স্ক্রিন টাইম এড়ানোর কোনও উপায় এখন জানা নেই কারও। মহামারীর পর থেকে মানুষ আরও ঝুঁকে গেছে অনলাইনে। বাজার থেকে ব্যবসা– সব কাজে স্ক্রিনে তাকিয়ে থাকাই যেন মানুষের প্রতিদিনের নিয়তি।
একজন চাকরিজীবী অন্তত ১৩ ঘণ্টা কমপিউটার স্ক্রিনের সামনে বসে থাকেন। আট ঘণ্টা ঘুম ছাড়া একজন ব্যক্তি প্রতিদিন অন্তত ১৬ ঘণ্টা জেগে থাকেন; ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ৮১ শতাংশ সময়ই স্ক্রিনে চোখ সেঁটে রাখতে হয় তাকে।
স্ক্রিনের দিকে দীর্ঘ সময় তাকিয়ে থাকার ক্ষতি পোহায় শরীর ও মন; চোখ টনটন করে, মাথা ব্যথা হয় এবং ঘুমের ঘাটতি বা ইনসমনিয়ায় ভোগায়।
চোখে আরাম দিতে তারপর বাজারে এল ব্লু লাইট ব্লকিং গ্লাস বা নীল আলো নিরোধী চশমা। জানা গেল, নাকের উপর এই চশমা বসালে সেরে যাবে চোখের ব্যথা; তাহলে ঘুম হবে ভালো।
এখন অনেক ব্র্যান্ডের মোড়কে দোকানে পাওয়া যাবে এই নীল আলো নিরোধী কাচ। যারা চোখে কম দেখার কারণে চিকিৎসকের পরামর্শে চশমা পরেন, তারাও এই বিশেষ কাচ বেছে নিতে পারেন।
বলা হয়, এই কাচ স্ক্রিন ও বৈদ্যুতিক যন্ত্র থেকে বিচ্ছুরিত রশ্মি থেকে বাঁচিয়ে রাখে আমাদের চোখ । এমন কথা লুফে নেওয়ার মতোই, তাই না? কিন্তু সারাদিনে আট ঘণ্টা বা এরও বেশি সময় স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকলেও কি চোখের রক্ষাকবচ হয়ে থাকবে নীল আলো নিরোধী কাচ?
ভারতের চক্ষু বিশেষজ্ঞ, রাহিল চৌধুরী এক কথায় নীল আলো নিরোধী কাচ অকাজের বলে জানিয়ে আলোচনায় এসেছেন।
ইউটিউবার রনভির আল্লাহবাদিয়ার এক পডকাস্টে রাহিলের এই মন্তব্য নিয়ে শুরু হয় পাল্টাপাল্টি আলোচনা। কেউ বলেন, চশমায় এই কাচ বসিয়ে চোখে আরাম পেয়েছেন। আবার কেউ বলেন, এসব আসলে পণ্য বিক্রির পাঁয়তারা।
নীল আলো চোখের ক্ষতি করে?
দেহঘড়ির চলায় আলোর বড়সর ভূমিকা আছে। যেমন সকালের আলো জানান দেয়, এখন ঘুম থেকে উঠতে হবে। নীল আলো শরীরে মেলাটোনিন উৎপাদন ব্যাহত করে। এই মেলাটোনিন হলো ঘুমের ঘড়ি পরিচালনাকারী হরমোন। এই হরমোন কমে যাওয়া মানে ঘুম ঘাটতি হবে।
চট করে তাকালে ডিজিটাল ডিভাইসগুলোর স্ক্রিন নীল মনে না হলেও, ক্ষুদ্র তরঙ্গদৈর্ঘ্যের নীল আলোর নিঃসরণ ঘটছে ঠিকই। রাত জেগে সোশাল মিডিয়া স্ক্রল করে চলা কেউ অথবা সন্ধ্যায় জমিয়ে কমপিউটার গেম খেলা একজন তার মস্তিষ্ককে জানাচ্ছে এখন ঘুম নয় বরং জেগে থাকতে হবে।
এসব কৃত্রিম আলোর আগে সূর্য আমাদের ঘুমের চক্র পরিচালনা করতো। এখন দিনের পর রাতেও মানুষের চোখে স্ক্রিনের আলো পড়ছে।
ফ্লুরোসেন্ট এবং ইনক্যান্ডিসেন্ট বালবের চেয়ে এলইডি থেকে অত্যধিক পরিমাণে নীল আলোর নিঃসরণ ঘটে। স্মার্টফোন, ট্যাবলেট এবং টিভি স্ক্রিনেও এলইডি ব্যবহার করা হয়। ল্যাপটপ, আইপ্যাড, আগের আইফোন মডেলে এলসিডি স্ক্রিন থাকলেও ডিসপ্লের পেছনে এলইডি দেওয়া হয়।
চোখের জ্বালাপোড়া থেকে দৃষ্টিশক্তি হারানোতে নীল আলোর ভূমিকা আছে মনে করা হয়। যদিও এসবের অকাট্ট কোনো প্রমাণ নেই এমন দাবিও রয়েছে বিপরীতে।
দ্য আমেরিকান একাডেমি অব অপথালমোলজি বলছে, মানুষ তো সব সময় সূর্য থেকে আসা নীল আলোর মধ্যে দিন কাটায়। স্ক্রিন থেকে নিঃসরিত নীল আলোর কারণে চোখের ক্ষতি হওয়ার কোনও প্রমাণ এখনও নেই।
প্রযুক্তিভিত্তিক প্রকাশনা সিনেটের সঙ্গে আলাপে আমেরিকান একাডেমি অব অপথালমোলজি প্রতিষ্ঠানের মুখপাত্র ড. রাজ মাতুরি বলেন, “দিনের বেলা সূর্য থেকে যে পরিমাণ নীল আলো আমরা পাই তা কমপিউটার স্ক্রিনের থেকে ১০ গুণ বেশি। আমাদের শরীর এর সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছে এরমধ্যে।”
আবার জরিপ থেকে আমেরিকান অপটোমেট্রিক অ্যাসোসিয়েশন (এওএ) বলছে, কমপিউটারের সামনে অনেকক্ষণ বসে থাকা অর্থ্যাৎ দীর্ঘক্ষণ নীল আলোর সংস্পর্শে থাকলে চোখের রেটিনার ক্ষতি হয়।
দৃষ্টিশক্তি হারানোর ক্ষতি পুষিয়ে আনতে কাজ করছে অলাভজনক সংস্থা প্রিভেন্ট ব্লাইন্ডনেস। আগের অনেক গবেষণার বরাতে তারা বলছে, নীল আলোর কারণে চোখে ব্যথা হতে পারে।
যারা কমপিউটার, ট্যাবলেট, ই-রিডার এবং মোবাইল ফোনে হরদম কাজ করছেন তাদের চোখের আর্দ্রতা কমে যাওয়া, মাথা ব্যথা এবং ঘাড়ে ব্যথা দেখা দেয়।
নীল আলো ঠেকাবে চশমা?
চশমা বিক্রেতা কোম্পানিগুলো বলছে, ব্লু লাইট ব্লকিং গ্লাস ক্ষতিকারক নীল রশ্মিকে আটকে দিতে পারে; কোনো কোনো ক্ষেত্রে আলট্রা ভায়োলেট বা অতিবেগুনি রশ্মিও ঠেকিয়ে দেয়। স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকার সময়, বিশেষ করে অন্ধকারে, চোখে এই ফিল্টার দেওয়া চশমা থাকলে ক্ষতি অনেকখানি কমিয়ে আনা সম্ভব।
যদিও এর পেছনে বিজ্ঞানসম্মত কোনো প্রমাণ নেই, এমন মন্তব্য করেছেন চোখের চিকিৎসক ভারতের রাহিল চৌধুরী। তার মতে এই ব্লু লাইট ফিল্টার গ্লাসের চশমা চোখে পরার কোনো মানেই হয় না।
বরং তার পরামর্শ হচ্ছে, আজকাল কমপিউটার বা ল্যাপটপে ইন-বিল্ট থাকা ব্লু লাইট ফিল্টার সফটওয়ার চালু করে রাখতে হবে সবাইকে।
রাহিল চৌধুরীর মতো অনেক বিশেষজ্ঞই নীল আলো নিরোধী চশমাতে ভরসা করতে পারছে না।
পুনে শহরে রুবি হল ক্লিনিকের জ্যেষ্ঠ পরামর্শক এবং চোখের সার্জন সানতোষ ভিড়ে মনে করেন, “এমন সব ঝকমারি কথা বলা হয় ক্রেতা টানতে। নয়তো মোবাইল ফোন এবং অন্যান্য গ্যাজেট থেকে খুব সামান্য পরিমাণে নীল আলোর নিঃসরণ ঘটে; তা থেকে চোখের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা নেই।”
এমনকি আমেরিকান অ্যাসোসিয়েশন অব অপথালমোলজির পক্ষ থেকে নীল আলো নিরোধী চশমা পরার কোনো পরামর্শ দেওয়া হয়নি বলেও জানান সানতোষ ভিড়ে।
“এই বিজ্ঞাপনগুলো আসলে বিজ্ঞানসম্মত নয় একেবারে।”
নিখরচায় চোখের আরাম
কমপিউটারের সামনে বসে অনেকক্ষণ কাজ করে যদি চোখে ক্লান্তি আসে, তাহলে জীবন যাপনে একটু নজর দিয়েও আরামে থাকা যায়।
চোখের সুস্থতার জন্য ঘুমের অন্তত তিন ঘণ্টা আগে কাজ থেকে উঠে যেতে হবে। রাতের খাওয়া শেষে ঘরের উজ্জ্বল আলো কমিয়ে দিন। বিছানায় যাওয়ার অন্তত ৩০ মিনিট আগে ফোন সরিয়ে রাখুন এবং টিভি বন্ধ করে দিন। ঘুমানোর সময় ফোনে ডু নট ডিস্টার্ব ফিচারটি দিয়ে রাখুন।
স্ক্রিন নির্ভর কর্মজীবীদের জন্য ২০-২০-২০ পদ্ধতি মেনে চলার পরামর্শ দেন অনেকেই; প্রতি ২০ মিনিট পর ২০ সেকেন্ডের জন্য ২০ ফুট দূরে থাকিয়ে থাকতে হবে। এতে করে চোখের পেশী শিথিল হয়ে স্বস্তি দেবে।