Beta
বৃহস্পতিবার, ৯ মে, ২০২৪
Beta
বৃহস্পতিবার, ৯ মে, ২০২৪

বিস্তার

সাঁতারনামা

এখন শহরের সুইমিং পুলেও শিশুদের সাঁতার শেখানোর সুযোগ আছে। আলোকচিত্র: লেখক।

জলের মাঝে মাছেদের ঘুরে বেড়ানো দেখে ছোটবেলায় খুব জানতে ইচ্ছে হতো, কীভাবে তারা এমন সুন্দর করে সাঁতার কাটে। আমাদের কোনও লেজ নেই, কান-ফুলকি নেই, অনেকক্ষণ জলের নিচে মাথা ডুবিয়ে থাকতেও পারব না। তাহলে কী করে ভেসে থাকব জলে! এরপরও মানুষ সাঁতার কাটে। হাত-পা ছুড়ে ছুড়ে জলের সাথে গা ভাসিয়ে দিয়ে নীরবে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যায়। ভারি সুন্দর লাগে দেখতে!

চেষ্টা করলে হয়ত আমিও পারব এমন মনে হতো শৈশব থেকেই। ছোটবেলায় গ্রামে দাদুকে দেখতে গেলে যেমন আনন্দ হতো, তেমন পুকুর দেখেও খুব উৎফুল্ল হতাম। পানিতে নামার জন্য মন খুব ছটফট করত। সাঁতার শেখা হয়ে ওঠেনি তখনও। কিন্তু বাঁধানো পুকুরে ঠিকই নেমে পড়তাম। উঠার নামগন্ধ থাকত না। জোর করে মেরে-ধরে পানি থেকে তুলে আনত। একদিন বাবা পুকুরঘাট থেকে দূরে নিয়ে ছেড়ে দিল—হাঁসফাঁস করতে করতে একসময় পাড়ে চলে আসলাম। এরপর গভীর পুকুর, বড় হাউস, ঝরনার ধারা, নদী, হাওর, সুইমিং পুল কোনওটাই বাদ রইল না। পানি পেলেই নেমে পড়েছি। এখনও নেমে পড়ি। পানি কেন জানি খুব টানে।

আমি যখন বাচ্চাদের সাঁতারের প্রশিক্ষণ দেই, তাদের মা-বাবাদের পানিতে নেমে বাচ্চাদের সঙ্গে থাকতে বলি। তাতে তাদের আস্থা অনেক গুণ বেড়ে যায় এবং মা-বাবার সাথে সন্তানের বন্ধুত্বটাও পাকাপোক্ত হয়। সেদিন ১০ বছরের এক শিশু কোনওভাবেই পানিতে হাত ছাড়তে রাজি হচ্ছিল না। তাকে অনেক সময় ধরে বুঝিয়ে পানিতে ভেসে থাকার ব্যাপারে যখনই রাজি করাতে পারলাম এবং সে নিজেই হাত-পা ছেড়ে দিয়ে পানিতে ভাসা শিখে গেল তখন তাকে আর কে আটকায়। সারাদিন পানিতেই থাকবে এমন অবস্থা। আমার সেই ছোটবেলার কথা মনে পড়ে যায়।

উত্তম ব্যায়াম সাঁতার

সাঁতার নিয়ে কথা বললে বলতে হয়, কেবল পানিতে সাবলীল থাকা আর ডুবে যাওয়া থেকে নিজেকে বাঁচানোর কাজেই জরুরি নয়, শারীরিক সুস্থতার জন্যও সাঁতার গুরুত্বপূর্ণ এক উত্তম ব্যায়াম। সাঁতারকে সংজ্ঞায়িত করা হলে বলা যেতে পারে, হাত ও পা সঞ্চালনের মাধ্যমে পানির উপরে ভেসে থাকার সক্ষমতাকে সাঁতার বলে। ‘ফুল বডি ওয়ার্কআউট’-এর মধ্যে অন্যতম হলো সাঁতার। যা করতে হয় যথানিয়মে এবং এতে দমের ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় অনেকগুণ বেশি। সাঁতার এমনই এক ব্যায়াম যা চমৎকারভাবে কাজ করে মানসিক চাপ কমাতে, শক্তি বৃদ্ধি করতে, হৃদপিণ্ডকে ভালো রাখাসহ আরও নানাবিধ শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য সুফলের কাজে। আর্থ্রাইটিস, মাল্টিপল স্কেলরোসিস, অস্টিওপোরোসিস বা জয়েন্টের সমস্যা যাদের রয়েছে, তাদের জন্য সাঁতার বেশ উপকারি।

২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথ আয়োজিত এক গবেষণার অংশ হিসেবে অংশগ্রহণকারীরা তিন মাস ধরে সপ্তাহে তিনবার করে প্রতিবার ৪৫ মিনিট সাঁতার কাটেন। তাতে দেখা যায়, তাদের শারীরিক সীমাবদ্ধতা দূর হয়েছে এবং পেশিশক্তির উন্নতি ঘটেছে। এমনকি জয়েন্টের ব্যথা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গিয়েছে বলেও অনুভব করেন তারা।

গর্ভবতী অবস্থায়ও সাঁতার কাটা নিরাপদ বলে গণ্য করা হয়। কেননা এতে আঘাত পাওয়ার ঝুঁকি কম থাকে। তাছাড়া এ সময়ে করা যেতে পারে অ্যাকোয়া ব্যায়াম। বিষন্নতা এবং মানসিক চাপের ওপর সাঁতারের প্রভাব নিয়ে ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব ফিজিকাল এডুকেশন, স্পোর্টস অ্যান্ড হেলথ আয়োজিত এক গবেষণাতে দেখা যায়, সাঁতার কাটার আগে যারা মানসিক চাপ ও মৃদু বিষন্নতা অনুভব করেছিলেন তা সাঁতার কাটার পরে বেশিরভাগই শূন্যের কোঠায় চলে আসে।

সাঁতারের ইতিহাস কত আগের

মানুষ কী করে পানিতে সাঁতারের ব্যপারে প্রথম ধারণা পেল তা নিয়ে একটু আলোচনা করা যাক। প্রায় সাত হাজার বছর আগে প্রস্তর যুগে দেয়ালে আঁকা পাওয়া গেছে সাঁতারের দৃশ্য। গিলগামেশ, ইলিয়াড, ওডিসি, বাইবেল এবং অন্যান্য প্রাচীন গদ্যকাহিনীতেও সাঁতারের কথা উল্লেখ রয়েছে।

১৭৭৮ সালে জার্মান ভাষার অধ্যাপক নিকোলাস ওয়াইনম্যান ‘দ্যা সুইমার অর অ্যা ডায়লগ অন দি আর্ট অব সুইমিং’ নামে সাঁতার বিষয়ক প্রথম গ্রন্থ লেখেন। ১৮০০ সালের দিকে ইউরোপে প্রতিযোগিতামূলক সাঁতার বিশেষ করে ব্রেস্ট স্ট্রোক ইভেন্ট চালু হয়। আধুনিক অলিম্পিকে সাঁতার বিষয়ক প্রথম অন্তর্ভুক্তি ঘটে ১৮৯৬ সালের গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকে। ১৯০২ সালে রিচমন্ড ক্যাভিল পশ্চিমা বিশ্বে ফ্রন্ট ক্রল ধারার সূচনা ঘটান। ১৯০৮ সালে বিশ্ব সাঁতার সংস্থা বা ‘ফিনা’ গঠিত হয়। ১৯৩০-এর দশকে বাটারফ্লাইয়ের আধুনিকায়ন ঘটে। ১৯৫২ সালে স্বতন্ত্র পদ্ধতি হিসেবে প্রচলনের আগ পর্যন্ত ব্রেস্টস্ট্রোকের মতো বাটারফ্লাই সাঁতারও চালু ছিল।

১৭৭৮ সালে জার্মান ভাষার অধ্যাপক নিকোলাস ওয়াইনম্যান ‘দ্যা সুইমার অর অ্যা ডায়লগ অন দি আর্ট অব সুইমিং’ নামে সাঁতার বিষয়ক প্রথম গ্রন্থ লেখেন। ১৮০০ সালের দিকে ইউরোপে প্রতিযোগিতামূলক সাঁতার বিশেষ করে ব্রেস্ট স্ট্রোক ইভেন্ট চালু হয়। আধুনিক অলিম্পিকে সাঁতার বিষয়ক প্রথম অন্তর্ভুক্তি ঘটে ১৮৯৬ সালের গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকে।

প্রাচীন গ্রিসে নিম-এর সমাধিগাত্রে খোদিত তত্ত্বের ভিত্তিতে জানা যায়, খ্রিষ্টপূর্ব ৮৮০ অব্দ থেকে ৬৫০ অব্দ পর্যন্ত আসিরীয়রা বিভিন্ন কায়দায় সাঁতার কাটত। এ সময় পশুর চামড়ার মধ্যে হাওয়া ঢুকিয়ে তাতে উপুর হয়ে শুয়ে বা বসে হাত-পা এর সাহায্যে পানির উপর দিয়ে চলত। এই ভাসমান বস্তুকে ‘মুশুক’ বলা হতো। তাদের ধারণা ছিল, পানির ভেতরে এক ধরনের বৃহদাকার মাছ মানুষের পেটে কামড় দিয়ে নাড়ি-ভুড়ি বের করে ফেলে। ফলে তারা মুশকের সাহায্যে সাঁতার কাটাকে নিরাপদ মনে করত। তবে সাঁতারের বিষয়ে বিখ্যাত ঐতিহাসিক ব্যালফ টমাস মনে করেন যে, খরস্রোতা নদীতে সাঁতার কাটার জন্য তখন মানুষ মুশুক ব্যবহার করত।

মানুষকে মূলত নিজের প্রয়োজনেই সাঁতার শিখতে হয়েছিল। অতীতকাল থেকেই সাঁতার সামরিক বাহিনীর প্রশিক্ষণের অংশ ছিল। রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজার যুদ্ধে পরাজিত হয়ে সাঁতার কেটে নিজের জীবন রক্ষা করেছিলেন। এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে, সেকালে রোমান ও গ্রিকরা সাঁতারের ওপর যথেষ্ট গুরুত্ব প্রদান করেছিলেন। প্রাচীন গ্রিস ও রোমের বীর যোদ্ধারা শরীর ঠিক রেখে যুদ্ধের কৌশল রপ্ত করার জন্য নিয়মিত সাঁতার অনুশীলন করত। এ সময় রোমের ৮৫০টি স্নান ঘরের প্রত্যেকটিতে সাঁতার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু প্রাচীন গ্রিক সভ্যতায় সাঁতার চর্চার প্রচলন থাকলেও তাদের স্ট্রোক সম্পর্কে তেমন কোনও ধারণা ছিল না।

ফ্রান্সের শার্লিম্যান তার সময়ে একজন অন্যতম সাঁতারু ছিলেন। ফরাসি সম্রাট লুই ও তার পরিষদবর্গ ‘সিন’ নদীতে নিয়মিত সাঁতার অনুশীলন করতেন। তবে এ সকল বিখ্যাত ব্যক্তি সাঁতারের কোনও স্ট্রোক ব্যবহার করতেন তার কোনও ছবি বা প্রমাণ নেই। যদিও ১৫০০ শতাব্দীতে একটি কাঠখোঁদাই চিত্রের মাধ্যমে প্রমাণ পাওয়া যায় যে, এক ব্যক্তি প্রাচীনকালে প্রাচ্য দেশীয় ‘মুশক’-এর ন্যায় একটি ‘ফ্লট’ ব্যবহার করেছিলেন। নরওয়ের সৈনিকরা শত্রু এড়ানোর কৌশল হিসেবে বর্মসজ্জিত অবস্থায় পানিতে ডুব দিয়ে শরীর থেকে বর্ম খুলে ফেলার কৌশল অনুসরণ করত।

সামরিক বাহিনীতে সাঁতার

প্রাচীনকালের সৈনিকদের বেলায় যেমন তেমনি আধুনিক কালের কমান্ডো ট্রেনিংয়েরও একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হচ্ছে সাঁতার। এটি কত প্রকার হতে পারে, কমান্ডো ট্রেনিংয়ে যারা যায়, কেবল তারাই বুঝতে পারে। এই গুরুত্বপূর্ণ অংশে দক্ষ হওয়া, প্রতিটি কমান্ডো প্রশিক্ষণার্থীর জন্য অবশ্যকর্তব্য! কারণ একজন কমান্ডোকে তার কর্মজীবনে, যেকোনও সময় যেকোনও পরিস্থিতিতে অপারেশনে যেতে হয়। একজন কমান্ডো যে কোনও আবহাওয়াতে, যে কোনও প্রতিকূলতা পেরিয়ে, যে কোনও লক্ষ্যবস্তুতে হামলা করতে যায়। আসলে সবকিছুর ওপরে হলো মিশনের গুরুত্ব। জলে, স্থলে, অন্তরীক্ষে সব স্থানে কমান্ডো মিশনে যেতে প্রস্তুত থাকবে একজন কমান্ডো। তাই জলপথে অপারেশনের জন্য একজন কমান্ডোর সাঁতারে দক্ষ হওয়া অতি জরুরি। সেই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই, কমান্ডো কোর্সে সাঁতারের প্রশিক্ষণ উপলক্ষ্যে একটা আলাদা ‘লেগ’ রাখা হয়েছে। কমান্ডো কোর্সে নানা ধরনের সাঁতারের অনুশীলন করানো হয়।

এর মধ্যে আছে ১০ মিনিট ফ্লোটিং। এই সাঁতারের নিয়ম হচ্ছে, প্রশিক্ষণার্থীকে ইউনিফর্ম পরিহিত অবস্থায় মোট ১০ মিনিট পানিতে ভেসে থাকতে হবে। ইউনিফর্ম বলতে পরিহিত ড্রেস, পায়ে যথারীতি লংবুট এবং মাথায় হেলমেট। এই ভেসে থাকা অবস্থায় স্বাভাবিক সাঁতার কাটা যাবে না, কোনও ধরনের সাপোর্ট নেওয়া যাবে না। পুরো প্রক্রিয়া নির্ভর করে কিছু টেকনিকের ওপর। এই টেকনিক ধরতে না পারলে, পানিতে দাপাদাপি করেও, খুব একটা সুবিধা করা যাবে না। ডুবে যাওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র।

উদ্ভাবিত এই সামরিক পদ্ধতি সাধারণ সাঁতারের চেয়ে ভিন্ন ধরনের। এখানে একজন কমান্ডোকে প্রকৃতি হতে পাওয়া উপকরণ এবং নিজের সাথে বহনযোগ্য সামরিক সরঞ্জাম ব্যবহার করে ভেলা বানাতে হয়। সেই ভেলাতে নিজের সাথের অস্ত্র, অ্যামিউনিশন, হ্যাভারস্যাক সবকিছু ভাসিয়ে, তার সাথে জলাশয়ে সাঁতরে ২০০ মিটার দূরত্ব অতিক্রম করতে হয়।

বিশেষ পরিস্থিতিতে একজন কমান্ডোকে সব সরঞ্জামসহ, কোনও জলাশয় পাড়ি দেওয়ার প্রয়োজন হতেই পারে। জলাশয় পাড়ি দিয়ে অপর পাড়ে গোটা গ্রুপ মিলিত হয়ে, পুনরায় কোনও অভিযান পরিচালনা করার প্রয়োজনীয়তা সামনে আসবে, এটা তারই প্রশিক্ষণ। মোট এক কিলোমিটার সাঁতারে এন্ডিওরেন্স টেস্ট করার জন্য, কমান্ডো কোর্সের সবচেয়ে বড় দূরত্বের সাঁতার হয়। এক্ষেত্রে দূরত্বের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে, সাঁতারুদের পোশাক খানিকটা শিথিল হয়ে থাকে। এই সাঁতারে সুইমিং কস্টিউম পরে সাঁতার কাটতে হয়।

ওজনসহ সাঁতার কমান্ডো কোর্সের সবচেয়ে ‘আশাহীন সাঁতার’-এর একটি। আশাহীন সাঁতার বলতে বোঝায়, সাঁতার শুরুর আগে আপনি যথার্থই নিরাশ হয়ে যাবেন। আপনাকে গভীর পানিতে সাঁতার কেটে মোট ২০০ মিটার অতিক্রম করতে হবে। এক্ষেত্রে সাঁতারের সময়ে আপনাকে বহন করতে হবে— ইউনিফর্ম, পায়ে বুট, মাথায় হেলমেট, পিঠে ২০ পাউন্ড ওজনসহ হ্যাভারস্যাক, কাঁধে একে-৪৭। এ সময় স্রোতের অনুকূলে এবং প্রতিকূলে নদীতে প্রায় ১০০ মিটার এর মতো দূরত্বের সাঁতার কাটতে হবে। 

সামরিক গুরুত্বের কারণে মধ্য যুগে ইউরোপে সাঁতারের চর্চা থাকলেও কাল পরিক্রমায় একসময় তা প্রায় অপ্রচলিত হয়ে পড়েছিল। ১৮৩৭ খ্রিস্টাব্দে লন্ডনের ‘ন্যাশনাল সুইমিং সোসাইটি’ গঠিত হলে জনসাধারণের মধ্যে আবার সাঁতার চর্চার সম্পর্কে সাড়া জাগে। ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দের ২৪ আগস্ট গ্রেট ব্রিটেনের ক্যাপ্টেন ‘ম্যাথিউ ওয়েব’ প্রথম ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রম করেন।

পানির দেশে সাঁতার বনাম পানিতে ডুবে মৃত্যু

নদীতে-পুকুরে সাঁতার কাটা বাঙালির জীবন-যাপনের প্রাত্যহিক অংশ। বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। ভাটি অঞ্চলের দেশ আর বদ্বীপ হওয়ার কারণে এ দেশে নদীর সংখ্যা প্রায় হাজারেরও বেশি। জালের মতো অসংখ্য ছোট-বড় নদী বেস্টন করে আছে এ দেশে। বাংলাদেশের এমন কোনও জেলা নেই যেখানে নদী নেই। এছাড়া রয়েছে বিস্তীর্ণ হাওর-বাওর আর অগুনতি খাল-বিল-জলাশয়।

তাই নদীবেস্টিত এই দেশে পানিতে ডুবে মৃত্যুর হারও অনেক বেশি। প্রতি বছরই পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়। এছাড়া জলযান ডুবে অসংখ্য মানুষের প্রাণহানি হয় প্রতিবছর। এর অন্যতম কারণ সাঁতার না জানা বা সাঁতার শেখার ব্যাপারে অবহেলা করা। সাঁতার জানা থাকলে অন্তত সে তার জীবন বাঁচাতে সক্ষম হবে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৭ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বছরে তিন লাখ ৬০ হাজার মানুষ পানিতে ডুবে মারা যায়, যার ৯০ শতাংশ ঘটে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে। বৈশ্বিক তথ্য অনুযায়ী, পানিতে ডুবে সবচেয়ে বেশি মারা যায় এক থেকে চার বছরের শিশুরা এবং দ্বিতীয় ঝুঁকিপূর্ণ বয়স হলো পাঁচ থেকে নয় বছর। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, মেয়ে শিশুদের তুলনায় দ্বিগুণ ছেলে শিশু পানিতে ডুবে মারা যায়।

তবে পানিতে ডুবে মৃত্যুর হার কমিয়ে আনা সম্ভব। কিন্তু এমন মৃত্যু পরিহারে প্রতিরোধমূলক কর্মসূচি বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশে অপেক্ষাকৃত কম। পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের পানিতে ডুবে যাওয়া প্রতিরোধের জন্য প্রয়োজন মায়েদের বা পরিচর্যাকারীদের সার্বক্ষণিক তত্ত্বাবধান। অপরদিকে পাঁচ বছর বা তার বেশি বয়সী শিশু-কিশোরদের সাঁতার শিক্ষাদানের মাধ্যমে পানিতে ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধ সম্ভব। আমাদের দেশে পানিতে ডুবে মৃত্যু সংখ্যা বিবেচনা করলে সমীক্ষায় তা খুব একটা কম নয়।

গণমাধ্যম উন্নয়ন ও যোগাযোগবিষয়ক প্রতিষ্ঠান ‘সমষ্টি’ সংবাদপত্রে প্রকাশিত পানিতে ডুবে মৃত্যুর তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করেছে। সংগঠনটির দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ থেকে ২০২২— এই তিন বছরে পানিতে ডুবে তিন হাজার ২৮৫ জন মারা গিয়েছে। এর ৮৭ শতাংশই শিশু। ‘সমষ্টি’-এর হিসাব শুধু সংবাদপত্রের প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে। যদিও বাস্তবে এ সংখ্যা অনেক বেশি।

বাংলাদেশের প্রথম স্বাস্থ্য ও তথ্য জরিপ ২০১৩ অনুযায়ী, এক থেকে ১৭ বছরের শিশুদের অপমৃত্যুর প্রধান কারণ পানিতে ডুবে মৃত্যু। যা যৌথভাবে নিউমোনিয়া, অপুষ্টি ও কলেরার কারণে মৃত্যুর চেয়েও বেশি। বাংলাদেশের দ্বিতীয় স্বাস্থ্য ও তথ্য জরিপ ২০১৬ অনুযায়ী, বছরে এক থেকে ১৭ বছর বয়সী ১৪ হাজার ৪৩৮ জন শিশু পানিতে ডুবে মারা যায়। বাংলাদেশে আট-নয় বছরের শিশুদের সাঁতার না জানার কারণে পানিতে ডুবে মারা যেতে দেখা যায়। যদিও একটি সুস্থ শিশুকে চার-পাঁচ বছর বয়স থেকেই সাঁতার শেখানো উচিত। পুকুর, ডোবা, খাল, দিঘী ইত্যাদি জায়গায় বিভিন্ন বয়সী শিশুরা পানিতে ডুবে মারা যায়। ২০১৮ সালের ‘স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস’ অনুযায়ী, দেশে পাঁচ বছর বয়সী শিশু মৃত্যুর পঞ্চম বড় কারণ ছিল পানিতে ডুবে মৃত্যু। এই বয়সী শিশুদের মোট মৃত্যুর তিন ভাগ হয় পানিতে ডুবে। এই মৃত্যুর হার গ্রামে প্রায় চার শতাংশ আর শহরে এক দশমিক দুই শতাংশ ছিল।

গণমাধ্যম উন্নয়ন ও যোগাযোগবিষয়ক প্রতিষ্ঠান ‘সমষ্টি’ সংবাদপত্রে প্রকাশিত পানিতে ডুবে মৃত্যুর তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করেছে। সংগঠনটির দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ থেকে ২০২২— এই তিন বছরে পানিতে ডুবে তিন হাজার ২৮৫ জন মারা গিয়েছে। এর ৮৭ শতাংশই শিশু। ‘সমষ্টি’-এর হিসাব শুধু সংবাদপত্রের প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে। যদিও বাস্তবে এ সংখ্যা অনেক বেশি।

উদ্যান বা পার্কগুলোর উন্মুক্ত জলাশয়ে এমন বেষ্টনি দিয়ে রাখা জরুরি। আলোকচিত্র: লেখক।

এছাড়া আরেক গবেষণায় উঠে এসেছে, প্রতিবছর পাঁচ বছর বয়সী অন্তত ১১ হাজার শিশুর মৃত্যু হয় পানিতে ডুবে। এই মৃত্যুর বড় অংশের খবর পত্রিকায় আসে না।  সেন্টার ফর ইঞ্জুরি প্রিভেনশন এন্ড রিসার্চ (সিআইপিআরবি) ২০০৫ সাল থেকে শিশু মৃত্যুরোধে কাজ করে আসছে। পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণগুলোর মধ্যে আছে— ১. বয়স্কদের তত্ত্বাবধানের অভাব, ২. গ্রামে শিশু পরিচর্যা কেন্দ্রের অভাব, ৩. অতি দারিদ্র, ৪. পুকুর-জলাধারে নিরাপত্তা বেষ্টনীর অভাব, ৫. শিশুদের সাঁতার না জানা।

২০২২ সালের এক গবেষণায় দেখা যায়, পাঁচ বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে যারা পানিতে ডুবে মারা যায় তাদের ৮০ শতাংশই বসত ঘর থেকে ২০ মিটার দূরত্বের মধ্যে কোনও পুকুর-জলাশয়ে দুর্ঘটনায় পড়ে। বাংলাদেশে একাধিক শিশু, বিশেষভাবে যুগল শিশুদের একই স্থানে একইসঙ্গে পানিতে ডুবে মারা যেতে দেখা যায়। সাধারণত একটি শিশু অন্য শিশুকে পানিতে ডুবে যাওয়ার সময় বাঁচাতে গিয়ে একসঙ্গে মারা যায়। এতে বোঝা যায়, শিশুদের পানি নিরাপত্তা কৌশল, বিশেষত নিরাপদ উদ্ধার কৌশল সম্পর্কে সচেতনতার অভাব রয়েছে। আর বয়স্কদের শিশু তত্ত্বাবধানের অসচেতনা এবং অবহেলাকেও পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে গণ্য করা হয়।

অনেক সময় অনেকে মনে করেন, তাদের শিশু পানিতে ডুবে মারা যাবে না, কারণ তারা অত্যন্ত ভালো পিতা-মাতা। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, শিশু পানিতে ডুবে মারা যাওয়ার আগে এমন চিন্তাই করেন মা-বাবারা। কেউই ভাবেন না যে, তাদের শিশু পানিতে ডুবে মারা যেতে পারে।

সঠিক তত্ত্বাবধান ছাড়া কোনও শিশুই পানি থেকে নিরাপদ নয়। অনেকে তাদের ছোট সন্তানকে বড় সন্তানের তত্ত্বাবধানে রেখে নিশ্চিন্ত অনুভব করেন। কিন্তু এমন সময়েও অনেক শিশু মারা যেতে দেখা যায়। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের অনেক মানুষের বসত বাড়িতেও পুকুরের পানিতে ডুবে শিশুদের মৃত্যু হয়। তাই মনে রাখা উচিত, আপনি আপনার সন্তানের প্রধান নিরাপত্তাকারী। অনেকে মনে করেন, শিশু সাঁতার জানলেই সে পানিতে নিরাপদ। যদিও বাস্তবতায় দেখা যায়, সাঁতার জানা শিশুরাও অনেক সময় পানিতে একা বিপদে পড়ে। যাদের ধারণা, তাদের শিশু সবসময় তাদের সঙ্গে বাসায় থাকে; তাদের মনে রাখা দরকার যে, শিশুরা অত্যন্ত দ্রুত এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় চলে যায়। আপনার অগোচরেই হয়ত শিশু কোনও জলাশয়ে পড়ে যেতে পারে। পানিতে ডুবে যাওয়া অত্যন্ত নীরব ঘটনা। শিশুরা পানিতে ডুবে যাওয়ার সময় কোনও আওয়াজ করতে বা সাহায্য চাইতেও পারে না বেশিরভাগ সময়। ফলে শিশুরা নীরবে পানিতে ডুবে মারা যায়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক প্রতিবেদনে পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু নিবারণে ছয়টি প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করেছে। এর মধ্যে আছে: ১. প্রাক-স্কুল বয়সী শিশুদেরকে পানি থেকে নিরাপত্তা দিতে ব্যবস্থা গ্রহণ, ২. পানিতে যাওয়ার পথে বেষ্টনী প্রদান, ৩. সাঁতার শেখানো এবং পানি থেকে নিরাপত্তার কৌশল প্রশিক্ষণ প্রদান, ৪. বন্যা ও অন্যান্য পানি থেকে সংঘটিত দুর্যোগ থেকে সুরক্ষা, ৫. পানি থেকে শিশুদেরকে নিরাপদে উদ্ধার এবং সিপিআর প্রশিক্ষণ প্রদান, ৬. নৌকা, জাহাজ ও ফেরিতে নিরাপদে যাতায়াতে কার্যকর বিধি ব্যবস্থা প্রণয়ন এবং প্রতিষ্ঠাকরণ।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সাঁতারের গুরুত্ব নিয়ে যদি আমরা আলোচনা করি তাহলে দেখতে পাব, নদীমাতৃক এই দেশে বহু আগে থেকেই মানুষ পানির সাথে সহ-অবস্থানে আছে। ঝড়, বন্যা, জলচ্ছ্বাসের সাথে যুদ্ধ করে টিকে থাকার জন্য মানুষ ছোটবেলা থেকেই পানিতে টিকে থাকার কৌশল শিখে নেয় যেকোনও ভাবেই। গ্রামের কয়েক বাড়ি পরপরই পুকুর-দীঘির প্রাপ্যতা ছিল আগে। পরবর্তী সময়ে শহুরে আগ্রাসনে জলের সহজলভ্যতা অনেকাংশে কমে এসেছে। গোসলের জন্য মানুষ পুকুর ব্যবহার না করে এখন গোসলখানায় যাওয়া শুরু করেছে। সাঁতার শেখার জন্য বেছে নিয়েছে সুইমিং পুল।

সাঁতারপুকুর বা সুইমিং পুল

সাঁতারপুকুর বা ইংরেজি পরিভাষায় সুইমিং পুলের ব্যবহার মূলত শুরু হয় খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় সহস্রাব্দে। সেই সময়ে বর্তমান পাকিস্তানে অবস্থিত প্রাচীন মহেঞ্জোদারো নগরীতে খনন করা ‘মহাস্নানাগার’ সম্ভবত ইতিহাসের প্রথম সাঁতার-পুকুর ছিল। ১২ বাই ৭ মিটার (৩৯ বাই ২৩ ফুট) আয়তনের এই জলাশয়টি ইট দিয়ে আস্তরিত ও একটি আলকাতরাভিত্তিক জলনিরোধক (সিল্যান্ট) দিয়ে আবৃত ছিল। প্রাচীন গ্রিক এবং রোমানরা তাদের মল্লক্রীড়া বিদ্যালয় ‘পালাইস্ত্রা’-গুলিতে প্রশিক্ষণের জন্য জলক্রীড়া এবং সামরিক অনুশীলনের জন্য কৃত্রিম জলাশয় তৈরি করত। রোমান সম্রাটদের ব্যক্তিগত সাঁতার-পুকুর ছিল, যেগুলির মধ্যে মাছও রাখা হতো। তাই স্নান বা সাঁতারের পুকুরের জন্য লাতিন শব্দটি হলো ‘পিসকিনা’ যার অর্থ মাছের পুকুর। উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে সাঁতার-পুকুর ব্রিটেনে জনপ্রিয়তা লাভ করে। ১৮৩৭ সালের প্রথম দিকে ইংল্যান্ডের লন্ডন নগরীতে ঝাঁপমঞ্চসহ ছয়টি অভ্যন্তরীণ সাঁতার-পুকুর ছিল। ১৮৪৪ সালে মেডওয়ে নদীতে ডুবে যাওয়ার উদ্বেগের প্রতিক্রিয়া হিসাবে এটি নির্মাণ হয়েছিল।                                 

বাংলাদেশের সাঁতারুদের কথা

স্বাধীনতা লাভ করার পরে ১৯৭২ সালে ‘বাংলাদেশ অ্যামেচার সুইমিং ফেডারেশন’ গঠিত হয়। আর আমাদের দেশে সুইমিং পুলের ব্যবহার মূলত শুরু হয় আশির দশকে। ১৯৮৭ সালে আট জন সাঁতার প্রশিক্ষণার্থী ও একজন কোচ বা প্রশিক্ষক নিয়ে বিকেএসপিতে সাঁতার বিভাগের কার্যক্রম শুরু হয়। এ সংগঠনটি বাংলাদেশে সাঁতারের মানোন্নয়ন, দেশের সুইমিং পুলগুলোর পৃষ্ঠপোষকতা ও পরিচালনায় ভূমিকা রাখে। এছাড়া জাতীয় সাঁতার দলের পৃষ্ঠপোষকতায় এ ফেডারেশন দায়বদ্ধ। 

বাঙালি সাঁতারু হিসেবে প্রথমেই যার নাম আসে তিনি হলেন ইতিহাস বিখ্যাত ব্রজেন দাস (৯ ডিসেম্বর ১৯২৭ – ১ জুন ১৯৯৮), যিনি প্রথম দক্ষিণ এশীয় ব্যক্তি হিসেবে সাঁতার কেটে ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দেন। ১৯৫৮ সালের ১৮ আগস্ট তিনি এই কৃতিত্ব অর্জন করেন। লম্বা সাঁতারে এই বঙ্গে আরও নাম রয়েছে। কিংবদন্তী সাঁতারু মোশাররফ হোসেনের কথা এখানে উল্লেখযোগ্য। ক্যারিয়ারে যার ৯৬টি স্বর্ণপদক জেতার রূপকথা অনেকেরই অজানা। এক জীবনে দেশের জন্য সাঁতারে তিনি কি জেতেননি সেটাই প্রশ্ন। ‘সাফ’-এর এক আসরে পাঁচটি স্বর্ণপদকসহ মোট ৪৪টি আন্তর্জাতিক পদক তিনি অর্জন করেন। ৬৪ বার ভেঙেছেন জাতীয় রেকর্ড। প্রথম ও আধুনিক বাংলাদেশের একমাত্র ব্যক্তি হিসেবে ১৯৮৮ সালে পাড়ি দেন ইংলিশ চ্যানেল। যে রেকর্ড এখনও অক্ষুণ্ণ আছে। এছাড়া তিনি ক্রীড়াক্ষেত্রে অবদানের জন্য দেশে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা স্বাধীনতা পদকে ভূষিত হয়েছেন।

লম্বা সাঁতারকে সবার কাছে জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন যিনি তিনি হলেন এডভেঞ্চার গুরু প্রয়াত হামিদুল হক। বঙ্গোপসাগরে ১৬ দশমিক এক কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে যে সেন্ট মার্টিনস দ্বীপে যাওয়া যায় সে পথ তিনি খুঁজে বের করেছিলেন আজ থেকে ১৭ বছর আগে। ২০০৬ সালে প্রথমবার হামিদুল হকের নেতৃত্বে তিনজনের দল সফলভাবে এই ‘বাংলা চ্যনেল’ পাড়ি দেন। এখন প্রতিবছর টেকনাফের শাহপরী দ্বীপ থেকে সেন্টমার্টিনস পর্যন্ত বাংলা চ্যনেল পাড়ি দেওয়ার এ আয়োজন হয়ে আসছে নিয়মিতভাবে। 

দূরপাল্লার সাঁতারে দেশের আরও একজন রেকর্ড করেছেন যিনি ৬৫ বছর বয়সে বিরামহীন ১৪৬ কিলোমিটার সাঁতার কেটে নতুন রেকর্ড গড়েছেন। তিনি সাঁতারু ক্ষীতিন্দ্র চন্দ্র বৈশ্য। ১৯৭৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের পুকুরে টানা ৯৩ ঘণ্টা ১১ মিনিট সাঁতার কেটে গড়েন জাতীয় রেকর্ড। তখন বঙ্গবন্ধুর হাত থেকে পেয়েছিলেন উপহার। ১৯৭৬ সালে ১০৮ ঘণ্টা সাঁতার কেটে আগের সেই রেকর্ড নিজেই ভেঙেছেন। তাঁর সম্মানে জগন্নাথ হলে রয়েছে স্মারক ফলক। বাংলাদেশের এমন জাঁদরেল সাঁতারুদের মধ্যে আরও রয়েছেন বজলুর রহমান, কারার সামেদুল, মাহবুবুর রহমান, রুবেল রানা, শাজাহান আলী রনি, মাহফিজুর রহমান, মাহফুজা খাতুন প্রমুখ।

সাঁতার শেখার চর্চা জরুরি

সাঁতার শেখার আলোচনার আগে জেনে নিই সাঁতারের প্রকারভেদ সম্পর্কে। সাঁতার এর স্টাইল মূলত চার প্রকার: ক) ফ্রিস্টাইল বা মুক্ত সাঁতার, খ) ব্যাকস্ট্রোক বা চিত সাঁতার, গ) ব্রেস্টস্ট্রোক বা বুক সাঁতার, ঘ) বাটারফ্লাই বা প্রজাপতি সাঁতার।

সাঁতার প্রশিক্ষণে ফ্রি-স্টাইল বা ফ্রন্ট-ক্রল সাঁতার প্রথমে শিখতে হয়। কারণ সাঁতারের কলাকৌশল রপ্ত করার জন্য প্রশিক্ষণের সময় ফ্রিস্টাইল সাঁতারের ব্যবহার বেশি। অবশ্য নবিশদের প্রশিক্ষণের সময় কোনও একটি স্টাইল নির্দিষ্ট করে দেওয়া ঠিক না। সাঁতারের কলাকৌশল শিখতে কোমরে বেশি চাপ প্রয়োগ না করে প্রথমে ভেসে থাকার চেষ্টা করা, এরপর একে একে শ্বাস নিয়ে হাত এবং পায়ের কিকের সমন্বয়ে পানিতে এগিয়ে যাওয়ার কৌশলকে রপ্ত করতে হয়। 

যথাসময়ে সাঁতার না শেখার কারণে জীবন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। মানুষের জীবনে হাঁটতে জানা যেমন অবশ্য প্রয়োজনীয়, তেমনি পৃথিবীপৃষ্ঠের চারভাগের তিনভাগ এলাকা জুড়ে বিস্তৃত জলভাগ থাকার কারণে সাঁতার জানাও সমান প্রয়োজনীয়। আর সে কারণে প্রয়োজন দক্ষ সাঁতার প্রশিক্ষক। একজন সাঁতার প্রশিক্ষক কেবল সাঁতারই শেখান না। তিনি জলে স্থলে বিচরণ করতে শেখান ভয়হীন এবং ঝুঁকিমুক্তভাবে। নিশ্চিত করেন জীবনের নিরাপত্তা।

সাঁতার প্রশিক্ষণের কাজটি সঠিকভাবে সম্পন্ন করতে প্রশিক্ষক গ্রহণ করেন বিশেষ প্রস্তুতি। ফলে শিক্ষার্থীকে জীবনরক্ষাকারী বিদ্যা শিক্ষা দিতে হলে স্বাভাবিকভাবেই একজন প্রশিক্ষককে মেধা এবং দক্ষতা অর্জন করতে হয়। সাঁতারে এ দক্ষতা অর্জন বলতে বোঝাবে, একজন শিশু বা পূর্ণ বয়স্ক ব্যক্তি কারও সাহায্য ছাড়াই জলাশয়ে নেমে ২৫ মিটার সাঁতার কাটতে পারবে এবং ৩০ সেকেন্ড গভীর পানিতে ভেসে থাকতে পারবে। পানিতে ভেসে থাকার কৌশলটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নৌকাডুবির সময় অনেক ক্ষেত্রে পানি থেকে দ্রুত উঠে আসা সম্ভব হয় না। সেক্ষেত্রে ভেসে থাকার (treading) কৌশল জীবন রক্ষায় সাহায্য করে।

যথাসময়ে সাঁতার না শেখার কারণে জীবন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। মানুষের জীবনে হাঁটতে জানা যেমন অবশ্য প্রয়োজনীয়, তেমনি পৃথিবীপৃষ্ঠের চারভাগের তিনভাগ এলাকা জুড়ে বিস্তৃত জলভাগ থাকার কারণে সাঁতার জানাও সমান প্রয়োজনীয়। আর সে কারণে প্রয়োজন দক্ষ সাঁতার প্রশিক্ষক। একজন সাঁতার প্রশিক্ষক কেবল সাঁতারই শেখান না। তিনি জলে স্থলে বিচরণ করতে শেখান ভয়হীন এবং ঝুঁকিমুক্তভাবে। নিশ্চিত করেন জীবনের নিরাপত্তা।

সাঁতারের মৌলিক দক্ষতাগুলো অনেকটা এরকম: ক) নিরাপদে পানিতে নামা বা পানি থেকে উঠে আসা, খ) নিরাপদে এবং আত্মবিশ্বাসের সাথে পানিতে দাঁড়িয়ে থাকা, গ) পানিতে শরীর স্বাভাবিক রাখা, ঘ) পানিতে মুখ ডোবানো, ঙ) পানিতে ডুব দিয়ে বুদবুদ ছাড়া এবং চোখ মেলে দেখা, চ) পানিতে ডুবে থাকা অবস্থায় শ্বাস বন্ধ রাখা এবং নিঃশ্বাস ছাড়া, ছ) পানির মধ্যে হাঁটা, জ) হাত দিয়ে পানি টেনে হাঁটা, ঝ) বাঁশ বা দণ্ডের সাহায্যে নিজেকে উদ্ধার করা।

কেউ পানিতে পড়ে গেলে তাৎক্ষণিক পানিতে না নেমেও জলাশয়ের কিনারা থেকে বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে এবং সঠিক কৌশল প্রয়োগ করে ডুবন্ত ব্যক্তিকে উদ্ধার করা যায়। এক্ষেত্রে জলাশয়ের পাড়ে শুয়ে ডুবন্ত ব্যক্তির দিকে একটি লাঠি বা বাঁশ এগিয়ে দিয়ে অথবা দড়ি ছুঁড়ে দিতে হবে। এটি ধরে ডুবন্ত ব্যক্তি পানি থেকে নিরাপদে পাড়ে পৌঁছাতে পারবে। ছোটদের শেখাতে হবে, যখন কেউ পানিতে ডুবে যেতে দেখবে তখন উদ্ধারে এগিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে বড়দের ডাকতে হবে।

সেই আদিকালের সাঁতার এবং বর্তমানে সাঁতার কাটার মধ্যে এখন বিস্তর তফাৎ থাকলেও কালের পরিক্রমায় তা উন্নতির দিকেই যাচ্ছে। তবে সাঁতারের মান উন্নয়নের জন্য আধুনিক কলাকৌশল, বিজ্ঞানসম্মত প্রশিক্ষণ, দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা, অধিক সংখ্যক পুল নির্মাণ, সাঁতার কাটার নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবন, বিভিন্ন বয়সের প্রতিযোগিতার আয়োজন, সাঁতার কোচদের প্রশিক্ষণসহ সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে সর্বস্তরে পানিতে ডুবে অপমৃত্যু প্রতিরোধ করতে নানামুখী সচেতনতামূলক কর্মকাণ্ডের উদ্যোগ নিতে হবে।

সাঁতার জীবন বাঁচায়। তাই সাঁতার শেখার ব্যপারে গুরুত্ব দিন। আপনার শিশুকে সাঁতার শেখানোর ব্যপারে উদ্যোগী হোন।

লেখক: প্রফেশনাল সুইমিং কোচ, বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা সংস্থা (বিকেএসপি) থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত।
ইমেইল: choukathperiye@gmail.com

হোমায়েদ ইসহাক মুন। প্রতিকৃতি অঙ্কন: সব্যসাচী মজুমদার।
ad

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত