Beta
বৃহস্পতিবার, ৯ মে, ২০২৪
Beta
বৃহস্পতিবার, ৯ মে, ২০২৪

শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে কী বার্তা দিচ্ছে

হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটিতে গাজার সমর্থনে শিক্ষার্থীদের একাংশের বিক্ষোভ সমাবেশ।
হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটিতে গাজার সমর্থনে শিক্ষার্থীদের একাংশের বিক্ষোভ সমাবেশ।

গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ চলছে যুক্তরাষ্ট্রের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোতে। সাধারণ শিক্ষার্থীরা স্বতস্ফুর্তভাবে মানবিকতার পক্ষে অবস্থান নিয়ে ইসরায়েলের বিরোধিতা করছে।

এই ঘটনা যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান ডেমোক্রেট প্রশাসনের জন্য মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও তার প্রশাসন ইসরায়েলের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। অন্যদিকে দেশটির তরুণ প্রজন্ম ও বহু আমেরিকান ফিলিস্তিনকে সমর্থন দিচ্ছে।

এমন পরিস্থিতি যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক অঙ্গণে প্রজন্মগত ব্যবধানকে আরও স্পষ্ট করে তুলেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের তরুণদের ইসরায়েলবিরোধী মনোভাব দেশটির রাজনীতিকদের ও প্রশাসনকে চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। দেশটির বয়স্কদের মধ্যে ইসরায়েলকে সমর্থনের হার বেশি।

পর্যবেক্ষকদের অনেকে মনে করেন, তরুণদের মধ্যে ফিলিস্তিনের প্রতি সমর্থন বেশি থাকায় বাইডেনকে আগামী নির্বাচনে জিততে যথেষ্ট বেগ পেতে হবে। একই সঙ্গে চলমান বিক্ষোভের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের উভয় রাজনৈতিক দলের কাছে ইসরায়েলের গ্রহণযোগ্যতা হারানোর ঝুঁকি তৈরি হতে পারে।

মিনেসোটায় গাজার প্রতি সংহতি জানিয়ে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ সমাবেশ।

ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্র বিজ্ঞানের সহকারী অধ্যাপক ওমর ওয়াসো বলেন, “আমরা এরইমধ্যে ইসরায়েল প্রশ্নে প্রজন্মগত ব্যবধানের প্রমাণ দেখতে পাচ্ছি। এটি ডেমোক্রেটিক পার্টির জন্য দীর্ঘমেয়াদী সমস্যা হয়ে দেখা দেবে। এই বিক্ষোভগুলো প্রজন্মের ব্যবধানকে ত্বরান্বিত করছে।”

নিউ ইয়র্কের কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা গত সপ্তাহে ফিলিস্তিনের প্রতি সমর্থন জানিয়ে ক্যাম্পাসে একটি অস্থায়ী শিবির তৈরি করে। সেখান থেকেই তারা বিক্ষোভ করছেন।

এদিকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিক্ষোভাকারীদের সরিয়ে দিতে পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছে। এরপর থেকে শিক্ষার্থীদের গ্রেপ্তার ও বিভিন্ন শাস্তিমূলক পদক্ষেপের মুখোমুখি হতে হচ্ছে।

বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্র, শিক্ষক ও সাংবাদিকদের গ্রেপ্তারের ভিডিও ফুটেজ ব্যাপক ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। তবে এতে বিক্ষোভ কমেনি, উল্টো বেড়েছে।

গুরুত্বপূর্ণ মোড়

আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা মূলত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিনিয়োগের তথ্য প্রকাশ হোক তা চাইছে। অস্ত্র নির্মাতা ও ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর সঙ্গে জড়িত কোনও কোম্পানিতে যেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিনিয়োগ না থাকে, তা নিশ্চিত করতে চাইছে তারা।

যুক্তরাষ্ট্রের উভয় প্রধান দলের রাজনীতিবিদ, হোয়াইট হাউস এবং ইসরায়েলপন্থী গোষ্ঠীগুলো আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে ইহুদিবিদ্বেষ ছড়ানোর অভিযোগ এনেছে। যদিও এমন অভিযোগ শুরু থেকেই অস্বীকার করে আসছে আন্দোলনকারীরা।

ইসরায়েলের সঙ্গে যুক্ত প্রতিষ্ঠানে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিনিয়োগ প্রত্যাহারের আহ্বান।

শিকাগো ইউনিভার্সিটির সমাজবিজ্ঞানী ঈমান আবদেল হাদি মনে করেন, অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক নীতির বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে তরুণদের মধ্যে ক্রমশ হতাশা বাড়ছে। বিক্ষোভগুলো যুক্তরাষ্ট্রের জনগণকে একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে দাড় করিয়েছে।

তিনি বলেন, “বয়স্ক প্রজন্মের প্রতি এবং তারা যে ব্যবস্থা পরিচালনা করছে, তার প্রতি তরুণদের অসন্তোষ অনেক। আমেরিকার ইতিহাসে জনমতের বড় পরিবর্তন বড় ছাত্র আন্দোলনের কারণেই হয়েছে।”

আবদেল হাদির মতে, ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের এসব কর্মকাণ্ড রাজনৈতিক পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এসব বিক্ষোভকে তিনি ভবিষ্যতের জন্য ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন।

দুশ্চিন্তায় বাইডেন

যুক্তরাষ্ট্রে পরিচালিত গত কয়েক বছরের জনমত জরিপ বলছে, দেশটির তরুণদের মধ্যে ফিলিস্তিনিদের প্রতি সহানুভূতিশীল ও ইসরায়েলের সমালোচনা করার হার বাড়ছে। শুধু তরুণরাই নয়, সাধারণ আমেরিকানদের মধ্যেও একই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।

একাধিক জরিপ বলছে, অধিকাংশ আমেরিকান ফিলিস্তিনের গাজায় স্থায়ী যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবকে সমর্থন করে। গাজায় গত ৭ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া সংঘাতে এরই মধ্যে ৩৪ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি ইসরায়েলের হাতে নিহত হয়েছে। এই অমানবিক পরিস্থিতি মেনে নিতে পারছেন না সাধারণ আমেরিকানরা।

শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ সমাবেশ ব্যারিকেড দিয়ে আটকে দিয়েছে পুলিশ।

কিন্তু এতো কিছুর পরেও প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইসরায়েলকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছেন। আর এনিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে চলছে তুমুল সমালোচনা। বাইডেনের এই অবস্থানের জন্য তাকে চড়া মাসুল দিতে হতে পারে। কারণ নভেম্বরে তাকে রিপাবলিকান পূর্বসূরি ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে ভোটের লড়াইয়ে নামতে হবে।

জরিপ বলছে, ইসরায়েলকে সমর্থন দেওয়ার প্রশ্নে রিপাবলিকান পার্টির মতো ঐক্যবদ্ধ নয় ডেমোক্রেট শিবির। দলটিতে ইসরায়েল ইস্যুতে বিভাজন স্পষ্ট।

যুক্তরাষ্ট্রের ছাত্র আন্দোলনবিষয়ক ইতিহাসবিদ অ্যাঙ্গাস জনস্টনের মতে, ইসরায়েল নিয়ে প্রজন্মগত বিভাজন সবচেয়ে বেশি ডেমোক্রেটদের মধ্যে।

তিনি বলেন, “তরুণ ভোটাররা কী চায়, তা ডেমোক্রেটিক রাজনীতিকরা বুঝতে পারছে না। তরুণদের মূল্যবোধের সঙ্গে ওই রাজনীতিকদের ব্যাপক বিচ্ছিন্নতা রয়েছে।

“ওই একই বিচ্ছিন্নতা আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি ক্যাম্পাসের তরুণদের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, সাবেক শিক্ষার্থী ও দাতাদের মধ্যে।”

বিক্ষোভকারী এক শিক্ষার্থীকে আটকের দৃশ্য।

সমাজবিজ্ঞানী আবদেল হাদির মতে, ডেমোক্র্যাটরা বলেছিল বাইডেনকে নির্বাচিত করলে ট্রাম্পের মতো কর্তৃত্ববাদী নেতার হাত থেকে দেশ রক্ষা পাবে। কিন্তু গাজা সংহতি আন্দোলনে পুলিশের কঠোর পদক্ষেপ ডেমোক্রেটদের ওই যুক্তিকে দুর্বল করেছে।

আল জাজিরাকে তিনি বলেন, “বাস্তবতা হলো ডেমোক্রেটরা আমাদের বলেছে যে, তরুণদেরই গণতন্ত্রকে বাঁচাতে হবে। আর গণতন্ত্রকে বাঁচাতে বর্তমান প্রশাসনের সঙ্গে যেকোনও বিবাদ দূর করতে হবে। কিন্তু যখন রাষ্ট্রীয় পুলিশ শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের প্রতিবাদ করার জন্য মারধর করে এবং হোয়াইট হাউস এনিয়ে কোনও মন্তব্য করে না, তখন কি গণতন্ত্র থাকে?”

অধ্যাপক ওয়াসোও মনে করেন, বিক্ষোভকারীদের উপর পুলিশি নির্যাতন তরুণদের বাইডেনের প্রতি উদাসীনতা বাড়াবে। ডেমোক্রেটদের পক্ষে এমন কিছু করা উচিত হবে না যাতে জনগণ ভোট দেওয়ার সময় বাইডেনের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়।

নীতির পরিবর্তন

যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষার্থীরা ফিলিস্তিনিদের মানবাধিকার রক্ষার জন্য বিক্ষোভ করছে। তাদের এই কর্মকাণ্ড দেশটির দলগত রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্কিত নয়।

সেক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের নীতিতে পরিবর্তন আনতে ও বিনিয়োগ প্রত্যাহারের দাবি পূরণে এই বিক্ষোভগুলো কি সহায়ক হতে পারে? এমন প্রশ্ন অনেকের।

কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে অস্থায়ী তাঁবু খাটিয়ে চলছে বিক্ষোভ।

ইতিহাসবিদ জনস্টনের মতে, কলেজগুলো স্বল্প সময়ের মধ্যে বড় প্রতিষ্ঠান ও প্রতিরক্ষা শিল্প থেকে তাদের বিনিয়োগ প্রত্যাহার করবে বলে মনে হচ্ছে না। তবে তাদের বিনিয়োগের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা বজায় রাখার দাবি যুক্তিসঙ্গত। দীর্ঘমেয়াদী পরিবর্তন সম্ভব। কিন্তু তা রাতারাতি হবে না।

তিনি বলেন, “ইতিহাস বলে, ছাত্র আন্দোলন নীতির পরিবর্তন করতে পারে। তবে এই পরিবর্তন সবসময় দ্রুত এবং শিক্ষার্থীদের আশা অনুযায়ী হয় না। কিন্তু আন্দোলন তীব্র হলে এর উল্লেখযোগ্য প্রভাব পড়তে পারে।”

উদাহরণ হিসেবে জনস্টন দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদের বিরুদ্ধে ১৯৫০ এর দশকের ছাত্র আন্দোলনের কথা বলেন। ওই আন্দোলনের কারণে তৎকালীন প্রশাসন নীতি পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছিল।

জনস্টন বলেন, “আমি মনে করি ১৯৮০-এর দশকে দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলন যুক্তরাষ্ট্রের জনমত বদলে দিয়েছিল। এটি দক্ষিণ আফ্রিকার শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক মতামত পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।”

১৯৬০ এর দশকের নাগরিক অধিকার আন্দোলন নিয়ে গবেষণা করেছিলেন ওয়াসো। তার মতে, বিক্ষোভ জনমত পরিবর্তন করতে পারে। এটি রাজনৈতিক জোট গঠনের পাশাপাশি নাগরিক ক্ষমতা গড়ে তুলতেও পারে।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ad

সর্বাধিক পঠিত