Beta
বুধবার, ৮ মে, ২০২৪
Beta
বুধবার, ৮ মে, ২০২৪

গণমাধ্যম এখন

শিশুর স্ক্রিনে গণমাধ্যম কোথায়

সুমন কায়সার। প্রতিকৃতি অঙ্কন: সব্যসাচী মজুমদার

শুরুতেই বলে নিই, আমি সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও এই লেখাটা মূলত অভিভাবকের দৃষ্টিকোণ থেকে লেখা। যে অভিভাবক আর কিছু না হোক, নিজের সন্তানসহ দেশের সমুদয় শিশুর জন্য চিন্তিত থাকেন। যুক্তি-তথ্য-তত্ত্বে ভরপুর কেতাবি লেখা তাই এটি মোটেই হবে না। তবে কথা হচ্ছে, আপনি নীতিনির্ধারক হন আর হন আমজনতার একজন, দিনশেষে ‘কচিকাচাদের ডাঁটো করে তোলা’র দায়টা সবারই। তাদের ভবিষ্যৎ কোন দিকে যাচ্ছে তা নিয়ে কথা বলার অধিকার তাই ‘পদাধিকারবলে’ অভিভাবকমাত্রেরই আছে।

এ লেখার বিষয়বস্তু মূলত গণমাধ্যমে শিশুদের জন্য কনটেন্ট বা আধেয়র পরিমাণ, মান ও শিশুদের কাছে সেসবের অভিগম্যতা। গণমাধ্যম হিসেবে সংবাদ প্রতিষ্ঠানগুলো আরো বেশি কিছু করতে পারে কিনা। বিনোদন বা শিক্ষার জন্য শিশুরা বিভিন্ন ডিভাইসে যে সময় কাটাচ্ছে তার ভালোমন্দ নিয়েও কিছু কথা বলা। এ নিয়ে চারপাশে যা দেখছি মূলত সে অভিজ্ঞতা থেকে কিছু কথা বলা।

আমরা অনেক দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। অনেক ক্ষেত্রে লক্ষ্মীর কৃপা উপচে পড়ছে বলা যায়। কিন্তু সব মিলিয়ে হচ্ছেটা কি? হা-হুতাশটা শুধু জাতীয় বা আঞ্চলিক ব্যাপার নয়। এই সময়ের গোটা বিশ্ব আছে সংকটে। সেজন্য সুইডেনের কিশোরী (শুরুটা সে বয়সেই) গ্রেটা থুনবার্গকে নামতে হয় পুঁজিবাদী বিশ্বের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বাণিজ্যিক মাথাদের সঙ্গে অসম লড়াইয়ে। পর্তুগালের তিন শিশু কিশোর তরুণ ভাইবোনকে তাদের ‘সুস্থভাবে বাঁচার পরিবেশ কেড়ে নেওয়ার জন্য’ মামলা ঠুকতে হয় তিরিশটির বেশি দেশের সরকারের বিরুদ্ধে। আমাদের প্রিয় আবাসভূমি দক্ষিণ এশিয়ার কথা আর নাই বা বলি। গণমাধ্যম শুধু নয়, আরো অনেক ক্ষেত্র নিয়ে কথা বলার সময়ই এই বাস্তবতাটা মাথায় রাখা দরকার।

নিজের শৈশবের দিকে ফিরে তাকালে বুঝি, সমাজটা মাত্র কয়েকদশকে কী পরিমাণ বদলে গেছে। কালে কালে পেছন ফিরে তাকানোর বয়সে এ ধরনের উপলব্ধি সবারই আসে। তবে এটা মানতেই হবে, মূলত প্রযুক্তির উন্নয়নের জেরে সমাজের পরিবর্তনটা হয়েছে আগের শতকগুলোর তুলনায় অবিশ্বাস্য গতিতে। তার কতটা ভালো কতটা মন্দ, কতোটার জন্য আমরা তৈরি ছিলাম বা আছি তার মধ্যেই আরো অনেক প্রশ্নের জবাব আর সে সূত্রে সমাধানের চাবিকাঠিও নিহিত।

চকিত জরিপে হতাশা:

এই লেখাটার জন্য পরিচিত মহলে সংক্ষিপ্ত এক জরিপ চালিয়ে দেখেছি, মূলধারার বাংলাদেশি বা বিদেশি গণমাধ্যমের (প্রিন্ট/টিভি/অনলাইন) বিষয়ে শিশু-কিশোরদের আগ্রহ ন্যুনতম পর্যায়ে। প্রায় প্রতিটি বড় পত্রিকারই শিশুদের পাতা আছে। অনলাইন আউটলেটগুলোরও শিশুদের জন্য কনটেন্ট থাকে। কিন্তু এক বা একাধিক শীর্ষ পত্রিকা বাসায় রাখা হয় এমন পরিবারেরও অনেক শিশু সেসব পাতায় চোখ রাখে না। সিংহভাগ শিশুর বিনোদনের মূল জায়গা হয়ে উঠেছে মোবাইল ফোন, গেমস কনসোল বা টিভি (বিশেষ চ্যানেল/ইউটিউব) এবং ঘরের বাইরে ফাস্টফুড রেস্তোরাঁ বা ক্ষুদে ‘অ্যামিউজমেন্ট পার্কগুলো’। মোবাইল ফোন ব্যবহার তেমন করে না এমন শিশুকিশোরদেরও অনেকেই পত্রিকার শিশু পাতা পড়ে না। কারণ হিসেবে তারা বলেছে, স্কুলের পড়াশোনার অতিরিক্ত চাপের জন্য তারা সেদিকে মন দিতে পারে না। শিশুদের জন্য একমাত্র নিবেদিত টিভি চ্যানেলটিতে অনেক ভালো অনুষ্ঠান হলেও তার দর্শকসংখ্যা স্পষ্টতই সম্ভাবনার তুলনায় অনেক কম।

ডিভাইসের দৌরাত্ম:

আমার এক সমাজসচেতন, ইতিহাসে পিএইচডি করা বন্ধুর বাসায় অনেকদিন পর গিয়ে অবাক হয়েছিলাম। তার স্ত্রী দেশের শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। তারা উভয়েই ব্যবহার করেন ফিচার ফোন। লিভিংরুমসহ কোথাও টিভি নেই। জিজ্ঞেস করে জানা গেল, দুই শিশু সন্তানের মোবাইল ফোন ও টিভি আসক্তি ঠেকাতেই এই চরম ব্যবস্থা। অতি সম্প্রতি জানা গেছে, মোবাইল ফোন ‘দেখতে’ না দেওয়ায় ১৭ বছরের ছেলের আঘাতে মৃত্যু হয়েছে এক বাবার। দুটি ঘটনাই চরমধর্মী। তবে শিশুদের ডিভাইস ব্যবহারের প্রবণতা ও আসক্তি যে দিনে দিনে আশঙ্কার পর্যায়ে চলে গেছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

বলার অপেক্ষা রাখে না, অভিভাবকদের অসচেতনতা/আপাত অসহায়ত্ব এ ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখছে।

আপনি নীতিনির্ধারক হন আর হন আমজনতার একজন, দিনশেষে ‘কচিকাচাদের ডাঁটো করে তোলা’র দায়টা সবারই। তাদের ভবিষ্যৎ কোন দিকে যাচ্ছে তা নিয়ে কথা বলার অধিকার তাই ‘পদাধিকারবলে’ অভিভাবকমাত্রেরই আছে।’

দীর্ঘসময় স্ক্রিন দেখা শিশুদের চোখের জন্য ক্ষতিকর একথা কমবেশি সব আর্থসামাজিক স্তরের মানুষেরই এখন জানা। কিন্তু তারপরও তথাকথিত সচেতন পরিবারেও এ দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। অনেকে ক্ষেত্রে অভিভাবকরা অসহায়। শিশুরা খাওয়া, পড়া বা ঘুমের জন্য মোবাইল ফোন ব্যবহারের শর্ত দিচ্ছে। বকুনি থেকে মারধর কোনো কায়দাতেই কাজ হচ্ছে না। মিডিয়ায় বিশেষজ্ঞরা এই বিপত্তি থেকে পরিত্রাণের যেসব কৌশল বাতলে দেন তার মধ্যে সাধারণত থাকে শিশুকে বাইরে নিয়ে যাওয়া, তার সঙ্গে ঘরেই সময় কাটানো, আনন্দময় খেলাধুলায় (মূলত ইনডোর) ব্যস্ত রাখা। অন্তত শহুরে মধ্যবিত্ত অভিভাবকদের জন্য এর অনেককিছুই মানা কঠিন। বিশেষ করে জনসংখ্যার তুলনায় ঢাকা শহরে খেলাধুলার জায়গা প্রায় শূন্যের কোঠায়। জীবিকার ব্যস্ততা ও গৃহকর্মের ক্লান্তিতে বাবা-মা শিশুদের পেছনে খুব কমই সময় দিতে পারেন। জীবনযাত্রার ব্যয়ের সঙ্কট পরিস্থিতিকে আরো জটিল করেছে।

ঘরবন্দি শিশুর দৃষ্টিসীমা মোবাইলের স্ক্রিনে আটকে যাওয়ায় ক্ষতি হচ্ছে চোখের। বহু শিশু দূরের কিছু ভালো দেখছে না। চশমাধারী শিশুর তাই ছড়াছড়ি।

চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা বলেন, ডিজিটাল প্রযুক্তির মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার (যাকে চলতি ভাষায় বলছি স্ক্রিন টাইম) শিশুর সামাজিক ও মানসিক বিকাশের ওপর খুবই বিরূপ প্রভাব ফেলে। পর্দায় আসক্ত শিশুরা খেলাধুলা, দৌড়ানো বা সাইকেল চালানোর মতো শারীরিক কার্যকলাপে অংশ নেয় না। এতে তাদের দক্ষতার বিকাশ বাধা পায়। কোনো বিষয়ে মনোনিবেশ করার ও বাস্তবজীবনে কার্যকরভাবে যোগাযোগ করার ক্ষমতাকেও থমকে দিতে পারে তা। গবেষণা বলে, টিভি দেখা, মোবাইলে গেমস খেলা বা কোনো ধরনের ভার্চুয়াল বিনোদনের সময় মস্তিষ্কের কোষ থেকে এক ধরনের রাসায়নিক নিঃসরণ হয় যা মনে ভালোলাগার অনুভূতির সঞ্চার করে। এতে সহজেই শিশুরা এ ধরনের বিনোদন মাধ্যমে আসক্ত হয়ে পড়ে। বিশেষজ্ঞরা তাই কঠিনভাবে শিশুদের গ্যাজেট ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ এমনকী বয়সভেদে নিষিদ্ধ করতে বলেন।

ইন্টারনেট ব্যবহারের আরো ঝুঁকির দিক আছে। ইউনিসেফ-এর বছর পাঁচেক আগের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশের ১৩ শতাংশ শিশু-কিশোর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হয়রানি বা উত্ত্যক্তের শিকার হয়েছে। এ কারণে ৩ দশমিক ৩ শতাংশ শিক্ষার্থী তাদের সোশ্যাল মিডিয়ার অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দিয়েছিল।

স্থানীয় মিডিয়া বনাম নেট জগত:

আমাদের মিডিয়ার তৈরি করা কনটেন্টগুলো শিশুদের আকৃষ্ট করতে পারছে কিনা তা একটা সাধারণ প্রশ্ন। সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান ছাড়া সীমিত প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এই প্রশ্নের শুধু ঢালাও জবাব হতে পারে। সেটা হতে পারে ‘‘তেমন না’’। সাধারণভাবে বলা যায়, স্থানীয় মিডিয়ার তুলনায় ইন্টারনেটে পাওয়া অনেক কনটেন্টের মানই বহুগুণে ভালো। ৭/৮ বছরের বাচ্চারাও সেখানে মহাকাশ, বন্যপ্রাণী, মানবদেহ, ডাইনোসর— হেন বিষয় নেই যা সম্পর্কে কিছু না কিছু দেখছে না। অনেক ক্ষেত্রে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি তথ্যে ভারাক্রান্ত হচ্ছে শিশুদের নবীন মস্তিস্ক। কিন্তু বড় মুশকিল হচ্ছে, তারা সবসময় বয়স উপযোগী বিষয় দেখছে না। শুধু জটিলতর নয়, প্রাপ্তমনস্কদের উপযোগী এমনকী অশ্লীল কনটেন্টও তাদের সামনে চলে আসতে পারে। তেমনটা হচ্ছেও।

ইন্টারনেট জগতে বেশি সময় কাটানোর বিপদের আরো নানা দিক আছে। অনেক ক্ষেত্রে শিশুদের যোগাযোগের দক্ষতাও একটা বড় সমস্যা হয়ে উঠতে পারে ভবিষ্যতে। বহু শিশু সারাক্ষণ ইংরেজি বা হিন্দি ভাষার কনটেন্ট দেখে মাতৃভাষায় পিছিয়ে যাচ্ছে। শুধু ইংরেজি বা হিন্দিতে সরগড় হলে ভালোই ছিল। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, অনেক শিশু তার বয়সের উপযোগী সহজ বাংলাও বুঝতে অসুবিধায় পড়ছে। বাবা-মাকে জিজ্ঞেস করছে, ‘‘এটা ইংরেজিতে কী?’’ তারা হাস্যকর বাংলা বলছে ও লিখছে। কিন্তু শিশুসন্তানের ‘‘ফটফট করে’’ ইংরেজি বলা নিয়ে বেশিরভাগ বাবা-মায়ের গর্বের শেষ নেই। ‘‘বাংলাটা ওর তেমন আসে না’’— কথাটা একসময় ছিল মুষ্টিমেয় পশ্চিমাশিক্ষিতকে নিয়ে চালু রঙ্গ। তা হয়তো অদূর ভবিষ্যতে ঘরে ঘরে শোনার দিন আসছে।

প্রিন্ট ও অনলাইন মিডিয়ার প্রচুরসংখ্যক ভালো মানের কনটেন্ট তৈরি করা উচিত। দরকার শিশুদের আকৃষ্ট করার মতো উন্নতমানের প্রচুর ভিডিও। শুধু ইউটিউবের জগতই অনেক বড়। এবাবদ আর্থিক উপার্জনের দিকটিও যথেষ্ট আকর্ষণীয় হতে পারে মিডিয়া কর্তৃপক্ষের কাছে। টিভি চ্যানেলগুলোরও শিশুদের অনুষ্ঠানের পরিমাণ ও গুণগত মান দুই-ই বাড়ানো উচিত। নেটমাধ্যমের ভিডিওতে অবাঙালিদের বিকৃত উচ্চারণের (এবং ভুল ও দুর্বল) বাংলা শোনা ও শেখা থেকে শিশুদের রক্ষা করতেও এসব জরুরি। তবে আমাদের মিডিয়াগুলোর জনবলের যে গুণগত ও সংখ্যাগত অবস্থা তাতে এ কাজ দুরূহ। ফলে সরকারি-বেসরকারি সব মহলে ভাবনায় বড় ধরনের পরিবর্তন ছাড়া এ  পরিস্থিতির উন্নতি অসম্ভব।

শিশুদের গণমাধ্যম ব্যবহার ও তার ওপর প্রভাব:

বাংলাদেশের শিশুদের গণমাধ্যম ব্যবহার চিত্র কেমন তা নিয়ে গুগল করে ঠিক এক দশক আগের (২০১৩) একটি জরিপের চিত্র পেলাম। এর চেয়ে হালনাগাদ কিছু পাইনি। হয়তো হয়েছে বা এখনো কাজ করছেন কেউ। যাই হোক, এক দশক আগের গবেষণা হলেও মৌলিক ধারণার জন্য হয়তো এর প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্তের উল্লেখ করা যেতে পারে। আলোচ্য জরিপে দেখা গেছে, দেশের শিশুরা যেসব গণমাধ্যম ব্যবহার করে, তার মধ্যে এগিয়ে আছে টেলিভিশন। তার পরে রয়েছে বেতার। এর পরে সংবাদপত্র ও ইন্টারনেট। শিশুদের ওপর পরিচালিত জরিপের ফলাফলে দেখা গেছে, ২০১৩ সালের জুলাই মাসে শহরের ৪০ শতাংশ ছেলে ও ২৯ শতাংশ মেয়ে বেতার শুনেছে। এদিকে, গ্রামের ৪১ শতাংশ ছেলে ও ২৭ শতাংশ মেয়ে বেতার শুনেছে। বেতারে তারা বেশি শুনেছে গান (৮৪ শতাংশ), সংবাদ (৬১ শতাংশ) এবং খেলা (৩৬ শতাংশ)। একই সময়ে টেলিভিশন দেখেছে ৯১ শতাংশ শিশু। প্রতিদিন গড়ে ৬৪ শতাংশ শিশু টেলিভিশন দেখে। সংবাদপত্র পড়েছে শতকরা ৪২ জন শিশু।

৫৫ শতাংশ শিশু জানিয়েছে, তারা সপ্তাহে এক দিন পত্রিকা পড়ে। ২২ শতাংশ জানিয়েছে, তারা প্রতিদিন পত্রিকা পড়ে। পাঠের দিকে এগিয়ে রয়েছে খেলার পাতা (৫২ শতাংশ),  বিনোদন পাতা (৫২ শতাংশ) শিক্ষা পাতা (৪৩ শতাংশ) শিশু পাতা (২৬ শতাংশ)।

লক্ষ্যণীয় শিশুদের নিজেদের পাতা বা ‘শিশু পাতা’ পড়ার হারই সবচেয়ে কম! একই সময়ে ১৫ শতাংশ শিশু ইন্টারনেট ব্যবহার করেছে। এক সপ্তাহে সব মিলে তিন-চতুর্থাংশ শিশু ছয় ঘণ্টার বেশি ইন্টারনেট ব্যবহার করেছে। জরিপে অংশ নেওয়া ৭০ শতাংশ শিশু দেখে সামাজিক যোগাযোগ সাইট। গান বা সিনেমা ডাউনলোড করে ৬১ শতাংশ শিশু। ৩৩ শতাংশ দেখে তথ্যভিত্তিক সাইট। অনলাইনে বই পড়ে ১২ শতাংশ, ইউটিউব ৬ শতাংশ এবং ৪ শতাংশ শিশু দেখে ব্লগ সাইট। অনলাইনেও দেখা যাচ্ছে, বইপড়ার মতো ভালো অভ্যাসের তুলনায় শিশুদের মন অনেক বেশি পড়ে থাকছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।

আমাদের গণমাধ্যম শিশুদের জন্য যথেষ্ট সংখ্যায় এবং ভালো মানের বা আকর্ষণীয় কনটেন্ট তৈরি করছে না এ কথাটা এতক্ষণের আলোচনার ভিত্তিতে সম্ভবত আরেকটু জোর দিয়েই বলা যায়। যা তৈরি হচ্ছে তা-ও বোধগম্য কারণে যথেষ্টসংখ্যক শিশুর কাছে পৌঁছাচ্ছে না। তাই এটা একটা বড় পরিহাস যে, শিশুরাই এই গণমাধ্যমের প্রভাবের শিকার হচ্ছে তুলনামূলকভাবে বেশি। তারা বলিউড বা হলিউডের ফ্যান্টাসি নায়ক হতে চায়,  বুঝে বা না বুঝে দুধের বয়সেই অশিষ্ট কথ্য ইংরেজি শেখে, বাবা-মাকে অতিষ্ঠ করে লেটেস্ট মডেলের আইফোন, স্মার্টওয়াচ বা দামি খেলনা কিনে দিতে ঘ্যান ঘ্যান করে। ভুল শিক্ষা, কুশিক্ষার বিপদ তো আছেই। মানুষ এমনিতেই দিনে দিনে হয়ে পড়েছে আত্মকেন্দ্রিক। করোনাভাইরাস এসে বিশ্বজুড়ে আপন প্রাণ বাঁচার মানসিকতাকে একটা স্থায়ী রূপ দিয়ে গেছে। শিশুদের সামাজিকীকরণের কার্যত প্রধান অবলম্বন হয়ে উঠছে টেলিভিশন ও ইন্টারনেটের নানা প্ল্যাটফর্ম। কখনো কখনো তা সামাজিকীকরণের প্রথম ও প্রধান প্রতিষ্ঠান পরিবার থেকেও বেশি শক্তিধর হয়ে উঠেছে যেন।

শেষ কথা:

অনেক সময়ই শিশু বিষয়ে গণমাধ্যমের তৎপরতা হয় কেবল দিবসভিত্তিক। জাতীয় কিংবা আন্তর্জাতিক কোনো দিবসকে কেন্দ্র করে হয় শিশুদের জন্য সংবাদ বা অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা। ইউনিসেফ-এর একটি গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্য অনুসারে আমাদের গণমাধ্যমে শিশুদের অংশগ্রহণ মোটেও আশাব্যঞ্জক নয়। গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত এবং টেলিভিশনে প্রচারিত সংবাদে শিশুদের উপস্থিতি শতকরা ৩ ভাগ বা তারচেয়েও কম। এতে হয়তো খুব বেশি অবাক হওয়ারও কিছু নেই। টেক বিলিয়নেয়ার, প্রদর্শন-পারঙ্গম শোবিজ ও স্পোর্টস তারকা, পপুলিস্ট নেতা, কথিত ইনফ্লুয়েন্সার এমনকী ধর্মীয় বক্তারা এখন আইকন। আর সব কিছুর মতো মিডিয়ার ওপর এ প্রবণতার ছায়া পড়বে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সামাজিক অঙ্গীকার আর জাতির কাছে দায়বদ্ধতার বিষয় খুব অগ্রাধিকার পাবে সেটা আশা করাও যেন বোকামির পর্যায়ে পড়ে।

শিশু সাংবাদিকদের প্ল্যাটফর্ম হ্যালোডট বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম-এ ২০১৯-এর মার্চ মাসে পৃথা প্রণোদনা নামের এক শিশু লিখেছিল: ‘‘আমাদের দেশে টেলিভিশন চ্যানেলের সংখ্যা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। এখন চ্যানেলের সংখ্যা এতই বেশি যে, আমরা অনেকেই সব চ্যানেলের নামও জানি না। কিন্তু এর মধ্যে বেশিরভাগ চ্যানেলই হয়ে যাচ্ছে সংবাদভিওিক এবং এদের মধ্যে কিছু বিনোদনের। বিষয়ভিত্তিক চ্যানেলের অভাব বর্তমানে প্রকট। এর মধ্যে শিশুদের উপযুক্ত চ্যানেল নেই বললেই চলে!…গণমাধ্যমের দায়িত্বপ্রাপ্ত মানুষেরা আমাদেরকে দিয়ে তাদের টিভি শো, নাচ, গান ইত্যাদি করায়। কিন্তু দিনশেষে আমরা একজন ‘শিশু’ হিসেবেই বাড়ি ফিরে আসি, যাকে নিয়ে বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলোর কোনো পরিকল্পনা নেই। আসলেই কি গণমাধ্যম আমাদের কথা ভাবে?’’

পৃথা প্রণোদনার প্রশ্নটা তোলার পর তিন বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গেছে। উত্তরটা ‘হ্যাঁ’ হওয়ার মতো কিছু অন্তত আমার চোখে পড়েনি।

লেখক: সাংবাদিক ও অনুবাদক।
ইমেইল: sumonkaiser@gmail.com