Beta
মঙ্গলবার, ৭ মে, ২০২৪
Beta
মঙ্গলবার, ৭ মে, ২০২৪

শ্রদ্ধাঞ্জলি

সাঈদ ভাই, তোমার জন্য

আবু সাঈদ খান। প্রতিকৃতি অঙ্কন: সব্যসাচী মজুমদার।

এই পৃথিবী ছেড়ে সাঈদ ভাই চলে গেছেন এপ্রিল মাসের ২২ তারিখে, কিন্তু সাঈদ ভাই, তুমি গেলে কোথায় বলো তো!

এই লেখা তোমার জন্য শোকগাথা নয় মোটেও, বরং তোমার জীবন উদযাপন করা বলতে পারো, ইংরেজিতে যাকে বলে ‘সেলিব্রেটিং দ্য লাইফ’!

ফেলে আসা জীবনের স্মৃতিপথে যতটুকু দেখতে পাই, আমাদের ময়মনসিংহ শহরের বাড়ির বৈঠকখানা ঘরে বা আমাদের বাড়ির উল্টোদিকেই তোমার নানার বাড়ি ‘মাজেদা ভিলা’র মাথা সমান উঁচু বারান্দায় পা ঝুলিয়ে বসে গল্প করছি বা লুডো খেলছি। তুমি কমই খেলতে, আমি, শরমিন (তোমার ছোট বোন) বাবু আর নিতু আপা (রুকু খালার মেয়েরা) খেলতাম। তুমি সেই বয়সেই পণ্ডিত ছিলে গো! পুরোনো দেশ পত্রিকার শব্দ ধাঁধা খেলতে বসে বসে, কত যুগ আগের কথা সেসব।

সাঈদ ভাইয়ের মা আর আমার মা খালাতো বোন, দুজন আবার একসাথে স্কুল-কলেজে পড়েছেন। আমাদের আনু খালা (আনোয়ারা বেগম) আর আবু (আবু আহমেদ খান) খালুজান।

আবু সাঈদ খানের সঙ্গে লেখক।

সাঈদ ভাইয়ের প্রবল সাহিত্য প্রীতি ছিল— আসলে আমাদের পরিবারেই সাহিত্যের দিকে ঝোঁক প্রবল ছিল। ‘আউট বই’ পড়তাম আমরা অনেক, বলা যায় গোগ্রাসে গিলতাম। পাড়ার অন্য সমবয়সীরা যখন নানা ধরনের খেলায় ব্যস্ত, আমরা তখন বাহ্যজ্ঞ্যান শুন্য হয়ে ‘শ্রীকান্ত’ কি ‘দেশে বিদেশে’ পড়ছি। আলোচনা করছি। সাঈদ ভাই ছিলেন এসবের নেতা। ক্লাস নাইন বা টেনে বিলাসীর চরিত্র বিশ্লেষণের একটা প্রশ্ন থাকতো, ১০ নম্বরের প্রশ্নে সাঈদ ভাই ১০+ পেয়েছিলেন। পূর্ণ নম্বর প্রশ্নের উত্তরের বিস্তৃত আলোচনার জন্য আর এক্সট্রা দুই নম্বর ওই বয়সেই তাঁর বিশ্লেষণের গভীরতার জন্য। তাঁর বাংলার শিক্ষক তাঁকে উৎসাহিত করেছিলেন বাংলা সাহিত্যে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করবার জন্য।

সাহিত্য পড়েছিলেন সাঈদ ভাই। হয়তো প্রফেশনাল জীবনে টেলিকম বিষয়ে পলিসি অ্যানালিস্ট হিসাবে তাঁর সফলতা তাঁর পর্যালোচনা করবার সুক্ষ্ম ক্ষমতা আর তীক্ষ মেধাশক্তিরই প্রতিফলন।

ক্লাস নাইন বা টেনে বিলাসীর চরিত্র বিশ্লেষণের একটা প্রশ্ন থাকতো, ১০ নম্বরের প্রশ্নে সাঈদ ভাই ১০+ পেয়েছিলেন। পূর্ণ নম্বর প্রশ্নের উত্তরের বিস্তৃত আলোচনার জন্য আর এক্সট্রা দুই নম্বর ওই বয়সেই তাঁর বিশ্লেষণের গভীরতার জন্য। তাঁর বাংলার শিক্ষক তাঁকে উৎসাহিত করেছিলেন বাংলা সাহিত্যে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করবার জন্য।

একটা সময় পর্যন্ত সাঈদ ভাই আমাদের কাজিনদের নেতা ছিলেন। আমরা দেয়াল পত্রিকা বের করতাম, পারিবারিক দেয়ালিকা। তিনি থাকতেন প্রধান সম্পাদক, আমার হাতের লেখা ভালো ছিল বলে সেই দেয়ালিকা লেখার দায়িত্ব পড়তো আমার উপর। চোখ বন্ধ করলেই যেন দেখতে পাই, হয় আমাদের বাড়ির সুপারি বাগানের ভিতরে এক টুকরা জায়গায় পাটির উপরে দাদীর বড় জলচৌকির উপরে কাগজ পেতে দেয়ালিকার লেখা কপি করছি অথবা সাঈদ ভাইদের টানা বারান্দায় মেঝের উপরে কাগজ ফেলে লিখছি। সাঈদ ভাই সাবধান করছেন, ‘‘ওই লাইন বেকা করবি না, কালি লেপ্টায় না যেন (তখন আমরা সুলেখা কালি দিয়ে লিখতাম), এহ্ বানান ভুল করলে কিন্তু কিল খাবি!’’

কবিতা আবৃত্তি করতেন তিনি ভালোই, নিতু আপা গান গাইতেন, মিতু গান গাইতো, আমি তেমন কিছুই পারতাম না কেবল উপভোগ করা ছাড়া। নিজেরা আমরা সাংস্কৃতিক  অনুষ্ঠান করতাম, পরিচালক-নির্দেশক সাঈদ ভাই, আর এইসব অনুষ্ঠানের সময় আমাকে তাঁর সহকারীর পদ দেওয়া হতো।

তারপর জীবনের নিয়মে সবাই ছড়িয়ে গেছি, পড়া শেষ করে নিজের নিজের জীবন শুরু করেছি। নব্বইয়ের দশকে আমাদের ভাই বোনদের সেই জীবন কঠিন ছিল বলা চলে, সবারই অর্থকষ্ট প্রবল ছিল। তারপরও বাংলা একাডেমিতে যেতাম আর দুই কাপ চা চারজনে ভাগ করে খেতাম। পাজামা-পাঞ্জাবিতে আমাদের সুদর্শন সাঈদ ভাই কবি কবি ভাবে একটা শান্তিনিকেতনি ব্যাগ কাঁধে ঘুরতেন।

সাঈদ ভাই বিয়ে করলেন, ১৯৮৭ সনে, আমি যদিও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র কিন্তু আমার প্রথম সন্তান আমার জীবনে এসে গেছে তখন। সাঈদ ভাই আর খুকু ভাবীর বিয়ে খুব সিম্পলভাবে হয়েছিল। বিয়ের সিদ্ধান্তটা অত সহজ সমীকরণের ছিল না, কিন্তু সাঈদ ভাই আর খুকু ভাবী আমাদের কাছে ছিলেন “অ্যা কাপল মেইড ফর ইচ আদার”! ‘আমার খুকু’ ছাড়া ভাবীর রেফারেন্স কখনো দিতেন না। আমরা আড়ালে হাসতাম কিন্ত ভালোও লাগতো অনেক।

তাঁর প্রয়াত পিতা, ম্যালেরিয়া বিভাগের ডাইরেক্টর ছিলেন, তাঁদের মহাখালীর সরকারি বাসায় বসে আমি, সাঈদ ভাই, নিতু আপা কত কথা বলেছি। যত সমস্যার কথাই আলাপ করি না কেন, সাঈদ ভাইয়ের সাথে আলাপ শেষে কখনোই হতাশ হতাম না। সব কিছুতে ভারী একটা পজিটিভ এটিচিউড তাঁর ছিল। বলতেন, মরার আগে মরিস না’রে, যুদ্ধ চালায়া যাইতে হবে।’’ নিজের যুদ্ধটা বেশিদিন চালাতে পারলেন না নিজেই, বা কে জানে চাইলেনই না হয়তো।

ভালো সাহিত্যের রস আস্বাদন করবার পাশাপাশি ভালো মুভি, মিউজিকের প্রতিও ঝোঁক ছিল তাঁর। এই সেদিনও কয়েকটা মুভির নাম দিলেন— বেশ ক’টা পুরোনো মুভিও ছিল সেই লিস্টে। ভালো কফির সুঘ্রাণ তাঁকে মাতাতো। আমি আফ্রিকা চলে যাওয়ার আগে সাঈদ ভাইয়ের মহাখালীর অফিসে গেলাম, আমাকে খেতে দিলেন খুকু ভাবীর নিজের হাতে তৈরি করা ভেজিটেবল ক্লাব সান্ডউইচ আর গ্রিন টি। সেই সাহেবী খানা খেতে খেতে আমরা ফিরে গিয়েছিলাম আমাদের কৈশোরে পাট শাক ভাজা আর শুকনা মরিচ দিয়ে লাল বিরুইয়ের ভাতের থালায়। আমাদের এক্সটেন্ডেড ফ্যামিলিতে কাঁসার কানাউঁচু থালাতে ক্ষীর আর মুড়ি মিশিয়ে খাওয়ার চলনকে আমরা দুজনেই মনে করে হাসলাম।

নিজেদের মধ্যে টাঙ্গাইল আর ময়মনসিংহের মিশেল ভাষায় কথা বলতাম আমরা। তাঁদের বাড়ি টাঙ্গাইল আর আমার নানার বাড়ি টাঙ্গাইল। টাঙ্গাইলের কিছু অপ্রচলিত শব্দ (বর্তমানে) ‘ব্যাভার’ করতাম আমরা। ফোন তুলেই তিনি বলতেন, ‘‘ওই বুরবক!’’ বা ‘‘দুরমুশা’’—এসব শব্দের মানে হলো বোকা, বা নালায়েক। অনেক হাসতাম আমরা নিজেরা নিজেরাই।

সাঈদ ভাই আর আমি পাশাপাশি রোডে থাকি দেড় যুগের বেশি। অথচ আমাদের দেখা হতো কোনো প্রোগ্রামে অথবা গুলশান পার্কে হাঁটতে গিয়ে। তাতে কি আমাদের ভাই বোনের টান কমে গিয়েছিল! মোটেও না। আফ্রিকায় থাকতে নিয়মিত খবর নিতেন আমার। আমার ফেইসবুক ফলো করতেন। আমার ভালো মন্দে আলোড়িত হতেন। কোভিডের সময় নিয়মিত ফোন করতেন, ‘‘কিরে দুরমুশা, ঠিকঠাক আছস তো? অবশ্য কিছু হইলে তো জানতে পারমু, তুই তো আবার সেলিব্রেটি!’’ আমি তখন ব্র্যাকের রোহিঙ্গা প্রোগ্রামের আঞ্চলিক পরিচালক।

নিজেদের মধ্যে টাঙ্গাইল আর ময়মনসিংহের মিশেল ভাষায় কথা বলতাম আমরা। তাঁদের বাড়ি টাঙ্গাইল আর আমার নানার বাড়ি টাঙ্গাইল। টাঙ্গাইলের কিছু অপ্রচলিত শব্দ (বর্তমানে) ‘ব্যাভার’ করতাম আমরা। ফোন তুলেই তিনি বলতেন, ‘‘ওই বুরবক!’’ বা ‘‘দুরমুশা’’—এসব শব্দের মানে হলো বোকা, বা নালায়েক। অনেক হাসতাম আমরা নিজেরা নিজেরাই।

আমার শ্যামল বরণের পুত্রটিকে তিনি ‘কালোজাম’ বলে ডাকতেন। আমার কন্যাটিকে আশীর্বাদ করেছিলেন, ‘‘মায়ের মতন সাহসী হও’’। আবার আমাকে বলতেন, ‘‘তোর এই মাপছাড়া সাহসই তোর কাল হইবো রে!’’ আহা—সেই সব তর্কযুদ্ধ।

স্ত্রী ‘খুকু’র সঙ্গে আবু সাঈদ খান।

২০১৯ সালে খুকু ভাবীর প্রয়াণের পর থেকেই সাইদ ভাই যেন জীবনের বাঁধন খুলে ফেলবার জন্য অস্থির হয়েছিলেন। লাংস ক্যান্সার ধরা পরলো লাস্ট ষ্টেজে। তাঁর শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী তাঁর খুকুর পাশেই সমাহিত হলেন তিনি।

সাঈদ ভাই, তোমার জন্য কাঁদবো না, ভালো থাকো তুমি ‘তোমার খুকু’র সাথে। তোমাকে ছাড়া কেবল অনেক খালি খালি লাগবে।

লেখক: উন্নয়নকর্মী।
ইমেইল: leena.huq@gmail.com

ad

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত