Beta
বৃহস্পতিবার, ৯ মে, ২০২৪
Beta
বৃহস্পতিবার, ৯ মে, ২০২৪

ভারতের অর্থনীতি কতটা শক্তিশালী

বর্তমানে ভারতের ৬ কোটি মানুষের বার্ষিক গড় আয় ১০ হাজার ডলার।
বর্তমানে ভারতের ৬ কোটি মানুষের বার্ষিক গড় আয় ১০ হাজার ডলার।

ভারতে লোকসভায় ভোট চলছে, তাতে নরেন্দ্র মোদী তৃতীয় মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হবেন বলেই মনে করা হচ্ছে। সেটা হলে জওহরলাল নেহেরুর পর ভারতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নেতা হিসেবে মর্যাদা পাকাপোক্ত হবে মোদীর।

চা-বিক্রেতা থেকে রাজনীতির ময়দানে পা রাখা নরেন্দ্র মোদীর এই সাফল্যকে অন্য দৃষ্টিকোণ থেকেও দেখছেন অনেক বিশ্লেষক।

দ্য ইকোনমিস্টের এক নিবন্ধে বলা হয়েছে, মোদীর নির্বাচনী সাফল্য প্রতিফলিত করে তার রাজনৈতিক দক্ষতা, হিন্দু-জাতীয়তাবাদী আদর্শের শক্তি এবং তার হাতে ভারতের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষয়।

আবার এটাও ঠিক যে, সাধারণ ভোটার ও অভিজাতদের একটি অংশের ধারণা তিনি ভারতের জন্য আর্থিক সমৃদ্ধি ও শক্তি বয়ে আনছেন।

ডিগ্লোবালাইজেশনের মধ্যেও কীভাবে শক্তিশালী নেতৃত্বের মাধ্যমে বিত্তশালী হওয়া যায়, মোদীর ভারত নিয়ে সে গবেষণাও হতে পারে।

হতে পারে, ভারত দ্রুত এগিয়ে যাবে এবং অস্থিরতা এড়াবে। যার মাধ্যমে আগামী ১০-২০ বছরে দেশের ১৪০ কোটি মানুষের ভাগ্যের পাশাপাশি বিশ্ব অর্থনীতিকেও নতুন রূপ দিতে পারে ভারত।

দ্য ইকোনমিস্টের একটি বিশেষ প্রতিবেদনের ব্যাখ্যার বরাত দিয়ে ওই নিবন্ধে বলা হয়েছে, মোদীর ফর্মুলা একটি নির্দিষ্ট পর্যায় পর্যন্ত কাজ করছে। তবে ভারতের এই সাফল্য স্থায়ী হবে কি না কিংবা মোদীর ক্ষমতায় থাকার উপর বিষয়টি নির্ভর করে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।

বিশ্বের দ্রুত বর্ধনশীল দেশগুলোর অন্যতম ভারত, যার অর্থনীতি বছরে ৬-৭ শতাংশ হারে প্রসারিত হচ্ছে।
নতুন পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১০ সালের পর এখনই সর্বোচ্চে রয়েছে ভারতের ব্যক্তিমালিকানাধীন খাতের আত্মবিশ্বাস। এরই মধ্যে দেশটি বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হয়েছে। এই ধারা চলতে থাকলে ২০২৭ সালের মধ্যে তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ হবে ভারত। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের পরেই থাকবে তার অবস্থান।

ভারত এখন নতুন নতুন উপায়ে দাপট দেখাচ্ছে। ভারতে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন কোম্পানির অন্তত ১৫ লাখ কর্মী রয়েছে, যা অন্য যেকোনো দেশের তুলনায় বেশি।

বিশ্বের সবচেয়ে মূল্যবান পুঁজিবাজারগুলোর মধ্যে চতুর্থ অবস্থানে ভারতের পুঁজিবাজার, বিমান চলাচলের বাণিজ্যের দিক দেশটির অবস্থান তৃতীয়।

ভারতের অর্থনৈতিক অবস্থান বুঝতে রাশিয়া থেকে তেল কেনার উদাহরণও দেওয়া যেতে পারে। সেসময় ভারত রুশ জ্বালানি কিনতে শুরু করায় তার প্রভাব পড়তে শুরু করে গোটা বিশ্ববাজারের ওপর।

সাধারণ দৃষ্টিতে, একটি দেশের সম্পদ বেড়ে যাওয়ার অর্থ হলো তার ভূ-রাজনৈতিক শক্তিও বেড়ে যাওয়া।

ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীদের কারণে সুয়েজ খালে জাহাজ চলাচল বিঘ্নিত হওয়ার পর মধ্যপ্রাচ্যে ১০টি যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন করে ভারত। যে পদক্ষেপে কোনও বাধাও দেননি জো বাইডেন বা ডোনাল্ড ট্রাম্পও।

তবে কেউ যদি মনে করে ভারত আরেকটি চীন হতে চলেছে, অর্থাৎ চীনের মতো ব্যাপক উৎপাদনভিত্তিক দেশ হতে চলেছে তাহলে তা সঠিক নয়। দেশটি এমন এক সময়ে উন্নয়নের পথে হাঁটছে যখন পণ্য বাণিজ্য কিছুটা স্থির হয়ে আছে এবং কলকারখানাগুলোও স্বয়ংক্রিয় হয়ে উঠেছে। তাই অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য একটি নতুন মডেল প্রবর্তন করতে হবে ভারতকে।

এই মডেলের একটি স্তম্ভ অবশ্য বেশ পরিচিত, সেটি হলো বিভিন্ন অবকাঠামোর ব্যাপক একটি নেটওয়ার্ক তৈরি করা, যার মাধ্যমে একটি বিস্তৃত একক বাজার পরিচালিত হয়।

ভারতে এখন বিমানবন্দরের সংখ্যা ১৪৯টি, যা এক দশক আগের সংখ্যার চেয়ে দ্বিগুণ। এছাড়া ১০ হাজার কিলোমিটার নতুন রাস্তা ও বছরে ১৫০০ কোটি ওয়াট সৌর-শক্তি উৎপাদন সক্ষমতাও যোগ হচ্ছে। ডিজিটাল পেমেন্ট, আধুনিক পুঁজিবাজার, ব্যাংক এবং সমন্বিত ডিজিটাল কর ব্যবস্থাসহ এই অবকাঠামোর একটা অংশ অবস্তুগত বা ভৌত নয়। ফলে এর সুবিধা কাজে লাগিয়ে কোম্পানিগুলো কম খরচেই উৎপাদন অনেক বাড়াতে পারে।

দ্বিতীয় স্তম্ভটি হল বিভিন্ন ধরনের পরিষেবা রপ্তানি, যা দেশটির জিডিপির ১০ শতাংশে পৌঁছেছে। বিশ্বব্যাপীই এখন পরিষেবার চাহিদা বাড়ছে, সেখানে ভারতীয় তথ্যপ্রযুক্তি সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো বিশেষ জায়গা করে নিয়েছে।

ভারতীয় ফার্মগুলো সফলভাবে ‘গ্লোবাল ক্যাপাবিলিটি সেন্টার’ বাজারজাত করতে পেরেছে, যেখানে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর জন্য গবেষণা ও উন্নয়ন এবং আইন ও হিসাবরক্ষণের মতো পরিষেবাগুলো দেওয়া হয়।

প্রযুক্তি খাতে দারুণ উন্নতি করার পরেও, এটা ঠিক যে ভারতের একটি বড় অংশে এখনও আধা- আধা-গ্রামীণ সমাজ ব্যবস্থা বিদ্যমান। আর এখানেই এর নতুন অর্থনৈতিক মডেলের শেষ স্তম্ভটি নিহিত। সেটি হলো, নতুন ধরনের কল্যাণ ব্যবস্থা সৃষ্টি করা যেখানে কোটি কোটি দরিদ্র ভারতীয়ও ডিজিটাল ট্রান্সফার-পেমেন্ট ব্যবহার করে।

পরিসংখ্যান বলছে, ভারতের বর্তমান জনসংখ্যার মাত্র ৫ শতাংশ দারিদ্রসীমার নিচে বাস করে। ২০১১ সালে এই হার ছিল প্রায় ১২ শতাংশ।

সব মিলিয়ে নরেন্দ্র মোদী আসলে কতটুকু কৃতিত্ব পাওয়ার যোগ্য?

তার সবচেয়ে সফল নীতিগুলো ১৯৯০ ও ২০০০ এর দশকে ভারতে গৃহীত উদারপন্থী সংস্কার কর্মসূচিগুলোর ওপর ভিত্তি করেই তৈরি হয়েছে। তবে তাতেও তাকে কৃতিত্ব দিতে কোনও সমস্যা নেই। কারণ তিনি স্থবির সংস্কার প্রক্রিয়াগুলো জোরদার করেছেন, সেগুলো সামনে তুলে এনেছেন। এমনিক কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে ব্যক্তিগতভাবে তত্ত্বাবধানও করেছেন, আমলাতন্ত্রকে প্রতিহতও করেছেন।

অবশ্য এসব করতে গিয়ে তিনি ‘ক্রোনি ক্যাপিটালিজম’ করেছেন বা রাজনৈতিক সম্পর্কের ভিত্তিতে বড় বড় ব্যবসায়ী ও কোম্পানিগুলোকে বেশি সুবিধা দিয়েছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে।

কিছু বড় বড় কোম্পানি সুবিধা পেলেও ব্যবসায় কেন্দ্রীভবন বা একচেটিয়াত্ব কমছে, দুর্নীতি কমেছে এবং ব্যবসা-বাণিজ্যে বৈচিত্র্য এসেছে।

দ্য ইকোনমিস্টের নিবন্ধে নরেন্দ্র মোদীকে প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী ও জনপ্রিয় নেতার মিশেল বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়, নরেন্দ্র মোদী সভা-সমাবেশ যেমন উপভোগ করেন, পাওয়ারপয়েন্ট উপস্থাপনাও তার কাছে সমান পছন্দের।

তিনি যদি আরও পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকেন তাহলে অর্থনৈতিক দিক থেকে ভারত আরও উন্নতি করতে থাকবে। দেশটির মধ্যবিত্তও শক্তিশালী হবে।

বর্তমানে দেশটির ৬ কোটি মানুষের বার্ষিক গড় আয় ১০ হাজার ডলার। বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় বিনিয়োগ ব্যাংক, সিকিউরিটিজ এবং বিনিয়োগ ব্যবস্থাপনা ফার্ম গোল্ডম্যান স্যাকস বলেছে, ২০২৭ সালে এই সংখ্যা ১০ কোটিতে পৌঁছাবে। গোল্ডম্যান স্যাকসের ২০ শতাংশ কর্মী বর্তমানে ভারতে কর্মরত।

তবুও ভারত একটি গুরুতর সমস্যার মুখোমুখি হয়েছে। দেশটির ১০০ কোটি কর্মক্ষম জনসংখ্যার মধ্যে মাত্র ১০ কোটি বা তার কিছু বেশি মানুষের আনুষ্ঠানিক কর্ম বা চাকরি আছে। বাকিদের অধিকাংশই খণ্ডকালীন কাজ বা বেকারত্বে আটকে আছেন।

কর্মসংস্থানের জন্য রাষ্ট্রীয় প্রণোদনার মাধ্যমে উৎপাদনমূলক কাজ বাড়াতে একটি প্রকল্পও চালু করেন মোদী। প্রকল্পটি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করলেও মাত্র ৭০ লাখ কর্মসংস্থান তৈরি করবে।

চীনে রপ্তানি বৃদ্ধির জন্য দেশটির প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের নতুন পরিকল্পনা মোদীর কাজকে আরও কঠিন করে তুলবে বলেও মনে করা হচ্ছে।

অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে ভারতকে ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে। এক্ষেত্রে একটি পথ হতে পারে তথ্যপ্রযুক্তি খাতকে আরও প্রসারিত করা। যা ক্রমাগত ডিজিটাল হয়ে ওঠা বিশ্বের জন্য একটি কেন্দ্র হিসেবে কাজ করবে এবং ডিজিটাল অর্থায়ন, খাদ্য ও প্রতিরক্ষাসহ রপ্তানি শিল্পের একটি ক্লাস্টার হবে (যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শক্তিশালী সম্পর্ক এক্ষেত্রে সাহায্য করবে)।

এসব শিল্পের কর্মীরা যখন জীবনযাত্রায় অর্থ ব্যয় বাড়াবেন, তখন স্বাভাবিকভাবেই নির্মাণ থেকে শুরু করে হোটেল পর্যন্ত অন্যান্য খাতে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। ফলে একটি দক্ষ ও একক শক্তিশালী অভ্যন্তরীণ বাজার গড়ে উঠবে। যার মাধ্যমে সামগ্রিক উৎপাদনশীলতা বাড়াবে এবং সামাজিক কল্যাণমূলক কর্মসূচির মাধ্যমে পিছিয়ে পড়া গোষ্ঠীর মানুষকেও সহায়তা করা যাবে।

এর জন্য, ভারতকে শিক্ষা ও কৃষি খাতে পরিবর্তন আনতে হবে। জনবহুল উত্তর ভারত থেকে মানুষকে দক্ষিণ ও পশ্চিম ভারতের বড় শহরগুলোতে অভিবাসনে পাঠাতে হবে।

নরেন্দ্র মোদীর দল ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) দারুণ কিছু ভাবনা থাকলেও বেশিরভাগ মতাদর্শই মুসলিম-বিদ্বেষের দিকে বেশি মনোযোগী। দলটির ক্রমবর্ধমান কর্তৃত্ববাদ রাজনৈতিক বিরোধিতা ও বাকস্বাধীনতা খর্ব করেছে।

ফার্মগুলোর আশঙ্কা, কেন বিনিয়োগ এখনও বাড়েনি সে প্রশ্নের ব্যাখ্যা হয়ত মোদী দেবেন। ২০৩০ সাল নাগাদ বিরাট সামাজিক পরিবর্তনের জন্য জনসাধারণকে প্রস্তুত করার প্রক্রিয়াও এখনও ঠিক মতো শুরু হয়নি।

এসময়ে শিক্ষার উন্নয়ন, শহর ও কৃষির পুনর্নির্মাণের জন্য রাজ্য সরকারগুলোর সহযোগিতার প্রয়োজন হবে। এর মধ্যে অনেক রাজ্য সরকারই বিজেপির নেতৃত্বে চলে না। মোদীর রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গী ও অবস্থানের কারণে তাদের অনেকের সঙ্গে বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি হয়েছে।

ভারত ও এর ‘হেভিওয়েট’ অর্থনীতির জন্য প্রশ্নটি মোদি জয়ী হবেন কি না তা নয়, বরং প্রশ্নটি হলো তিনি বিবর্তিত হবেন কি না? কারণ, ৭৩ বছর বয়সে পৌঁছে তিনি তার ব্যবস্থাপনার সক্ষমতা ম্লান হয়ে যেতে দেখতে পারেন।

১৯৯০-র দশকে শুরু হওয়া সংস্কার কর্মসূচির সঙ্গে মিল রেখে একটি নতুন সংস্কার কর্মসূচি তৈরি করতে এবং একটি সমৃদ্ধ জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি গড়ে তুলতে চাইলে মোদীকে এখন তার স্বৈরাচারী প্রবৃত্তিকে সামলাতে হবে।

ভবিষ্যতের জন্য আরও বেশি স্থানীয় এবং বিদেশী বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে এবং উন্নতি-মনস্ক উত্তরসূরি খুঁজে পেতে, তার দলকে উগ্র জাতীয়তাবাদী রাজনীতি থেকে সরে আসতে হবে। যদি তা না হয়, মোদীর জাতীয় পুনর্নবীকরণের পরিকল্পনা প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে পারবে না।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ad

সর্বাধিক পঠিত