাকা একটি একান্ত জীবন ছিল, এমন এক গোপন জীবন যা কিছু লোকের মতে নিন্দনীয়। আমি জানি না, জনসাধারণ তাদের নিজের বলে মনে করে এমন একজন মানুষ এর সঙ্গে যুক্ত বলেই তার মেয়ে থাকার ঘটনাটি খবর হওয়ার যোগ্য কিনা।

দাসো সালদিবার:
আমি আরও অনেক কিছু জানি। কিন্তু আমি সেগুলো বলতে যাচ্ছি না। অন্তত আপাতত না।

স্টিফেন এনিস (হ্যারি র‌্যানসম সেন্টারের পরিচালক):
একদিন আমার কাছে একটি ফোন কল এসেছিল। কলার জানতে চাইছিলেন আমাদের সেন্টার গার্সিয়া মার্কেজের কাগজপত্র কিনতে আগ্রহী কিনা। করার মতো প্রশ্নই বটে! তার উত্তরও হয় একটাই।

এলিজাবেথ পেজ (র‌্যানসম সেন্টারের সাবেক যোগাযোগ বিষয়ক প্রধান):
আমাদের কাছে পাণ্ডুলিপি, ছবি এসব রয়েছে। কিছু চিঠিপত্র। পারিবারিক অ্যালবামগুলো আমার খুব পছন্দের।

‘ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ার্স অব সলিচিউড’-এর পাণ্ডুলিপি নিয়ে মশগুল গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ। আলোকচিত্র: হ্যারি র‌্যানসম সেন্টার।

স্টিফেন এনিস:
আমাদের কাছে তার তিনটি কম্পিউটারও আছে। যদিও যোগাযোগের জন্য তিনি মনে হয় টেলিফোনের ওপরই নির্ভর করতেন বেশি ।

এলিজাবেথ পেজ:
এগুলো সব হিমায়িত করে রাখার মতো আছে।

দিয়েগো গার্সিয়া ইলিও (মেক্সিকান প্রকাশক যিনি মার্কেজের দুই ছেলের ছোটবেলার বন্ধু):
আমি কিন্তু বলব, গাবোর কালিয়ে ফুয়েগোর বাড়ির পেছনের স্টুডিওটা ছিল আস্ত নরক। সেখানকার তাপমাত্রা ছিল একশ ডিগ্রির উপরে!

এলিজাবেথ পেজ:
আমরা সাতাশ হাজারের বেশি নথিপত্র স্ক্যান করেছি। এ সংগ্রহ নিয়ে লোকের সেইরকম আগ্রহ দেখেছি। সারা দুনিয়া থেকে আসা মানুষজন এটি দেখেন, বিশেষ করে লাতিন আমেরিকার লোকেরা। এ কারণেই এটি স্প্যানিশ ভাষায় হওয়াটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

স্টিফেন এনিস:
আমরা সংগ্রহটা বেশ দ্রুতই গড়ে তুলেছি। গাবো মারা গেলেও মের্সেদেস তখনও বাড়িটায় থাকতেন। কিছু সামগ্রী দেওয়ার অফার পেয়ে এক সহকর্মীকে নিয়ে আমি তা দেখতে মেক্সিকো সিটিতে গিয়েছিলাম। গাবোর অফিসটি ছিল বাড়ির পেছনে একটি আলাদা ভবনে। এককথায় দারুণ অফিস। দেয়ালজুড়ে শেলফে রাখা বই আর শিল্পকর্ম। দেখেছিলাম তার ডেস্কটাও। সেখানে ছিল একটা পেপার শ্রেডার (কাগজ কাটার যন্ত্র)। আমি জিনিসটা সেখানে দেখার আশা করিনি মোটেই।

মরণোত্তর উপন্যাসটি প্রকাশের পেছনে আমার একটি যুক্তি হচ্ছে ‘মাই মেলানকলি হোরস’ তার সমাপনী কাজ হতে পারে না। তিনি ‘মি টু’ আন্দোলনকারীদের প্রকাশ্য টার্গেটে পরিণত হয়েছিলেন। আজকাল লেখকদের নাকচ করে দেওয়া খুবই সোজা। বইয়ের কাহিনীর চরিত্রদের কৃতকর্মের জন্য আক্রমণ করা হচ্ছে লেখককে!

দিয়েগো গার্সিয়া ইলিও:
আমি র‌্যানসম সেন্টারকে বেশ কয়েকটা জিনিস দিয়েছিলাম। যেমন, আমার মায়ের কাছে থাকা ‘দ্য জেনারেল ইন হিজ ল্যাবিরিন্থ’-এর দুটি পাণ্ডুলিপি যেগুলোর গল্প শেষ হয়েছে আলাদাভাবে। তিনি সবসময় প্রায় সমাপ্ত পাণ্ডুলিপিগুলো আমার মাকে পড়তে দিতেন। তারা মার্কেসকে তার সমসাময়িক লেখকদের উৎসর্গ করা প্রথম সংস্করণের বইগুলো নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তিনি নিজে যে বইগুলো পড়তেন, তার দৈনন্দিন পড়ার জিনিসপত্র সেগুলো রেখে যায়। তবে কালিয়ে ফুয়েগোর স্টুডিওতে এখনও তার আঁকা চিত্রকর্ম, আলোকচিত্র, ডেস্ক, তার কম্পিউটার সবই যেমনটি ছিল তেমনই আছে।

মিলাগ্রোস মালদনাদো:
তিনি ঘুম থেকে ওঠার পর থেকে দুপুর পর্যন্ত লিখতেন। তা রোদবৃষ্টিঝড় যাই হোক না কেন। চোখে ঝুলতো কোক-বোতল টাইপের চশমা। তার কাচ এত পুরু আর ঘোলাটে যে আমার মাথায় ঢোকে না কীভাবে ও দিয়ে আদৌ কিছু দেখতেন তিনি। কিন্তু এটাও ঠিক তার তো স্পষ্ট করে দেখার জন্য নিজের চোখের প্রয়োজন ছিল না। তিনি তো আসলে তাকাতেন অন্তরের দিকে। মানুষটির আসলেই কোনো অনুপ্রেরণার জন্য অপেক্ষা করতে হতো না। স্রেফ অনুপ্রাণিত বোধ করছেন বলেই লিখতে হবে এমনটা মনে করতেন না তিনি। এছাড়াও, মেক্সিকোর কালিয়ে ফুয়েগোর বাড়ির পেছনে তার একান্ত নিজস্ব আস্তানা। সেখানে কেউ তাকে বিরক্ত করতোনা। সে স্টুডিওর দেওয়ালে ঝুলতো আমার যোগাড় করে দেওয়া রেভারন আর তামায়োর পেইন্টিংগুলো।

দিয়েগো গার্সিয়া ইলিও:
মার্কেসের ব্যক্তিগত সহকারীটি তার মৃত্যুর সময় সেখানে ছিলেন। এখনও চলে যাননি। মনিকা বরাবরই পারিবারিক সচিব ছিলেন এবং এখনও সে কাজে আছেন। বুকিং দেওয়া সাপেক্ষে জায়গাটা দেখা যায়। বাড়ির বাকি অংশগুলো দেখার জন্য এখন উন্মুক্ত নয়। তবে পরে তা-ও খুলে দেওয়া হবে। যাইহোক, সেখানে অনেক কিছুই আছে, তারা সবকিছু ঝেড়েঝুড়ে নিয়ে যায়নি।

স্টিফেন এনিস:
তিনি যার গুরুত্ব দিতেন তা হচ্ছে সমাপ্ত কাজ। তাই তিনি তার লেখার খসড়াগুলো সংরক্ষণ করেননি। সুতরাং আর্কাইভে থাকা বেশিরভাগ পাণ্ডুলিপি হচ্ছে হালকা সংশোধনীসহ প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ের পাণ্ডুলিপি। কিন্তু ব্যতিক্রম শেষ উপন্যাসটা। সম্ভবত মৃত্যুর আগে শেষ করা হয়নি বলেই এর একাধিক খসড়া পাওয়া গেছে। অর্থাৎ তখনো বইটার কাজ চলছিল।

মিলাগ্রোস মালদনাদো:
কাজের ব্যাপারে তিনি কোনো শর্টকাট করেননি। বেশিরভাগ কস্তোনোর মতো তার মধ্যে শৃঙ্খলার অভাব ছিল না। কস্তেনোদের গভীর রাত পর্যন্ত পানাহার আর পার্টি করার পরের দিন কাজে না যাওয়ার অভ্যাস আছে। কিন্তু তিনি পরের দিন ঠিকই কাজে বসতেন।

স্টিফেন এনিস:
উপন্যাসটি শুরু থেকেই আর্কাইভের অংশ ছিল, যদিও এটি প্রকাশিত হয়নি। গাবোর একটি অজানা ও অপঠিত কাজ আর্কাইভে আছে জেনে আমরা খুব খুশি হয়েছিলাম। তবে মার্কেসের সংগ্রহ ডিজিটাইজ করার জন্য আমরা যে অনুমতি পেয়েছি তার মধ্যে অপ্রকাশিত উপন্যাসটা নেই। তাই এটি অন্যান্য ডিজিটাইজড সামগ্রীর সাথে অনলাইনে নেই। এটা কখনোই অনলাইনে ছিল না।

গুস্তাভো আরাঙ্গো:
অস্টিনে আসার পর আমি প্রথম যে কাজটি করি তা হলো সেই উপন্যাসটি খুঁজে বের করা। ২০১৪ সালে যখন তিনি মারা যান, তখন এটি নিয়ে অনেক আলোচনা হয়। আমি জানতাম বইটা সেখানে ছিল। আর্কাইভিস্টদের এটার কথাই প্রথম জিজ্ঞেস করেছিলাম। আমি এক বসায় বইটা পড়ে ফেলি। তখন যে অনুভূতিটা হয়েছিল তা হচ্ছে এর মধ্যে সম্পাদনার হাত লাগেনি। এটা ছিল সম্পূর্ণ, সুন্দরভাবে বিকশিত। সমাপ্তিটাও ছিল খুব স্পষ্ট।

গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ। আলোকচিত্র: ড্যানিয়েল মোর্দজিনিস্কি, দ্যা প্যারিস রিভিউ।

নাদিয়া সেলিস:
আমি ২০১৬ সালে অস্টিনে গিয়েছিলাম। উদ্দেশ্য ছিল মার্কেসের রোমান্টিক প্রেমের সংজ্ঞা আর তার সাথে ক্ষমতার সম্পর্কটার তত্ত্বতালাশ করা। উপন্যাসটা আমি তখনই পড়ি। আমি জানতাম যে পাণ্ডুলিপিটা সেখানে থাকলেও তা আর প্রকাশ করা হবে না। আমি এখান ওখান থেকে টুকরা টাকরা পড়েছি। তাতে আমার উপলব্ধি হয়েছে যে এটা প্রকাশ করার জন্য ছিল না। সত্যিই কাহিনীটা মোটেও প্রকাশের জন্য প্রস্তুত বলে মনে হয়নি।

গুস্তাভো আরাঙ্গো:
আমি জানতাম তার পরিবার এটা প্রকাশ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কারমেন বালসেলস এর এজেন্সির একজন সম্পাদকের পরামর্শমত তারা কয়েক বছর আগেই এ কথা ঘোষণা করেছিল। গাবো তখনও উপন্যাসটি লেখার কাজ চালিয়ে গেলেও ওই সম্পাদক বলেছিলেন, ‘না, এ বেশি লম্বা, পুনরাবৃত্তিতে ভরা এক গল্প’। অর্থাৎ লেখা চলার মধ্যেই তিনি উপন্যাসটিকে কবর দিয়েছিলেন বলা চলে। এর পরে আর গাবো এ নিয়ে কাজ করার উৎসাহ পাননি। কারমেন বালসেলস এর এজেন্সির ওই সম্পাদকের প্রতিবেদনটি উপন্যাসের পানণ্ডুলিপির সঙ্গেই রয়েছে। আত্মপ্রকাশ করতে যাবে ঠিক এমন সময় এর মুক্তি আটকে দেওয়া হয়েছিল।

স্টিফেন এনিস:
আমার মনে হয় তার ছেলে রদ্রিগো আর গঞ্জালো উভয়েরই ধারণা হয়েছিল যে, বাবা উপন্যাসটা সম্পূর্ণ করে যেতে পারেননি বলে তা অপ্রকাশিতই থাকা উচিত। এটাই ছিল মূল ভাবনা। সে কারণেই ডিজিটাইজেশনে এটাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।

গুস্তাভো আরাঙ্গো:
উপন্যাসটির কিছু সমন্বয় দরকার ছিল। দেখবেন সেখানে তিনি কিছু শব্দ পরিবর্তন বা বাক্য পুনর্গঠন করেছেন— তার নিজের হাতের লেখায়। তবে তা বাদে উপন্যাসটি সম্পূর্ণই ছিল। আমরা সবাই তো সম্পাদক ম্যাক্সওয়েল পারকিন্সের নানা গল্প শুনেছি। টমাস উল্ফসহ অনেক তাবড় লেখকের সাথে কাজ করেছেন তিনি। পারকিন্স কার্যত তার অনেক লেখকের বই নতুন করে লিখেছেন। এখানে কিন্তু তার দরকার নেই। পুনর্লিখন না, এখানে শুধু দরকার কিছু পুনর্বিন্যাস আর ঘষামাজা।

অ্যান ম্যাকলিন (‘আনটিল অগাস্ট’ এর অনুবাদক):
আমাকে ২০২৩ সালের মার্চে ‘এন আগোস্তো নস বেমোস’ এর পাণ্ডুলিপিটি পড়তে বলা হয়েছিল। আমি এতই রোমাঞ্চিত হয়েছিলাম যে কথাই বলতে পারছিলাম না। এর পাঁচ/ছয় বছর আগে গার্সিয়া মার্কেজের সাংবাদিকতা বিষয়ে একটি বই অনুবাদ করার প্রস্তাব পেয়ে আমি অত্যন্ত সম্মানিত হই। কিন্তু আমার ধারণা ছিল না তার কোনো অপ্রকাশিত গদ্যের অস্তিত্ব আছে।

ফাবিও রদ্রিগেজ আমায়া (ঔপন্যাসিক এবং চিত্রশিল্পী):
আমি নিশ্চিত উপন্যাসটা তিনি শেষ করতে পারেননি। এটা বই হিসাবে প্রকাশ করা অবশ্যই আপত্তিকর। সারামাগোর ক্ষেত্রেও এমন ঘটনা ঘটেছে।

প্রেসিডেন্ট উরিবের স্ত্রী আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন। দলে আমরা প্রায় সত্তর জন ছিলাম। সবাই ছিল খুব বন্ধুত্বপূর্ণ ও মিশুক। যাই হোক, হঠাৎ করেই কক্ষটা নিস্তব্ধ হয়ে গেল। গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ প্রবেশ করেছেন! তখনই আমি বুঝতে পেরেছিলাম, কলম্বিয়াতে তিনি ঈশ্বরের মতো।

অ্যান ম্যাকলিন:
মার্কেজের উপন্যাস আমি প্রথম পড়েছিলাম ইডিথ গ্রসম্যান এবং গ্রেগরি রাবাসার অনুবাদের কল্যাণে। তার সাহিত্যই আমাকে আশির দশকের শেষের দিকে কলম্বিয়া ভ্রমণ করার এবং তার কিছু পরে স্প্যানিশ ভাষা শিখতে প্রলুব্ধ করেছিল। সুতরাং, সম্প্রতি আমার হাতে রাজ্যের কাজ থাকলেও এই উপন্যাসটি অনুবাদ করার সুযোগ পেলে তা ফিরিয়ে দেওয়ার প্রশ্নই আসে না।

গুস্তাভো আরাঙ্গো:
এ উপন্যাসটি পড়া এক কথায় রোমাঞ্চকর। আপনি পাবেন গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ পড়ার সেই আরাম, সেই স্বচ্ছন্দগতি যা আমাদের খুব চেনা আর প্রিয়। এর প্রেক্ষাপট আর সেই পুরনো ছোট মফস্বল শহর নয়— সেই একই ক্যারিবিয়ান অঞ্চল হলেও পরিবেশটা আরও আধুনিক আর শহুরে। মূল চরিত্রটি প্রতি ১৬ আগস্ট তার মায়ের কবরে ফুল দিতে ফিরে আসে।

হাভিয়ার মুঙ্গিয়া (লাস কার্তাস দেল বুমের যুগ্ম সম্পাদক):
হ্যাঁ, একটি দ্বীপে বসবাসকারী বিবাহিত নারীটি প্রতি বছর তার মায়ের কবরে ফুল দিতে যান। আর সেখানেই প্রথমবারের মতো তিনি তার স্বামীর প্রতি অবিশ্বস্ত হন। গাবো জীবিত থাকতেই কিন্তু কয়েকটি সংক্ষিপ্ত অংশ প্রকাশিত হয়েছিল। এল পাইসে এর দুটি অধ্যায় প্রকাশিত হয়। একটি অধ্যায়ের অনুবাদ ছাপা হয় ১৯৯৯ সালে নিউ ইয়র্কারে।

অ্যান ম্যাকলিন:
আমার মনে হয় আমি স্প্যানিশ ভাষায় বইটি প্রথম পড়ার সময় তার মনের অবস্থা বিবেচনায় নিয়েছিলাম। কিছু অসম্পূর্ণতার সন্ধান করছিলাম তার গদ্যে সাধারণত যা থাকে না। কিন্তু অনুবাদ করার সময় আমি উপন্যাসের বর্ণনামূলক ভাষ্যটাকে নতুন রূপ দিতে মন দিয়েছিলাম। আমরা জানি তিনি অন্তত সিকি শতাব্দী আগে এ ফর্মটা গড়ে তোলা শুরু করেছিলেন। অর্থাৎ তার ফোকাস হারাতে শুরু করার অনেক আগে।

গুস্তাভো আরাঙ্গো:
তিনি বইটা লিখতে শুরু করেন সেই নব্বইয়ের দশকে। প্রথমে এর দুটি অধ্যায় তৈরি করেন। তারপরে ২০০৪ সালে প্রকাশ করেন তার শেষ উপন্যাসিকা ‘মেমোরিজ অব মাই মেলানকলি হোরস্’। তবে এর মধ্যেই কিন্তু সেই ২০০০ সালের দিকেই ‘আনটিল অগাস্ট’ নিয়ে কাজ করছিলেন। তার উৎসাহের কমতি ছিল না। কিন্তু দম ফুরিয়ে যাচ্ছিল।

গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ (৬ মার্চ, ১৯২৭, কলাম্বিয়া-১৭ এপ্রিল, ২০১৪, মেক্সিকো) আলোকচিত্র: বিজনেস পোস্ট।

ফাবিও রদ্রিগেজ আমায়া:
‘মেমোরিস অব মাই মেলানকলি হোরস্’ একজন লেখক হিসাবে তার জীবনে সম্পূর্ণতা এনেছে। লোকে যা মন চায় বলতে পারে, কিন্তু তার লেখা সুন্দর। এ বইটি তার নস্টালজিয়ার গল্প। বারানকিয়া শহরের প্রতি তার শ্রদ্ধার্ঘ্য।

দাসো সালদিবার:
গুস্তাভো অস্টিনে গিয়ে পাণ্ডুলিপিটি পড়েন ও নোট নেন। তারপর তিনি একটি সুন্দর নিবন্ধ লেখেন যা মেক্সিকোর এল ইউনিভার্সালে ‘গাবোর মরণোত্তর উপন্যাসের সমর্থনে’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়।

গুস্তাভো আরাঙ্গো:
আর্কাইভটায় যাওয়ার পরেই আমি বইটা প্রকাশের পক্ষে প্রচারণা শুরু করবো বলে ঠিক করি।

দাসো সালদিভার:
উপন্যাসটা পড়ার সময় গুস্তাভো আমাকে মাদ্রিদে ফোন করেছিলেন। ফোনে তিনি বললেন, “দাসো, জানো আমি কোথায় এখন? আমি গাবোর উপন্যাস পড়ছি।’’ ‘‘কেমন লাগছে?’’, জানতে চেয়েছিলাম আমি। ‘‘নিখাঁদ গাবোর মতোই’’, জবাব দিয়েছিলেন গুস্তাভো।

নাদিয়া সেলিস:
উপন্যাসটি কিছু পাঠকের কৌতুহল মেটাতে পারে, মুগ্ধ করতে পারে কৌশলের কেরদানি দেখিয়ে। মার্কেজের কাজের সাথে যুক্ত চিরন্তন ক্যারিবিয়ান অঞ্চল সম্পর্কে তাদের পূর্বকল্পিত ধারণাগুলোর সঙ্গেও মিলে যেতে পারে তা। তবে বইটি নারীর যৌনতা সম্বন্ধে পুরুষের ফ্যান্টাসির বহিঃপ্রকাশেরই আরেকটি উদাহরণ। গার্সিয়া মার্কেজের কাজ জুড়েই যা দেখা যায়। নারীর কামনা-বাসনা সম্পর্কে ওই ফ্যান্টাসির মূল ভিত্তি হলো আমরা নারীরা সত্যিকার অর্থেই যা চাই তা হচ্ছে পুরুষ।

দাসো সালদিভার:
আমি গুস্তাভোর নিবন্ধ গিজেরমো আঙ্গুলোর কাছে পাঠিয়েছিলাম যিনি কিনা গাবোর ছেলেদের খুব ভালো বন্ধু। তিনি আবার এটি রদ্রিগো আর গঞ্জালোর কাছে পাঠান। আমি এটি কারমেন বালসেলস এজেন্সিতে গাবোর এজেন্ট মারিয়া ইসাবেল লুকেও পাঠাই। মারিয়া লেখাটা পড়ে আমাকে বলেছিলেন, ‘‘দাসো, বিষয়টা কি বলুন তো? গুস্তাভো কিভাবে এটা দেখার অনুমতি পেলেন? তিনি কিভাবে এই সব নোট নিতে পারলেন?’’ আমি তাকে বলেছিলাম, ‘‘চিন্তা করবেন না, ঘটনাটা ঘটেছে আমেরিকার মাটিতে। তাকে এটি পড়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। এটা তো দারুণ একটা টেক্সট। এটা নিজে পড়ুন। রদ্রিগো ও গঞ্জালোর সাথে শেয়ার করুন।’’ এভাবেই একসময় ওরা সবাই এক হয়ে উপন্যাসটা নিয়ে কথা বলতে শুরু করে।

গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ। আলোকচিত্র: দ্যা নিউ ইয়র্কার।

হাভিয়ের মুঙ্গিয়া:
তাদের ভাষ্য সমর্থন করার মতো কিছু দেখিনি। আসলে বিষয়টি হচ্ছে, তাদের প্রত্যেকেই বলতে পারে ‘‘আমিই লোকজনকে এটি নিয়ে কথা বলতে উৎসাহিত করেছি’’, যাতে লেখকের উত্তরাধিকারীরা এ নিয়ে আরও আগ্রহী হয়।

গুস্তাভো আরাঙ্গো:
আর্কাইভের ওরা আমাকে ফোল্ডারসহ বইটি দেওয়ার সময় বলেছিল, ছবি তোলা যাবে না। তবে আমাকে নোট নেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। সুতরাং আমি বেশ কিছু অংশ টুকে নিয়েছিলাম। প্রায় দশ পাতা ঠাসবুনট নোট।

স্টিফেন এনিস:
আমার যতটা মনে আছে, তারা উপন্যাসটা প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত নিলে মার্কেসের পরিবার ফাইলটি সবার দেখার সুযোগ বন্ধ করে দেয়।

গুস্তাভো আরাঙ্গো:
এটি কোন হারিয়ে যাওয়া উপন্যাস নয়। বরং একটি উপেক্ষিত উপন্যাস বলা যায়।

হাইমে আবেলো বানফি:
ব্যাপার হচ্ছে, রদ্রিগো এবং গঞ্জালো যদি এটি প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত না-ও নেন, তবে অন্য কেউ নিশ্চয়ই তা করবে। পাইরেটেড কপির কথা বলছি আর কি। 

নাদিয়া সেলিস:
আপনি কি দেখেছেন যে একটি পাইরেটেড কপি ইতিমধ্যেই কলম্বিয়াতে ছড়িয়ে পড়েছে? প্রকাশের তারিখের এক সপ্তাহ আগেই। আমি একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে একটি পিডিএফ পেয়েছি। সেখানে যে খুব পড়ুয়া লোকজন আছে তা-ও কিন্তু নয়।

হাভিয়ের মুঙ্গিয়া:
দেখুন, এটা ধরেই নেওয়া যায় যে তার মৃত্যুর দশ বছর হয়ে যাওয়ায় তারা উপন্যাসটা প্রকাশ করতেই চায়। এটি গাবোর শেষ উপন্যাস। বইটা বাজারে বের হলে আমি অবশ্যই পড়ব। গাবোর একজন উৎসুক পাঠক হিসাবে তার শেষ সাহিত্যকর্মটি কেমন হয়েছে তা দেখতে আমার তর সইছে না। প্রথম মার্কেসের বই পড়ার সময় আমার বয়স ছিল পনের বা ষোল বছর। তখনও মেক্সিকোর হারমোসিওতে থাকতাম আমি। সুপারস্টোর থেকে বাবা আমাকে সলিচিউডের একটি কপি কিনে দিয়েছিলেন। আমি ইতিমধ্যেই পাঁড় পাঠক হয়ে উঠেছিলাম। সমানে হেস, কাফকা, হেমিংওয়ে পড়েছি। কিন্তু সলিচিউডের প্রথম অনুচ্ছেদটি পড়েই মনে হলো ভারি বুলেটের ধাক্কা খেলাম। এটা ছিল সম্পূর্ণ অন্য মাত্রার।

নাদিয়া সেলিস:
খোলাখুলিই বলি, নারী পাঠকদের জন্য যৌন বা অন্য কোনো ধরনের স্বাধীনতা নিয়ে দাদার বয়সী কারো পথনির্দেশের প্রয়োজন নেই।

মেক্সিকোর নিজ বাড়ি গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ, ২০০৩। আলোকচিত্র: ইন্দিরা রেসস্ত্রেপো।

মিগেল ফাল্কেজ-সার্টেন (কবি এবং ঔপন্যাসিক):
আমরা সবাই জানি কিছু প্রকাশকের এমন সম্পাদকও আছেন যারা বেপরোয়া গোছের। ঝোঁকের বশেই তারা কোনো লেখকের কাজকে প্রত্যাখ্যান করতে পারেন। বালসেলস সেই কাজটি যে সম্পাদকের হাতে অর্পণ করেছিলেন (যার নাম আমরা এখনও জানি না) তিনি উপন্যাসটা সোজা সাপ্টা নাকচ করে দিয়েছিলেন। তার সেই জোরদার অভিমতের কারণেই এজেন্সি ও পরিবার উভয় পক্ষই বইটা না ছাপানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু এটি যদি কেবল একটি কাজ অসমাপ্ত থাকার বিষয়ই হত তবে কিন্তু আজ অবধি আমরা মুজিলের অসাধারণ কাজ ‘দ্য ম্যান উইদাউট কোয়ালিটিজ’ সম্পর্কে জানতাম না। বা কাফকার কিছু কাজ। কিন্তু তুলনা আর না করি! সারভান্তেস তাঁর মহান উপন্যাসে বলেছেন না, তুলনা ব্যাপারটা সত্যিই জঘন্য!

দাসো সালদিবার:
মনে হচ্ছে বালসেল্সের এজেন্সির সেই সম্পাদক বার্গাস ওসার মহাভক্ত। আর সে কারণেই ওরকম রিপোর্ট  দিয়েছিলেন। স্পষ্টতই তার সাহিত্যরুচি নিতান্তই খারাপ। (হাসি)

গুস্তাভো আরাঙ্গো:
মরণোত্তর উপন্যাসটি প্রকাশের পেছনে আমার একটি যুক্তি হচ্ছে ‘মাই মেলানকলি হোরস’ তার সমাপনী কাজ হতে পারে না। তিনি ‘মি টু’ আন্দোলনকারীদের প্রকাশ্য টার্গেটে পরিণত হয়েছিলেন। আজকাল লেখকদের নাকচ করে দেওয়া খুবই সোজা। বইয়ের কাহিনীর চরিত্রদের কৃতকর্মের জন্য আক্রমণ করা হচ্ছে লেখককে!

নাদিয়া সেলিস:
আমি মনে করি না যে গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজকে ‘বাতিল’ করা উচিত, যেমনটি কেউ কেউ সমর্থন করেছেন। আমি প্রধান উপন্যাসগুলোর জন্য গার্সিয়া মার্কেজের পক্ষে বলে যাবো। মানুষের আত্মবিনাশী ক্ষমতা সম্পর্কে তার সতর্কতামূলক আখ্যানগুলো গভীরভাবে দাগ কাটে। তার বর্ণনায় আমরা দেখতে পাই ক্ষমতার জন্য বিপজ্জনক লালসার ছবি যা এই পৃথিবীতে আমাদের অস্তিত্বকেই  হুমকির মুখে ফেলে। দরিদ্র ও ধনী, আম নাগরিক আর তাদের দুর্নীতিগ্রস্ত শাসক কিংবা ছোট দেশ এবং সাম্রাজ্যবাদী দূতদের মধ্যে মিথস্ক্রিয়ার ক্ষেত্রে মার্কেজ এই লালসার বিপদগুলো দেখতে পেয়েছেন ঠিকই। দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে, যে শক্তিটি তার পুরুষ চরিত্রগুলোর মধ্যে সব ধরনের  স্বৈরতান্ত্রিক ক্ষমতার সঞ্চার করেছে তাকে তিনি উপেক্ষা করে গেছেন। আধিপত্যের প্রতি ওই চরিত্রগুলোর আবেগের শেষ নেই। তাদের মধ্যে আরো আছে সহিংসতার মাধ্যমে পৌরুষ জাহির করার প্রবণতা, যা শুরু হয় তারা যে নারীদের ‘ভালোবাসে’ তাদের ওপরই সহিংসতার মধ্য দিয়ে।

ভ্যানেসা রোজালেস ( লেখক এবং পডকাস্টার):
আমি অবশ্যই উপন্যাসটি পড়তে চাই। নারী অনুভূতি গত দশকের সাহিত্যে সামনে এসেছে। প্রসঙ্গত বলা যায় ফেরান্তের ঘটনা, অ্যানি আর্নোর নোবেল পুরস্কার জয় এবং ল্যাটিন আমেরিকার নারীদের সম্পূর্ণ ভিন্ন রাজনৈতিক, শারীরিক, সামাজিক প্রাসঙ্গিকতার জায়গা থেকে লেখার কথা। সুতরাং গার্সিয়া মার্কেজ নারী স্বাধীনতা ও তার কামনা বাসনাকে কীভাবে কল্পনা করেন তা জানাটা কৌতুহলকর।

হাভিয়ের মুঙ্গিয়া:
সেদিনই দেখলাম গাবোর উপন্যাসটার প্রচ্ছদ প্রকাশিত হয়েছে। প্রচ্ছদে গাছের নিচে দাঁড়ানো এক নারী। ফ্রাংকফুর্ট বইমেলায় সদ্যই ঘোষণা করা হয়েছে এটা। আমরা উনাকে নিয়েই কথা বলছিলাম। আর তার মধ্যেই পেলাম খবরটা। কোনো না  কোনোভাবে গাবো আমাদের মাঝে থাকবেনই। তিনি সবসময়ই বিরাজ করেন।

রোজানা বুলমার (হে ফেস্টিভ্যাল অব লিটারেচার অ্যান্ড আর্টস এর কাউন্সিল সদস্য):
কার্লোস ফুয়েন্তেসের কল্যাণে ২০০৫ সালের জানুয়ারিতে প্রথম কার্তাহেনা হে ফেস্টিভ্যাল অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তিনি আমাদের পরিচালককে বলেছিলেন, কলম্বিয়া একটা অন্ধকার সময় থেকে বেরিয়ে আসছে বলে আমাদের এ ফেস্টিভ্যালটা আয়োজন করার কথা ভেবে দেখা উচিত। গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের দেশ কলাম্বিয়া যাওয়া ছিল আমার বড় স্বপ্নগুলোর একটি। এক নৌ ঘাঁটিতে আমাদের জন্য সংবর্ধনার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। দেশটির প্রেসিডেন্ট নাকি এলাকাটি সফরের সময় সেখানেই থাকেন। পৌঁছেই লক্ষ্য করলাম, ভবনটা খুব সাদামাটা। প্রেসিডেন্ট উরিবের স্ত্রী আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন। দলে আমরা প্রায় সত্তর জন ছিলাম। সবাই ছিল খুব বন্ধুত্বপূর্ণ ও মিশুক। যাই হোক, হঠাৎ করেই কক্ষটা নিস্তব্ধ হয়ে গেল। গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ প্রবেশ করেছেন! তখনই আমি বুঝতে পেরেছিলাম, কলম্বিয়াতে তিনি ঈশ্বরের মতো।

কারমেন বালসেলস (গাবোর এজেন্ট, ২০১৫ সালে মারা গেছেন):
গাবিসমো একদিন একটি ধর্মে পরিণত হবে।

স্টিফেন এনিস:
ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ার্স অব সলিচিউড এর টাইপ করা পাণ্ডুলিপির স্থান নিঃসন্দেহে আমাদের গুটেনবার্গ বাইবেলের পাশে।

গুস্তাভো তাতিস গেরা:
গাবোর যে ছবিটা আমার মনে গাঁথা ছিল তাতে সবসময় তিনি সাদা পোশাক পরা, চটপটে আর খুশি। নানান কাজ হাতে নেওয়ার কথা বলছেন। দেখা হলে সবসময় বলতেন, কোনো সাহিত্য কাজের নির্দিষ্ট ফর্মুলা নেই। আপনাকে শুধু লিখে যেতে হবে। নিরন্তর। থামার কোনো কারণ নেই। এ পরামর্শটাই তিনি আমাকে দিতেন সবসময়।

গ্যাব্রিয়েল এলিজিও তরেস গার্সিয়া:
একবার যখন আমি কাকাকে বললাম, আমি একটি উপন্যাস লিখেছিলাম কিন্তু হারিকেন ক্যাটরিনার সময়ে তা অন্যান্য জিনিসপত্রের সঙ্গে ভেসে গেছে, তিনি বলেছিলেন, ‘চিন্তা কোরো না। ওই উপন্যাসটা এমনিতেও খুব ভালো কিছু হতো না। এখন তোমাকে ওটা নতুন করে লিখতে হবে আর সেজন্যই তা আগেরটার চেয়ে ভালো হবে।’

দাসো সালদিবার:
আমি স্বপ্নে দেখেছিলাম যে আমি মার্কেজ যে বাড়িতে একশো বছরের নিঃসঙ্গতা লিখেছেন সেখানে গিয়েছি। গাবো এবং মের্সেদেজ ইতিমধ্যেই বাড়িটি ছেড়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু তারা সবকিছু ভুলে ফেলে গেছেন! এমনকি বাক্সগুলোও। গাবো প্রাথমিক সংস্করণসহ তার সমস্ত পাণ্ডুলিপি রেখে গেছেন। ফাইলগুলো পর্যন্ত। আমি নিজেকেই বললাম, ‘চমৎকার, দারুণ একটা উপভোগ্য সময় কাটাতে যাচ্ছি তাহলে!’ কিন্তু তারা চলে যাওয়ায় সব বাতি নিভে গিয়েছিল। তখন অন্ধকার হতে শুরু করেছে। আমি সব কিছু পড়ে ফেলার জন্য তৈরি হচ্ছিলাম। কিন্তু ততক্ষণে রাত নেমে গেছে আর মেঝেতে ঘুমের কোলে ঢলে পড়া ছাড়া আমার আর কিছুই করার ছিল না। কারণ এটি ততক্ষণে আর স্বপ্ন ছিল না, পরিণত হয়েছিল দুঃস্বপ্নে।

লরা মোরা (আসন্ন ‘হান্ড্রেড ইয়ার্স অব সলিচিউড’ টিভি সিরিজ এর পরিচালক):
আমার মা বলেন, আমি এ কাজটার মধ্যে এমনভাবেই ঢুকে গেছি মনে হয় উনিশ শতকের মাকন্দোতেই বসবাস করছি। আমি কোনো স্বপ্ন বা দুঃস্বপ্ন দেখিনি, কিন্তু দ্যাখো কেউ একজন আমাকে একটা মোমবাতি দিয়েছিলেন। (তিনি মোমটা স্ক্রিনের দিকে তুলে ধরেন। সেক্রেড হার্ট বা ভার্জিন অব গুয়াদালুপের বদলে উঠে আসে গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের মুখচ্ছবি। তার পরনের সাদা কলারটা সার্ভেন্তেস বা শেক্সপিয়ারের আমলের মতো।) আমরা সেটে এটা জ্বালিয়েছিলাম।

হাইমে আবেলো বানফি:
তাহলে শুনুন, বছর দুয়েক আগে কার্তাহেনায় তার বাড়িতে আমার কি অভিজ্ঞতা  হয়েছিল। গাবোর চলে যাওয়ার কয়েকবছর হয়ে গেছে। তার স্ত্রী মের্সেদেস খুব ঘনিষ্ঠ কোনো আত্মীয়কে একটা বিয়ের অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য বাড়িটা ব্যবহার করতে দিয়েছিলেন। আমি সে অনুষ্ঠানে গিয়েছি। তো শ্যাম্পেনের গ্লাস হাতে নিতেই আচমকা সেটা আমার হাতে ফেটে গেল! বেয়ারা তাড়াতাড়ি আমাকে আরেকটা গ্লাস এনে দিল। কিন্তু এ কী! আবার সেই একই ঘটনা। ব্যাপারটা সবকিছু বদলে দিল। প্রথমে আমার ভয় হয়েছিল। ঠিক পরের মূহুর্তেই ঘিরে ধরল এক অন্যরকম বিস্ময়। তখনই আমার মনে হলো, নির্ঘাত গাবো স্বয়ং এখানে উপস্থিত। তিনি আমাদের সাথে মজা করছেন। স্রেফ আরেকটা নতুন মজা করলেন আরকি!

লেখক: সাংবাদিক এবং মার্কেজকে নিয়ে লেখা ‘সলিচিউড অ্যান্ড কম্পানি’ (বন্ধু, পারিবার, ভক্ত, সমালোচনাকারী, সহ-প্র্যাংকস্টার, মাতাল এবং কিছু সজ্জন ব্যক্তির জবানিতে গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের জীবন) বইয়ের লেখক। লেখাটি ৭ মার্চ ২০২৪ দ্য প্যারিস রিভিউ-তে প্রকাশিত। ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন সুমন কায়সার

সিলভানা পাতেরনস্ত্রো
ad

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত