Beta
বৃহস্পতিবার, ৯ মে, ২০২৪
Beta
বৃহস্পতিবার, ৯ মে, ২০২৪

বুয়েট নিয়ে বঙ্গবন্ধু আসলে কী বলেছিলেন

আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা বুয়েটে কোনও ছাত্র সংগঠনের তৎপরতা দেখতে চায় না।
আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা বুয়েটে কোনও ছাত্র সংগঠনের তৎপরতা দেখতে চায় না।

বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি ফিরিয়ে আনা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টির সাবেক শিক্ষক আইনুন নিশাতের একটি বক্তব্য ঘুরছে সোশাল মিডিয়ায়। যেখানে তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়কে আলাদা রাখতে চেয়েছিলেন।

বুয়েটের শিক্ষার্থীরা যখন ছাত্র রাজনীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে, আর হাইকোর্ট যখন বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের ঘোষণাকে অবৈধ বলেছে, তখন আইনুন নিশাতের বক্তব্য ধরে নানা মতামত আসছে সোশাল মিডিয়ায়।

বর্তমানে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক আইনুন নিশাতের বক্তব্যটি আসে গত সোমবার ইংরেজি দৈনিক দি ডেইলি স্টারে প্রকাশিত ‘বুয়েটকে বুঝতে হবে, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মতামতকে শ্রদ্ধা করতে হবে’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন থেকে।

সেখানে তিনি বলেছিলেন, “দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য নতুন অধ্যাদেশ করে শিক্ষকদের রাজনীতি ইত্যাদির অনুমতি দেওয়া হয়। কিন্তু কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও বুয়েটের জন্য অধ্যাদেশের খসড়া যখন বঙ্গবন্ধুর সামনে উপস্থাপন করা হয়, তখন তিনি বলেছিলেন যে এই দুটো বিশ্ববিদ্যালয় নষ্ট করা চলবে না।”

ছাত্র রাজনীতির বিপক্ষে ‍বুয়েটের অবস্থান নিয়ে প্রকৌশল শিক্ষার প্রতিষ্ঠানটির সাবেক শিক্ষার্থী আরও বলেন, “আমি সেখানে পড়েছি, পড়িয়েছিও ….. এখানে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের মতের ভিত্তিতেই বলা হয়েছিল যে আমরা এখানে রাজনীতি চাই না।”

আইনুন নিশাত বঙ্গবন্ধুকে উদ্ধৃত করে যে কথা বলেছেন, তার উৎস কী? সোশাল মিডিয়ায় সেই প্রশ্ন তুলেছেন অনেকেই, কেননা বঙ্গবন্ধুর এই বক্তব্যের কোনও লিখিত ভাষ্যের হদিস মেলে না।

বিষয়টি জানতে সকাল সন্ধ্যা অধ্যাপক আইনুন নিশাতের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু একথা বলেছিলেন বলে তিনি বুয়েটে তার জ্যেষ্ঠ সহকর্মীদের কাছে শুনেছেন।

তিনি বলেন, “আপনি যদি বলেন- আমি দেখেছি কি না বঙ্গবন্ধু এসব বলেছে। তা হলে সত্যি হলো আমি তো দেখি নাই। আমি শুনেছি।

“পঞ্চাশ বছর আগে আমি কী ছিলাম? আমি তখন অনেক ছোট। আমরা সবই শুনেছি। আমরাও শুনেছি, বঙ্গবন্ধু বুয়েট এবং কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়কে আলাদাভাবে হ্যান্ডেল করতে বলেছেন।”

স্বাধীনতার পর বুয়েটে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন আইনুন নিশাত। তখন দেশের চারটি বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার জন্য ১৯৭৩ সালে একটি অধ্যাদেশ হয়। কিন্তু তার আওতার বাইরে রাখা হয় বুয়েট ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়কে।

বিশেষায়িত শিক্ষার দুটি প্রতিষ্ঠান কেন আলাদা আইনে হলো- তার প্রেক্ষাপট তুলে ধরে আইনুন নিশাত বলেন, “তখন বুয়েট এবং কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বলল, আমাদের জন্য (অর্ডিন্যান্স) নাই কেন? এবং তখন শিক্ষকরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আদলে একটি খসড়া তৈরি করে টিচার্স অ্যাসোসিয়েশনের মিটিং এ উত্থাপন করল। আমি তো তখন অনেক ছোট, টিচার্স অ্যাসোসিয়েশনে সবাই তো অনেক সিনিয়র এবং আমারও শিক্ষক। আমি মিটিং এ ভোকালে ছিলাম না, ছোট হওয়ায় বসতাম পেছনে।

“সেই খসড়া নিয়ে যখন বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করতে চাইলেন শিক্ষকরা, বঙ্গবন্ধু রিফিউজ করলেন তাদের। কিন্তু শিক্ষকদের মধ্যেও কেউ কেউ ছিলেন, যাদের রাজনৈতিকভাবে আলাদা গুরুত্ব আছে। তারা বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করলেন। বঙ্গবন্ধু তাদের বলে দিলেন এটা শিক্ষামন্ত্রী এবং সচিব হ্যান্ডেল করবে। বঙ্গবন্ধু যা বলার তা বলে দেবেন।”

১৯৭৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

আইনুন নিশাত আরও বলেন, “বঙ্গবন্ধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন নিয়েও বিরক্ত ছিলেন। আমরাও এও শুনেছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুযায়ী, যে সব কিছুতে ইলেকশন, তা নিয়ে বঙ্গবন্ধু বিরক্ত ছিলেন। তিনি কামাল হোসেনকে ডেকে অর্ডিন্যান্স ঠিক করতে বলেছিলেন। কিন্তু তিনি তা করার সুযোগ পাননি।”

একই কথা মঙ্গলবার চ্যানেল ২৪ এর এক আলোচনা অনুষ্ঠানেও বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন।

তিনি বলেন, “বঙ্গবন্ধু ৭৩ এর অর্ডিন্যান্সে চারটি বিশ্ববিদ্যালয়কে স্বায়ত্তশাসন দিলেন। পরে বঙ্গবন্ধু অর্ডিন্যান্সটা ভালো করে পড়ে কামাল হোসেনকে বললেন, দেখি শিক্ষকরা সারা বছরই নির্বাচন করবেন,পড়াবেন কখন?  

“তখন কামাল হোসেন বলেছিলেন, তাহলে আপনি আইনটি বদলে দেন। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন,তা তো বদলাতেই হবে। বঙ্গবন্ধুর (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে) আসার কথা ছিল ১৫ই আগস্ট। কিন্তু তিনি তো আসতেই পারলেন না। হয়ত তিনি আসলে আমরা এ ব্যাপারে দিক-নির্দেশনা পেতাম।”

বুয়েটে ছাত্র রাজনীতির প্রসঙ্গ ধরে ১৯৭৩ এর অধ্যাদেশ আলোচনায় এলেও এই আইনে শিক্ষার্থীদের রাজনীতির বিষয়ে কোনও কথা নেই। বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার এই আইনে শিক্ষকদের রাজনীতিকে যুক্ত হওয়ার স্বাধীনতা দেওয়া রয়েছে।  

এই আইনটি কেন এসেছে, তার প্রেক্ষাপট তুলে ধরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আবদুল খালেক ২০১৭ সালে দৈনিক জনকণ্ঠে এক কলামে লিখেছেন, “বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে তৎকালীন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যে আইন দ্বারা পরিচালিত হতো, সে আইনগুলোকে আমরা বলতাম ‘কালো আইন’। ওই আইনে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কোনওরকম স্বাধীনতা ছিল না। সরকার নিয়োজিত উপাচার্যের তখন প্রচণ্ড দাপট এবং সীমাহীন ক্ষমতা ছিল। উপাচার্যের কথার বাইরে শিক্ষকদের যাওয়ার কোনও উপায় ছিল না।

“এর ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ নানারকম চাপের মধ্যে দিন কাটাতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ছিল সে এক অস্বস্তিকর জীবন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পক্ষ থেকে একটি গণতান্ত্রিক কল্যাণমুখী অধ্যাদেশ প্রণয়নের দাবি ওঠে।”

সব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সমন্বয়ে গঠিত ‘বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন’র নেতৃত্বে সেই দাবি ‍ওঠার কথা জানিয়ে তিনি লিখেছেন, “আমাদের মনে রাখতে হবে ১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশটি মোটেই সহজলভ্য ছিল না। অনেক আন্দোলন-সংগ্রামের ফসল ১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশটি।

“আমরা জানি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিক্ষকদের গভীরভাবে শ্রদ্ধা করতেন, শিক্ষকদের দাবি-দাওয়ার প্রতি তিনি অত্যন্ত সহানুভূতিশীল ছিলেন। ১৯৭৩-এর অধ্যাদেশে শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের স্বার্থ সংরক্ষণ নয়, সিনেটে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদেরও অংশীদারিত্ব থাকবে এমন কথা বঙ্গবন্ধুকে স্পষ্ট জানিয়ে দেওয়া হয়। আমার যতদূর মনে পড়ে, বঙ্গবন্ধু বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের কাছ থেকে প্রস্তাবিত অধ্যাদেশের একটা রূপরেখা চেয়ে নিয়েছিলেন। সেই রূপরেখার আলোকেই অধ্যাদেশটি চূড়ান্ত করা হয়।”

কুদরত ই খুদা শিক্ষা কমিশনের প্রতিবেদন নিচ্ছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা নিয়েই কথাবার্তা হয় বেশি’

বুয়েটের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে বঙ্গবন্ধুর এক বক্তব্য উদ্ধৃত করে চলমান আলোচনা নিয়ে একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক অজয় দাশগুপ্ত বলেছেন, সোশাল মিডিয়ায় ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ নিয়েই কথাবার্তা বেশি হয়।

স্বাধীনতার পরবর্তী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিনেটে ছাত্র প্রতিনিধি ছিলেন অজয় দাশগুপ্ত। তিনি বলেছেন, বঙ্গবন্ধুর যে কথা ধরে আলোচনা চলছে, এমন কথা তিনি তখন শোনেননি।

একটি ‘বিচ্ছিন্ন’ কথা ধরে বঙ্গবন্ধুর অবস্থান ব্যাখ্যা করাটাও ভুল হবে বলে মনে করেন তিনি।

অজয় দাশগুপ্ত বলেন, “বঙ্গবন্ধু বিভিন্ন সময় কী বলেছেন, না বলেছেন, তার থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ তিনি একটি জীবন দর্শন। বাংলাদেশের শিক্ষা, অর্থনীতি, সমাজ সবকিছুর ব্যাপারে তার নিজস্ব স্বচ্ছ ধারণা ছিল। তিনি বাংলাদেশকে কোথায় নিয়ে যেতে চান, তার ব্যাপারেও তার ধারণা ছিল। ফলে বঙ্গবন্ধু কোথায় কী বলেছেন, এটা বিচ্ছিন্ন বিষয়।”

এর ব্যাখায় তিনি বলেন, “তাকে উদ্ধৃত করে কিছু বলে দেওয়া উচিৎ না। তিনি আক্ষেপ করে অনেক সময় অনেক কিছু বলেছেন। তিনি বলেছেন- সবাই পায় সোনার খনি, আমি পাই চোরের খনি।

“তা এটাকে অনেক ভূল ব্যাখ্যা করে বলে যে আমরা সবাই চোর। সবাই চোর হলে কি দেশের জন্য লক্ষ মানুষ জীবন দিত? লক্ষ লক্ষ মানুষ হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছিল না? কাজেই বিচ্ছিন্নভাবে বলে দিলেন যে বঙ্গবন্ধু সবাইকে চোর বলেছেন। এটা তো ঠিক না।”

সোশাল মিডিয়া কুপ্রভাব তুলে ধরে এই সাংবাদিক বলেন, “এখানে তো আসলে অনেক মতামত তৈরি হয়। লক্ষ লক্ষ বললে ভূল হবে কোটি কোটি মত ঘুরে বেড়ায়। এখন আমি আপনাকে কিছু বলব, আপনি আপনার মতো করে কথা লিখবেন। সেটা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘুরে বেড়াবে।

“আমি আসলে কী বলেছি, কী অবস্থার বর্ণনা করতে বলেছি, তা কেউ খুঁজে দেখবে না। আর এরকম বিচ্ছিন্ন ঘটনা নিয়েই কথাবার্তা বেশি হয়।”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ad

সর্বাধিক পঠিত