আপিল বিভাগে নতুন তিনজন বিচারক নিয়োগের পর ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণার রায় পুনর্বিবেচনার আবেদনের শুনানির আশা জেগেছে।
ছয় বছর ধরে ঝুলে থাকা আবেদনটি এবার আলোর মুখ দেখবে বলে আশা করছেন রিট আবেদনকারী আইনজীবী মনজিল মোরসেদ।
রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিনও তেমনটাই আশা করছেন।
বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের কাছে ফিরিয়ে নিয়ে ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সংবিধানের যে ষোড়শ সংশোধনী হয়েছিল, তা হাইকোর্ট অবৈধ ঘোষণা করে।
রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করলে আপিল বিভাগও হাই কোর্টের রায়ই বহাল রাখে। এরপর ২০১৭ সালে রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ। কিন্তু আপিল বিভাগে বিচারক সংকটের কারণে এই সেই শুনানি এতদিনেও হয়নি।
বুধবার আপিল বিভাগে নতুন তিন বিচারক নিয়োগ পান। বৃহস্পতিবার তারা শপথও নিয়েছেন। তাদের নিয়ে সর্বোচ্চ আদালতে বিচারকের সংখ্যা এখন আটজন।
ফলে বিচারক সংকটের আপাত অবসান দেখে আশাবাদী হয়ে উঠেছেন অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “এ মামলার শুনানির জন্য আদালত চলতি বছরের ১৮ জানুয়ারি দিন ধার্য ছিল। এরপর মামলাটি কার্যতালিকায় আসেনি।
“আপিল বিভাগে নতুন তিনজন বিচারপতি নিয়োগ হওয়ায় আপিলে এখন বিচারক সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। আমি মনে করি, এখন এ মামলার শুনানি করতে কোনও বাধা নেই।”
এবার শুনানির উদ্যোগ নেবেন কি না- জানতে চাইলে তিনি বলেন, “এটা শুনানির জন্য ফিক্সড (নির্ধারিত) তো আছেই। আশা করি, এখন যে কোনও দিন শুনানি হবে।”
অ্যাটর্নি জেনারেল আমিন উদ্দিনও সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “শুনানির জন্য মামলাটি তালিকাতেই আছে। সুতরাং আশা করছি, দ্রুতই আবেদনটি নিষ্পত্তি হবে।”
ষোড়শ সংশোধনের প্রেক্ষাপট
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর সংবিধানে উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতেই রাখা হয়েছিল। কিন্তু ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু আমলে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনের পর বিচারক অপসারণের ক্ষমতা ন্যস্ত হয় রাষ্ট্রপতির হাতে।
জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় যাওয়ার পর সংবিধানের পঞ্চম সংশোধন এনে বিচারক অপসারণের বিষয় নিষ্পত্তির ভার দিতে সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল গঠন করা হয়। এরপর সেভাবেই চলছিল।
আওয়ামী লীগ আমলে ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সংবিধানে ষোড়শ সংশোধনী এনে বিচারক অপসারণের ক্ষমতা আবার সংসদের হাতে ফেরত নেওয়া হয়। বিলটি পাসের পর ওই বছরের ২২ সেপ্টেম্বর গেজেট প্রকাশিত হয়।
এরপর ওই সংশোধনী চ্যালেঞ্জ করে ২০১৪ সালের ৫ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্টের ৯ আইনজীবী হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন করেন। পরে ৯ নভেম্বর হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ রুল জারি করে। এরপর ২০১৬ সালের ৫ মে তিন বিচারপতির সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের একটি বিশেষ বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ, বাতিল ও সংবিধান-পরিপন্থী বলে রায় দেয়। ওই বছরের ১১ আগস্ট পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়।
এরপর রাষ্ট্রপক্ষের করা আপিলের শুনানি নিয়ে ২০১৭ সালের ৩ জুলাই ঐকমত্যের ভিত্তিতে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে হাইকোর্টের রায় বহাল রাখেন তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহারনেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগ। এরপর ওই বছরের ১ আগস্ট ৭৯৯ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ পায়।
রায়ে মুক্তিযুদ্ধ, গণতন্ত্র, সংসদসহ বিভিন্ন বিষয়ে পর্যবেক্ষণ রাখা হয়। তাতে ‘বঙ্গবন্ধুকে খাটো করা হয়েছে’ অভিযোগ তুলে বিচারপতি সিনহার পদত্যাগের দাবিতে সরব হয়ে উঠে আওয়ামী লীগ সমর্থক আইনজীবীরা। জাতীয় সংসদেও সেই রায় ও প্রধান বিচারপতির অনেক সমালোচনাকরা হয়।
এরপর ওই বছরের ১৪ সেপ্টেম্বর সংসদে রায় পুনর্বিবেচনার জন্য আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার প্রস্তাব গৃহীত হয়। এরপর ২০১৭ সালের ২৪ ডিসেম্বর আপিল বিভাগে রায় পুনর্বিবেচনা (রিভিউ) চেয়ে আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ।
৯৪টি সুনির্দিষ্ট যুক্তি তুলে ধরে ৯০৮ পৃষ্ঠার রিভিউ আবেদনে পুরো রায়টি বাতিল চায় রাষ্ট্রপক্ষ।
এদিকে এ রায়কে কেন্দ্র করে তুমুল আলোচনা-সমালোচনার মধ্যে ২০১৭ সালের ৩ অক্টোবর ছুটিতে যান তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা। পরে ১৩ অক্টোবর তিনি বিদেশে চলে যান। সেখান থেকে তিনি পদত্যাগপত্র পাঠান। পরে তিনি অভিযোগ করেন, তাকে দেশছাড়া হতে বাধ্য করা হয়েছে।
যে যুক্তিতে রিভিউ
সংবিধানের তফসিলে সন্নিবেশিত ১৯৭১-এর ১০ এপ্রিল প্রণীত ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ উল্লেখ করে রিভিউ আবেদনে বলা হয়েছে, একমাত্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই বাংলাদেশের ‘ফাউন্ডিং ফাদার’ রূপে স্বীকৃত। আপিল বিভাগ ‘ফাউন্ডিং ফাদার্স’ বহুবচন ব্যবহার করে ভুল করেছে। তাই এর পুনর্বিবেচনা প্রয়োজন।
রায়ের একটি অংশে পর্যবেক্ষণে ‘আমিত্ব’ ধারণা থেকে মুক্তি পেতে হবে বলে যা উল্লেখ আছে, সে প্রসঙ্গে রাষ্ট্রপক্ষ রিভিউ আবেদনে যুক্তি দেখিয়ে বলছে, আদালতের এই পর্যবেক্ষণ ভিত্তিহীন ও অপ্রত্যাশিত, যা এই মামলার বিবেচ্য বিষয় নয়।
ষোড়শ সংশোধনীর আপিলের রায়ের আরেকটি পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, “১. আমাদের নির্বাচন প্রক্রিয়া ও সংসদ এখনও শিশুসুলভ; ২. এখনও এই দুটি প্রতিষ্ঠান মানুষের আস্থা অর্জন করতে পারেনি।”
এ বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের যুক্তি হচ্ছে, এই পর্যবেক্ষণ আদালতের বিচার্য বিষয় নয়। বিচারিক শিষ্টাচারের বাইরে গিয়ে এই পর্যবেক্ষণ দিয়েছে উচ্চ আদালত, যা সংশোধনযোগ্য।
ষোড়শ সংশোধনীর আপিলের রায়ের আরেকটি পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, “সংসদীয় গণতন্ত্র অপরিপক্ব। যদি সংসদের হাতে বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা দেওয়া হয়, তবে তা হবে আত্মঘাতী।”
এক্ষেত্রে রাষ্ট্রপক্ষ বলছে, আদালতের এই পর্যবেক্ষণ শুধু অবমাননাকরই নয়, বরং ভিন্ন রাজনৈতিক প্রশ্ন। আদালতের বিচারিক এখতিয়ারের বাইরে গিয়ে এই মন্তব্য করা হয়েছে।
রাষ্ট্রের একটি অঙ্গ অন্য একটি অঙ্গের বিরুদ্ধে এরূপ মন্তব্য করতে পারে না। এটা বিচারিক মন্তব্য নয়, এ মন্তব্য করে আদালত ভুল করেছেন, যা সংশোধনযোগ্য ও বাতিলযোগ্য।
আপিল বিভাগের যে সাত বিচারপতি ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় দিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা পদত্যাগ করেন। বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা ও বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার স্বাভাবিকভাবে অবসরে যান এবং বিচারপতি আব্দুল ওয়াহহাব মিয়া পদত্যাগ করেন।
এরপর প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব পালন করেন বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন। তিনি অবসরে গেলে ২০২১ সালের ৩০ ডিসেম্বর দেশের ২৩তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী।
এতে দৃশ্যত ক্ষুব্ধ হয়ে ওই বছরের ৩১ ডিসেম্বর ছুটিতে যান আপিল বিভাগের তৎকালীন জ্যেষ্ঠ বিচারক মোহাম্মদ ইমান আলী। এরপর তিনি আর এজলাসে না বসে বাকি সময়টুকু ছুটি কাটিয়ে অবসরে যান তিনিও।
বর্তমানে প্রধান বিচারপতির দায়িত্বে রয়েছেন বিচারপতি ওবায়দুল হাসান। তার সঙ্গে আপিল বিভাগে আছেন- বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম, বিচারপতি আশফাকুল ইসলাম, বিচারপতি আবু জাফর সিদ্দিকী ও বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন। এছাড়া নতুন বিচারপতি যুক্ত হয়েছেন-বিচারপতি মুহাম্মদ আবদুল হাফিজ, বিচারপতি মো. শাহিনুর ইসলাম ও বিচারপতি কাশেফা হোসেন।