Beta
বৃহস্পতিবার, ৯ মে, ২০২৪
Beta
বৃহস্পতিবার, ৯ মে, ২০২৪

বাস্তুকৃষ্টি

মানুষের ঊর্ধ্বে না যাওয়া স্থাপত্য

ওয়াহিদুজ্জামান রাতুল। প্রতিকৃতি অঙ্কন: সব্যসাচী মজুমদার।

স্থাপত্যাচার্য্য মাজহারুল ইসলামের সঙ্গে সাক্ষাৎ বদলে দিয়েছিল স্থাপত্যকলার এক নবীন শিক্ষার্থীকে। প্রথম সাক্ষাতে যে শিক্ষার্থী বিস্ময়-মুগ্ধতায় হয়ে গিয়েছিলেন মৌন, তিনি কি ধীরে ধীরে ভাষা খুঁজে পেলেন মাজহারুল ইসলামের স্থাপত্যে? এক দশক ধরে ঘুরে ঘুরে তাঁর স্থাপত্যের গাম্ভীর্যপূর্ণ উপস্থিতি অবলোকন করে? আলো-ছায়া-অন্ধকারের সেই অভিজ্ঞতা সাদা-কালোয় ছবি তুলে ধরে রেখে? তরুণ স্থপতি ওয়াহিদুজ্জামন রাতুল এই লেখায় তুলে ধরেছেন তার সেই অভিজ্ঞতার কথা।

২০০৯ সালের ১৬ই ডিসেম্বর। স্থপতি মাজহারুল ইসলামের সাথে আমার প্রথম সাক্ষাৎ। আমি তখন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপত্যে তৃতীয় বর্ষে পড়ছি। সেদিন সন্ধ্যায় তাঁর গুলশানের বাসায় উপস্থিত হই। তার বাসার ফ্যামিলি লিভিংয়ে বসে কিছুক্ষণ কথা হয়। লুই আই কানের একটি বইয়ে তাকে নিয়ে সচিত্র লেখা প্রকাশিত হয়েছে, সেটা বের করে দেখান। একসময় বেডরুমের সামনের করিডোরে টাঙানো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ছবি দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করেন, ভবনটিতে আমি গিয়েছি কিনা।

চারুকলা অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। আলোকচিত্র: ওয়াহিদুজ্জামান রাতুল

চারুকলা অনুষদ ভবন, মাজহারুল ইসলামের স্থাপত্য। আমার প্রথম দেখা ২০০৪ সালে, স্থাপত্যে পড়ালেখা শুরুরও আগে। এরপর থেকে যখনই ঢাকায় আসি ছুটিতে, চারুকলায় যাওয়া হয়। ধীরে ধীরে হয়ত বুঝতেও পারছি এর স্থাপত্যিক বৈশিষ্ট্য এবং মাজহারুল ইসলামের উদ্দেশ্য। কিন্তু ২০০৯ সালের ওই দিন সাক্ষাতের সময় তাঁকে এ বিষয়ে কিছুই বলিনি। শুধু মাথা ঝুঁকিয়েছিলাম। এরপর জানতে চাইলেন, আমার গাড়ি আছে কিনা, তাকে ঢাকা শহরে ঘুরতে নিয়ে যেতে পারব কিনা। আবারও আমার মৌনতা। আসলে এতদিন ধরে একজন এই মাপের স্থপতির কথা শুনেছি, কাজ দেখেছি। কিন্তু তার সাথে সাক্ষাতের পর বিস্ময়, মুগ্ধতা, উত্তেজনায় হয়ত কিছুটা মৌন হয়ে গিয়েছিলাম। এরপর থেকে বেশ কয়েকবার তার বাসায় গিয়েছি, বুয়েটের বন্ধুদের নিয়ে, খুলনার বন্ধুদের নিয়ে, লুকিয়ে তার ছবি তুলেছি।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। আলোকচিত্র: ওয়াহিদুজ্জামান রাতুল

২০১২ সালে জানুয়ারিতে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার থিসিস শেষ করি। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক জুনিয়রের সাথে শুরু করি মাজহারুল ইসলামের কাজের ডকুমেন্টেশন। তাঁর হাতে আঁকা ড্রইংগুলোকে ডিজিটাল ড্রইং-এ নতুন করে আঁকা, কাগজের মডেল তৈরি করা, ত্রিমাত্রিক ডিজিটাল মডেল তৈরি করে তার কাজগুলো স্টাডি করা।

ব্যাপারটা এরকম ছিল— পড়ালেখা শেষ করে সদ্য মাজহারুল ইসলামের অফিস বস্তুকলাবিদ-এ যোগদান করেছি। ড্রইং সবসময় যথেষ্ট ছিল না, তথ্য ঘাটতির কারণে কোনও প্রজেক্টই পুরোপুরি বোঝা সম্ভব হচ্ছিল না। তখন শুরু করি ড্রইং নিয়ে সশরীরে প্রজেক্টগুলোতে চলে যাওয়া। কাজের সুবিধার জন্য ছবি তোলা। এভাবে তার প্রায় সবগুলো কাজ দেখতে যাই এবং প্রচুর ছবি হয়ে যায়। বেশ কিছু প্রজেক্টের সম্পূর্ণ ডকুমেন্টেশন করা হয়। কিছু কিছু প্রদর্শনী করেছি, লেকচারে কিছু কাজ দেখিয়েছি, কিন্তু কোনও গোছানো প্রকাশনা করা হয়নি।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। আলোকচিত্র: ওয়াহিদুজ্জামান রাতুল

আরও প্রায় ১০ বছর পর, ২০২১-এর শেষদিকে, ছবিগুলো নিয়ে বসি এবং ছবিতে কিছু কাজ করি। এক পর্যায়ে ৪০টি ছবি গুছিয়ে ফেলি একটি বই আকারে প্রকাশ করার জন্য। ছবিগুলো নিয়ে স্থপতি শামসুল ওয়ারেস স্যারকে দেখিয়ে তাঁকে অনুরোধ করি মুখবন্ধ লিখে দিতে। সাথে সাথে তিনি সম্মতি দেন। দুই সপ্তাহের ভেতর মুখবন্ধটি লিখে দেন। বইটি প্রকাশিত হয় ২০২৩-এর ফেব্রুয়ারিতে। একটি প্রদর্শনী আয়োজন করা হয় ছবিগুলো দিয়ে ঢাকার লালমাটিয়ায় ‘কলাকেন্দ্র’-তে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। আলোকচিত্র: ওয়াহিদুজ্জামান রাতুল

৪০টি ছবি, সাদা-কালো, ১০ বছরের কাজের প্রতিফলন, অনেকটা ডায়রি লেখার মতো করে উপস্থাপিত হয়েছে বইটিতে। ছবিগুলোতে যতটুকু তথ্য আছে, তার থেকে বেশি আছে ব্যক্তিগত অভিব্যক্তি। আলো, ছায়া এবং অন্ধকার— কিছুটা স্থাপত্যের, বাকিটা ব্যক্তিগত, মনের— চোখের।

সেখানে কুয়াশা ভেদ করে দাঁড়ানো জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের দেয়াল, গাছগাছালির ভেতর থেকে দেখা ইটের বন্ধন। একটি ভবন যতটা গুরুত্বপূর্ণ, তার সমপরিমাণ গুরুত্ব বহন করছে এর পারিপার্শ্বিক পরিবেশ। যেটা কখনো একটি বা একগুচ্ছ গাছ। কখনো আলো, কখনো আমার কোনও বন্ধু।

পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, বগুড়া। আলোকচিত্র: ওয়াহিদুজ্জামান রাতুল

পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট-এর র‍্যাম্প, এর ভেতর আলো এবং গতিশীলতা, বিমূর্ত সিঁড়ি, এলোমেলো শ্রেণিকক্ষের চকচকে রাইটিং বোর্ড; যেখানে প্রতিফলিত হচ্ছে বাইরের গাছ। পানির ট্যাংকের একদম নিচ থেকে দেখা, বাড়িগুলোর পোর্চ-এ আলো-ছায়া, পুকুর ও গাছের ভেতর থেকে দূরে একটি দেয়াল।

স্থপতি মাজহারুল ইসলামের এসব স্থাপত্যকর্ম এক গাম্ভীর্যপূর্ণ উপস্থিতিতে অনেক অনেক মানুষের জীবনের অপরিহার্য উপাদান হয়ে আছে। সেই গাম্ভীর্য কিছুটা মায়া দিয়ে উপস্থাপনের জন্য সাদা-কালোর ভারসাম্য দিয়ে মাজহারুল ইসলামের কাজের ভারসাম্য বোঝার চেষ্টা করেছি। যা বইটিতে প্রকাশিত হয়েছে ‘PROFOUND PRESENCE’ হিসেবে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। আলোকচিত্র: ওয়াহিদুজ্জামান রাতুল

চারুকলা অনুষদ, বি.সি.এস.আই.আর, বাংলাদেশ রোড রিসার্চ ল্যাবরেটরি, জয়পুরহাট কঠিন শিলা প্রকল্প, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, আজিমপুরের ডরমিটরি— সবগুলো ছবিতেই প্রজেক্ট এবং পারিপার্শ্বিকতার গভীর সম্পর্ক, দৈনন্দিনতার ছাপ সাবলীলভাবে প্রকাশ করার চেষ্টা করা হয়েছে।

মাজহারুল ইসলামের কাজে খুব সহজভাবে জীবনকে অনেক গভীরভাবে উপস্থাপন করা আছে। বাংলাদেশের স্থাপত্যকে আধুনিকতার পর্যায়ে উপনীত করার জন্য প্রথম প্রজেক্ট থেকেই তাঁর এই বিবৃতি পরিষ্কার।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। আলোকচিত্র: ওয়াহিদুজ্জামান রাতুল

পরিচ্ছন্নতা তার কাজগুলোতে এতটাই প্রবল যে সাদা-কালো ছবিগুলোতে প্রজেক্টগুলোর জাগতিক বাস্তবতার জীর্ণ অবস্থা খুব একটা চোখে পড়ে না।

মাজহারুল ইসলাম স্থাপত্য দিয়ে যে বিমূর্ততা সৃষ্টি করেছেন তা কখনোই সাধারণের ভাবনার উর্ধ্বে চলে যাবে এমনটি হয়নি। বরং ব্যবহারকারীরা এত সহজভাবে তাদের জীবনে গ্রহণ করেছে যে, অনেক সময়ই তা অযত্নের দলে পড়ে গিয়েছে, অবহেলিত হয়েছে এর সুদৃঢ় অবস্থান। কিন্তু ভাবনার পর্যায়ে একটু স্থিতি দিলেই অবাক হয়ে যেতে হয় এইসব মহান স্থাপত্যের বিমোহিত সৌন্দর্য্যে।

বাংলাদেশ রোড রিসার্চ ল্যাবরেটরি, ঢাকা। আলোকচিত্র: ওয়াহিদুজ্জামান রাতুল

এজন্য বলতে চাই, দৈনন্দিন ব্যস্ততা, গতিশীলতা, বিশৃঙ্খলা থেকে একটু আড়াল হয়ে, একটু স্থির হয়ে, আমরা যেন তার স্থাপত্যগুলোকে সময় দেই। সেসব স্থাপত্যের ভেতর থেকে উদ্ভাসিত ঐশ্বর্যের এক অপরিসীমতা খুব সহজেই আমাদেরকে অনেক অনেক আলোকিত করবে। ভাবতে শেখাবে।

মাজহারুল ইসলামের স্থাপত্য মানুষের ঊর্ধ্বে যায়নি। তিনি সেই চেষ্টাও করেননি। বরং স্থাপত্যের মাধ্যমে মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের চেষ্টা করেছেন। অতীতের দৃঢ় সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যকে জ্যামিতিক বিন্যাসের ভেতরে নিয়ে এসে জল-বায়ুর সুচিন্তিত নিয়ন্ত্রণ মাজহারুল ইসলামের প্রথম এবং প্রধান বৈশিষ্ট্য।

মাজহারুল ইসলামের স্থাপত্যের এই বৈশিষ্ট্য গভীরভাবে অবলোকন করলে, আমাদের পক্ষে তা এখনো বোঝা সম্ভব। সামনে আরও বহু বছর মাজহারুল ইসলামের স্থাপত্য আমাদের জন্য অনেক প্রাসঙ্গিক এবং গুরুত্বপূর্ণ।

মাজহারুল ইসলামের স্থাপত্যের সাদা-কালো আলোকচিত্র নিয়ে ওয়াহিদুজ্জামান রাতুলের বই ‘PROFOUND PRESENCE’।

লেখক: স্থপতি ও আলোকচিত্রী

ই-মেইল: mdwahiduzzamanratul@gmail.com

ad

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত