মুদ্রা বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে যে সব হাতিয়ার রয়েছে, তার মধ্যে প্রধান হচ্ছে রেপো সুদের হার। দেশের অর্থনীতি স্থিতিশীল থাকায় এই হারটি বেশ কয়েক বছর ধরে ৪.৭৫ শতাংশে স্থির ছিল। ইউক্রেইন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল, খাদ্য, সারসহ বিভিন্ন পণ্যের দাম বেড়ে গেলে দেখা দেয় মূল্যস্ফীতি। ফলে পশ্চিমাদের সংকটের ঘা এসে পড়ে আমাদের উপর; আমাদের অর্থনীতিতে যুক্ত হয় আমদানিকৃত মূল্যস্ফীতি।
এমন অবস্থা মোকাবেলা করার জন্য ২০২২ সালের মে মাসে কেন্দ্রীয় ব্যাংক রেপো রেট ০.২৫ শতাংশ বৃদ্ধি করে ৫ শতাংশ করে। অনেক বছর পর দেশে নীতি সুদ হার বাড়ে। নীতি সুদ হার যখন বাড়ানো হয়, তখন মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৬.২৯ শতাংশ, যা সরকারের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে মাত্র এক শতাংশ উপরে ছিল। একই সময়ে ইউরোপ-আমেরিকায় মূল্যস্ফীতির হার ১০ শতাংশ ছাড়িয়ে গিয়েছিল। এত মূল্যস্ফীতি পশ্চিমা বিশ্ব ১৯৭৩ সালের মধ্যপ্রাচ্য সংকটের পর আর দেখেনি। জুন ২০২৩ পর্যন্ত আমাদের রেপো রেট আরও এক শতাংশ বাড়িয়ে ৬ শতাংশে উন্নীত করা হয়। এ সময়ের মধ্যে মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৯.৭৪ শতাংশে উঠে যাওয়ায় সুদের হার বাড়িয়ে তা নিয়ন্ত্রণ করার দাবি জোরাল হয়।
২০০৯ সাল থেকে ক্রমবর্ধমান উচ্চ হারের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ফলে বিনিয়োগের চাহিদা বেড়ে গিয়েছিল অনেক। কার্যকর মূলধন বাজারের অনুপস্থিতে বেসরকারি বিনিয়োগের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ জোগান দেওয়ার একমাত্র উৎস ব্যাংক ঋণ। ক্রমবর্ধমান বিনিয়োগ চাহিদা মেটাতে ২০২০ সালের পূর্বে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে ঋণের সুদের হার ১৭/১৮ শতাংশ পর্যন্ত উঠে গিয়েছিল। ১৭/১৮ শতাংশ সুদ হারে ঋণ নিয়ে করা বিনিয়োগ টেকসই হয় না। এতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মুনাফা আসমানে উঠলেও ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে বিনিয়োগকারীরা; বাড়ে পণ্য উৎপাদন খরচ।
এ সমস্যা সমাধানের জন্য সরকার উদ্যোগী হয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করে জামানতের সুদের হারের সর্বোচ্চ সীমা ৬ শতাংশ এবং ঋণের সুদ হারের সর্বোচ্চ সীমা ৯ শতাংশ নির্ধারণ করে দেয়। এ ব্যবস্থা ব্যবসাবান্ধব। এতে উৎপাদনের খরচ কমে যায়, যার সুবিধা প্রত্যক্ষ করা যায় করোনাকালে। সে সময়ে সারা দুনিয়ার অর্থনীতি সঙ্কুচিত হলেও গতিশীল ছিল বাংলাদেশ।
জামানত এবং ঋণের সুদের মধ্যকার ব্যবধান ৩ শতাংশ রাখার পরেও মন ভরেনি ব্যাংকারদের। তারা আরও বেশি মুনাফা করতে চায়। ৬-৯ পদ্ধতি জনসমক্ষে মেনে নিলেও এর বিরোধিতা আসতে থাকে কায়েমি স্বার্থবাদীদের ধামাধরা কিছু অর্থনীতিবিদের কাছ থেকে। তারা জোরাল কোনও যুক্তি না দেখিয়েই সমালোচনা করতে থাকে সুদের হারের সর্বোচ্চ সীমা বেঁধে দেওয়ার। ইউক্রেইন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর যখন দেশে মূল্যস্ফীতি বাড়তে শুরু করে, তখন তারা আদাজল খেয়ে নামেন এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে সুদের হার বন্ধনমুক্ত করে দেওয়ার জন্য। বিভিন্ন সভা, সেমিনার, পত্রিকার কলাম, টেলিভিশন টকশোতে তারা সুদের হার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করার পক্ষে বক্তব্য রাখতে থাকেন। সুদের হার বাড়ানোর পক্ষে তাদের যুক্তি একটাই— পশ্চিমা দুনিয়া সুদের হার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করেছে, অতএব আমাদের এখানেও সুদের হার বাড়াতে হবে।
পশ্চিমাদের সঙ্গে আমাদের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির সামঞ্জস্য নেই। প্রধান পার্থক্য হচ্ছে: করোনাকালে তাদের অর্থনীতির ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হয়েছে, আমাদের ধনাত্মক; সে সময়ে তাদের সাধারণ মানুষকে প্রচুর নগদ সহায়তা দেওয়ায় তাদের বাজারে অর্থ প্রবাহ ছিল মাত্রাতিরিক্ত। তাদের মুদ্রাস্ফীতি থেকে উৎসারিত মূল্যস্ফীতি শুরু হয়েছে ইউক্রেইন যুদ্ধ শুরুর আগেই। ইউক্রেইন যুদ্ধ তাদের মূল্যস্ফীতির মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে মাত্র। বাজারের অর্থ প্রবাহ কমাতে প্রায় শূন্যের কাছাকাছি থাকা সুদের হার তারা ৫/৬ শতাংশ বাড়িয়ে দিয়েছিল। এতে বাজারে অর্থের প্রবাহ কমে যায়। ফলে দ্রব্যের চাহিদা, উৎপাদন, মজুরি কমে জীবনযাত্রার মান কমে যায়। কষ্ট পায় নিম্ন আয়ের মানুষেরা। মজুরি বাড়ানোর দাবিতে ইউরোপ-আমেরিকার রাজপথগুলোতে নেমে আসে লাখ লাখ প্রতিবাদী মানুষ। পুলিশের লাঠির আঘাত জোটে অনেকের কপালে।
আমাদের চিত্র ভিন্ন। আমাদের এখানে বাজারে অর্থের অতিরিক্ত প্রবাহ ছিল না। আমাদের বাজারে মুল্যস্ফীতি হয়েছে বিশ্ববাজারে দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাওয়ার ফলে। তার সঙ্গে জ্বালানি তেলের ও বিদ্যুতের দাম বাড়ার ডমিনো ইফেক্ট, পশ্চিমা বাজারে সুদের হার বেড়ে যাওয়ায় এবং ডলারের বিপরীতে টাকার দাম কমে যাওয়া; বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনের হার নিয়ন্ত্রণ বাফেদা ও এবিবি’র কাছে ছেড়ে দেওয়া; তিন রকমের বিনিময় হার নির্ধারণ করা এবং মজুতদারি, সিন্ডিকেট করে পণ্যমূল্য বাড়িয়ে রাখা, ডলার সংকট, নির্বাচনের বছরে রাজনৈতিক অপপ্রচার ও গুজবসহ স্থানীয় অনেক বিষয় যুক্ত হয়ে প্রকৃত মূল্যস্ফীতি আরও অনেকখানি বেড়ে যায়। তবে তা ইউরোপ-আমেরিকার গড় মাত্রা ১০ শতাংশ ছাড়ায়নি। ইউরোপের কোনও কোনও দেশে মূল্যস্ফীতি ২০/২২ শতাংশ পর্যন্ত উঠেছিল।
প্রথম দিকে স্বার্থান্বেষী মহলের সুদের হার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করার দাবির প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংক খুব বেশি গুরুত্ব আরোপ করেনি। ২০২২ সালের মে মাস থেকে ’২৩ সালের জুন পর্যন্ত— এক বছরের বেশি সময়ের মধ্যে নীতি সুদ হার বাড়ানো হয়েছে মাত্র এক শতাংশ। কিন্তু ’২৩ সালের শুরুর দিকে আইএমএফের ঋণ অনুমোদনের সঙ্গে ব্যাংক ঋণের সুদের হার উম্মুক্ত করে দেওয়ার পরামর্শ যুক্ত থাকায় কেন্দ্রীয় ব্যংক নমনীয় হতে শুরু করে। দেশীয় বাঘা বাঘা অর্থনীতিবিদদের পরামর্শ এবং তথাকথিত মুক্তবাজার অর্থনীতির নিয়মানুসারে আইএমএফ এ পরামর্শ দিয়েছে বলে পর্যবেক্ষক মহলের ধারণা।
২০২৩ সালের জুন মাসের ৬ শতাংশ রেপো রেট ’২৪ সালের জানুয়ারিতে ৮ শতাংশে উঠে যায়। একই সময় বাড়ে সরকারের ট্রেজারি বন্ড ও বিলের সুদের হার। বর্তমানে যা যথাক্রমে ১১.৫৫ এবং ১১.৩৩ শতাংশ। এর প্রভাব পড়ে বাণিজ্যিক ব্যাংক এবং অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের দেওয়া ঋণের সুদের হারে। ব্যাংক ঋণের গড় হার এখন ১৩.১৩ শতাংশ, যা কিছুকালের মধ্যে ১৫ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। উচ্চ সুদ হারের ফলে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে তারল্য সংকট; কমে গেছে বেসরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি; নাভিঃশ্বাস উঠেছে কৃষি ও শিল্প উৎপাদকদের।
বাংলাদেশে সুদের হার বৃদ্ধি করে আন্তর্জাতিক বাজারের পণ্যমূল্য কমানো যায় না; বাড়ানো যায় না টাকার মান কিংবা বাজারে পণ্য সরবরাহ; নিয়ন্ত্রণ করা যায় না সিন্ডিকেট, অপ-রাজনীতি, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অর্থনৈতিক ব্যাখ্যা।
সুদের হার বাড়ানোর ফলে বেড়েছে উৎপাদন খরচ, যা মূল্যস্ফীতিকে আরও উস্কে দিচ্ছে; কষ্ট পাচ্ছে বাংলার মানুষ। ইউরোপ, আমেরিকা, জাপান সুদের হার বাড়িয়ে মুদ্রা ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করেছে ঠিকই, কিন্তু সে নিয়ন্ত্রণ এসেছে চড়া দামে। জার্মানি, ব্রিটেন ও জাপানে চলছে অর্থনৈতিক মন্দা। আমেরিকা ‘ইনফ্লেশন রিডাকশন’ আইন করে বাজারে অর্থ প্রবাহ চালু রেখে এখন পর্যন্ত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে বটে, তবে তা কত দিন ধরে রাখা যাবে সে বিষয়ে নিশ্চিত নন পৃথিবীর বড় বড় অর্থনীতিবিদরা। উচ্চ হারের সুদ নিয়ে টিকতে পারে না কোনও অর্থনীতি।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের আশায় বাংলাদেশ ব্যাংক দেড় বছরের বেশি সময় ধরে সুদের হার বাড়িয়ে চলছে। এখন পর্যন্ত তা নিয়ন্ত্রণে আসেনি। আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যমূল্য কমে আসা, ডলারের বিপরীতে টাকার মান স্বাভাবিক হওয়া এবং সিন্ডিকেট দমন না হওয়া পর্যন্ত মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসবে না। উচ্চ সুদের হার মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে করতে পারেনি; পারবে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি কমাতে; ব্যাংক মালিকদের পকেট বোঝাই করতে।
চলতি অর্থ বছর শেষ হতে এখনও আড়াই মাসের মতো বাকি। এখনই বলা যায়, ২০২৩-২৪ সালের জন্য সরকারের প্রত্যাশিত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৭.৫ শতাংশ অর্জন করা সম্ভব হবে না। ১২/১৫ শতাংশ সুদের হার টেকসই অর্থনীতির পরিচায়ক নয়। কমাতেই হবে সুদের হার। নির্মূল করতে হবে মজুতদারি, সিন্ডিকেট; কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে ফিরিয়ে আনতে হবে একক মুদ্রা বিনিময় হার। কেননা বাজারভিত্তিক বিনিময় হার নির্ধারণ করার মতো অবস্থায় আমরা নেই।
লেখক: চার্টার্ড একাউন্ট্যান্ট ও অর্থনীতি বিশ্লেষক।
ইমেইল: [email protected]