ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলের অভিযান বন্ধের দাবিতে যুক্তরাষ্ট্রের একের পর এক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছড়িয়ে পড়ছে বিক্ষোভ।
কলাম্বিয়া, ইয়েল ও নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটিসহ আরও কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীরা তাঁবু গেঁড়ে টানা বিক্ষোভ চালিয়ে যাচ্ছে।
বিক্ষোভ ঠেকাতে একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্তৃপক্ষ পুলিশ ডেকে শত শত শিক্ষার্থীকে গ্রেপ্তারও করিয়েছে।
কিন্তু এতে শিক্ষার্থীরাও আরও ফুঁসে উঠেছে। দেশটির আরও কয়েকটি অঙ্গরাজ্যের শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও বিক্ষোভ শুরু হয়েছে।
ক্যালিফোর্নিয়া, বার্কলে, এমআইটি, মিশিগান, নর্থ ক্যারোলাইনা, বোস্টন ও টাফটস ইউনিভার্সিটি এবং এমারসন কলেজসহ আরও কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে।
গত সপ্তাহে কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির নিউ ইয়র্ক ক্যাম্পাসে শুরু হয় এই বিক্ষোভ। এরপর নর্থওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটি, ওহাইও স্টেট ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অফ নর্থ ক্যারোলাইনা এট চ্যাপেল হিল, টেম্পল ইউনিভার্সিটি, প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অফ নেভাডা, লাস ভেগাসসহ আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে ক্লাস বর্জন করে সমাবেশ হয়েছে।
গত বছরের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার জেরে গাজায় ইসরায়েলের হামলা শুরু হওয়ার পর থেকেই যুদ্ধের পক্ষে-বিপক্ষে তর্ক-বিতর্ক শুরু হয় যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। তা এখন বিক্ষোভে রূপ নিয়েছে।
বিক্ষোভে কারা
এই বিক্ষোভে ইহুদি ও মুসলমানসহ বিভিন্ন ধর্ম ও জাতীয়তার শিক্ষার্থীসহ শিক্ষকরাও অংশ নিচ্ছেন।
বিক্ষোভের আয়োজনকারী সংগঠনগুলোর মধ্যে রয়েছে স্টুডেন্টস ফর জাস্টিস ইন প্যালেস্টাইন ও ইহুদি ভয়েস ফর পিস।
বিক্ষোভ শিবিরগুলোতে আলোচনা, আন্তঃধর্মীয় প্রার্থনা এবং বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে অভিনব উপায়ে প্রতিবাদ করছেন শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা।
এই বিক্ষোভের আয়োজকরা ইসরাইলপন্থি পাল্টা-বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে কোনও সহিংসতায় জড়ায়নি। যদিও কিছু ইহুদি শিক্ষার্থী বলেছে, তারা ক্যাম্পাসে অনিরাপদ বোধ করছে এবং বিক্ষোভকারীদের ইহুদিবিরোধী স্লোগানে আতঙ্কিত হচ্ছে।
বিক্ষোভকারীদের কী দাবি
বিক্ষোভরত শিক্ষার্থীদের মূল দাবিগুলো হলো- গাজায় একটি স্থায়ী যুদ্ধবিরতি, ইসরায়েলের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সহায়তা বন্ধ, অস্ত্র তৈরি ও সরবরাহকারী এবং যুদ্ধ থেকে লাভবান সংস্থাগুলোর সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সম্পর্ক ছিন্ন করা।
বিক্ষোভে অংশগ্রহণের কারণে বহিষ্কৃত শিক্ষার্থী ও অনুষদ সদস্যদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার দাবিও জানানো হচ্ছে।
কর্তৃপক্ষের কী প্রতিক্রিয়া
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এবং স্থানীয় আইন প্রয়োগকারীরা বিক্ষোভকারীদের ওপর দমন অভিযান শুরু করেছে।
কলাম্বিয়া ও এর অধিভুক্ত বার্নার্ড কলেজ বিক্ষোভে জড়িত কয়েক ডজন শিক্ষার্থীকে সাময়িক বহিষ্কার করেছে। কলাম্বিয়ায় শতাধিক বিক্ষোভকারীকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে।
কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট মিনোচে শাফিক নিউ ইয়র্ক পুলিশকে ডেকে আনেন বিক্ষোভকারীদের তাঁবুগুলো সরিয়ে ফেলার জন্য।
এর একদিন আগে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি পরিষদে সাক্ষ্য দিয়ে তিনি বলেন, বিক্ষোভকারীরা অনুমতি ছাড়াই প্রতিবাদ শিবির স্থাপন করে নিয়ম লঙ্ঘন করেছে।
ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয় বলেছে, বিক্ষোভকারীদের সরে যাওয়ার সুযোগ দেওয়ার পর পুলিশ সোমবার ৬০ জনেরও বেশি জনকে গ্রেপ্তার করেছে।
নিউ ইয়র্ক পুলিশ বিভাগ জানিয়েছে, সোমবার বিকালে নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটি থেকে ১২০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তারা বলেছেন, তারা পুলিশকে হস্তক্ষেপের অনুরোধ করেছেন কারণ বিক্ষোভকারীরা ক্যাম্পাসে জটলা পাকাচ্ছে এবং সুরক্ষা ও নিরাপত্তা বিঘ্নিত করছে।
মঙ্গলবার ব্রুকলিনের রাস্তায়ও বিক্ষোভ হয়েছে। তবে পুলিশ সেখানেও ব্যাপক ধারপাকড় চালায়।
ক্যাম্পাসে কী প্রভাব
কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটিতে সোমবার থেকে স্বশরীরে ক্লাস নেওয়া বন্ধ হয়ে গেছে, ক্লাস চলছে অনলাইনে।
বিশ্ববিদ্যালয়টি ঘোষণা করেছে, বেশিরভাগ কোর্সের সেমিস্টারের বাকি ক্লাসগুলো অনলাইনে, আর যখন সম্ভব হবে তখন স্বশরীরে নেওয়া হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রেসিডেন্ট মিনোচে শাফিক এক বিবৃতিতে বলেছেন, তিনি কোনও গোষ্ঠীকে শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত করার সুযোগ দেবেন না।
ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট পলিটেকনিক ইউনিভার্সিটি হামবোল্ট বুধবার পর্যন্ত স্বশরীরে ক্লাস স্থগিত করেছে।
শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রশাসনিক ভবন দখল করে নিয়ে বিক্ষোভ করছে। তারা ইসরায়েলের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক এবং অংশীদারত্ব প্রকাশ করার দাবি করে ইসরায়েলি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার দাবিও জানাচ্ছে।
মিশিগান ইউনিভার্সিটি বলেছে, মে মাসের শুরুর দিকে গ্র্যাজুয়েশন অনুষ্ঠানগুলোতে স্বাধীন মতপ্রকাশ এবং শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের অনুমতি দেবে তারা। তবে শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত করা যাবে না।
মঙ্গলবার মিশিগান ক্যাম্পাসের কেন্দ্রে বিক্ষোভকারীরা প্রায় ৪০টি তাঁবু স্থাপন করে।
মিনেসোটা ইউনিভার্সিটিতে নয়জন যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এসময় পুলিশ গ্রন্থাগারের সামনের একটি ছাউনি সরিয়ে দেয়। তাদের মুক্তির দাবিতে মঙ্গলবার বিকালে মিনেসোটা ক্যাম্পাসে মিছিল করেছে শত শত শিক্ষার্থী।
ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী হান্না দিদেহবানি বলেছেন, “আমাদের প্রতিবাদকারীরা কলাম্বিয়ার শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভে অনুপ্রাণিত হয়েছে।
“এই মুহূর্তে ক্যাম্পাসে বেশ কয়েকজন অধ্যাপক আছেন, যারা ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে সরাসরি গবেষণা তহবিল পাচ্ছেন। আমরা এমআইটিকে সেই গবেষণা সম্পর্কগুলো ছিন্ন করতে আহ্বান জানিয়েছি।”
ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া বার্কলেতে মঙ্গলবার প্রায় ৩০টি তাঁবুতে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করে। তারাও কলাম্বিয়ার বিক্ষোভে অনুপ্রাণিত হয়েছেন। আইনের ছাত্র মালাক আফানেহ বলেন, “কলাম্বিয়াকে আমরা ছাত্র আন্দোলনের হৃদয় বলে মনে করি।”
মঙ্গলবার মিনেসোটা ও পিটসবুর্গ ইউনিভার্সিটিতেও তাঁবু গেড়ে বিক্ষোভ শুরু হয়েছে। স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে সোমবার মিছিল করেছে প্রায় ৩০০ শিক্ষার্থী।
রাজনৈতিক নেতাদের প্রতিক্রিয়া কী
যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতাসীন ডেমোক্রেটিক প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইসরায়েলকে অর্থ ও অস্ত্র সরবরাহের জন্য বিক্ষোভকারীদের সমালোচনার মুখে পড়েছেন।
সোমবার সাংবাদিকদের তিনি বলেছেন, তিনি ‘ইহুদিবিদ্বেষী প্রতিবাদ’ এবং ‘যারা বোঝেন না যে ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে কী চলছে’ উভয়েরই নিন্দা করেন।
এর আগে রবিবার এক বিবৃতিতে জো বাইডেন বলেন, ইহুদি সম্প্রদায়কে নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য তার প্রশাসন ফেডারেল সরকারকে পূর্ণশক্তি দিয়েছে।
বাইডেন বলেন, “সাম্প্রতিক দিনগুলোতে আমরা ইহুদিদের বিরুদ্ধে হয়রানি এবং সহিংসতার আহ্বান দেখেছি। এই নির্লজ্জ ইহুদিবিদ্বেষ নিন্দনীয় এবং বিপজ্জনক – এবং কলেজ ক্যাম্পাসে বা আমাদের দেশের কোথাও এর কোনও স্থান নেই।”
কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটিতে বিক্ষোভরতরা বাইডেনের বিবৃতির সমালোচনা করে বলেছেন, তাদের বিক্ষোভের কিছু সংগঠকও ইহুদি। আর সংবাদমাধ্যমগুলো তাদের প্রতিনিধিত্ব করে না, উত্তেজনা ছড়ানো এমন ব্যক্তিদের খবর প্রকাশ করে আমাদের সম্পর্কে ভুল বার্তা দিচ্ছে।
তারা এক বিবৃতিতে বলেছে, “আমরা দৃঢ়ভাবে যে কোনও ধরনের ঘৃণা বা ধর্মান্ধতা প্রত্যাখ্যান করি। আর বহিরাগতদের বিরুদ্ধে সজাগ আছি, তারা ফিলিস্তিনি, মুসলিম, আরব, ইহুদি, কালো ও ফিলিস্তিনি সমর্থক সহপাঠী ও সহকর্মীদের মধ্যে সংহতি নষ্ট করতে চায়।”
বার্নার্ড সোফোমোর লিয়া সেলিম নামের এক শিক্ষার্থী বলেন, “এটা আমাদের কাছে খুবই স্পষ্ট যে, বাইরের লোকেরা বুঝতে পারছে না যে এই শিবিরটি কীসের।”
সেলিম গত সপ্তাহে কলম্বিয়ায় গ্রেপ্তার হওয়া ১৫ ইহুদি শিক্ষার্থীর একজন। তিনি বলেন, ইসরায়েল রাষ্ট্রের অপকর্মের সমালোচনা করলেই ইহুদিবিদ্বেষ হয়ে যায় না।
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, নিউ ইয়র্কের ম্যানহাটনের আদালতে হেঁটে যাওয়ার সময় ক্যাম্পাসের বিক্ষোভ পরিস্থিতিকে ‘জগাখিচুড়ি’ অবস্থা বলে মন্তব্য করেন।
তথ্যসূত্র: রয়টার্স, এপি