Beta
সোমবার, ৬ মে, ২০২৪
Beta
সোমবার, ৬ মে, ২০২৪

কলাম

খনার বচন কি তাপদাহ থেকে আমাদের মুক্তি দেবে

অরণ্য লুট করে, নদী খুন করে, গাছপালা পুড়িয়ে, মাটির তলার তেল-কয়লা তুলে আমাদের একটিমাত্র গ্রহকে আমরা ছিন্নভিন্ন করে ফেলছি। প্রচণ্ড দাবদাহে শরীর-মন জুড়ানোর মতো জলাধার এই শহরে কোথায়? ছবি : হারুন-অর-রশীদ।

২০২৩ সালের মধ্য এপ্রিলের কথা মনে আছে? টানা ১৩ দিন চুয়াডাঙ্গায় দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল। চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসন জরুরি প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে মানুষকে বের না হওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। চুয়াডাঙ্গায় ঐ বছর তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৪২.২ ডিগ্রি। ২০২৩ সালের এপ্রিলকে বলা হয়েছিল দেশের উষ্ণতম মাস। সে বছর তাপমাত্রা ছিল ২ ডিগ্রির বেশি এবং ৬৬ ভাগ বৃষ্টি কম হয়েছিল। তবে এর আগে ২০১৪ সালে দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল ৪৩.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ২০১৫ সালের এপ্রিল মাসকে সেইসময় বলা হয়েছিল চল্লিশ বছরের ভেতর সবচেয়ে বেশি তপ্ত ও দীর্ঘ দাবদাহের। ২০১৬ সনের ৬ এপ্রিল থেকে শুরু হওয়া প্রায় মাসব্যাপি দীর্ঘ তাপপ্রবাহ দেশের সকল প্রান্তের জনজীবন, প্রতিবেশ ও বাস্তুসংস্থানে বিশৃংখলা তৈরি হয়েছিল তখন। ‘হিটস্ট্রোকে’ প্রায় ৯ জন পূর্ণবয়স্ক মানুষের মৃত্যু হয়েছিল এবং তীব্র গরমে সবচে বেশি মৃত্যু তখন ঘটেছিল চুয়াডাঙ্গাতেই।

দেশ স্বাধীনের পর এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ তাপমাত্রার রেকর্ড ১৯৭২ সালে। ঐ বছরের ১৮ মে রাজশাহীর তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৪৫.১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। একই বছরের ১৯ এপ্রিল দৈনিক বাংলা পত্রিকায় প্রকাশিত একটি খবরের শিরোনাম থেকে জানা যায়, রাজশাহীতে ১১৩ ডিগ্রি ফারেনহাইট (৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস) তাপমাত্রা ছিল।

প্রচণ্ড দাবদাহে শরীর-মন জুড়াতে ঢাকার হাতিরঝিল-রামপুরা স্লুইস গেইটের দূষিত পানিতে নেমে পড়েছে এই বালক। ছবি : হারুন-অর-রশীদ।

১৯৮১ থেকে ২০২৩ এই ৪৩ বছরের এপ্রিল মাসের তাপমাত্রা নিয়ে করা একটি গবেষণার উল্লেখ করে দ্য ডেইলি স্টার (২৩/৪/২৪) জানায়, এপ্রিল মাসে ধারাবাহিকভাবে তাপপ্রবাহের দিনসংখ্যা বাড়ছে। ১৯৮১ থেকে ১৯৮৮ পর্যন্ত তাপপ্রবাহ ছিল দুই দিন। ১৯৯৪ সালে ১৬ দিন, ১৯৯৫ সালে ২৩ দিন, ২০০১ সালে ১৭ দিন, ২০০৮ সালে ১৬ দিন, ২০০৯ সালে ১৭দিন, ২০১৪ সালে ২৩ দিন এবং ২০২৩ সালে তাপপ্রবাহ ছিল ১৭দিন। এই গবেষণাটি একইসাথে এটিও জানায়, তাপপ্রবাহ দুম করে বাড়ছে না, তাপপ্রবাহ বেশি দিন স্থায়ী হচ্ছে কিংবা তাপমাত্রার পারদ উঠছে, কিন্তু এই তাপদাহের সাথে ধারাবাহিকভাবে এই অঞ্চলের জনমানুষের এক ধরণের অভিজ্ঞতাও তৈরি হচ্ছে।

তাপপ্রবাহের ধারাবাহিকতার নথি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, উষ্ণতা আর তীব্র তাপদাহের রেকর্ড গত পঞ্চাশ বছরের ইতিহাসে ‘নতুন’ কোনো ঘটনা নয়। বৈশাখ ও জৈষ্ঠ্য মিলে গ্রীষ্মকাল, আর এটি বাংলার উষ্ণতম তাপদাহের ঋতুকাল। গ্রীষ্মকাল উত্তপ্ত হবে, ‘কাঠ-ফাটা’, ‘ছাতি-ফাটা’ হবে এটাই স্বাভাবিক। ‘আল্লা মেঘ দে, পানি দে’ বলে শিশুরা মাগন করবে, বৃষ্টির জন্য নামাজ হবে, ব্যাঙের বিয়ে, হাবামুয়া বা হুদুমাদের কৃত্য আয়োজিত হবে। উচ্চ বরেন্দ্র অঞ্চলে শরীর পুড়িয়ে দেওয়া গরম হলকা বাতাস ‘পইচ্ছা ঝাটি’ ছুটবে কিংবা একটুখানি পানির খোঁজে ঝিরির ধারে নামবে পাখির দল।

তাপপ্রবাহের ধারাবাহিকতার নথি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, উষ্ণতা আর তীব্র তাপদাহের রেকর্ড গত পঞ্চাশ বছরের ইতিহাসে ‘নতুন’ কোনো ঘটনা নয়। বৈশাখ ও জৈষ্ঠ্য মিলে গ্রীষ্মকাল, আর এটি বাংলার উষ্ণতম তাপদাহের ঋতুকাল। গ্রীষ্মকাল উত্তপ্ত হবে, ‘কাঠ-ফাটা’, ‘ছাতি-ফাটা’ হবে এটাই স্বাভাবিক। ‘আল্লা মেঘ দে, পানি দে’ বলে শিশুরা মাগন করবে, বৃষ্টির জন্য নামাজ হবে, ব্যাঙের বিয়ে, হাবামুয়া বা হুদুমাদের কৃত্য আয়োজিত হবে।

কিন্তু নিদারুণভাবে এই উত্তপ্ত গ্রীষ্মকালকে আমাদের কাছে ‘অসহনীয়’ আর ‘বিপদজনক’ মনে হচ্ছে। আমরা কোনোভাবেই গ্রীষ্মকালের এই তীব্র তাপদাহ সইতে পারছি না, কিংবা নানাভাবে ছড়িয়ে যাওয়া গণমাধ্যমে সমকালের গ্রীষ্মকাল আমাদের কাছে ‘নিদারুণ অসহনীয়’ হয়ে উঠছে। এক তীব্র গ্রীষ্মকাল সামাল দেওয়া ভূগোলের মানুষ আমরা, কিন্তু সেটি কী ক্রমেই আমরা বিস্মৃত হয়ে যাচ্ছি। আমাদের সংস্কৃতিতে তাপদাহ ও গ্রীষ্মকাল সামাল দেওয়ার বহু চিহ্নরেখা এখনো স্পষ্ট। তাহলে কী ঘটেছে বা ঘটে চলেছে চারধারে, যে, তাপপ্রবাহ আর উষ্ণতাকে আমাদের অসহনীয় মনে হচ্ছে? কিংবা আমরা কি তাপদাহ সামালের শারিরীক, মানসিক ও সাংস্কৃতিক শক্তি হারিয়ে ফেলছি?

তাপদাহ সামাল দেওয়ার বহু লোকায়ত অনুশীলন ও জীবনবীক্ষা প্রচলিত ছিল আমাদের নানা এলাকায়, নানা জীবনসংস্কৃতিতে। খনার বচন, পই, প্রবাদ, ডাক, ডিঠান, রূপকথা, পালাগান, আখ্যানে প্রকৃতির নানাবিধ পরিবর্তনশীলতা এবং দুর্যোগ সামাল দেওয়ার বহু উদাহরণ আছে। কিন্তু আমরা আমাদের বসতিস্থাপন, স্থাপত্য, গ্রাম কী নগর পরিকল্পনা, কৃষিকাজ কোনোকিছুতেই সেইসব লোকায়ত জ্ঞানভাষ্যকে গুরুত্ব দেয়নি। তাই আমাদের ভোগান্তি বাড়ছে, আবহাওয়ার অদলবদলে আমরা নিজেদের শক্তি সামর্থ্যকে বাতিল করে কেবল কিছুটা সময়ের জন্য বাঁচতে কর্পোরেট কোম্পানির কোনো না কোনো বাণিজ্যের কাছে আত্মসমর্পণ করছি।

জীবাশ্মজ্বালানি নির্ভর সভ্যতার ক্ষমতার মাস্তানি না থামালে পৃথিবী আরো বেশি উত্তপ্ত হবে আর অতি চরম তীব্র তাপপ্রবাহ শুরু হতে পারে তা আমরা সবাই জানি। জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কি কার্বণ নিঃসরণ কিছুই আমরা থামাতে পারছি না, তাহলে জলবায়ুগত পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নিজেদের প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক শক্তি নিয়ে কীভাবে আমরা বেঁচেবর্তে থাকতে পারি সেই তৎপরতাও আমাদের নাই।

খনার আরেক জগতবিখ্যাত বচন স্মরণ করা যাক, ‘দক্ষিণ দুয়ারী ঘরের রাজা/পূর্ব দুয়ারী তাহার প্রজা/পশ্চিম দুয়ারীর মুখে ছাই/উত্তর দুয়ারীর খাজনা নাই’। ঢাকা শহরের কোনো দালান কি খনার বচনের ভাষ্য মেনে করা হয়েছে? ঢাকা শহরের নগর পরিকল্পনায় কী আমাদের লোকায়ত জ্ঞানভাষ্য কোনো জায়গা পেয়েছে? তাহলে এই শহর কেন গরমে আরো বেশি উষ্ণ এবং অসহনীয় হবে না? কেন বর্ষাকালে সবকিছু আটকে গিয়ে জলাবদ্ধ হবে না? এখনি আমাদের সতর্ক এবং সংবেদনশীল হওয়া জরুরি।

মহামতি বিজ্ঞানী খনার একটি বচন আছে, ‘পূবে হাঁস, পশ্চিমে বাঁশ’। বসতি স্থাপনের ক্ষেত্রে খনার এই বচন মানলে গৃহ শীতল ও স্বাস্থ্যকর থাকে। কারণ ঘরের পূবদিকে জলাশয়  থাকলে ঘরে ঠাণ্ডা বাতাস আসতে পারে এবং পশ্চিমে বাঁশ ঝাড় বা গাছের উঁচু ঝোপ থাকলে বসতি ছায়াময় থাকে। কিংবা খনার আরেক জগতবিখ্যাত বচন স্মরণ করা যাক, ‘দক্ষিণ দুয়ারী ঘরের রাজা/পূর্ব দুয়ারী তাহার প্রজা/পশ্চিম দুয়ারীর মুখে ছাই/উত্তর দুয়ারীর খাজনা নাই’। ঢাকা শহরের কোনো দালান কি খনার বচনের ভাষ্য মেনে করা হয়েছে? ঢাকা শহরের নগর পরিকল্পনায় কী আমাদের লোকায়ত জ্ঞানভাষ্য কোনো জায়গা পেয়েছে? তাহলে এই শহর কেন গরমে আরো বেশি উষ্ণ এবং অসহনীয় হবে না? কেন বর্ষাকালে সবকিছু আটকে গিয়ে জলাবদ্ধ হবে না? এখনি আমাদের সতর্ক এবং সংবেদনশীল হওয়া জরুরি।

এই চলমান তীব্র তাপদাহ হয়তো আমাদের সামনে কেবল একটুকরো নমুনা, সামনে আবহাওয়ার বহু উল্টাপাল্টা নজির আসবে। কারণ এই বিপদজনক পরিস্থিতি আমরাই, এই স্যাপিয়েন্স মানুষেরাই তৈরি করে চলেছি। তাপদাহসহ আবহাওয়াগত নিদারুণ সংকটগুলো সামাল দিতে চলতি আলাপ খনার বচনসহ দেশের নানাপ্রান্তের লোকায়ত অনুশীলন ও জ্ঞানভাষ্যগুলোর প্রতি তাকানোর আহবান জানায় সবাইকে। আমাদের প্রাণ-প্রকৃতি এবং আপন সংস্কৃতির ধারা থেকেই আমাদের তাপদাহ সামালের শক্তি সামর্থ্য অর্জন করা জরুরি। 

রাজধানীর জুরাইনের একটি স্টিল রি-রোলিং মিলের এক শ্রমিক প্রচণ্ড গরমে তৃষ্ণা মেটাচ্ছেন। ছবি : হারুন-অর-রশীদ।

বিস্মৃত ‘গ্রীষ্মকাল’, উত্তপ্ত এপ্রিল
জাতিসংঘ ঘোষণা দিয়েছে, ২০২৪ হতে যাচ্ছে এ যাবতকালের উষ্ণতম বছর। জলবায়ু বিপর্যয়ের কারণে বৈশ্বিক উষ্ণতাও বাড়ছে। বাংলাদেশে দেখা যাচ্ছে এপ্রিল হয়ে উঠছে তীব্র তাপদাহের মাস। রাজশাহী থেকেও উষ্ণতর হয়ে উঠছে চুয়াডাঙ্গা ও যশোর। ২০২৪ সালের এপ্রিলের অভিজ্ঞতায়ও দেখা যাচ্ছে চুয়াডাঙ্গায় প্রায় ১৪ দিন ধরে চলতি বছরের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা বিরাজ করেছে। ২০ এপ্রিল যশোরে এখন পর্যন্ত বছরের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪২.৬ ডিগ্রি রেকর্ড হয়েছে। তীব্র তাপদাহের ফলে হিট স্ট্রোক, জ্বর, কাশিসহ নানা স্বাস্থ্যগত সমস্যা দেখা দিয়েছে।

গরমের কারণে অনেকেই মারা গেছেন। গবাদিপ্রাণিসম্পদ, রাস্তার কুকুর-বিড়াল ও বন্যপ্রাণীর খাবার পানির সংকট হয়েছে। চিড়িয়াখানায় বন্দি প্রাণিদের অবস্থা দুর্বিষহ। গরমের কারণে এক সপ্তাহের স্কুল ছুটি হয়েছে। ১৯-২৫ এপ্রিল পর্যন্ত হিট এলার্ট জারি করেছে সরকার। গ্রাম কী শহর জুড়ে পানির আকাল দেখা দিয়েছে। তীব্র তাপদাহের কারণে বহু শ্রমজীবী, দিনমজুর, নিম্নআয়ের মানুষ কাজে যেতে পারছে না। বহু মানুষ ঘরের ভেতর থাকার চেষ্টা করছে দিনের পুরো সময়টাই। এমন অবস্থায় শহরে বিদ্যুৎ থাকলেও গ্রামে নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ থাকছে না।

রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্বাধীনতা স্তম্ভের পাশের অগভীর জলাধারে নেমে এসেছে চিলের দল। এই নগরে তাপদাহে পানির তৃষ্ণা মেটাতে পাখিদেরও বেগ পেতে হয় জলাধার খুঁজে পেতে। ছবি : হারুন-অর-রশীদ।

কিন্তু এই তাপদাহের ভেতরেই হাওরাঞ্চলে শুরু হয়েছে বোরো মওসুমের ধান কাটা। তাপদাহের ভেতরেই জমিনে কাজ করছে কৃষক, চাবাগানে চাশ্রমিক। তুলনামূলকভাবে ২০১৫ সালের পর থেকে তাপদাহে করণীয় ও প্রস্তুতি নিয়ে নানা মাধ্যমে সচেতনামূলক বার্তা প্রচারিত হচ্ছে এবং লেখালেখিও হচ্ছে। এইসব বার্তা ও প্রচারণা বহুজনকে হয়তো সাবধান করে তুলছে, তবে আবার একইসাথে তাপদাহ সামাল দেওয়ার ঐতিহাসিকতাকে থেকে মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে রাখছে। এমনকি এই তীব্র তাপপ্রবাহকে পুঁজি করে চাঙ্গা হচ্ছে নানাবিধ কর্পোরেট বাণিজ্য। এসি, ফ্রিজ, ফ্যান, ঠাণ্ডা পানীয় ও নানাধরণের উপকরণের বিক্রি ও ব্যবহার বাড়ছে। মনস্তাত্ত্বিকভাবে নাগরিক মনে গরম সামাল দেওয়ার জন্য কর্পোরেট বাণিজ্যের বৈধতা তৈরি হচ্ছে, বরং আড়াল হয়ে যাচ্ছে উষ্ণতা সামাল দেওয়ার ঐতিহাসিক লোকায়ত অনুশীলন এবং পরিবেশপ্রশ্ন।

কোনো এলাকায় গড় তাপমাত্রার চেয়ে অন্তত টানা ৫ দিন তাপমাত্রা ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি হলে এই পরিস্থিতিকে দাবদাহ বলে। বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর ৩৬ থেকে ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রাকে ‘মৃদু দাবদাহ’, ৩৮ থেকে ৪০ ডিগ্রিকে ‘মাঝারি দাবদাহ’ এবং তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রির ওপরে গেলে ‘তীব্র দাবদাহ’ হিসেবে উল্লেখ করেছে। চলতি গ্রীষ্মকালে চুয়াডাঙ্গা, যশোর ও পাবনার উপর দিয়ে অতি তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। রাজশাহী জেলা, খুলনা বিভাগের অবশিষ্টাংশ এবং ঢাকা বিভাগের ওপর দিয়ে তীব্র তাপপ্রবাহ; ময়মনসিংহ, মৌলভীবাজার, ফেণী, কক্সবাজার, চাঁদপুর, রাঙামাটি, বরিশাল বিভাগ এবং রাজশাহী বিভাগের ওপর দিয়ে মৃদু থেকে মাঝারি ধরনের তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে।

দেশজুড়ে তাপপ্রবাহ বইলেও, ঢাকা সব এলাকার চেয়ে অসহনীয়। এটি কি কেবলমাত্র উষ্ণতার পারদের সাথে সম্পর্কিত? নিশ্চয়ই নয়। কারণ ঢাকায় তাপমাত্রার চেয়েও অনুভূত হয় বেশি, বিরক্তি ও ভোগান্তি বেশি। এর কারণ আমাদের কর্পোরেট ভোগবাদী লুটতরাজ উন্নয়ন এবং প্রাণ-প্রকৃতির বিনাশ। এ বছর ঢাকায় তাপমাত্রা ৪০ পেরুয়নি এখনো। কিন্তু পুরো শহর জবজব, নিস্তেজ, প্রাণহীন, দমবন্ধ আর অস্বস্তিকর। ১৯৬০ সালের ৩০ এপ্রিল ঢাকায় তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৪২.৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ২০১৪ সালের ১৪ ও ২৩ এপ্রিল ছিল ৪০.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গেল বছরের ১৪ এপ্রিলেও ঢাকায় তাপমাত্রা রেকর্ড হয় ৪০.২ ডিগ্রি। ঢাকার নানাপ্রান্তের বহুজনের সাথে আলাপ করে দেখেছি পূর্বে তাপমাত্রা বেশি রেকর্ড হলেও বর্তমানে ঢাকায় গ্রীষ্মকাল অসহনীয় হয়ে উঠছে। কেবল তাপমাত্রার পারদের রেকর্ড নয়, এই তাপমাত্রা সামাল দিতে হলে ঢাকাসহ শহর এলাকায় তাপদাহের ভোগান্তির কারণ খুঁজতে আমাদের তাকাতে হবে চারপাশে। আমাদের জল, মাটি, হাওয়া আর উত্তুঙ্গ উন্নয়নের দিকে। 

ঢাকা কেন এতো উত্তপ্ত
গরমে একটুখানি ছায়ার খোঁজ করেনি এমন কেউ কী আছেন? আর জীবনভর খুনখারাবি সয়ে গাছেরা আমাদের এই ছায়া দেয়। একটা এসির দাম কতো কিংবা একটা ফ্যানের? আর দশ মিনিট গাছের মায়ময় শীতল ছায়ায় জিরিয়ে নেওয়ার দাম কত হতে পারে? যাহোক আমাদের নিশ্চয়ই মনে আছে ঢাকা শহরের ছায়াদানকারী গাছেদের নির্মমভাবে কেটে ফেলা হয়েছিল ধানমন্ডিতে সৌন্দর্যবধনের নামে। তখন ‘সাত মসজিদ সড়ক গাছ রক্ষা আন্দোলনের’ ব্যানারে গাছ রক্ষায় আন্দোলনে নামেন নাগরিক সমাজ। এমনি সৌন্দর্যবর্ধন ঘটেছে আর এখন এই তীব্র তাপদাহে ধানমন্ডির ২৭ নম্বর সড়কে একটুখানি দম ফেলার ছায়া পাচ্ছে না শিশু, প্রবীণ, শ্রমিক কোনো পথচারী।

প্রচণ্ড তাপদাহে গাছের ছায়ায় সবুজ ঘাসে একটু জিরিয়ে নেওয়ার সুযোগ এই নগরে নেই বললেই চলে। যৎসামান্য যেটুকু সবুজ আছে সেখানে পাশাপাশি জিরিয়ে নিচ্ছে শ্রমজীবী মানুষ আর পথের কুকুর। ছবি : হারুন-অর-রশীদ।

আন্দোলনকারীরা তখন গাছ বাঁচাতে এই চলমান তীব্র তাপদাহের কথাই বলেছিলেন সিটি কর্পোরেশনকে। কিন্তু কেউ কথা রাখেনি। তার মানে এই নয় যে, তাপদাহ কেউ বন্ধ করতে পেরেছে। বরং গাছ না থাকার ফলে ভোগান্তি ও যন্ত্রণা আরো বাড়ছে। ধানমন্ডি সড়কের গাছ রক্ষা আন্দোলনের একটা হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ আছে। এখানে সক্রিয়ভাবে যুক্ত আছেন প্রায় ৮৮ জন পরিবেশকর্মী, সংস্কৃতিকর্মী, শিক্ষার্থী, শিক্ষক, সাংবাদিক, গবেষক, সংগঠক, আইনজীবীসহ নানা শ্রেণিপেশার নাগরিক।

সর্বাধিক ২২টি ভোট পড়ে খাল, পুকুর, নদী, জলাশয় কম এবং দখল ও দূষণের কারণে। ২১টি ভোট পড়ে গাছ ও সবুজ বলয় অনেক কম। ১৯টি ভোট পড়ে বিল্ডিং নির্মাণে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ও উপকরণ কম ব্যবহৃত হয়, বরং কাচ ও স্টিল যা তাপ বাড়ায় সেসব বেশি ব্যবহৃত হয় এই কারণের ক্ষেত্রে। ১৬টি ভোট পড়ে শহরে বেশি এসি, ফ্রিজ ও গাড়ি চলে। ১৩টি ভোট পড়ে শহরের বাতাস নানাভাবে দূষিত ও বাতাসে বিপদজনক ভারী কণা আছে এই কারণের ক্ষেত্রে। ১১টি ভোট পড়ে ঘরের ডিজাইন ঠিক নাই তাই ঘরের ভেতর গরম বেশি লাগে।

২২ এপ্রিল ২০২৪ তারিখে এই গ্রুপে মোট আটটি সম্ভাব্য কারণ উল্লেখ করে ‘শহরে এত গরম লাগার কারণ কি মনে হয় আপনার’ এই প্রশ্নটি রাখা হয়। সর্বাধিক ২২টি ভোট পড়ে খাল, পুকুর, নদী, জলাশয় কম এবং দখল ও দূষণের কারণে। ২১টি ভোট পড়ে গাছ ও সবুজ বলয় অনেক কম। ১৯টি ভোট পড়ে বিল্ডিং নির্মাণে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ও উপকরণ কম ব্যবহৃত হয়, বরং কাচ ও স্টিল যা তাপ বাড়ায় সেসব বেশি ব্যবহৃত হয় এই কারণের ক্ষেত্রে। ১৬টি ভোট পড়ে শহরে বেশি এসি, ফ্রিজ ও গাড়ি চলে। ১৩টি ভোট পড়ে শহরের বাতাস নানাভাবে দূষিত ও বাতাসে বিপদজনক ভারী কণা আছে এই কারণের ক্ষেত্রে। ১১টি ভোট পড়ে ঘরের ডিজাইন ঠিক নাই তাই ঘরের ভেতর গরম বেশি লাগে। ৭টি ভোট পড়ে গরমের সময় দেশজ খাদ্য উপাদান সহজে পাওয়া যায় না বলে এবং সবচে কম ৩টি ভোট পড়েছে মানুষের গরম সহ্য করার ক্ষমতা ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাচ্ছে বলে।

সাম্প্রতিক সময়ে চলমান তীব্র তাপদাহ নিয়ে দ্রুততম সময়ে অতিসহজে জানা (জানি এতে নানাবিধ প্রশ্ন ও তর্ক থাকতে পারে) এই পথচলতি নাগরিক প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে আমরা আবারো জানতে পারলাম গাছ, সবুজ বলয়, উন্মুক্ত ক্ষেত্র এবং জলাভূমি না থাকায় ঢাকার মতো শহর তাপমাত্রার চেয়েও বেশি অসহনীয় এবং উত্তপ্ত। আমরা যদি ঢাকাসহ পুরো দেশকে ভবিষ্যতে এভাবেই দেখতে চাই, তবে তাপমাত্রার পারদ কমলেও নাগরিক ভোগান্তি কিন্তু কোনোভাবেই কমবে না, বরং আরো তীব্রতর হবে। 

তাপদাহ ছড়িয়ে পড়ছে সবখানে
শুধু বাংলাদেশ নয়, অসহনীয় এই তাপপ্রবাহে ঝলসে যাচ্ছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া। ভারত, পাকিস্তান, মিয়ানমার, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, লাওস কি ইন্দোনেশিয়ার তাপপ্রবাহের ভোগান্তিও আমরা দেখেছি। আর এটি ঘটছে কর্পোরেট নয়াউদারবাদী উন্নয়ন মারদাঙ্গার কারণেই। অরণ্য লুট করে, নদী খুন করে, গাছপালা পুড়িয়ে, মাটির তলার তেল-কয়লা তুলে একটিমাত্র গ্রহকে আমরা ছিন্নভিন্ন করে ফেলছি। বাড়ছে বন্যা, খরা, লবণাক্ততা, তাপদাহ কী বজ্রপাত। প্রাণ-প্রকৃতির লুটেরা, খুনী, মাস্তানরা হয়তো মাতৃদুনিয়াকে তপ্ত রেখে নিজেদের ঘর-যান সবই তারা শীতল রেখেছেন, ঢকঢক করে গিলেছেন ঠাণ্ডা পানীয়। কিন্তু দেশকে যারা রক্ত-ঘামে দিনরাত জাগিয়ে রাখছেন সেই নিম্নবর্গ কিভাবে এই তাপপ্রবাহ সামাল দিয়ে চলেছে তার দিকে রাষ্ট্র একবারও তাকায়নি। পূর্বাভাষ ও পূর্বপ্রস্তুতি যেকোনো ধরনের দূর্যোগ মোকাবেলা করতে সময় ও কৌশল জোগায়। ২০১৪ থেকে পর পর তাপদাহের একটা বিস্তৃতি প্রকট হলেও রাষ্ট্র এখনও এ বিষয়ে তাপদাহ সামালের কোনো সমন্বিত জাতীয় কর্মপরিকল্পনা করছে না। কিন্তু এটি জরুরি। তাপপ্রবাহ বিষয়ে পূর্বাভাষ এবং অঞ্চলভেদে জনগণের প্রস্তুতির ক্ষেত্রে স্ব স্ব জনগোষ্ঠীর লোকায়ত চর্চা ও সম্পদের সুরক্ষা দেওয়া রাষ্ট্রের মৌলিক দায়িত্ব। কারণ তা না হলে ভোগান্তি বাড়ে, তৈরি হয় প্রশ্নহীন সংকট। যা শেষতক জাতীয় প্রবৃদ্ধি কী রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন বিকাশের ধারাকে আটকে দেয়।

জলের ধারে গাছের ছায়ায় জিরোনোর মতো জায়গা এই নগরে কমই আছে। তীব্র তাপদাহ থেকে বাঁচতে শিশু সন্তানদের নিয়ে রাজধানীর হাতিরঝিলের পাড়ে আশ্রয় নিয়েছে শ্রমজীবী একটি পরিবার। ছবি : হারুন-অর-রশীদ।

বরেন্দ্রর লোকায়ত বিজ্ঞান
নাটোরের লালপুর দেশের উষ্ণতম স্থান হলেও দেশের বরেন্দ্র অঞ্চল ঐতিহাসিকভাবেই শুষ্ক ও উষ্ণ এলাকা। যদিও যশোর, চুয়াডাঙ্গায় ধারাবাহিকভাবে দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে, সাতক্ষীরায় বেশি দিন বেশি তাপমাত্রা স্থায়ী থাকার রেকর্ড আছে। বরেন্দ্র অঞ্চলে প্রবাদ বা বচনকে স্থানীয় মুন্ডা আদিবাসীরা ‘ফষ্ঠি’ বলেন। আমে ধান, তেঁতুলে বান কিংবা ব্যাঙ ডাকলে বর্ষা হবে আর শিয়াল বেশি ডাকলে খরা হবে বলে তারা মনে করেন। আগে বৈশাখ থেকে জৈষ্ঠ খুব গরম ছিল, আষাঢ়ে ছিল সহ্য করার মতো গরম, কিন্তু ভাদ্রে ছিল তালপাকা গরম। স্থানীয়দের মতে, আম-জাম-তাল পেকে গেলে গরম বাড়ে তখন পুরো বরেন্দ্র এলাকায় ‘নিন্দ লাগা থায়’ অবস্থা সৃষ্টি হয়। মানুষ দিনের বেলা দুপুরে মাঠে কাজ করতে পারে না, বাড়িতেই বসে থাকতে হয়। শরীরে একটা ঢুলুঢুলু অবশ ভাব চলে আসে। কিন্তু সেই গরমকাল এখন কমে গেছে। এছাড়াও ছিল পইচ্ছ্যা-ঝাটি। চৈত্র মাসে পইচ্ছ্যা-ঝাটি নামে গরম বাতাস বইতো বরেন্দ্রভূমিতে। লাহিরবেলা (সকাল) থেকে দুপুর পর্যন্ত এই গরম বাতাস বইতো। সাইনঝর (সন্ধ্যা) পর থেকে গরম কমে গিয়ে আবার পুরো এলাকা ঠাণ্ডা হয়ে আসতো। পইচ্ছ্যা-ঝাটি খুব ক্ষতি করতো ফসলের, গাছপালার। সব জ্বলে পুড়ে যেত। কিন্তু প্রায় তিরিশ বছর যাবত পইচ্ছ্যা-ঝাটি একেবারেই বিদায় নিয়েছে। প্রবীণদের ভাষ্য, পইচ্ছ্যা-ঝাটি বরেন্দ্রর একটি বৈশিষ্ট্য। এটি বরেন্দ্রর মানুষের শরীর গঠনে এবং শরীরে শক্তি তৈরিতে সহায়তা করতো। আগের দিনে বেশি পরিশ্রম এবং ভারী জিনিস বহন করা এখানকার চাইতে সহজ ছিল। কারণ পইচ্ছ্যা-ঝাটি শরীরকে টানটান পেশীবহুল মেদহীন মজবুত করতো। বরেন্দ্র অঞ্চলে তীব্র তাপদাহ থেকে সুরক্ষার জন্য মাটির ঘরের দেয়াল গুলো চৈত্র মাসেই লেপা হয়। লাল, সাদা, কালো, হলুদ রঙের মাটি এবং দেয়ালগাত্রের নকশা এবং লেপন পদ্ধতি এক্ষেত্রে গরম আবহাওয়ার সাথে মানিয়ে নেওয়ার কাজ করে। তাপপ্রবাহ থেকে সুরক্ষার জন্য এ সময়টাতে বরেন্দ্র অঞ্চলে খুব বেশি তেঁতুল পাতার টক, তিতা শাক ও ঝোল জাতীয় খাবার খাওয়া হয়। পায়রা, গম ও যবের ছাতু আখের গুড় দিয়ে মেখে খাওয়া হয়। বরেন্দ্র অঞ্চলের গ্রামে তেঁতুল ও নিম গাছের সারি তীব্র তাপপ্রবাহ থেকে সুরক্ষার জন্যই।

পাহাড়ের লোকায়ত জ্ঞান
তীব্র তাপদাহ প্রাণ ও প্রকৃতির বহুমুখী ক্ষত ও দাগ রেখে যায়। এর প্রভাব মানুষের কৃষিকাজ, উৎপাদন, স্বাস্থ্য, অর্থনীতি ও জীবনযাত্রা সবকিছুতেই পড়ে। বাংলাদেশের সর্বাধিক শীতলতম ও বৃষ্টিপ্রবণ অঞ্চল মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল। কিন্তু সেখানকার টিলাপাহাড়ে বসবাসরত আদিবাসী খাসিরা সেই বৃষ্টির ধরণ ও তাপপ্রবাহে উল্টাপাল্টা ধারাবাহিকতা টের পাচ্ছেন। বিশেষ করে কয়েক বছর ধরে চৈত্র থেকে আষাঢ় বৃষ্টিহীন হয়ে পড়ছে এবং একটা দীর্ঘ তাপপ্রবাহ থাকছে। প্রবীণ খাসিরা মনে করেন জংগলের তলায় সবুজ ব্যাঙ এবং তেতস্লাং নামক বুনো মাশরুমের অনুপস্থিতি প্রকৃতিতে আগাম তাপদাহের বার্তা জানায়। এ সময়টাতে তাপপ্রবাহ যত দীর্ঘ হয় ততই খাসিদের জীবনজীবিকা মুষড়ে পড়ে। কারণ পান-সুপারি, লেবু ও ফলফলাদির উপর নির্ভর খাসি জীবন তীব্র তাপপ্রবাহে লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। খাসি ভাষায় তীব্র তাপদাহের ফলে সৃষ্ট খরা অবস্থাকে বলে ‘তরহাং’। তরহাং অবস্থা খাসিদের প্রধান জীবিকা পানজুমকে একেবারে নিশ্চিহ্ন করে দেয়। এই অবস্থা খাসিদের পানজুমে উৎরাম নামে এক বিপদজনক রোগ উসকে দেয়। খাসিরা তাপদাহ থেকে সুরক্ষা পেতে বেশ কিছু নিয়ম মেনে চলেন। এ সময় ছড়ার পানি খুব কম ব্যবহার করা হয়। বনতলের সকল প্রাণের প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখা হয়। কেঁচোর মাটি এবং সেই মাটির রস দেখেও তারা ধারণা করেন সামনের দিনে এই তাপদাহ কতটা থাকতে পারে। সাধারণত ডুমুর ও বৃক্ষজাতীয় শাকের কচি ডগা এ সময়টাতে বেশি খাওয়া হয়।

বাংলাদেশের সর্বাধিক শীতলতম ও বৃষ্টিপ্রবণ অঞ্চল মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল। কিন্তু সেখানকার টিলাপাহাড়ে বসবাসরত আদিবাসী খাসিরা সেই বৃষ্টির ধরণ ও তাপপ্রবাহে উল্টাপাল্টা ধারাবাহিকতা টের পাচ্ছেন। বিশেষ করে কয়েক বছর ধরে চৈত্র থেকে আষাঢ় বৃষ্টিহীন হয়ে পড়ছে এবং একটা দীর্ঘ তাপপ্রবাহ থাকছে। প্রবীণ খাসিরা মনে করেন জংগলের তলায় সবুজ ব্যাঙ এবং তেতস্লাং নামক বুনো মাশরুমের অনুপস্থিতি প্রকৃতিতে আগাম তাপদাহের বার্তা জানায়। এ সময়টাতে তাপপ্রবাহ যত দীর্ঘ হয় ততই খাসিদের জীবনজীবিকা মুষড়ে পড়ে। কারণ পান-সুপারি, লেবু ও ফলফলাদির উপর নির্ভর খাসি জীবন তীব্র তাপপ্রবাহে লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়।

হাওরের লোকায়ত জ্ঞান
হাওরাঞ্চলে বিলে শামুকের চলন, জলচর পাখিদের ওড়াওড়ি এবং পতঙ্গের ধরণ দেখে তাপমাত্রার প্রকটতা বোঝা যায়। এমনকি বনতুলসী ও ঢোলকলমী গাছের পুষ্পবিন্যাসের ধরণও বৃষ্টিময়তা ও খরাকে জানান দেয়। হাওরাঞ্চলে তাপদাহ পাড়ি দেওয়ার জন্য এ সময়টাতে নানা রকমের আয়োজন থাকে। কারণ হাওরাঞ্চল এ সময়টাতে বোরো মওসুমের ধান কাটায় ব্যস্ত। অনেক বাড়িতে ধানশ্রমিক থাকে। এ সময়টাতে সকালবেলা বরুণ গাছের কচি ডগা বা বেত গাছের ডগার ‘ঝোরা (ভর্তা)’ করা হয়। খুদের জাউয়ের ভেতর পাট শাক বা কাটাখুদরি শাক দিয়ে রান্না করা হয়। হিদল শুঁটকি, মিষ্টিআলু, কাঁঠাল বিচি ও কচুর লতি দিয়ে পাতলা ঝোল রান্না করা হয়।

হাসপাতালের বিছানাতেও রেহাই নেই তীব্র গরম থেকে। ছবিটি রাজধানীর মুগদা জেনারেল হাসপাতাল থেকে মঙ্গলবার তোলা। ছবি : হারুন-অর-রশীদ।

কাগুজে স্বীকৃতি নয়, লোকায়ত চর্চার অনুশীলন জরুরি
তাপদাহ কি তীব্র শীত এই জনপদের আবহাওয়া ও ভূগোলের সম্পর্কের বিজ্ঞান। এই তাপদাহ সামাল দেওয়ার জন্য এই জনপদের নানা ভূগোল ও জনপদে রয়েছে ভিন্নরকম চর্চা ও আখ্যান। এ সময়টাতে তিতা জাতীয় শাক খাওয়ার চল অনেক বেশি। তেল-মশলা জাতীয় খাবারের চল এ সময়টাতে নিম্নবর্গের লোকায়ত জীবনে নেই। তীব্র তাপদাহ পেটের পীড়া, হজম, শ্বাসকষ্ট, খোঁস পাঁচড়াসহ নানা রোগ দেখা দেয়। বীজের অংকুরোদগম থেকে মুকুল সব বিপদাপন্ন হয়ে পড়ে। দেখা গেছে এ সময় আমের মুকুল ঝরে পড়েছে অনেক, যা আমের ঘাটতি তৈরি করবে ব্যাপক। মৌমাছির পরাগায়ণেও বাধা তৈরি করে তাপদাহ। সুন্দরবনের মৌয়ালরা এ সময়টাতে মধু মওসুমে তেমন মধুও এবার খুঁজে পাচ্ছেন না। এমনকি এ সময়টাতে অনেক মাছের প্রজনন ও পোনা মাছের বিচরণেও তাপদাহ সমস্যা তৈরি করে। লোকায়ত জীবনে তাপদাহের সাথে বেঁচে থাকবার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বেও রাষ্ট্র কী আবহাওয়া দপ্তর কখনোই নিম্নবর্গের এসব জ্ঞান ও চর্চাকে গুরুত্ব দেয়নি। কিন্তু এখানেই আছে তীব্র তাপদাহকে আগলে বেঁচে থাকবার বিজ্ঞান।

প্রশ্ন হলো খনার বচনসহ লোকায়ত জ্ঞানভাষ্য কি আমাদের তাপদাহ থেকে মুক্তি দিতে পারে? অবশ্যই পারে। কারণ লোকায়ত বিজ্ঞান গাছ কেটে রাস্তা বানানোর বিপক্ষে, বন কিংবা নদী পাহাড় খুন করে কারখানা বসানোর বিরুদ্ধে। খনার বচন চারধারের প্রাণ-প্রকৃতির রূপ-রস-গন্ধকে আন্দাজ করে, পাঠ করে, বিশ্লেষণ করে বৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্ত নেয়। লোকায়ত বীক্ষা আমাদের পৃথিবীকে কর্পোরেট হঠকারী জীবাশ্মজ্বালানি নির্ভরতা থেকে বাঁচাতে পারে। কারণ তা না হলে উষ্ণতার পারদ থামবে না।

মহামতি খনার এক বচনে আছে, ‘‘পাঁচ রবি মাসে পায় ঝরায় কিংবা খরায় যায়।’’ প্রশ্ন হলো খনার বচনসহ লোকায়ত জ্ঞানভাষ্য কি আমাদের তাপদাহ থেকে মুক্তি দিতে পারে? অবশ্যই পারে। কারণ লোকায়ত বিজ্ঞান গাছ কেটে রাস্তা বানানোর বিপক্ষে, বন কিংবা নদী পাহাড় খুন করে কারখানা বসানোর বিরুদ্ধে। খনার বচন চারধারের প্রাণ-প্রকৃতির রূপ-রস-গন্ধকে আন্দাজ করে, পাঠ করে, বিশ্লেষণ করে বৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্ত নেয়। লোকায়ত বীক্ষা আমাদের পৃথিবীকে কর্পোরেট হঠকারী জীবাশ্মজ্বালানি নির্ভরতা থেকে বাঁচাতে পারে। কারণ তা না হলে উষ্ণতার পারদ থামবে না। কেবল বছর বছর এসি, ফ্রিজ আর ঠাণ্ডা পানীয়য়ের বিজ্ঞাপন দিয়ে খুব বেশি দিন উত্তপ্ত হয়ে ওঠা পৃথিবীতে বাঁচা যাবে না।

খনার বচন কিংবা দেশজুড়ে আড়াল করে রাখা লোকায়ত বিজ্ঞান অনুশীলন আমাদের তীব্র তাপপ্রবাহ থেকে মুক্তি দিতে পারে এবং একইসাথে তাপপ্রবাহ সামাল দেওয়ার জন্য দেহ ও মনে প্রস্তুত করে তুলতে পারে।

লেখক: গবেষক ও লেখক।
ইমেইল: animistbangla@gmail.com

পাভেল পার্থ । প্রতিকৃতি অঙ্কন: সব্যসাচী মজুমদার
ad

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত