Beta
বৃহস্পতিবার, ৯ মে, ২০২৪
Beta
বৃহস্পতিবার, ৯ মে, ২০২৪

বাস্তুকৃষ্টি

আগুন থেকে ঢাকার বাড়িঘর ও শহর বাঁচাতে হলে

ভবন নকশায় ক্রটি এবং অগ্নি নির্বাপন ব্যবস্থা না থাকায় এই বছরের ২৯ ফেব্রুয়ারি বেইলি রোডে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে এই বহুতল ভবনে। মর্মান্তিক এ ঘটনায় ৪৬ জনের মৃত্যু হয়। আলোকচিত্র: হারুন-অর-রশীদ।

‘রূপকল্প ২০৪১’ বাস্তবায়ন করার অন্যতম লক্ষ্য হলো বাংলাদেশে নিরাপদ গ্রাম-নগর গড়ে তোলা। কিন্তু অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠা ঢাকা মহানগরে অগ্নি নিরাপত্তার বিষয়টি দ্রুততম সময়ে নিশ্চিত করা জরুরি একটি বিষয়। এছাড়া ইমারত নির্মাণ বিধিমালায় যেসব অসঙ্গতি রয়েছে তা দ্রুত হালনাগাদ করা করা দরকার। অগ্নি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ঢাকা শহরের জলাধার উদ্ধার ‘স্মার্ট শহর’ গড়ার বিষয়ে হতে পারে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। নগর ও ভবনে অগ্নি নিরাপত্তার বিভিন্ন দিক নিয়ে লিখেছেন স্থপতি ও নগর পরিকল্পনাবিদ তাসলিহা মওলা।

বিশ্বের সব দেশেই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে নানান সময়ে। উন্নত দেশগুলোতে অগ্নি দুর্ঘটনার হার উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশগুলোর চেয়ে অনেক কম। একসময় তারাও এসবের মধ্য দিয়ে গেছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তারা নগর পরিকল্পনা ও ভবন নকশার প্রভূত উন্নতির ফলে অগ্নি নির্বাপণের অত্যাধুনিক সব ব্যবস্থারও উদ্ভাবন করেছে।

নিউইয়র্ক শহরের অনেক পুরনো ভবনে দেখা যাবে— বাইরের দিকে স্টিলের সিঁড়ি লাগানো আছে। মূলত এসব ভবনে শুরুর দিকে অগ্নি নিরাপত্তার বিষয়টি খেয়াল রাখা হয়নি। কিন্তু পরবর্তী সময়ে ফায়ার স্টেয়ার সংযুক্ত করা হয়েছে।

উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায়, অগ্নি দুর্ঘটনা প্রতিরোধ, অগ্নি নির্বাপণ ইত্যাদিতে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে আছে। যদিও ২০২৬ সালের মধ্যেই বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত রাষ্ট্র থেকে উন্নয়নশীল রাষ্ট্র হিসেবে সনদপ্রাপ্ত হবে এবং ২০৪১ সালে বাংলাদেশ উন্নত রাষ্ট্রগুলোর একটি হওয়ার লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু নগরগুলোতে নগরবাসীর জন্য সঠিক ও মানসম্মত নিরাপত্তা নিশ্চিত না করে এই লক্ষ্য অর্জন কতটা পরিপূর্ণতা পাবে সে প্রশ্ন থেকেই যায়। 

বাংলাদেশে নগর পরিকল্পনা ও ভবন নকশার দুর্বলতাই অগ্নি দুর্ঘটনার মূল কারণ বলে মনে করা হয়। আমাদের নগর ও ভবনের নকশায় অগ্নি নিরাপত্তার বিষয়টি কীভাবে দেখা হয়েছে এবং কাগজে-কলমে কীভাবে থাকা উচিত সেটাই এই আলোচনার মূল বিষয়।  

২৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ বেইলি রোডে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে এই বহুতল ভবনে। মর্মান্তিক এ ঘটনায় ৪৬ জনের মৃত্যু হয়। আলোকচিত্র: হারুন-অর-রশীদ।

অগ্নি দুর্ঘটনায় নগর পরিকল্পনার ভূমিকা
বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা গেছে, রাজধানী ঢাকায় পরিকল্পিত এলাকার পরিমাণ বড়জোর ৩০ শতাংশ। বাকি ৭০ শতাংশ অপরিকল্পিত এলাকাগুলোর অবস্থা খুবই ভয়াবহ। এছাড়া এই সময়ে ভবনের উচ্চতাও বেড়েছে আগের তুলনায়। গলির ভেতরেও নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই অনেক সুউচ্চ অট্টালিকা আবাসিক ব্যবহারের জন্যে তৈরি করা হচ্ছে।

ঢাকার এসব জনবহুল এলাকায় রাস্তা কম প্রশস্ত হওয়ায় সেখানে দমকল বাহিনীর গাড়ি প্রবেশ করতে পারে না। ভবনগুলোও অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে একেবারে গায়ে গায়ে লেগে। এমন অবস্থায় এসব ভবনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলে আগুন নেভানো কষ্টসাধ্য— অনেক ক্ষেত্রে অসম্ভব হয়ে পড়ে। বেশিরভাগ এলাকায় জলাধার নেই। ফলে ফায়ার সার্ভিসের পানি শেষ হয়ে গেলে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়।

তাই এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না, বাংলাদেশের শহরগুলো দুর্যোগের ঝুঁকি এড়ানো বা আপৎকালীন দুর্যোগ মোকাবেলার উপযুক্ত করে পরিকল্পনা করা হয়নি। বলাবাহুল্য, শহরগুলোকে কোনও সার্বজনীন ভৌত পরিকল্পনার আওতায়ও আনা হয়নি। বরং আমাদের শহরগুলো যেন ক্রমেই আরও দুর্যোগপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

ঢাকার এসব জনবহুল এলাকায় রাস্তা কম প্রশস্ত হওয়ায় সেখানে দমকল বাহিনীর গাড়ি প্রবেশ করতে পারে না। ভবনগুলোও অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে একেবারে গায়ে গায়ে লেগে। এমন অবস্থায় এসব ভবনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলে আগুন নেভানো কষ্টসাধ্য— অনেক ক্ষেত্রে অসম্ভব হয়ে পড়ে। বেশিরভাগ এলাকায় জলাধার নেই। ফলে ফায়ার সার্ভিসের পানি শেষ হয়ে গেলে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়।

অতীতে ঢাকা শহরে আবাসিক এলাকা ও বাণিজ্যিক এলাকা একেবারে আলাদা ছিল। ধানমন্ডি, গুলশান, মোহাম্মদপুর, বনানী ইত্যাদি আবাসিক এলাকা হিসেবে ব্যবহৃত হতো। আর বাণিজ্যিক এলাকা বলতে ছিল মতিঝিল— শিল্প এলাকা ছিল তেজগাঁও। কিন্তু দিন বদলেছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও মানুষের কাজের কাঠামোও বদলে গেছে অনেকাংশেই।

একসময় আবাসিক এলাকায় গড়ে উঠতে শুরু করে মিশ্র ব্যবহার সম্পন্ন ভবন। এমনকি উত্তরা, ধানমন্ডি ও গুলশানের মূল সড়কের দুই পাশের জমি বাণিজ্যিক ব্যবহারের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে যখন তখনও তার ঠিক পেছনেই রয়ে গেছে আবাসিক এলাকা।

বেইলি রোডের অগ্নিকাণ্ডের পর, ধানমন্ডির সাত মসজিদ রোডের দুইপাশের প্রায় দুইশ’র মতো রেস্তোরাঁ সিলগালা করা হয়েছে। এমন প্রেক্ষাপট ও পরিস্থিতিতে পরিকল্পনার ঘাটতির বিষয়টি সামনে চলে এসেছে। ধানমন্ডি আগে একটি আবাসিক এলাকা হওয়ায় সড়কটির দুইপাশে ছিল আবাসিক ভবন। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাণিজ্যিক এলাকা ঘোষণা করায় সাতমসজিদ রোডের দুইপাশে গড়ে উঠেছে সুউচ্চ নতুন ভবন। ব্যবহার ছাড়পত্রে এগুলো বাণিজ্যিক ভবন হিসেবে দেখানো হয়েছে। স্থপতিরা-প্রকৌশলীরাও এগুলো বাণিজ্যিক ভবন হিসেবেই নকশা করেছেন।

ইমারত নির্মাণ বিধিমালা অনুযায়ী এর শ্রেণিবিন্যাস হলো—‘F1’ অফিস, বা ‘F2’ দোকান ও বাজার। অফিস ভবন হিসেবে তৈরি করার পর দেখা যায়, নানান বাস্তবতায় ফ্লোরগুলো ভাড়া হয় না। এর মধ্যে একটা বড় কারণ হলো, ধানমন্ডিতে জমির দাম বেশি হওয়ার কারণে ভাড়াও অনেক বেশি। যার জন্য অফিস ফ্লোর হিসেবে সেগুলো ভাড়া হচ্ছে না। কিছু সময় এসব ভবন ফাঁকা থাকার পর ভবন মালিক সেগুলোকে রেস্তোরাঁর জন্য ভাড়া দিয়ে দিচ্ছেন। কারণ এতে ভাড়া পাওয়া যায় দ্বিগুণেরও বেশি।

ব্যবহার ছাড়পত্র বা অকুপেন্সি সার্টিফিকেটে অফিসের কথা উল্লেখ থাকার পরও কীভাবে সেসব ভবনে রেস্তোরাঁ ভাড়া দেওয়া হচ্ছে— সেটি নিয়ে অনুসন্ধান করতে গেলে ভিন্ন এক বিষয় আমাদের কাছে উঠে আসে। ‘ঢাকা ইমারত নির্মাণ বিধিমালা ২০০৮’ পর্যালোচনা করতে গিয়ে দেখা যায়, এখানে রেস্তোরাঁকে কোনও শ্রেণিবিন্যাসে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। বিধিমালায় এ ঘাটতি থাকলেও অর্থনৈতিক, সামাজিক ও পরিবেশ সংক্রান্ত যথাযথ সমীক্ষা ও সম্ভাব্যতা যাচাই না করেই কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে  ভবন তৈরি হচ্ছে।

ডেভেলপাররা মালিক পক্ষকে বিশাল অংকের অর্থ প্রদান করছেন জমির বদলে— নির্দিষ্ট সময় পর বুঝিয়েও দিচ্ছেন মহামূল্যবান ভবন। কিন্তু সঠিক পরিকল্পনার অভাবে সেই ভবন হয়ে উঠেছে মৃত্যুপুরী। এছাড়াও স্ট্রিট ফুডের নামে রাজধানীর রাস্তায় দেখা যায় শত শত গাড়ি। আজকাল এখানে ওখানে গড়ে উঠেছে ফুড কোর্ট। যথাযথ ও স্বাস্থ্যসম্মত বিনোদনের অভাবে মানুষকে ভোজনবিলাসে অভ্যস্ত করে তোলা হচ্ছে।

জনঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় কেমিক্যালের গোডাউন থাকায় ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড নিয়ন্ত্রণে বেগ পেতে হয়েছিল দমকল বাহিনীর কর্মীদের। এই ঘটনায় মর্মান্তিকভাবে ৭১ জন প্রাণ হারান। আলোকচিত্র: হারুন-অর-রশীদ।

এছাড়া রয়েছে বঙ্গবাজার, গাউসিয়া, চাঁদনীচকের মতো অপরিকল্পিত অগ্নি ঝুঁকিপূর্ণ মার্কেট। গত বছর রাজধানীর মোহাম্মদপুরের কৃষি মার্কেটে ভয়াবহ আগুন লেগে পুড়ে ছাই হয়েছে মূল্যবান সম্পদ। ওদিকে পুরনো ঢাকায় আছে কেমিক্যালের গুদাম এবং ছোট ছোট কারখানা যার উপরেই রয়েছে আবাসিক ইউনিট। এসব জায়গায় বহুবার অগ্নিকাণ্ড ঘটবার পরও অবস্থা একই আছে।

আরও আছে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বস্তি, যেখানে নিম্ন আয়ের মানুষদের বসবাস। বহুবার আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছে তাদের সর্বস্ব, ঘটেছে প্রাণহানি। এছাড়া ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, সিলেটের অবস্থাও প্রায় একইরকম। কারণ ঢাকার ভুলগুলোই বারবার এসব শহরের ক্ষেত্রে অনুসরণ করে আসা হচ্ছে।

বৈশ্বিক অগ্রযাত্রার সঙ্গে তাল মেলাতে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গ্রহণ করেছে ‘রূপকল্প ২০৪১’ শিরোনামের একটি কৌশলগত পরিকল্পনা বা স্ট্র্যাটেজিক প্ল্যান। ‘রূপকল্প ২০৪১’-এর অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জন করতেই মূলত ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’র রূপকল্প প্রণয়ন করা হয়েছে। যার মূল লক্ষ্য হলো ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করা।

বেইলি রোডের অগ্নিকাণ্ডের পর, ধানমন্ডির সাত মসজিদ রোডের দুইপাশের প্রায় দুইশ’র মতো রেস্তোরাঁ সিলগালা করা হয়েছে। এমন প্রেক্ষাপট ও পরিস্থিতি পরিকল্পনার ঘাটতির বিষয়টি চলে এসেছে। ধানমন্ডি আগে একটি আবাসিক এলাকা হওয়ায় সড়কটির দুইপাশে ছিল আবাসিক ভবন। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাণিজ্যিক এলাকা ঘোষণা করায় সাতমসজিদ রোডের দুইপাশে গড়ে উঠেছে সুউচ্চ নতুন ভবন। ব্যবহার ছাড়পত্রে এগুলো বাণিজ্যিক ভবন হিসেবে দেখানো হয়েছে। স্থপতিরা-প্রকৌশলীরাও এগুলো বাণিজ্যিক ভবন হিসেবেই নকশা করেছেন।

‘রূপকল্প ২০৪১’-এর অন্যতম লক্ষ্য হলো আমাদের শহরগুলোকে ‘স্মার্ট সিটি’ হিসেবে গড়ে তোলা। গ্রামগুলোকেও ‘স্মার্ট গ্রাম’ হিসেবে গড়ে তোলার কথা রূপকল্পে উল্লেখ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট এলাকায় বসবাসরত জনসংখ্যাকে বিবেচনায় নিয়ে ওই এলাকার জন্য মাস্টারপ্ল্যান তৈরি করার কথা বলা আছে। এর ফলে নগরগুলোকে নিরাপদ নগর হিসেবে গড়ে তোলার সুযোগ তৈরি হয়েছে। কারণ স্মার্ট নগরের অন্যতম মূল বৈশিষ্ট্য হলো নিরাপদ নগর।

এই পরিকল্পনার ক্ষেত্রে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা শনাক্ত করা এবং সেসবের জন্য আপৎকালীন জরুরি ব্যবস্থা কী হবে তা নির্ধারণ করে দেওয়ার কাজ নিরাপদ নগর পরিকল্পনার গুরুত্বপূর্ণ কাজ। উন্নত বিশ্বে রাস্তার উপরেই ফায়ার হাইড্রেন্টের ব্যবস্থা থাকে যেখানে আপৎকালীন পানির মজুদ থাকে। আমাদের দেশেও জলাধারগুলো পুনরুদ্ধার করা, পানির পুনঃব্যবহার ইত্যাদির মাধ্যমে আপৎকালীন জল সরবরাহ নিশ্চিত করা সম্ভব।  

নাগরিকদের জীবনের নিরাপত্তার জন্যে হলেও জলাশয়গুলো পুনরুদ্ধারে অতিদ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ প্রয়োজন। ‘স্মার্ট সিটি’ বলি বা ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’, প্রকৃতিকে বাদ দিয়ে তা কোনোভাবেই টেকসই হবে না। আর টেকসই স্থাপনা ও নগর নিশ্চিত করতে পারাই ‘স্মার্ট নগর’-এর অন্যতম মূল শর্ত।

সাধারণত নগরগুলো গড়ে ওঠে নদী বা জলাশয়ের ধারেই। আদিকাল থেকে এই কথা প্রচলিত যে, ঢাকা বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত। কিন্তু আসলে ঢাকা শহরের চারপাশেই রয়েছে নদী। বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, বালু, টঙ্গী ও তুরাগ নদী বেষ্টিত এ শহরে একসময় শতাধিক খাল থাকলেও সেসবের বেশিরভাগই এখন দখল হয়ে আছে।  

এদিকে, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের তথ্যমতে, ঢাকা মহানগরীর মোট ৮২ শতাংশ এলাকা ঢেকে গেছে কংক্রিটের আবরণে। জলাশয় কমতে কমতে এসে ঠেকেছে ২.৯ শতাংশে আর সবুজ আচ্ছাদন ৭.৯ শতাংশে।

নাগরিকদের জীবনের নিরাপত্তার জন্যে হলেও জলাশয়গুলো পুনরুদ্ধারে অতিদ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ প্রয়োজন। ‘স্মার্ট সিটি’ বলি বা ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ প্রকৃতিকে বাদ দিয়ে তা কোনোভাবেই টেকসই হবে না। আর টেকসই স্থাপনা ও নগর নিশ্চিত করতে পারাই ‘স্মার্ট নগর’-এর অন্যতম মূল শর্ত।

অগ্নিনিরাপদ ভবন নকশা এবং স্থপতি-প্রকৌশলীদের ভূমিকা
নগর পরিকল্পনায় পুরো একটি এলাকা বা একটি শহর নিয়ে কাজ করা হয়। নগর পরিকল্পনাবিদরা সব অংশীজনদের সঙ্গে নিয়ে এই কাজটি করে থাকেন। এছাড়া স্থপতি ও প্রকৌশলীদের কাজ হলো জাতীয় ও আন্তর্জাতিক কোড ও বিধি মোতাবেক ভবন নকশা করে তাতে অগ্নিনিরাপত্তা ও দুর্যোগকালীন জরুরি নির্গমন ব্যবস্থা নকশা করা। ফায়ার সেফটি ডিজাইন বা অগ্নিনিরাপত্তা নকশার দুইটি ধাপ—প্রথমটি একটিভ ডিজাইন বা প্রত্যক্ষ নকশা, আর দ্বিতীয়টি প্যাসিভ ডিজাইন বা পরোক্ষ নকশা।

হাইরাইজ ভবনে অগ্নিনিরাপত্তা তদন্ত ও অনুসন্ধান (কেস স্টাডি: বীর উত্তম আমিনুল হক এভিনিউ, ঢাকা)

ভবনের ফায়ার সেফটি ডিজাইনের এ অংশটা মূলত যন্ত্র ও তড়িৎ প্রকৌশলীদের কাজ। এখানে ফায়ার ডিটেকশন, ফায়ার প্রটেকশন ও সাপ্রেশন এই তিনটি বিষয় বা ক্ষেত্র নিয়ে কাজ করা হয়। ফায়ার ডিটেকশনে থাকে— স্মোক ডিটেকশন বা ধোঁয়া শনাক্তকরণ, হিট ডিটেকশন– তাপমাত্রার বৃদ্ধি শনাক্তকরণ। এর ফলে ভবনে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাতের সঙ্গে সঙ্গে ধোঁয়া বা তাপমাত্রা শনাক্ত করে অগ্নিকাণ্ড নির্দেশক ঘণ্টা বা ফায়ার অ্যালার্ম বেজে উঠে।

এরপর আসে ফায়ার প্রটেকশন বা অগ্নি নিরোধক ব্যবস্থা। এতে থাকছে ফায়ার এক্সটিঙ্গুইশার, স্প্রিংকলার বা ঝর্ণা এবং হোস রিল অর্থাৎ আগুন নেভানোর কাজে যে হোস পাইপের সাহায্য নেওয়া হয় সেই পাইপের কুণ্ডলি বা রিল রাখার জায়গা।

স্প্রিংকলার হলো একটি স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতি যার মাধ্যমে ধোঁয়া আর তাপমাত্রা বৃদ্ধি শনাক্তের সঙ্গে সঙ্গে স্বয়ংক্রিয়ভাবে পানি ছিটানো শুরু হয়। এ পদ্ধতিটি ভবন তৈরির সময় পানির লাইনের সঙ্গেই নকশা করা হয়। এছাড়াও আছে সাপ্রেশন সিস্টেম। এটি মূলত কেমিক্যাল যুক্ত আগুনের ক্ষেত্রে, পরীক্ষাগার বা কেমিক্যাল রাখা হয় এমন জায়গায়, যেখানে পানি ব্যবহার করা যায় না সেখানে প্রয়োগ করা হয়।

আরও আছে প্রেশারাইজড এয়ার ডাক্ট ও ফায়ার রেটিং ডোরের মতো ব্যবস্থা। ফায়ার রেটিং ডোর এমন একটি বিশেষ দরজা— যার কাজ হলো আগুন লাগার পরে জরুরি নির্গমন পথ, ফায়ার লবি ইত্যাদি স্থানগুলো একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত আগুন থেকে বাঁচিয়ে দেওয়া। এর সময়কাল এক ঘন্টাও হতে পারে— দুই ঘন্টাও হতে পারে।

প্রকৃতপক্ষে প্রত্যক্ষ অগ্নি নির্বাপন ব্যবস্থার পুরোটাই প্রকৌশলীদের আওতাধীন। কত মিটার পর পর স্মোক ডিটেকটর, স্প্রিংকলার হোস রিল ইত্যাদি স্থাপন করা হবে সেটি পুরোটাই গাণিতিক ও অন্য জটিল হিসাবের মাধ্যমে নির্ণয় করা হয়।

হাইরাইজ ভবনে অগ্নিনিরাপত্তা তদন্ত ও অনুসন্ধান (কেস স্টাডি: বীর উত্তম আমিনুল হক এভিনিউ, ঢাকা)

এরপর আসে প্যাসিভ ডিজাইন বা পরোক্ষ নকশার বিষয়টি। এটি সম্পূর্ণই স্থপতির কাজ। এক্ষেত্রে প্রথমেই মাথায় রাখতে হয় Means of Escape বা নির্গমন পথের বিষয়টি। নির্গমন পথের এ নকশার মূল বিষয় হলো, দরজা, সিঁড়ি সংযোগকারী করিডর বা প্যাসেজ, ধোঁয়া বা আগুন মুক্তবেষ্টিত এলাকা, অগ্নি নির্বাপন সিঁড়ি, ঝুলন্ত বারান্দা এসবের মাধ্যমে ন্যুনতম সময়ে সড়ক, খোলা ছাদ বা নির্দিষ্ট নিরাপদ আশ্রয়স্থলে প্রবেশ নিশ্চিত করা। লিফট এসকেলেটর বা তদসংলগ্ন হাঁটার রাস্তাগুলো এই নির্গমন পথ বা মিন্স অফ এসকেপের অন্তর্ভুক্ত হবে না।

এর কারণ হলো— লিফটের শ্যাফট, খোলা সিঁড়ি, সংযোগকৃত করিডোরগুলো মূলত অগ্নিকূপ হিসেবে কাজ করে। আগুন ও এর ফলে সৃষ্ট ধোঁয়া দ্রুততম সময়ের মধ্যে ভবনের সকল তলায় ছড়িয়ে পড়ে। তাই এমনভাবে নির্গমন পথ নকশা করতে হয়, যাতে কোনোভাবেই ভবনের বাসিন্দাদের লিফট লবি, এস্কেলেটর ইত্যাদি পার হতে না হয়। ফায়ার এক্সিট বা জরুরি নির্গমন পথটি হতে হবে ধোঁয়ামুক্ত ও বাধাহীন। এছাড়া প্রতিটি ফ্লোরে দেওয়া থাকবে পর্যাপ্ত নির্দেশনা যেন ১০ বছরের একটি শিশুও সহজে ফায়ার এক্সিট খুঁজে পায় ও নিরাপদ স্থানে চলে যেতে পারে।

বিল্ডিং কোড ও ইমারত নির্মাণ বিধিমালায় অগ্নি নিরাপত্তা
‘বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড ২০২২’, ‘ঢাকা মহানগর ইমারত নির্মাণ বিধিমালা ২০০৮’ এবং অন্যান্য বিভাগীয় শহর, পৌরসভা ও জেলা শহরগুলোর জন্য প্রণীত বিধিমালায় ‘অগ্নিনিরাপত্তা’ বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে আলোকপাত করা হয়েছে এবং সকল বৃহদায়তন প্রকল্পের জন্য তা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।

‘ঢাকা মহানগর ইমারত নির্মাণ বিধিমালা, ২০০৮’-এর ৫৯ নং বিধির ‘অনুচ্ছেদ চ’-এর প্রথমেই ভবনের অগ্নি নিরাপত্তা নিশ্চিত করবার জন্যে একটি বিস্তারিত নির্দেশনা অনুসরণের কথা বলা হয়েছে। চ (২) বলছে, “সকল ইমারতে (প্রযোজ্য ক্ষেত্র) জরুরি প্রস্থান প্রদর্শনকারী দিকচিহ্ন থাকিতে হইবে” এবং চ (৩) এ আছে, “যন্ত্রচালিত উঠানামার ব্যবস্থা ফায়ার এক্সিট হিসাবে ব্যবহৃত হইবে না।’’ পরিশিষ্ট – ১ এ বিস্তারিত বর্ণনা দেওয়া আছে ভবনের অগ্নি নিরাপত্তার নকশা সম্পর্কে।

সিঙ্গাপুর সিভিল ডিফেন্স ফোর্সের ফায়ার সেফটি প্ল্যান

নির্গমন পথের বিভিন্ন অংশের কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছে, Means of Escape: ‘‘যাহা একটি ইমারতে আগুন লাগিলে নিরাপদ নির্গমনের পথ, তাহার তিনটি অংশ হইতেছে; ক) Exit access, খ) Exit এবং গ) Exit Discharge। এখানে access অর্থ Exit এর মুখ পর্যন্ত পৌঁছানোর রাস্তা; Exit হইল ওই অংশটুকু যাহা আগুন লাগা অংশ হইতে Exit Discharge পর্যন্ত নিরাপদ নির্গমন ঘটায়; Exit Discharge হইল Exit শেষ হওয়া হইতে আশ্রয়স্থলের শেষ দেয়াল পর্যন্ত।’’ সুতরাং দেখা যাচ্ছে, বিধিমালায় পরিষ্কার করে বলে দেওয়া হয়েছে নির্গমন পথের ধাপগুলো।

‘সাধারণ প্রয়োজন’ অনুচ্ছেদে ‘০২.০১’-এ বলা হয়েছে: “জনসাধারণের ব্যবহারের জন্য নির্মিত সকল ধরনের ইমারত ও গুদাম ঘরে যথেষ্ট সংখ্যায় নির্গমনপথের ব্যবস্থা থাকিতে হইবে যাহাতে আগুন ও অন্যান্য বিপদের সময় ব্যবহারকারীরা দ্রুত ও নিরাপদে অন্যের সহযোগিতা ছাড়া বাহির হইয়া যাইতে পারে।’’

সিঙ্গাপুর সিভিল ডিফেন্স ফোর্সের ফায়ার সেফটি প্ল্যান

০২.০২ বলছে, “Exit কে কখনো এমন কোনো কাজে ব্যবহার করা যাইবে না যাহাতে Means of Escape হিসেবে উহার ব্যবহার ব্যহত হয়”। ০২.০৫ বলছে “সকল Exit পরিষ্কার দৃষ্টিগম্য হইতে হইবে এবং Exit access চিহ্নিত থাকিতে হইবে; যেইখানে একাধিক Exit বা Exit access থাকিবে এবং জনগণের ব্যবহার্য যেইসব এলাকা অন্ধকার থাকিবে সেইসব স্থানে Exit এর অবস্থান ও দিক নির্দেশ আলোকিত চিহ্ন ব্যবহার করিতে হইবে।’’

০২.০৬-এ বলা হয়েছে, “প্রতিটি ইমারতের মালিক বা ইজারাদার ইহার সমস্ত ব্যবহারকারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করিবে এবং বর্তমান কোন ইমারতে Exit সুবিধা অপ্রতুল হইলে, কর্তৃপক্ষ তাহার যথাযথ সংস্থানের নির্দেশ দিতে পারিবে।’’ অর্থাৎ বিধিমালায় স্পষ্টভাবে জরুরি নির্গমন পথের ধাপগুলো এবং এর অনুপস্থিতিতে কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করা আছে।

ফায়ার এক্সিট বা নির্গমন পথের নকশাটি ভবনের প্রকারভেদে এবং ব্যবহারকারীর সংখ্যা ভেদে ভিন্ন হতে পারে। আবাসিক ভবন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল ও সেবাকেন্দ্র, অফিস, হোটেল, শিল্প কারখানা ইত্যাদি ভবনের জনসমাগম বা অকুপেন্সি হিসেবে ফায়ার স্টেয়ারের সংখ্যা, দূরত্ব, নির্গমন পথের দৈর্ঘ্য, ফায়ার লবির ক্ষেত্রফল ইত্যাদি নির্ণয় করা হয়ে থাকে। সব ধরনের ভবনের জন্যই আলাদা আলাদা স্পেসিফিকেশন বা নির্দিষ্ট নির্ণায়ক লিপিবদ্ধ আছে।

‘Bangladesh National Building Code, BNBC 2022’-এর সঙ্গে ‘ঢাকা ইমারত নির্মাণ বিধিমালা ২০০৮’ এবং অন্যান্য নগরের জন্য প্রণীত বিধিমালার কোনোরূপ সংঘর্ষ নেই। যদিও ঢাকা বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা ২০২২-২০৩৫ এ BNBC 2022 থেকে কিছুটা বিচ্যুতি লক্ষ্য করা যায়। এসব বিধিমালা সমূহে ‘Building Construction Act, 1952’-এর অধীনে নিয়ম ভঙ্গের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ও যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও বলা হয়েছে।

ব্যবহারকারীর সংখ্যা অনুযায়ী সিঁড়ির প্রস্থ ও নির্গমন দরজা পর্যন্ত যাতায়াতের দূরত্ব নির্ণয় করা হয়েছে। যেমন— আবাসিক, প্রাতিষ্ঠানিক, স্বাস্থ্যসেবা— এসব ভবনের ক্ষেত্রে প্রতি ১২ জন ব্যবহারকারীর জন্য নির্গমন দরজা পর্যন্ত সর্বোচ্চ দূরত্ব হবে ২৩ মি.মি.। একই ক্ষেত্রে স্প্রিংকলার ছাড়া সিঁড়ির প্রস্থ হবে মাথাপিছু ৮ মি.মি. যা স্প্রিংকলার সিস্টেমসহ হবে ৫ মি.মি.। নির্গমন দরজার প্রস্থ সকল ভবনের জন্যই হবে ১ মিটার এবং স্লাইডিং বা হ্যাংগিং দরজা ব্যবহার করা যাবে না কোনোভাবেই।

দরজা সাইড সুইংগিং ধরনের হতে হবে এবং তা ব্যবহারকারীর সামনের দিকে, তথা ফায়ার লবির দিকে খুলবে। সিঁড়ির ফ্লাইটে সরাসরি কোনও দরজাই খোলা যাবে না। নির্গমন পথের দরজাগুলো কোনও অবস্থাতেই তালা দিয়ে বন্ধ করে রাখা যাবে না। এছাড়া নির্গমন পথ থেকে সিঁড়ি পর্যন্ত পুরো পথটি হতে হবে বাধাহীন।

যশোর আইসিটি পার্কের ফ্লোর প্ল্যান (প্রস্তাবিত নকশার সঙ্গে লেখক জড়িত ছিলেন)

কোনও ধরনের মালপত্র দিয়ে জরুরি নির্গমন পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিতে নিষেধাজ্ঞা ‘বিএনবিসি’ ও ‘ঢাকা ইমারত নির্মাণ বিধিমালা’ উভয়েই নির্দেশিত আছে। ১০ তলা বা ৩৩ মিটার উচ্চতা বিশিষ্ট শিল্প কারখানা, গুদাম ইত্যাদি বিপজ্জনক ভবনের ক্ষেত্রে কমপক্ষে দুইটি ফায়ার এক্সিটের নির্দেশনাও বিধিমালায় দেওয়া আছে।

উল্লেখ্য, ‘Bangladesh National Building Code, BNBC 2022’-এর সঙ্গে ‘ঢাকা ইমারত নির্মাণ বিধিমালা ২০০৮’ এবং অন্যান্য নগরের জন্য প্রণীত বিধিমালার কোনোরূপ সংঘর্ষ নেই। যদিও ঢাকা বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা ২০২২-২০৩৫ এ BNBC 2022 থেকে কিছুটা বিচ্যুতি লক্ষ্য করা যায়। এসব বিধিমালা সমূহে ‘Building Construction Act, 1952’-এর অধীনে নিয়ম ভঙ্গের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ও যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও বলা হয়েছে।

অগ্নি দুর্ঘটনা প্রতিকারে আশু করণীয়
এত বিধিমালা, আইন ইত্যাদির পরও বারবার ঘটছে ভয়াবহ সব দুর্ঘটনা। এ পেছনে মূল কারণ হলো, আমাদের আইন ও বিধি বিধানের যথাযথ প্রয়োগের অভাব। আইন ও বিধিমালাগুলোতেও কিছুটা ফাঁক থেকে গেছে।

অগ্নি নির্বাপন ব্যবস্থা ও ফায়ার এক্সিট না থাকায় ২০১৯ সালের ২৮ মার্চ  বনানীর সুউচ্চ এফ আর টাওয়ারে অগ্নিকাণ্ডের ঘটায় ২৫ জনের মৃত্যু হয়। আলোকচিত্র: হারুন-অর-রশীদ।

এর মধ্যে রয়েছে— ঢাকা ইমারত নির্মাণ বিধিমালায় স্থাপনার শ্রেণিবিন্যাসে রেস্তোরাঁর মতো ব্যবহারকে কোনো শ্রেণিতে পরিষ্কারভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। সমাবেশ ভবনকে E শ্রেণিভুক্ত করা হলেও সেখানে কোথাও রেস্তোরাঁর কথা উল্লেখ করা নেই। আবার F শ্রেণিভুক্ত বাণিজ্যিক ভবনের তালিকাতেও নেই রেস্তোরাঁর কথা। সুতরাং অকুপেন্সি সার্টিফিকেটে ব্যবহার বদলের যে বিষয়টা বলা হচ্ছে, তা এ ক্ষেত্রে ধোঁয়াশার সৃষ্টি করছে। বিধিমালার এই জায়গাটা পর্যালোচনা করে সংশোধন করা একান্ত প্রয়োজন।

বিধি-বিধান থাকলেও সব ভবনে অগ্নি নিরাপত্তা থাকে না। এক্ষেত্রে যেসব ভবনে ফায়ার এক্সিট নেই সেসব ভবনকে চিহ্নিত করে সেখানে যথোপযুক্ত অগ্নি নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে ভবনের একটি সুবিধাজনক অংশকে উপর থেকে নিচ অব্দি ভেঙে ফেলে সে জায়গায় বিএনবিসি অনুযায়ী শ্যাফটের জায়গা করে অগ্নি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।

উন্নত দেশগুলোতে প্রতি দুই বা তিন বছর অন্তর নগরের পরিবর্তন ও পরিস্থিতির বাস্তবতার সঙ্গে সঙ্গে বিধিমালা ও কোড হালনাগাদ করা হয়— আধুনিকায়ন করা হয়। আমাদের দেশে এই চর্চা নেই। আমাদের কোড ও বিধিমালাগুলো সংশোধন ও হালনাগাদ করতে হবে নিয়মিত। আমাদের ভবন নির্মাণ সংক্রান্ত আইনটি ১৯৫২ সালের যা, ‘Building Construction Act, 1952’ নামে পরিচিত। এ আইনের আধুনিকায়ন এখন সময়ের দাবি।

আমাদের পেশাজীবীদের মাঝেও কিছু ঘাটতি রয়ে গেছে এখনও। বিধিমালা ও বিএনবিসিতে অগ্নি নিরাপত্তা সম্পর্কে বিশদ বলা থাকলেও দেখা যায়, অনেক স্থপতি ও প্রকৌশলী সেই বিষয়গুলো যথাযথভাবে তাদের নকশায় প্রয়োগ করতে ব্যর্থ হন।

এ বিষয়গুলো যেমন পেশাজীবী স্থপতি ও প্রকৌশলীদের জানা একান্ত প্রয়োজন তেমনি শিক্ষা কারিকুলামেও এসব বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে সংযুক্তির প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। একেবারে স্নাতক ছাত্রাবস্থা থেকে অগ্নি নিরাপত্তা ও অগ্নি নির্বাপন সংক্রান্ত বিষয়গুলো আত্মস্থ করে ফেললে পেশাগত জীবনে তার প্রয়োগে একপ্রকার নীতিগত বাধ্যবাধকতা থাকে।

অসচেতনতার কারণে আইন প্রণেতা, কর্তৃপক্ষ, সংশ্লিষ্ট পেশাজীবী, ভবন মালিক, প্রতিষ্ঠান মালিক থেকে শুরু করে একেবারে সাধারণ জনগণ পর্যন্ত সকলে অগ্নি দুর্ঘটনার বিষয়টি এড়িয়ে যান। তাই সবার আগে প্রয়োজন আমাদের সকল পর্যায়ের মানুষের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধি করা। আগুনের ঘটনা প্রতিদিন ঘটবে না। কিন্তু যখন ঘটবে, এমনও হতে পারে পুরো একটি লোকালয়, একটি নগর ধ্বংস হয়ে যেতে পারে।

যদিও এখন অনেক আধুনিক অগ্নি নির্বাপন ব্যবস্থা রয়েছে, তবুও আমাদের অপরিকল্পিত নগরগুলো যে ধরনের ঝুঁকিতে রয়েছে সেখানে যেকোনো সময় আগুন ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কাকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তাই এখনই এ বিষয়ে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে আমাদের।

লেখক: স্থপতি ও নগর পরিকল্পনাবিদ।
ইমেইল:taslihamowla@gmail.com

তাসলিহা মওলা। প্রতিকৃতি অঙ্কন: সব্যসাচী মজুমদার।
ad

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত