Beta
বৃহস্পতিবার, ৯ মে, ২০২৪
Beta
বৃহস্পতিবার, ৯ মে, ২০২৪

বিস্তার

শ্যামলী নিসর্গের সেকাল একাল-১

ঢাকা শহরের বৃক্ষ বৃত্তান্ত: ফাল্গুন পর্ব

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির সামনে বেরিয়া ও বুদ্ধ-নারকেলের যুগল গাছ। আলোকচিত্র: লেখক।

নিসর্গী অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মা ১৯৬২ থেকে ১৯৬৫ সালের মধ্যে ঢাকা শহরের গাছপালা নিয়ে লিখেছিলেন ‘শ্যামলী নিসর্গ’। বাংলা একাডেমি থেকে ১৯৮০ সালে প্রথম প্রকাশিত সে বইটি এখনও ঢাকার বৃক্ষচর্চার আকরগ্রন্থ। তিনি শ্যামলী নিসর্গ লিখে রেখে না গেলে সেকালের ঢাকার পথতরুর বৃত্তান্ত আমরা হয়ত জানতে পারতাম না। কিন্তু ঢাকার সেসব পথতরুর এখন কী অবস্থা? আজও কি সেগুলো বেঁচে আছে? দ্বিজেন শর্মার আত্মজ সে বৃক্ষরা এখন ঢাকার কোথায় কীভাবে আছে সে কৌতুহল মেটানো আর একালের পাঠকদের সঙ্গে ঢাকার সেসব গাছপালা ও প্রকৃতির পরিচয় করিয়ে দিতে এই লেখা। কৃষিবিদ ও প্রকৃতিবিষয়ক লেখক মৃত্যুঞ্জয় রায় সরেজমিন অনুসন্ধানে তুলে ধরছেন ঢাকার শ্যামলী নিসর্গের সেকাল একাল। ঢাকার প্রাচীন, দুর্লভ, দুষ্প্রাপ্য ও অনন্য পথতরুর বৃত্তান্ত নিয়ে সকাল সন্ধ্যার পাঠকদের জন্য বাংলা বারো মাসে বারো পর্বের ধারাবাহিকের আজ পড়ুন ফাল্গুন পর্ব।  

ঢাকা শহরের বৃক্ষ বৃত্তান্ত: চৈত্র পর্ব

ঢাকা শহরের বৃক্ষ বৃত্তান্ত: বৈশাখ পর্ব

গাছেরও যে প্রাণ আছে, অনুভূতি আছে, গাছও যে সাড়া দেয়— সেসব কথা বুঝেছিলেন এবং বৈজ্ঞানিক গবেষণায় প্রমাণ করে বিশ্ববাসীকে জানিয়েছিলেন আমাদের বাঙালি বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসু। তাঁর কিছু কথা দিয়েই এই লেখা শুরু করছি:

‘‘গাছের প্রকৃত ইতিহাস সমুদ্ধার করিতে হইলে গাছের নিকটে যাইতে হইবে। সেই ইতিহাস অতি জটিল এবং বহু রহস্যপূর্ণ। … এই আমাদের মূক সঙ্গী, আমাদের ঘরের পার্শ্বে নিঃশব্দে যাদের জীবনের লীলাখেলা চলিতেছে তাদের গভীর মর্মের কথা তাহারা ভাষাহীন অক্ষরে লিপিবদ্ধ করিয়া দিল এবং তাহাদের জীবনের চাঞ্চল্য ও মনের আক্ষেপ আজ আমাদের দৃষ্টির সন্মুখে প্রসারিত করিল।’’

যদি গাছের কাছে না যাই, তাহলে তার ভাষা বুঝব না, তাকে যদি ভালো করে না দেখি তাহলে তার স্বরূপ চিনব না, যদি তাকে স্পর্শ না করি তাহলে অনুভব করব না তার মনের কথা। পৃথিবীতে গাছ আমাদের বয়োজ্যেষ্ঠ, গুরুজন। গাছ গুরুজনের মতোই আমাদের চিরকাল রক্ষা করে চলেছে, আমাদের অক্সিজেন দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছে। এই ঋণ কখনও শোধ হওয়ার নয়। অনেকটা এসব উপলব্ধি থেকে সুযোগ পেলেই গাছের কাছে ছুটে যাই, তাদের বোঝার চেষ্টা করি। ঢাকা শহরে শ্যামলী নিগর্গের বৃক্ষ সন্ধানে ব্রতী হয়ে যাত্রা শুরু করেছি পথে পথে, উদ্যান থেকে উদ্যানে, মহল্লা থেকে মহল্লায়।

প্রথমেই শাহবাগ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা পেলাম শ্যামলী নিসর্গের কিছু বৃক্ষসখার। শুরুতেই এই এলাকা বেছে নিয়েছি এ কারণে যে, ঢাকা শহরের পুরনো বৃক্ষাদির সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও শাহবাগের একটা সম্বন্ধ আছে। উনিশ শতকের শেষভাগে বর্তমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রশিক্ষক কেন্দ্র, কলা ভবন, চারুকলা অনুষদ ও বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর সংলগ্ন এলাকা নিয়ে বিস্তৃত ছিল ঢাকার নবাবদের বাগানবাড়ি। তবে, তারও আগে মুগল আমলে বর্তমান শাহবাগ এবং বর্তমান হাইকোর্ট ও বাংলাদেশ শিশু একাডেমি সংলগ্ন এলাকায় ছিল ‘বাগ-ই-বাদশাহী’। আর বর্তমান বাংলা একাডেমি ও টিএসসি এলাকায় একসময় ছিল সুজাতপুর নামের অভিজাত আবাসিক এলাকা। এই ‘বাগ-ই-বাদশাহী’ ও সুজাতপুরের মাঝে বিস্তীর্ণ খোলা মাঠটি রমনা নামে পরিচিত ছিল। ঢাকায় মুগল রাজধানী প্রতিষ্ঠা করা বাংলার মুগল সুবাদার ইসলাম খান চিশতীর বিখ্যাত সেনাপতি মির্যা নাথানের লেখা ‘বাহরিস্তান-ই-গায়েবী’ গ্রন্থের এক বর্ণনা থেকে এই ‘বাগ-ই-বাদশাহী’র কথা জানা যায়। মুগল আমলের ‘বাগ-ই-বাদশাহী’র মতোই পরবর্তীকালের ঢাকার নবাবদের ‘শাহবাগ’ বাগানবাড়িও ছিল সুসজ্জিত। সেখানে দেশ-বিদেশ থেকে অনেক রকমের গাছপালা এনে তারা লাগিয়েছিলেন। হয়ত সেসব দুর্লভ ও মূল্যবান গাছের কিছু বংশধর আজও সেখানে টিকে আছে! অনেকটা সে অনুসন্ধাানে প্রবৃত্ত হয়েই ‘রাজার বাগান’ অর্থাৎ ‘শাহবাগ’ থেকেই শুরু করলাম ঢাকা শহরের বৃক্ষ বৃত্তান্ত।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শামসুন্নাহার হলের পূর্বদিকে প্রাচীন বুদ্ধ-নারকেল গাছ। আলোকচিত্র: লেখক।

যুগলবন্দী বেরিয়া ও বুদ্ধ-নারকেল

অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মা ১৯৬৫ সালে ঢাকা শহরে দুষ্প্রাপ্য বুদ্ধ-নারকেল ও বেরিয়া গাছের দেখা পেয়েছিলেন ঢাকা বিশ্বদ্যিালয়ের টিএসসির পশ্চিম পাশে যে রাস্তাটি বকশি বাজারের দিকে গেছে তার পাশে। তিনি শ্যামলী নিসর্গ বইয়ে গাছটির অবস্থান বর্ণনা করে লিখেছেন: ‘‘ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের পশ্চিম পাশে বকশি বাজার রোডের যে অংশ রেসকোর্স রোড থেকে শুরু হয়েছে, সেখানে দাঁড়ালে যে কটি দীর্ঘ পথতরু আমাদের চোখে পড়ে আপাতদৃষ্টিতে তাদের সবাইকে একই প্রজাতিভুক্ত বলেই মনে হয়। অবশ্যই ধারণাটি যুক্তিযুক্ত। এখানকার গাছের দুটি প্রজাতির মধ্যে সাদৃশ্য এতই স্পষ্ট যে পেশাদার বিজ্ঞানী কিংবা বর্ষব্যপ্ত পর্যবেক্ষণ ছাড়া তাদের পার্থক্য নির্ণয় করা কঠিন। এদের একটি বুদ্ধ-নারকেল, অন্যটি বেরিয়া।’’ এ দুটি গাছই রয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি চত্বরে।

দ্বিজেন শর্মা বেরিয়ার কোনও বাংলা নাম খুঁজে পাননি। গাছটিই যেখানে দুষ্প্রাপ্য, সেখানে বাংলা ভূখণ্ডে এ গাছের কেই-বা বাংলা নাম দেবেন? বাংলাদেশের উদ্ভিদ নামকরণের অভিধান বইটিতে খুঁজতে খুঁজতে শেষে বেরিয়ার একটি বাংলা নাম পেয়ে যাই—‘চাবানদালাই’।

সৌভাগ্য যে টিএসসির সামনে গিয়ে বুদ্ধ-নারকেল আর বেরিয়ার সেই যুগল স্বরূপের দেখা পেলাম, গাছ দুটো এখনও টিকে রয়েছে। শীতকালে সে গাছ দুটোকে দেখে অবশ্য কিছুটা বিভ্রান্তও হয়েছিলাম। তখন গাছ দুটোতে না ছিল কোনও ফুল, না ছিল ফল। তাই কোনটি বেরিয়া আর কোনটি বুদ্ধ-নারকেল তা সঠিকভাবে চিনতে বেশ কষ্ট হচ্ছিল। কোন কৌতুহলে কোন তরুপ্রেমিক ঢাকা শহরে একই জায়গায় কেন যে এ দুটি গাছ লাগিয়েছিলেন তা জানা নেই, কিন্তু তিনি নিঃসন্দেহে যে একজন রসিক মানুষ ছিলেন তাতে কোনও সন্দেহ নেই। রমনা উদ্যানের মধ্যে থাকা বুদ্ধ-নারকেলগাছও অনেক বড়, সে সময়কালে হয়ত তিনিই লাগিয়েছিলেন সেখানে। এ দুটো গাছই দেখতে প্রায় এক রকম হলেও ওদের গুষ্টিগোত্র সবই আলাদা। একটা পাটগাছের সহোদর, অন্যটি জংলিবাদাম বা কৌট্টাবাদামের ভাই। গাছ দুটিতে ফুল-ফল ধরলেই সে পার্থক্য সহজে চোখে পড়ে। বুদ্ধ-নারকেলের ফল বড় ও শক্ত কাঠের মতো খোলাযুক্ত এবং বেরিয়ার ফল ছোট ও ডানাওয়ালা।

বেরিয়ার শুকনো ফল ও পাতা। আলোকচিত্র: লেখক।

দ্বিজেন শর্মা বেরিয়ার কোনও বাংলা নাম খুঁজে পাননি। গাছটিই যেখানে দুষ্প্রাপ্য, সেখানে বাংলা ভূখণ্ডে এ গাছের কেই-বা বাংলা নাম দেবেন? বাংলাদেশের উদ্ভিদ নামকরণের অভিধান বইটিতে খুঁজতে খুঁজতে শেষে বেরিয়ার একটি বাংলা নাম পেয়ে যাই—‘চাবানদালাই’। বেরিয়ার উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম Berria cordifolia ও গোত্র টিলিয়েসি। বেরিয়া নামাংশ জনৈক চিকিৎসক এনড্রু বেরিয়ার নামের সারণিক। বেরিয়া এ গাছের জেনাস বা গণগত নাম, ইংরেজি নাম ভিন্ন। শ্রীলংকায় এ গাছের কাঠ বেশ জনপ্রিয়। এজন্য কিনা জানি না, এর ইংরেজি নাম হয়েছে ‘Trincomali wood’। বেরিয়াগাছ প্রায় ২০ মিটার লম্বা হয়। পানপাতার মতো পাতা, বড়, থোকা ধরে সাদাটে গোলাপি ফুল ফোটে গ্রীষ্ম-বর্ষায়। ফুল খুব ছোট হলেও তার শাখায়িত মঞ্জরির অজস্র প্রস্ফুরণ গাছকে শোভাময় করে তোলে। সাদা পাপড়ির সঙ্গে সোনালি হলুদ পরাগচক্র এ ফুলের আসল সৌন্দর্য। ফলের সঙ্গে বৃতিগুলো স্থায়ীভাবে লেগে থাকে। ঘন বাদামি ও ফুলের মতো সেগুলোও থাকে অজস্র। ছোট্ট গোলাকৃতি শক্ত কাঠের মতো ফলের চারদিকে বিক্ষিপ্ত পাপড়ির মতো ছয়টি শুকনো পাখনা বা ডানা থাকে।

বেরিয়ার পাতা। আলোকচিত্র: লেখক।

বেরিয়া গাছ মূলত আসবাবপত্র তৈরির কাঠের জন্য ব্যবহার করা হয়। প্রাচীনকালে জাহাজ নির্মাণের জন্য এ গাছের কাঠের কদর ছিল। কেননা বেরিয়াগাছের গুড়ি সরল, লম্বা, উন্নত, ধূসর, মসৃণ ও মজবুত। এ গাছের গোড়া থেকে অনেকটা উঁচু পর্যন্ত কোনও শাখা বা ডালপালা থাকে না। চারা বাড়ে ধীরগতিতে, কিন্তু একবার বড় হয়ে উঠলে তখন গাছ দ্রুত বাড়ে। বীজ ও শিকড় থেকে বের হওয়া চারা (সাকার) দিয়ে বংশবৃদ্ধি করা যায়। বেরিয়ার বীজগুলো বেশ যন্ত্রণাদায়ক। কেননা, বীজের গায়ে শক্ত যে শুঁয়ো থাকে, হাত গিয়ে ধরলে বা গায়ে লাগলে সেগুলো ত্বকে ফুটে যন্ত্রণা দেয়।

এ গাছ বেশ কষ্ট সইতে পারে। তবে এ গাছ জলাবদ্ধতা সইতে পারলেও খরা সইতে পারে না। অনুর্বর মাটিতে জন্মাতেও তার আপত্তি নেই। যত্ন না নিলেও অরণ্যবৃক্ষের মতো অনাদরে বাড়ে। দক্ষিণ এশিয়া বেরিয়ার জন্মস্থান। বিশেষ করে দক্ষিণ চীন, ভারতীয় উপমহাদেশ, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, লাওস, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও অস্ট্রেলিয়ায় বেরিয়া গাছ রয়েছে। আফ্রিকাতেও এখন এ গাছ ছড়িয়ে পড়েছে। অস্ট্রেলিয়ার ক্রিসমাস দ্বীপের অরণ্যে এ গাছ দেখা যায়। তবে বাংলাদেশে এটি দুষ্প্রাপ্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির চত্বর ছাড়া ধানমন্ডির পুরনো ২২ নম্বর রোডে আবাহনী মাঠের সঙ্গের এলাকায় বেশ কয়েকটি বড় বেরিয়া গাছ আছে বলে উল্লেখ করেছিলেন নিসর্গী দ্বিজেন শর্মা তাঁর শ্যামলী নিসর্গ বইয়ে। বর্তমান ১২/এ নম্বর রোডের ৮৩ ও ৮৭ নম্বর বাড়ির সামনের ফুটপাতের উপর তিনটি বেরিয়াগাছ এখনও ওদের অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে। আকাশ ছোঁয়া ভবন গড়ার ভিড়ে এখনও পুরনো সেসব গাছ টিকে যে আছে কীভাবে, সেটিই বিস্ময়কর।

বুদ্ধ-নারকেলের ডালে ঝুলন্ত ফলের খোসা। আলোকচিত্র: লেখক।

নির্মাণাধীন ৮৭ নম্বর বাড়ির গার্ড মো. খলিলুর রহমান ফটকের বাইরেই দাঁড়িয়েছিলেন। তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ও গাছটা চেনেন? বললেন, চিনি। ওটা তো সেগুন গাছ, ভালো ফার্নিচার হয়। ওর দোষ কি? কিছুদিন আগে তো আমিই বেরিয়াগাছ চিনতাম না। তার ভুল শুধরে দিয়ে লাভ কী? তবু কি মনে করে জানি না, তাকে বললাম— এটি ঢাকার দুষ্প্রাপ্য গাছের একটি। সাকুল্যে ঢাকা শহরে এ গাছের দেখা পেয়েছি পাঁচটি, তার তিনটেই আপনাদের এ সড়কে, নাম বেরিয়া। গাছটার দিকে তাকিয়ে বললেন, হবে হয়তো। ফের জানতে চাইলাম, এমন দুষ্প্রাপ্য গাছ, অথচ তার দিকে কারও কোনও নজর নেই, কারা কেটেছে? প্রাচীন বৃক্ষ হলেও তার মাথার সব ডালগুলো কেটে ফেলা হয়েছে। খর্বাকৃতি সেসব গাছ দেখে কে বলবে যে সেগুলো ষাট বছর আগেও সেখানে ছিল! গাছগুলো এখনও আপনশক্তি বলে চরম সহ্যক্ষমতা প্রদর্শন করে কোনওমতে টিকে আছে। তার গোড়াটুকু বাদে সবটুকুই তো টাইলস আর কংক্রিটে ঢাকা। বৃষ্টির জল তার মাটিতে ঢুকবে কোথা দিয়ে? শিকড়গুলো তো পিপাসাতেই মরে যাবে! বেরিয়া গাছ তিনটির আসন্ন মৃত্যুর চিন্তা আমাকে বিমর্ষ করে তুলল। খলিল জানালেন, মাস দেড়েক আগে বিদ্যুৎ বিভাগের লোকজন এসে ওভাবে গাছগুলোকে ন্যাড়া করে দিয়েছে। ডালগুলো বড় হয়ে সেগুলো বিদ্যুতের তার স্পর্শ করলে তা পথচারীদের জন্য দুর্ঘটনার কারণ হবে। তাই ঝুঁকি কমাতে তারা গাছগুলোর এ দশা করেছে। আজ ডাল ছেটেছে, কাল হয়ত গাছগুলোই কেটে ফেলবে, আর হারিয়ে যাবে ঢাকা শহরের সুদর্শন পথতরু বেরিয়া।

টিএসসির সামনে বেরিয়ার আর এক সাথী দাঁড়িয়ে রয়েছে, তার নাম বুদ্ধ-নারকেল বুদ্ধ-নারকেলের উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম Pterygota alata ও গোত্র স্টারকুলিয়েসি, ইংরেজি নাম ‘Buddha coconut’। গ্রিক শব্দ টেরিগোটা অর্থ পক্ষাকৃতি, আর লাতিন শব্দ অ্যালাটা অর্থ পক্ষল। এর বীজ পাখা বা ডানাযুক্ত বলে এরূপ উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম। জংলি বাদাম ও সুন্দরীগাছও এর সমগোত্রীয়। নামটা বুদ্ধ-নারকেল হলেও নারকেল গাছের সঙ্গে এর কোনও মিল নেই। বর্ষার শেষে গাছে ঘন সবুজ পাতার ফাঁকে থোক ধরে নস্যি বাদামি রঙের ফলগুলো দেখতে কিছুটা নারকেলের মতো বলে এর এরূপ বাংলা নাম রাখা হয়েছে। ঢাকা শহরে থাকা বুদ্ধ-নারকেল গাছ আছে হাতে গোনা কয়েকটি। সত্তরের দশকেও টিএসসির আশেপাশে তিনটি বুদ্ধ নারকেল গাছ ছিল বলে জানা যায়। এগুলোর মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় টিএসসির সামনে থাকা গাছটি প্রাচীন, এক সময় অনেক লম্বা ছিল। ঢাকা শহরে অত উঁচু গাছ আর দেখাই যায় না।

বুদ্ধ-নারকেলের পাতা ও শুষ্ক ফল। আলোকচিত্র: লেখক।

কিন্তু গত বছর গাছটির উপরের অংশ ভেঙে পড়ে। ২০২৩ সালের ৭ সেপ্টেম্বর বিকালে হঠাৎ ঝড়ে গাছটির মাঝখান থেকে ভেঙে নিচে রাস্তায় কয়েকটা রিকশার উপর পড়ে। এতে শফিকুল ইসলাম নামে একজন রিকশাচালক মারা যান বলে জানালেন টিএসরি নিরাপত্তা কর্মী মো. আব্দুল কাদের। ঝুঁকির কারণে যতটুকু গাছ এখন আছে সেটাও কেটে ফেলা হবে বলে শুনেছেন তিনি। অবশ্য সেই বুদ্ধ-নারকেল গাছটিকে রক্ষার জন্য গাছের গায়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবেশ সংসদ একটি সাইনবোর্ড লাগিয়ে সবাইকে সে গাছটি রক্ষার আহ্বান জানিয়েছে। সেখানে লেখা আছে, ‘বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন ২০১২’-এর তফসিল ৪ অনুযায়ী বুদ্ধ-নারকেল গাছকে সংরক্ষিত উদ্ভিদ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।

টিএসসির এ বুদ্ধ-নারকেল গাছটি রয়েছে বিপন্নের ঝুঁকিতে। তাছাড়া এ গাছটি কালের সাক্ষীও। ঢাকা শহরে প্রাচীন যেসব বৃক্ষ রয়েছে সেগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম। অবশ্য আরও একটি প্রাচীন বুদ্ধ-নারকেল গাছ রয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি থেকে বকশি বাজারের দিকে যেতে রাস্তার পশ্চিম দিকে শামসুন্নাহার হলের দেয়ালের কোলে। এত উঁচু গাছ ঢাকায় বিরল। বুদ্ধ-নারকেলের আরও একটি বড় গাছ আছে রমনা উদ্যানের ভেতরে। ঢাকার মিরপুরে জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানেও আছে কয়েকটি বুদ্ধ-নারকেল গাছ। এক সময় আজিমপুরে ইডেন গার্লস ডিগ্রি কলেজের পশ্চিম দিকে বুদ্ধ-নারকেল গাছের একটি দীর্ঘ বন ছিল। শহর সম্প্রসারণ আর নির্মাণ কাজে সে বীথি আজ নিশ্চিহ্ন হয়েছে।

বুদ্ধ-নারকেল গাছের গোড়া। আলোকচিত্র: লেখক।

মাঘের শেষে একদিন টিএসসির সামনে ও পাশের বুদ্ধ-নারকেল গাছগুলোতে দেখলাম, ফাটা ফলের শুকনো শক্ত খোসাগুলো ঝুলছে। কিছু পাতা হলদে হয়ে ঝরে গেছে, কিছু ঝরার অপেক্ষায় রয়েছে, আবার বসন্তের আভাসে গাছে ডালের আগায় নস্যি রঙের বুটি বুটি ফুলের কুঁড়ি এসেছে। রাজু ভাস্কর্য চত্বরেও আছে আর একটি অপেক্ষাকৃত অনেক তরুণ বুদ্ধ-নারকেলগাছ। সে গাছেও কুঁড়ি এসেছে। ফুল ফুটবে বসন্তে, ফল ধরবে গ্রীষ্ম-বর্ষায়। মূলত বসন্তের শুরুতে শুরু হয় বুদ্ধ-নারকেল গাছের পাতা ঝরা, সব পাতা না ঝরা পর্যন্ত তা চলতে থাকে। চৈত্রে পুরোপুরি নিষ্পত্র সে। এ সময় পাতাবিহীন শাখায় শাখায় ঝুলতে থাকে শুকনো ফলের খোসা আর ফুটতে থাকে ছোট ছোট ফুল। ফুল দুর্গন্ধযুক্ত। আসলে বুদ্ধ-নারকেল ফুলের কোনও আকর্ষণ নেই। ফুল ফোটেও কম। এরপর গ্রীষ্মের আগমনে ডালে ডালে আসে নতুন পাতা। ঘন পত্র-পল্লবে ঢেকে যায় নিরাভরণ ডালগুলো। সেসব পাতার ফাঁকে ফাঁকে ঝুলতে থাকে ফল। বর্ষার পর ফল ফেটে চারদিকে তার বীজ ছড়িয়ে পড়ে। বীজ ডানাযুক্ত ও বাতাস ওদের ভাসিয়ে ভাসিয়ে দূরে নিয়ে যায়। এর বীজ কোনও কোনও দেশে আফিমের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এর কাঠও মূল্যবান।

বুদ্ধ-নারকেল গাছ হয় অনেক লম্বা, বেরিয়া গাছ তার তুলনায় খাটো। ঢাকায় বোটানিক্যাল গার্ডেনের মধ্যে বন বিভাগের নার্সারির মালি মোজাম্মেল বলেছিলেন, গ্রামে, বিলপাড়ে বা বড় মাঠের পাশের কিছু বুদ্ধ-নারকেল গাছ লাগানো ভালো। এ গাছ এত লম্বা হয় যে, সেগুলো বাজ পড়ার হাত থেকে জীবনকে রক্ষা করতে পারে, এর চারাও এখন সুলভ। তাই বলে গাছ নিজের জীবন দিয়ে মানুষের জীবন বাঁচাবে! মহাকালের ইতিহাস যে গাছদের নিয়তিতে তাই লিখে রেখেছে! শত সহস্র ঝড়-ঝঞ্ঝার হাত থেকে চিরকাল ওরা আমাদের রক্ষা করে চলেছে নিজেদের জীবন বাজি রেখে, চুলার লাকড়ি আর শোবার ঘরে খাটের কাঠের যোগান তো ওরাই যোগায়! গাছের নিজেদের জীবন উৎসর্গ করে প্রতিনিয়ত যেসব মানুষের সেবা করে চলেছে, সেসব মানুষদের কাছ থেকে ওরা কি পাচ্ছে? অবহেলা আর অযত্ন ওদের যেন নিত্য সাথী। ঢাকা শহরের বেরিয়া ও বুদ্ধ-নারকেল গাছগুলোই সে অবহেলার জীবন্ত সাক্ষী।

ইটকাঠের জঙ্গলে জংলিবাদাম

জঙ্গলের জংলি বাদাম যখন শহরে দেখা যায় তখন কিছুটা অবাক হতে হয় বৈ কি! রাজধানী ঢাকা শহরেই ছিল ও এখনও আছে জংলিবাদামের গাছ। নিসর্গী দ্বিজেন শর্মা তাঁর ‘শ্যামলী নিসর্গ’ বইয়ে ঢাকা শহরে ১৯৬৫ সালে থাকা জংলিবাদামের খোঁজ দিতে গিয়ে লিখেছেন: ‘‘ঢাকায় জংলিবাদাম দুষ্প্রাপ্য। তেজগাঁর পলিটেকনিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজের ফটকে ও আজিমপুর প্রসূতি সদনের সামনের দুটি গাছ শহরে এই তরুর প্রতিনিধি।’’ জংলিবাদামের আদি নিবাস নিরক্ষীয় আফ্রিকা থেকে অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত। বাংলাদেশে কবে কখন কে জংলিবাদামের গাছ এনেছে তার হদিস পাওয়া দুষ্কর। তবে ঢাকা শহরের কয়েকটি স্থানে প্রাচীন কয়েকটি জংলিবাদামের গাছ দেখে মনে হয় এ গাছ কয়েক শতক আগেই এ দেশে প্রবেশ করেছে, অনেকের বাড়িতেও আছে। এ দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে এসব গাছ বেশি দেখা যায়। বর্তমানে ফার্মগেটে তুলা ভবনের পেছনে ‘আ কা মু গিয়াস উদ্দীন মিল্কি অডিটরিয়াম’-এর সামনের প্রবেশমুখে একটি প্রাচীন জংলিবাদাম গাছ রয়েছে। নবীন একটি জংলিবাদাম গাছ রয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের বোটানিক্যাল গার্ডেনে। ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি গিয়ে সে গাছটিতে দেখলাম, কোনও ডালে একটাও পাতা নেই। শীতে ধরাশায়ী সে গাছটা যেন মরার মতো দাঁড়িয়ে আছে। নিষ্পত্র সেসব ডালে ডালে ঝুলছে ফেটে যাওয়া ফলের শুষ্ক খোসাগুলো।

খামারবাড়ির পাশে মিল্কি অডিটরিয়ামের সামনে জংলিবাদামের গাছ। আলোকচিত্র: লেখক।

বুদ্ধ-নারকেলের অন্য সহোদর হলো জংলিবাদাম, কেননা দুটো গাছই এক গোত্রের অর্থাৎ স্টারকুলিয়েসি গোত্রের। এর ইংরেজি নাম Box nut, যার বাংলা করলে দাঁড়ায় ‘বাক্স বাদাম’ বা ‘কৌট্টা বাদাম’। এ দেশে এ দুটি স্থানীয় নামেরই প্রচলন আছে। তবে গ্রামে কারও কারও কাছে এর বাদাম বা বীজ পেস্তাবাদাম নামে পরিচিত যা সঠিক নয়। কৌট্টা বা বাক্সের মতো শক্ত খোসার ভেতরে এই বাদাম বন্দী থাকে বলে এর নাম কৌট্টাবাদাম বা বাক্সবাদাম। জংলি বাদামের উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম স্টারকুলিয়া ফোটিডা (Sterculia foetida) ও গোত্র স্টারকুলিয়েসি। রোমানদের ফার্টিলাইজার বা সারের দেবতা স্টারগুইলিনাসের নামানুসারে এর গণের নামকরণ করা হয়েছে স্টারকুলিয়া, আর লাতিন ফোটিডা শব্দটির অর্থ দুর্গন্ধি। এর ফুলের গন্ধ উগ্র ও দুর্গন্ধযুক্ত। এসব সাযুজ্যে এর উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম এরূপ রাখা হয়েছে।

জংলিবাদামের গাছ বহুবর্ষজীবী বড় বৃক্ষ প্রকৃতির। গাছের ডালগুলো একটার পর একটা ঘূর্ণাবর্তে থাকে, কাঠ নরম। ডালের আগার দিকে পাতা জন্মে। পাতা উপবৃত্তাকার, বোঁটা খাটো, একটি পাতায় সাতটি পত্রক থাকে, অনেকটা শিমুল বা ছাতিম পাতার মতো দেখতে। মজার ব্যাপার হলো, জংলিবাদাম ফলের সঙ্গে মিল আছে বুদ্ধ-নারকেল ফলের, আর পাতার সঙ্গে মিল আছে শিমুল পাতার। তবে জংলিবাদামের পাতার পত্রকগুলোর আকার শিমুলের চেয়ে বড়। ফুল বা ফল না দেখলে এ গাছকে শিমুলগাছ বলে ভুল হতে পারে। শিমুলপাতার মতো এর পাতা করতলাকার ও সাত থেকে নয়টি পত্রকবিশিষ্ট। তবে শিমুলের চেয়ে জংলিবাদামের পাতার বোঁটা লম্বা।

শিমুলগাছের মতো এর কাণ্ডে কোনও কাঁটা নেই। শিমুলের সঙ্গে জংলিবাদামের মিলটা ফুল ফোটার কালে, দুটি ফুলই বসন্তে ফোটে। তবে একটির সঙ্গে অন্যটির ফুলের কোনও মিলই নেই। শিমুলের ফুল বড় ও টকটকে লাল, জংলিবাদামের ছোট ছোট ফুল ডালের আগায় ফোটে থোকা ধরে। ফুলের রঙ লাল হলুদ, সবুজাভ। তবে শিমুল আর জংলিবাদাম গাছের আর একটি মিল বিশেষভাবে লক্ষণীয়। তা হলো এ দুটি গাছে ফুল যখন ফোটে তখন গাছে একটি পাতাও থাকে না। জংলিবাদাম গাছে প্রতি বছর ফুল ফল ধরে ও পাতা ঝরে, বুদ্ধ-নারকেলেরও তাই।

জংলিবাদামের ফল ও বীজ। আলোকচিত্র: লেখক।

শীতে ফলগুলোর রঙ বদলে লাল হয়ে পেকে যায়। শীতের পর সেসব পাকা ফল ফেটে বীজগুলো গাছ থেকে আপনাআপনি ঝরে পড়ে মাটিতে, ফাটা ফলের কাঠের মতো শক্ত খোসাগুলো কালচে হয়ে শুকিয়ে ঝুলতে থাকে নিষ্পত্র গাছের ডালে ডালে। ফল শেষ হলে পাতাঝরা সেসব গাছে বসন্তে আবার ফুল ফুটতে শুরু করে। জংলিবাদামের ফুলগুলো দেখতে বেশ সুন্দর, তবে দুর্গন্ধি। যখন ছড়িয়ে অনেকগুলো সবুজ-বেগুনি ফুল ফোটে তখন তার শোভা হয় দেখার মতো। পুরুষ আর মেয়ে ফুল ফোটে আলাদা গাছে। বসন্তে ফুল ফোটে ও এরপর পাতা গজায়। ফুল ফোটার প্রায় এগারো মাস পর ফল পাওয়া যায়। অনেকেই এই বাদাম কাঁচা অবস্থায় খান, কিন্তু গবেষকদের পরামর্শ হলো সেগুলো ভেজে খাওয়া উচিত। কাঁচাবাদামে অনেক সময় বিষক্রিয়া হতে পারে।

রাঙা শিমুল ও শ্বেত শিমুলে বসন্তের আগমন

নিসর্গী দ্বিজেন শর্মা তাঁর ‘শ্যামলী নিসর্গ’ বইয়ে ঢাকা শহরে ১৯৬৫ সালে থাকা শিমুলগাছের অবস্থান নির্ণয়ে লিখেছেন: ‘‘আদি আবাস ভারত মহাদেশ ও মালয়। ঢাকায় শিমুলের সংখ্যা কম। গাছটি ভঙ্গুর এবং পথতরু হিসেবে আদর্শ নয়। শাহবাগের কাছে আজও যে কয়টি শিমুল বেঁচে আছে তাদের প্রস্ফুটনেই আমরা শহরে বসন্তের আগমনী লক্ষ্য করি।’’ তিনি সে সময় আরও সুনির্দিষ্টভাবে শিমুল গাছ দেখেছিলেন হোটেল শাহবাগের কাছে। আর একজন নিসর্গী বিপ্রদাশ বড়ুয়া তাঁর ‘গাছপালা তরুলতা’ বইয়ে ঢাকা শহরে শিমুলের অবস্থান আরও স্পষ্ট করেছেন। ২০১০ সালে তিনি লিখেছেন ‘‘ঢাকা শহরে বড় বড় তিনটি শিমুল গাছ আছে। একটি কাকরাইলের মোড়ে প্রধান বিচারপতির ফটকে, অন্যটি জাতীয় জাদুঘরের সামনে। জাদুঘরে শিমুলকে বীথি হিসেবে উত্তর সীমায় রোপণ করা হয়েছে। আর একটি পিজি ও সাকুরার মাঝামাঝি জায়গায়।’’

রাঙা শিমুল ফুল। আলোকচিত্র: লেখক।

এসব তথ্যের সূত্র ধরেই ঢাকা শহরে শিমুলের দেখা পেতে ওসব জায়গায় গিয়েছি। পিজি ও সাকুরার মাঝামাঝি জায়গার শিমুল গাছটি এখন নেই, জাদুঘরের সামনেরটা আছে। জাদুঘরের উত্তর সীমানায় যে এক সারি শিমুল বীথির কথা বলা হয়েছে, সেটি আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় টিএসসির মোড়ে রাজু ভাস্কর্যের প্রাঙ্গণে আছে একটি শ্বেতশিমুলের গাছ। এর অন্য নাম বর্মী শিমুল। ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি ওখানে গিয়ে দেখলাম, শ্বেত শিমুলের গাছগুলোতে কুঁড়ি এসেছে, ফুল ফোটাও শুরু হয়েছে। নামে শিমুল হলেও আমরা যাকে শিমুল বলে জানি তার ফুলের সঙ্গে এর কোনও মিল নেই। রাঙা শিমুলের ফুল টকটকে লাল ও বড়, শ্বেত শিমুলের ফুল সাদা ও ছোট। এ দুটি গাছের চেহারাতেও তফাৎ আছে। শিমুল গাছের কাণ্ড বড় বড় কাঁটায় ভরা, গোড়াটা ডানাযুক্ত। শ্বেত শিমুল গাছের কাণ্ড মসৃণ।  তবে দুটি গাছেই ফুল ফোটে বসন্তে যখন গাছে কোনও পাতা থাকে না। আর সব শিমুলই তুলা উৎপাদন করে, কিন্তু বালিশের জন্য আমরা কাজে লাগাই রাঙা শিমুল তুলাকে। তুলার বীজও কাজের।

শিমুল হলো বসন্তের দূত। শিমুলের উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম Bombax ceiba ও গোত্র বোম্বাকেসি। ইংরাজি নাম Cotton tree, Malabar silk-cotton tree; Red silk-cotton; Red cotton tree; বহুবর্ষজীবী বৃক্ষ প্রকৃতির এই গাছ এ দেশের গ্রামীণ অঞ্চলে বেশ দেখা গেলেও ঢাকা শহরে শিমুলের দেখা পাওয়া যেন সৌভাগ্যের ব্যাপার। শিমুল শাখায় বসন্ত দূত কোকিলের ডাক শোনা ঢাকায় ভাগ্যের বিষয়। ছোট থাকতে শিমুলগাছের কাণ্ডের গায়ে প্রচুর বড় বড় ফোঁড়ার মতো শক্ত কাঁটা হয়। এটিও যেন তার বেঁচে থাকার এক প্রাকৃতিক সুরক্ষা কবচ। কাঁটার ঘায়ে ক্ষত বিক্ষত হওয়ার ভয়ে হয়ত গবাদি প্রাণি তরুণ শিমুল গাছ খায় না বা নষ্ট করে না। গাছ বড় হলে আর ওদের গায়ে কাঁটা থাকে না। শিমুলগাছ গড়ে ২০ মিটার লম্বা হয়, তবে ৬০ মিটার পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। বড় গাছের গোড়ায় ডানার মতো অধিমূলের বিস্তার ঘটে। পাতা করতলাকার, একটি পাতায় সাধারণত ছয়টি পত্রক থাকে, প্রতিটি পত্রক ৭ থেকে ১০ সেন্টিমিটার লম্বা, অগ্রভাগ সূঁচালো।

কুঁড়ি ও ফুলসহ রাজু ভাস্কর্য চত্বরে শ্বেত শিমুল গাছ। আলোকচিত্র: লেখক।

উদ্ভিদজগতে চারটি গাছ বছরে দুই মাস উলঙ্গ থাকে। গাছ চারটি হলো— শিমুল, শ্বেত শিমুল, পলাশ ও মাদার বা পারিজাত। পত্রহীন ডালপালায় লজ্জা নিবারণের জন্য প্রকৃতিমাতা বসন্ত ঋতুতে তাদের গায়ে ফুলের পোশাক পরিয়ে দেয়। ফুল্ললিত অপূর্ব শোভায় গাছগুলোর সর্বাঙ্গে যেন জ্বলে ওঠে কামনার আগুন। সে আগুনে তাদের সঙ্গ কামনায় উদ্বেল হয়ে ওঠে মানুষ, কবি, পাখি, ভ্রমর, মৌমাছি ও পিঁপড়ে। কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত পুত্রশোকে রাবণের শোকাতুর মনের ভাব প্রকাশ করেছিলেন শিমুলের রক্তরাঙা রূপের মধ্য দিয়ে: ‘‘কাটিলা কি শাল্মলী তরুবরে ফুলদল দিয়া।’’ কাজী নজরুল ইসলামের দোলন-চাঁপা কাব্যের আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে কবিতাতেও রয়েছে সেই শিমুলের প্রশস্তি:

‘‘আজ    হাস্ল আগুন, শ্বস্ল ফাগুন,
মদন মারে খুন-মাখা তুণ
পলাশ আশোক শিমুল ঘায়েল
ফাগ লাগে ঐ দিক্-বাসে
গো      দিগ্বালিকার পীতবাসে;’’

দেবতারাও মোহিত হয়েছেন শিমুলের রূপে। স্বর্গের উদ্যানেও ছিল শিমুল-মাদারের গাছ। শিমুল ফুলের পুরুষ্ট লাল পাঁচটি পাঁপড়ির উজ্জ্বলতা বসন্ত প্রকৃতিতে যেন আগুন ধরিয়ে দেয়। অনেক দূর থেকেও সে রূপ দেখা যায়। পেয়ালা আকৃতির ফুল ফোটে ডাল ভরে একটা একটা করে বা থোকায়। সাধারণত ফুলগুলো থাকে ডালের আগার দিকে। ফুলের মধ্যে থাকা জননকেশরগুলো শক্ত সুতার মতো খাড়া থাকে। ফল ক্যাপসুলের মতো, লম্বাটে, কাঁচা ফলের রঙ সবুজ। পাকলে ফল ফেটে যায় ও তার ভেতর থেকে সাদা রেশমি তুলার আঁশ নিয়ে বীজগুলো বাতাসে ভেসে ভেসে চলে যায় দূর থেকে দূরে।

শ্বেত শিমুলের শাখা। আলোকচিত্র: লেখক।

শ্বেত শিমুলের উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম Ceiba pentandra ও গোত্র মালভেসি। অন্য নাম সাদা শিমুল বা বর্মী শিমুল। ইংরেজি নাম Java cotton, Java kapok, Silk-cotton। বড় বৃক্ষ, কাণ্ডের রঙ সবুজাভ, ফুল আড়াই সেন্টিমিটার চওড়া। পাতা শিমুলের পাতার মতই সাতটি পত্রকবিশিষ্ট করতলাকার, তবে শিমুলের চেয়ে শ্বেত শিমুলের পাতা ছোট। ফল লম্বা, দেখতে অনেকটা ধুন্দলের মতো, ৭ থেকে ১২ সেন্টিমিটার লম্বা, সবুজাভ। বড় গাছে ঠেকনামূল হয়, ছোট গাছে থাকে না। শ্বেত শিমুল এসেছে দক্ষিণ ও মধ্য আমেরিকা থেকে। তবে এশিয়া ও আফ্রিকার অনেক দেশে এদের দেখা যায়। বৈশাখে ফল পাকলে ফেটে যায় ও বীজের গায়ে জড়ানো তুলায় ভর করে বীজ বাতাসে ভেসে ভেসে অনেক দূরে চলে যায়। শ্বেত শিমুলের বীজ থেকে সহজে চারা হয়, ডাল কেটে মাটিতে পুঁতে দিলে তা থেকেও গাছ হয়।

ষাটের দশকে সবুজ বিপ্লবের সারথী নোবেলজয়ী ড. নরম্যান বরলগ্ বলেছিলেন, ‘‘গাছ কথা বলে ফিসফিস করে। তা বুঝতে হলে তার খুব কাছাকাছি থাকতে হবে।’ আমরা কি যাব তার কাছে? শুনব আজ সে ভাষা, গাছেদের সেসব প্রাণের কথা? নিজের মানুষের কাছে যাওয়াই তো আমরা ছেড়ে দিয়েছি, আর গাছের কাছে যাব কখন?

আমরা সাধারণত শিমুল বলতে রাঙা শিমুলকেই বুঝি। বিপ্রদাশ বড়ুয়া আরও এক রকম শিমুলের উল্লেখ করেছেন যার নাম ‘কূট শিমুল’। এটি কূটে অর্থাৎ পাহাড়ে জন্মে, পাহাড়ের চূড়ায় এসব গাছ সাধারণত দেখা যায়। ভারতে দাক্ষিণাত্যের সমুদ্র তীরবর্তী নিচু পাহাড়ে কূট শিমুল বা পাহাড়ি শিমুল প্রচুর দেখা গেলেও ঢাকায় চোখে পড়ে না। কূট শিমুলের কাণ্ডে ও শাখায় কাঁটা হয় না, ফুল বড় ও হলুদ। এর বাংলা নাম গোলগোল বা সোনালী শিমুল, সংস্কৃত নাম ‘কূট শাল্মলী’। এ গাছের আঠা বাজারে বিক্রি হয়, মুচিরা ব্যবহার করেন। কূট শিমুলের বীজ সেঁকে খাওয়া যায়। চমৎকার বীথি হয় কূট শিমুলের। কূট শিমুলের উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম Cochlospermum religiosum ও গোত্র কোচলোস্পারমাসি। ইংরেজি নাম Golden Silk cotton tree or Buttercup tree। কেননা, এর সোনালী হলুদ ও উজ্জ্বল ফুল দেখতে বাটারকাপ বা পেয়ালার মতো। থেরাবাদী বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের কাছে কূট শিমুল এক পবিত্র গাছ।

১৯৮০ সালে বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত নিসর্গী দ্বিজেন শর্মার লেখা ‘শ্যামলী নিসর্গ’ বইটির প্রচ্ছদ।

বৃক্ষ আমার চিরসখা

ষাটের দশকে সবুজ বিপ্লবের সারথী নোবেলজয়ী ড. নরম্যান বরলগ্ বলেছিলেন, ‘‘গাছ কথা বলে ফিসফিস করে। তা বুঝতে হলে তার খুব কাছাকাছি থাকতে হবে।’’ আমরা কি যাব তার কাছে? শুনব আজ সে ভাষা, গাছেদের সেসব প্রাণের কথা? নিজের মানুষের কাছে যাওয়াই তো আমরা ছেড়ে দিয়েছি, আর গাছের কাছে যাব কখন? আজ বড্ড বেশি আপন হয়ে গেছে একালের গেজেটগুলো, যান্ত্রিকতা আমাদের দেহ-মনকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে, আবেগ আর অনুভূতিগুলো ফিকে হয়ে আসছে। এই আসক্তি থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য হলেও আমাদের ফিরে যেতে হবে প্রকৃতিমাতার কোলে, আমাদের চিরসখা তরুদের কাছে। এই পুনঃসংযোগ যতটা দ্রুত করতে পারব, ততই তা আমাদের জন্য মঙ্গলজনক হবে।

লেখক: কৃষিবিদ ও প্রকৃতিবিষয়ক লেখক।
ইমেইল: kbdmrityun@gmail.com

মৃত্যুঞ্জয় রায়। প্রতিকৃতি অঙ্কন: সব্যসাচী মজুমদার।
ad

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত