Beta
বৃহস্পতিবার, ৯ মে, ২০২৪
Beta
বৃহস্পতিবার, ৯ মে, ২০২৪

বাস্তুকৃষ্টি

বাংলার মাটির বাড়ির ঠিকুজি তালাশ

টালির ছাউনিকরা ঘর। পুরুলিয়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত। আলোকচিত্র: সুদীপ পাত্র।

‘‘নয়া বাড়ী লইয়া রে বাইদ্যা বানলো জুইতের ঘর। লীলুয়া বয়ারে কইন্যার গায়ে উঠলো জ্বর॥’’

দ্বিজ কানাই প্রণীত এবং চন্দ্রকুমার দে সংগৃহীত ‘মহুয়া পালা’য় ‘জুইত’-এর ঘরের উল্লেখ পাই আমরা। কিন্তু কোন ঘরকে ‘জুইতের ঘর’ বলে আর ‘চালাঘর’ কোনটা? কোঠাবাড়ি, মাঠকোঠা বা লতাপেড়ে বাড়ি কোনটা? মাটির দেয়াল কেমন হলে লেপাকাঁথ কেমন হলে ছাঁটাকাঁথ? বাংলার ঐতিহ্যবাহী মৃৎ-স্থাপত্য বা মাটির বাড়ি তৈরির রীতি-কারিগরীই বা কেমন? মাটির বাড়ি কেমন নির্মাণ উপকরণ, কাঠামো ও নকশায় তৈরি? ইতিহাসের পাঠ ও সরেজমিন গবেষণার ভিত্তিতে তথ্য-উপাত্ত-ছবি সমেত বাংলার মাটির বাড়ি নিয়ে লিখেছেন ড. মো. শাহিনুর রশীদ।   

মাটির স্থাপত্যের ইতিহাস বহু প্রাচীন। বিশ্ব প্রেক্ষাপটে এই নির্মাণ-প্রযুক্তি প্রায় ৯০০০ বছরের পুরনো। বাংলা অঞ্চলে মৃৎস্থাপত্য ও মাটির বাড়ির ইতিহাসও অন্ততপক্ষে কয়েক হাজার বছরের। এর মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের বাণগড়েই সম্ভবত প্রথম মাটির স্থাপত্যের স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়। এছাড়া পাণ্ডু রাজার ঢিবিতে খ্রিস্টপূর্ব ১১ শতকের ও সমসাময়িক মহিষদলসহ চন্দ্রকেতুগড়, মঙ্গলকোট, তাম্রলিপ্তি, মহাস্থানগড়, উয়ারী-বটেশ্বর প্রভৃতি স্থানে প্রত্নতাত্ত্বিকগণ মৃৎ-স্থাপনার প্রমাণ পেয়েছেন। পূর্ববঙ্গের উয়ারী-বটেশ্বর ও পশ্চিমবঙ্গের তমলুকে ছাউনি হিসাবে ব্যবহৃত প্রচুর টালি পাওয়া গেছে। ‘কার্বন-১৪’ তারিখ অনুসারে উয়ারী-বটেশ্বরের টালি আচ্ছাদিত স্থাপনাটির কাল খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতক। প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের পাশাপাশি সাহিত্যিক সূত্রেও মৃৎস্থাপনার খোঁজ পাওয়া যায়। ফলে একথা বলা যায় যে প্রকরণ বা যে কাঠামোরই হোক বাংলায় মাটির বাড়ির ঐতিহ্য বহু প্রাচীন।

একটা বিষয় মনে রাখা দরকার, স্থানীয় ও সহজলভ্য নির্মাণ সামগ্রীর ব্যবহার স্থাপত্যের সহজাত বৈশিষ্ট্য। এই বৈশিষ্ট্যই সব দেশজ-স্থাপত্যের প্রধান বা মূখ্য প্রবণতা। নির্মাণ উপকরণ ছাড়াও ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য স্থাপত্যের আকার-আকৃতি, কাঠামো, বিন্যাস, প্রকৃতি নির্ধারণের গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক। সেই সাথে মানুষের আর্থিক সামর্থ্য ও নান্দনিকবোধও স্থাপত্যের বিকাশে প্রভাব বিস্তার করে। বাংলার স্থাপত্যও একইভাবে স্থানীয় উপাদান ও নিয়ামকগুলোর প্রভাবে বিকশিত হয়েছে। একই কারণে বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্নরকমের স্থানীয় বৈশিষ্ট্যপূর্ণ বসত-বাড়ি ও অন্যান্য স্থাপনা গড়ে উঠেছে। এসব স্থাপনার, বিশেষত বসত-বাড়ির আকার, আকৃতি, ছাউনির ধরন, নির্মাণ উপাদানের পার্থক্য সুস্পষ্ট। ঘরবাড়ি ও অন্যান্য স্থাপনার এই ভিন্নতা প্রকারান্তরে মানুষের সাংস্কৃতিক ও সামাজিক ঐক্য এবং প্রযুক্তিগত দক্ষতার পরিচায়ক; যা প্রধানত মাটির তৈরি স্থাপনাতেই বেশি প্রকাশিত হয়েছে।

হাতির পিঠের মতো বাঁকা কাঠামোর চালা। ১৮৬০ দশকে কাশিমপুর গ্রামে অজ্ঞাত শিল্পীর তোলা। আলোকচিত্র: ব্রিটিশ লাইব্রেরি।

বাংলার মাটির স্থাপত্যকলা

বাংলার মাটির বাড়ির পরিসর ব্যাপক— ইতিহাস, ধরণ, ভূমি-নকশা, উচ্চতা, আকার-কাঠামো, ছাউনি, সজ্জা, ব্যবহার উপযোগিতা, প্রযুক্তি প্রভৃতি ক্ষেত্র এত সমৃদ্ধ, বিচিত্র ও বৈশিষ্ট্যপূর্ণ যে প্রতিটিই পৃথক আলোচনার দাবি রাখে। বড় পরিসরের এই আলোচনার সূচক হিসেবে এই নিবন্ধে বাংলার মাটির বাড়ির নির্মাণ-উপকরণ ও আকার-কাঠামোর প্রতি আলোকপাত করা হয়েছে।

প্রত্নতাত্ত্বিক সূত্রসমূহ পর্যালোচনা করে ঐতিহাসিক নীহাররঞ্জন রায় অভিমত প্রকাশ করেছেন যে, বাংলায় প্রাচীন যুগে দরিদ্র ও অবস্থাসম্পন্ন ব্যক্তিরা সাধারণত মাটি, খড়, বাঁশ, কাঠ প্রভৃতির তৈরি বাড়িতে বাস করতেন। চাল ছিল খড়ের, বাঁশের চাঁচারী বুনে তৈরি হতো বেড়া, খুঁটি হতো বাঁশের বা কাঠের। মাটির দেয়াল ছিল সাধারণত রাঢ় ও উত্তরাঞ্চলে। ছাউনি ছিল ধনুকাকৃতি বা দুই তিন স্তরে পিরামিডাকৃতির।

খুব সাধারণ ভাষায় বলা যেতে পারে, মাটি দিয়ে নির্মিত স্থাপত্যই মৃৎ-স্থাপত্য। প্রকারন্তে যে-স্থাপত্য ধারায় মাটি প্রধান নির্মাণ উপকরণ হিসাবে ব্যবহৃত হয়, সে-স্থাপত্য রীতিই মৃৎ-স্থাপত্য। প্রকৃতপক্ষে মৃৎ-স্থাপত্য স্থাপত্যের একটি ধরন বা এক বিশেষ বৈশিষ্ট্যের স্থাপত্য— যার ভিন্নতা কার্যত নির্মাণ উপকরণকেন্দ্রিক। ইংরেজি ভাষায় Mud-Architecture বা Earthen-Architecture বলতে যা বোঝায় তা-ই মৃৎ-স্থাপত্য।

বাংলা অঞ্চলের প্রেক্ষাপটে মাটির বাড়ির আবেষ্টনী মাটির দেয়াল বা বেড়ার সাথে মাটির আস্তরণ লেপে দিয়ে তৈরি করা দেয়াল এবং খড়, শন, টালি, টিন প্রভৃতির ঢালুচালা দিয়ে আচ্ছাদিত। বাঁশ ও কাঠের সাথে মাটি দিয়ে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বিশেষত দ্বিতল ভবনে সমতল ছাদ নির্মিত হয়। দ্বিতল ভবনের বেশিরভাগ সিঁড়িও মাটি দ্বারা তৈরি। এমনকি অলংকরণ ও পরিচর্যার প্রধান মাধ্যমও মাটি। এমন মাটির বাড়ির নির্মাণ-প্রযুক্তি, উপকরণ, কারিগর সবই স্থানীয় এবং এমন বাড়ি নির্মাণে সবচেয়ে কম জৈব-শক্তি ব্যবহৃত হয়। এ জন্য মৃৎ-স্থাপত্য বা মাটির বাড়িকে ‘Vernacular-Architecture’, ‘Indigenous-Architecture’, ‘Sustainable- Architecture’ বলা হয়।

নির্মাণ-উপকরণ

মাটির বাড়ির প্রধান নির্মাণ-উপাদান মাটি; এ মাটি মূলত লাল, এঁটেল, বেলে-এঁটেল প্রভৃতি নামে পরিচিত। এসব মূলত আঠালো মাটি। নির্মাণের জন্য স্থানীয় মাটিই ব্যবহৃত হয়— সাধারণত অন্য অঞ্চল হতে মাটি আনা হয় না। মাটির সহ-উপাদানের মধ্যে বাঁশ, কাঠ, খড়, শণ, উলুখড়, কাশ, ধানের নাড়া, তুষ ও পাট প্রধান। মাটির বাড়ির আচ্ছাদন-উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হয় টালি, খড়, শণ, উলুখড়, কাশ, বাঁশ ও পাট বা দড়ি। যদিও শণের ব্যবহার এখন আর দেখা যায় না। কোনও কোনও ক্ষেত্রে বিশেষ করে উন্মুক্ত বারান্দা, দেয়ালের ভিতের ওপর আচ্ছাদন প্রভৃতি নির্মাণে— বৃষ্টি বা বন্যা থেকে রক্ষার জন্য প্রাপ্যতার ভিত্তিতে ইট-বালি-সিমেন্টও ব্যবহৃত হয়। নিশ্চয় ইট-বালি-সিমেন্ট প্রভৃতির ব্যবহার পরবর্তীকালের প্রভাব। ছাউনি তৈরিতে শণ ও আর্উ-এর পরিবর্তে টিনের ব্যবহারও পরবর্তীকালের। উল্লেখ্য, বাংলা অঞ্চলে নির্মাণ কাজে ঢেউটিনের ব্যবহার শুরু হয় বিশ শতকের প্রথম দিকে। তবে ছাউনি হিসাবে টালির ব্যবহার মনে হয় আধুনিক বিষয় নয়। কারণ উয়ারী-বটেশ্বর ও তমলুকে ছাউনি হিসাবে ব্যবহৃত প্রচুর টালি পাওয়া গেছে। উয়ারী-বটেশ্বরের টালি আচ্ছাদিত স্থাপনাটির কাল খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতক। বাণগড়, পাণ্ডু রাজার ঢিবিতেও ছাউনির টালি পাওয়া গেছে।

মাটির স্থাপনার নির্মাণ-উপকরণ প্রাকৃতিক হওয়ায় সেসব সংগ্রহের জন্য পূর্বপ্রস্তুতি ও পরিকল্পনার প্রয়োজন পড়ে। এই প্রস্তুতি শুরু হয় শুকনো মৌসুমে— প্রধানত হেমন্তকালে এবং নির্মাণ কাজ শেষ করতে হয় বর্ষার আগেই। যদিও অনেক সময় দ্বি-তল বা দোতলা বাড়ি এক মৌসুমে শেষ করা সম্ভব হয় না। বিশেষত দেয়ালের আস্তরণ এবং লেপা-পোছা প্রায়ক্ষেত্রে পরে  সুবিধাজনক সময়ে শেষ করা হয়। মাটির বাড়ি তৈরির উদ্যোগের সময় কয়েকটি বিষয়ে বিশেষ প্রস্তুতি নিতে হয়। সেগুলো হলো অন্তত দুই ধরনের বাঁশ, কাঠ বা তালগাছের বর্গা এবং ছাউনিসামগ্রী সংগ্রহ করা। কেননা বাঁশকে রোদে শুকিয়ে এবং পানিতে ভিজিয়ে ‘পানাট’ করে ব্যবহার উপযোগী করতে হয়। একইভাবে বর্গাও ব্যবহারের আগেই প্রস্তুত করে রাখতে হয়।

চিত্র: ০১। বরেন্দ্র অঞ্চলের বাড়ির মূল ভবনের কয়েক ধরনের ভূমি-নকশা (স্কেল ব্যতীত)। উল্লেখ্য, বরেন্দ্র অঞ্চলে শতাধিক কক্ষ বিশিষ্ট মৃৎ-স্থাপত্যের নিদর্শনও রয়েছে।

ভূমি-নকশা

বাড়ি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মসজিদসহ যে কোনও নির্মাণেই সামর্থ্য ও প্রয়োজন অনুসারে ভূমি-নকশা প্রণীত হয়। সাধারণত বাংলার বাড়ি একটি চত্বরকে কেন্দ্র করে নির্মিত হয়। অনেক সময়, বিশেষত বরেন্দ্র অঞ্চলের মাটির বাড়ি প্রাচীর বেষ্টিত। প্রাচীরের অভ্যন্তরে এক প্রান্তে বাসগৃহ, অন্যান্য প্রান্তে গবাদি পশু-পাখি ও বিবিধ জিনিসপত্র রাখার ব্যবস্থা এবং বাইরে উঠান বা খলা, পুকুর, চারপাশে নানান বৃক্ষ— এই হলো বাড়ির সাধারণ বিন্যাস। বাইরের উঠানের (external court) পাশে থাকে গবাদিপশু বাঁধার ব্যবস্থা এবং এই উঠান কার্যত উৎপাদিত ফসল মাড়াই কাজে ব্যবহৃত হয়। ‘মরাই’ বা গোলাঘর সাধারণত বাইরেই নির্মিত হতো; এখন তা বাইরে তো বটেই গৃহ-অভ্যন্তরেও বিরল। নিকট অতীত পর্যন্ত সম্ভ্রান্ত পরিবারে বাড়ির পাশেই বৈঠকখানা ও চণ্ডীমণ্ডপও তৈরি হতো।

বাড়ির ক্ষেত্রে এক-তলা এবং এক কক্ষ ও দুই কক্ষ বিশিষ্ট ঘর নির্মাণের জন্য ভূমি-নকশা খুবই সাধারণ হয়। এক কক্ষের ক্ষেত্রে তা প্রয়োজন অনুসারে বর্গাকার বা আয়তাকার হয়ে থাকে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এদের সম্মুখে উন্মুক্ত বারান্দা সংযুক্ত হয়। কোনও কোনও বাড়ির ভূমি-নকশা অত্যন্ত পরিকল্পিত এবং বাংলাদেশের বরেন্দ্র অঞ্চলের দোতলা মাটির বাড়ির নিদর্শনসমূহে অনেক ধরনের ভূমি-নকশা দেখা যায়। এদের বেশিরভাগই চার কক্ষের সমন্বয়ে এবং একটি কক্ষের সম্মুখে আর একটি কক্ষ নির্মাণ করে কক্ষ-শ্রেণি সৃষ্টি করা হয় (চিত্র: ১)। উভয় কক্ষের সম্মুখে একটি টানা বারান্দাও নির্মিত হয়। মসজিদ নির্মাণেও সাধারণত এই ধারা অনুসরণ করা হয়। বরেন্দ্র অঞ্চলে তিন কক্ষ বিশিষ্ট ভবনও নির্মিত হয়। এক্ষেত্রে পাশাপাশি দুটি কক্ষের সম্মুখে আড়াআড়ি করে দীর্ঘ একটি কক্ষ নির্মিত হয় এবং এটি প্রবেশকক্ষ হিসাবে ব্যবহৃত হয়। উভয় ক্ষেত্রে ভবনের দ্বিতীয় তলায় আরোহণের জন্য সম্মুখ কক্ষে কখনো একটি, কখনো দুটি সিঁড়ি নির্মিত হয়। ব্যতিক্রম হিসাবে কখনো তা মূল-কক্ষ থেকেও সূচিত হয়। সিঁড়ি একটি হলে দুই কক্ষশ্রেণির মধ্যস্থলে এবং দুটি হলে সম্মুখ কক্ষের দুই পাশের দিকে নির্মিত হয়। অনেক সময় কক্ষের সংখ্যা বেশি হলে ভবনের ভূমি-নকশা স্কুলের মতো দীর্ঘ হয়। উল্লেখ করা দরকার, বরেন্দ্র অঞ্চলে শতাধিক কক্ষ বিশিষ্ট মৃৎ-স্থাপত্যের নিদর্শনও রয়েছে। ভবনসমূহের আকার, কাঠামো, ভূমি-নকশা ও কক্ষের বিন্যাসে পার্থক্য থাকলেও সব ক্ষেত্রে ভবনের সম্মুখে উন্মুক্ত বারান্দা সংযোজিত হয়। বারান্দা প্রায়ক্ষেত্রে এক চালার ছাউনি দ্বারা আবৃত থাকে।

প্রয়োজন অনুসারে শুধু মূল ভবন বা ঘর নয়, সমগ্র বাড়ির পরিকল্পনা এমনভাবে প্রণীত হয় যে, সেসব বাড়ি সমৃদ্ধ কৃষক ও যৌথ পরিবারের প্রয়োজনীয় সমুদয় চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম। কিছু বাড়ির ভূমি-নকশা দুই অংশে বিভক্ত। এ বিভক্তি কৃষি ও কৃষি সংশ্লিষ্ট কার্যাবলীকে মূল বাড়ি থেকে পৃথক করায় পারিবারিক একান্ততা (family privacy) অধিক রক্ষিত হয়। আবার কিছু বাড়ির ভবনের কক্ষ-বিন্যাসে ভিন্নতাও দেখা যায়। যেমন— কক্ষসমূহ বাইত (bayt) আকারে বিন্যাসিত। বরেন্দ্র অঞ্চলে এ ধরনের কক্ষের বিন্যাসের নজির খুব স্বল্প। মধ্যপ্রাচ্যে উমাইয়া ও আব্বাসীয় প্রাসাদ স্থাপত্যে এ ধরনের এবং আরও যৌগিক বাইত দেখা যায়। এটা মূলত রোমান স্থাপত্যরীতি যা মুসলমানরা সিরীয় অঞ্চল থেকে গ্রহণ করেছিল।

নানান ধরনের কার্যালয়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মসজিদের ভূমি-নকশাও প্রয়োজন অনুসারেই নির্মিত হয়। কার্যালয় ও ছোট মসজিদসমূহ সাধারণত এক কক্ষ বিশিষ্ট হয়ে থাকে। তবে বড় এবং দোতলা মসজিদের পরিকল্পনা প্রায় ক্ষেত্রে দোতলা বাড়ির সাথে সমঞ্জস্যপূর্ণ। ব্যতিক্রমও লক্ষ্য করা যায়, যেমন নাচোলের আখিলা জামে মসজিদ— এর ভূমি-নকশা আদর্শ মসজিদের সাথে তুলনীয়। অপরদিকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সাধারণত সরল রেখায় বা ইংরেজি ‘এল’ বর্ণের আকারে নির্মিত হয়। প্রায় সব ক্ষেত্রেই বাড়ির মতই সম্মুখে উন্মুক্ত চত্বর রেখেই নির্মিত হয়। তবে নাটোরে চারদিকে বারান্দাবেস্টিত ইংরেজি বর্ণ ‘ইউ’ আকৃতির শতবর্ষী স্কুল ভবনও দেখা গেছে।

চিত্র: ০২। ছইঞ্চা যুক্ত দ্বি-তল ভবন, বাইরের ধারি পাকা এবং দেয়াল রং ও আলকাতরায় প্রলেপ করা। ২০১৫, মঙ্গলা, নওগাঁ।

আকার-আকৃতি ও কাঠামো

নির্মাতার আর্থিক সামর্থ্য ও প্রয়োজনীয়তা এবং অনুভূমিক আয়তন বা ব্যপ্তি, ভবনের উচ্চতা, আবেষ্টনী ও আচ্ছাদনের উপর মাটির বাড়ির আকার-আকৃতি ও কাঠামো নির্ধারিত হয়। এজন্য ব্যবহারের ভিত্তিতে ঘরের নাম: শয়নঘর, ঠাকুরঘর, আঁতুড়ঘর, রান্নাঘর, ভাঁড়ারঘর, গোয়ালঘর, ঢেঁকিঘর, সদরঘর। আরও আছে গোলাঘর, কাঁচাঘর, সিঁড়িঘর। আকারের দিক থেকে বাড়ি—চালাঘর, কোঠাবাড়ি, মাঠকোঠা, বারান্দাসহ লতাপেড়ে হয়ে থাকে। মাটির দেয়ালভেদে: লেপাকাঁথ, ছাঁট বা ছাঁটাকাঁথ, ঝিটে বা ছিটেবড়ার কাঁথ। উল্লেখ্য মাটির দেয়াল কাঁথ নামেও পরিচিত। চালাভেদে: একচালা, দোচালা, চারচালা, আটচালা, বারোচালা। উচ্চতা অনুসারে: একতলা, দোতলা, তিনতলা (চিত্র: ০২)। সম্মুখে উন্মুক্ত বারান্দাসহ এক কক্ষ বিশিষ্ট ভবন সবচেয়ে ছোট হয়। সম্মুখে উন্মুক্ত বারান্দাসহ দুই কক্ষ বিশিষ্ট ভবনই বেশি। তবে কক্ষশ্রেণির সংখ্যা বৃদ্ধি করে ভবনের আকার দীর্ঘও করা হয়ে থাকে। ছাদ নির্মাণের সুবিধার্থে কক্ষসমূহের প্রশস্ততা সবসময় সীমিত করা হয়। এ প্রশস্ততা সাধারণত দশ ফুটের বেশি হয় না। তবে কক্ষের দৈর্ঘ্য অধিক হতে কোনও বাধা নাই। মাটির বাড়ির আকার শুধু ভূ-সমান্তরালেই বৃদ্ধি পায় না; ঊর্ধ্বমুখীও হয়ে থাকে। এর উদাহরণ তিনতলা বাড়ি (চিত্র: ০৩)। বর্গাকার ভূমি-নকশায় নির্মিত ছাদ ব্যতীত শুধু চারটি চালা দ্বারা আচ্ছাদিত একতলা ভবন সবচেয়ে নিচু বা কম উচ্চতা বিশিষ্ট হয়ে থাকে। এরূপ ভবনের ভূমি দেয়াল সাধারণত সাত ফুট উঁচু এবং তার ওপরে চালা আরও প্রায় সাত থেকে দশ ফুট উঁচু হয়ে থাকে। এরূপ চালা ‘পিরামিডাল হিপ’ আকৃতির হয়ে থাকে। এরূপ ভবনে সমতল ছাদ নির্মিত হলে এবং তার ওপর ‘পিরামিডাল হিপ’ চালা তৈরি করলে এ উচ্চতা ১-২ ফুট বৃদ্ধি পায়। দোতলা বাড়ির ক্ষেত্রে দুটি সমতল ছাদ নির্মিত হয় এবং ওপরের সমতল ছাদের ওপর চালা নির্মিত হয়। দ্বিতীয় তলার উচ্চতা প্রায়ক্ষেত্রে কম হয়ে থাকে। নিচতলা সাধারণত সাত থেকে নয় এবং দ্বিতীয় তলা সাত-আট ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট হয়ে থাকে। অঞ্চলভেদে একতলার ঘরের ছাউনির জন্য ঘরের আকৃতিতে নতুন বৈশিষ্ট্য যুক্ত হয়। যেমন— কোর বা রাগ দেওয়া ঘর, যা ঢাকা ও ময়মনসিংহে ‘জুইত’-এর ঘর নামে পরিচিত। এগুলো দোচালা এবং দেখতে হাতির পিঠের মতো অর্ধবৃত্তাকার। এশ্রেণির ঘরের চালে এত রাগ (বাঁক) দেওয়া হয় যে, চালের নিচের কানা মাটির একেবারে কাছাকাছি আসে। মূলত ভৌগোলিক কারণেই মাটির বাড়ির আকার-আকৃতি-কাঠামোতে এসব ভিন্নতা দেখা যায়। এরূপ চালার প্রতিকৃতি দেখা যায় চন্দ্রকেতুগড়ে প্রাপ্ত খেলনা-টেরাকোটায়। এসব চালা শুধু বাংলায় নয়, সমগ্র ভারতে ব্যবহৃত হয়েছে এবং বিশ্বের অন্যত্রও নানান প্রকৃতির প্রত্ন-ইমারতে বিভিন্ন ধরনের চালা দেখা যায়। ভারতের মধ্যে বক্রাকার এই চালা সর্বাপেক্ষা সুন্দর হিসাবে আখ্যায়িত হয়।

চিত্র: ৩। তিন তলা ভবন, গৌরী, আরামবাগ, হুগলী। আলোকচিত্র: সুব্রত ঘোষ।

মাটির বাড়ির আবেষ্টন কাঠামো সম্পূর্ণরূপে মাটি দিয়ে নির্মিত। কাঠামো তৈরি হয় মাটির কতকগুলো দেয়াল নির্মাণের মধ্য দিয়ে। প্রায় ক্ষেত্রে অভ্যন্তর দেয়ালের তুলনায় বহির্দেয়ালের প্রশস্ততা বেশি হয়ে থাকে। এই প্রশস্ততা অঞ্চলভেদে ‘পানা’ নামেও পরিচিত। এই ‘পানা’ দেয়ালের উচ্চতার ওপর নির্ভর করে। একতলা এবং সমতল ছাদহীন ভবনের তুলনায় সমতল ছাদসহ দোতলা বাড়ির দেয়ালের প্রশস্ততা বেশি হয় এবং তা ত্রিশ থেকে বিয়াল্লিশ ইঞ্চি পর্যন্ত হয়ে থাকে। দেয়ালের এ প্রশস্ততা মেঝে হতে ক্রমান্বয়ে শীর্ষ দিকে উভয় পাশ থেকে হ্রাস পায়। ফলে সমগ্র কাঠামো ঢালু (Tapering)  হয়ে প্রায় পিরামিডের নিম্নাশের আকৃতি ধারণ করে । মাটির বাড়ির এমন বৈশিষ্ট্য বরেন্দ্র অঞ্চলের সবখানেই দেখা যায়। এ বৈশিষ্ট্যের জন্য নিচ-তলার কক্ষের তুলনায় ওপরের কক্ষের পরিসর বৃদ্ধি পায়। তবে এ বৈশিষ্ট্যের জন্য কাঠামোও বেশি শক্তিশালী ও দীর্ঘস্থায়ী হয়ে থাকে। এটাই এ বৈশিষ্ট্যের অনন্য দিক। এ প্রযুক্তির ব্যবহার বিশ্বের অন্যান্য স্থানেও দেখা যায়। মিশরের পিরামিড, সাসানীয় অগ্নিমন্দির, বুখারার সামানীয় সমাধি, শাহ্ রুকুন-ই-আলমের সমাধি, সুলতান গিয়াসউদ্দিন তুঘলকের সমাধি প্রভৃতি তার উদাহরণ। তবে এদের দেয়াল ভিতর দিক থেকে ঢালু নয়, শুধু বাইরের দিক থেকে ঢালু।

মাটির বাড়ির দোতলা ভবনে প্রায় সময় আরেকটি কাঠামো সংযুক্ত হয়ে থাকে; আর তা হলো: ঝুলবারান্দা (চিত্র: ০৪)। নিচের উন্মুক্ত বারান্দার ওপরে এবং প্রথম সমতল ছাদের সমান্তরালে প্রক্ষিপ্ত আকারে (Projected) এ ঝুলবারান্দা তৈরি করা হয়। ঝুলবারান্দা প্রধানত বাড়ির প্রধান অঙ্গনের দিকে, তবে অনেক সময় চারদিকে বেষ্টিত আকারেও তৈরি হয়ে থাকে।

চিত্র: ০৪। দূর্গাপুরের হাজীবাড়ির চারদিকে বেষ্টিত ঝুলবারান্দার উত্তরাংশ। ২০১২, নওগাঁ।

ছাদ বা চালা

মাটির বাড়ির সমতল ছাদের ওপর টিন বা খড়-শণের আচ্ছাদন দিতে হয় (চিত্র: ০৫)। এ আচ্ছাদন চাল বা চালা নামে পরিচিত। ভবনের আকার ও সামর্থ্যের ওপর চালার সংখ্যা নির্ধারিত হয়। চালার সংখ্যা এক থেকে বারোচালাও হতে পারে। বর্গাকৃতির ভবনের চারচালা পিরামিডের ন্যায়। অর্থাৎ সংযুক্ত চারটি চালাই আকারে ত্রিভুজাকার। চালার এরূপ আকৃতি ‘পিরামিডাল হিপ’ নামে পরিচিত। অনেক সময় আয়তাকার ভূমি-নকশায় নির্মিত ছাদ ছাড়া ভবন দুইটি চালা দ্বারা আচ্ছাদিত হয়। অর্থাৎ ‘ঢাকি চাল’ ব্যবতীত শুধু ‘দৌড় চাল’ সংযুক্ত হয়। এরূপ চালা স্থাপত্যের পরিভাষায় গ্যাবল রুফ (gable roof) নামে পরিচিত। আবার আয়তাকার ভূমি-পরিকল্পনায় নির্মিত ভবন চারটি চালা অর্থাৎ দুটি ঢাকি ও দুটি দৌড় চালা দ্বারা আচ্ছদিত থাকলে, এরূপ চালা ‘হিপ রুফ’ নামে পরিচিত। ঢাকি চালা দুটি ত্রিভুজাকার এবং দৌড় চালা দুটি সমদ্বিবাহু ট্রাপিজিয়ামের (isosceles trapezium) আকার বিশিষ্ট। এধরনের চালা সাধারণত সমতল ছাদের ওপর নির্মিত হয়। প্রায়ক্ষেত্রে এরূপ ঘর ‘চৌকারি’ নামে পরিচিত হয়। কিন্তু যখন ভবন ইংরেজি বর্ণ ‘এল’ আকারের ভূমি-নকশায় নির্মিত হয়ে ছয়টি চালায় আচ্ছাদিত থাকে, তখন ঐরূপ চালা ‘ক্রস হিপড রুফ’ (cross hip roof) আকৃতির নামে পরিচিত হয়।

চিত্র: ০৫। দ্বিতীয় তলার ওপর সমতল ছাদ ব্যতীত ভবন। দিঘলচাঁদ, দিনাজপুর, ২০২১।

চৌকারির সামনের বারান্দায় অতিরিক্ত একটি চালা সংযুক্ত হলে ঘর হয় ‘পাঁচচালা’। আর চারপাশে আরো চারটি চালা যুক্ত হলে গৃহ হয় ‘আটচালা’ এবং আটচালার চতুর্দিকে আরো চারটি চাল সংযোজিত হলে তৈরি হয় ‘বারোচালা’ ঘর। চারের অধিক চালা স্তরে স্তরে নির্মিত হয়। আগে চালা নির্মাণে প্রধানত শণ বা খড় জাতীয় উপাদানের পাশাপাশি টালি ব্যবহৃত হতো। বর্তমানে ঢেউটিনেই বেশি ব্যবহৃত হয়। শণ বা খড়ের ছাউনির কাঠামো নির্মাণে বাঁশ আর ঢেউটিনের ক্ষেত্রে প্রধানত কাঠ ও অনেক সময় বাঁশ ব্যবহৃত হয়।

কাঠামো ও চালার বিভিন্ন অংশের এবং বাঁধনসমূহের অত্যন্ত সুন্দর সুন্দর আঞ্চলিক নাম রয়েছে। যেমন, চালার বিভিন্ন অংশের নাম— ‘শর্’, ‘পাইড়’ (প্যাড়), ‘রুয়া’, ‘সাঁড়ক’, ‘মুখ সাঁড়ক’, ‘বাতা’, ‘উড়ানি বাতা’, ‘ছিপন’ ইত্যাদি এবং বাঁধনের নাম—

‘কাঁড়া বান্দন’, ‘কাঞ্চন বান্দন’, ‘হাঁড় বান্দন’ প্রভৃতি। বাঁধনসমূহ সাধারণত পাটের দড়ি দিয়েই সম্পন্ন করা হয়। তবে আগে মনে হয় চালার কাঠামো বাঁধতে কোনও কোনও অঞ্চলে ‘সুন্দিবেত’ও ব্যবহৃত হতো।

ঘরের ভেতর ওপর থেকে সিঁড়ির ধাপ। মালাহার, নওগাঁ, ২০১৬।

শুধু নামেই নয়, চালার আকৃতিও পৃথক হয়ে থাকে। নৌকার উল্টোপিঠের মতো বা খানিকটা অর্ধচন্দ্রাকৃতির হয়ে দু’পাশে ক্রমশ ঢালু হয়ে আসা বাঁকানো চালাবিশিষ্ট ঘর পূর্ববঙ্গে সাধারণত ‘জুইতের ঘর’ বা ‘জুইত পাইড়’ দেওয়া ঘর হিসাবে খ্যাত। এরূপ ‘জুইতের ঘর’ পশ্চিমবঙ্গে রাগ বা কোর দেওয়া ঘর হিসাবে পরিচিত।

পরিশেষে বলা যায়, বাংলার মাটির স্থাপত্যকলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য যতটা সমৃদ্ধ, তার চর্চা ততটা ঋদ্ধ বা প্রাগ্রসর নয়। বাংলা অঞ্চলে প্রত্নপ্রস্তর যুগের মানব বসতির খোঁজ পাওয়া গেলেও বাস্তু বা অন্যান্য স্থাপনার আকৃতি-প্রকৃতি সম্পর্কে বিশেষ জানা যায় না। তাই এ বিষয়ে গবেষণায় আরও মনোনিবেশ করা প্রয়োজন। কারণ মাটির বাড়ি বা মৃৎ-স্থাপত্যর ছাপ ইতিহাসচর্চায় যথাযথভাবে উন্মোচিত হলে সমাজ-সংস্কৃতির অধ্যয়ন এবং সামাজিক ইতিহাস রচনা যথেষ্ট যৌক্তিক মানে উন্নীত হবে।

ড. মো. শাহিনুর রশীদ। প্রতিকৃতি অঙ্কন: সব্যসাচী মজুমদার।

লেখক: শিক্ষক। প্রাচীন বাংলার সামাজিক প্রযুক্তির ইতিহাস গবেষক। ‘মাটির বাড়ি: বাংলার স্থাপত্য ঐতিহ্য’ (কলকাতা) গ্রন্থের লেখক।  

ইমেইল: srtutul71@gmail.com

ad

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত