Beta
মঙ্গলবার, ৭ মে, ২০২৪
Beta
মঙ্গলবার, ৭ মে, ২০২৪

কলাম

আপনি কার পাশে ঘুমোতে চান—আইনস্টাইন না ম্যারিলিন মনরো

আলবার্ট আইনস্টাইন ও ম্যারিলিন মনরো।

প্রয়াত বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের পাশে কেউ সমাহিত হতে চান নি, কোনো নারীও না। প্রয়াত ম্যারিলিন মনরোর পাশে শোয়ার সুযোগটা যদি স্বল্পমূল্যেও সম্ভব হতো লক্ষ পুরুষের লাইন পড়তো।

লাইন এখনো আছে, মনরোর মৃত্যুর ৬২ বছর পরও। প্লেবয় খ্যাত হিউ হেফনার ১৯৯২ সালে ম্যারিলিনের কাছাকাছি একটি কবর কিনে নিয়েছেন, ২০১৭-তে মৃত্যুর পর সেখানে সমাহিতও হয়েছেন। ম্যারিলিন মনরোর পাশে থাকার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে তার। ক’দিন আগে বেভারলি হিলসের আইটি খাতে বিনিয়োগকারী অ্যান্থনি জেবিন আড়াই কোটি টাকা খরচ করে কাছাকাছি একটি কবর কিনে নিয়েছেন, ম্যারিলিন মনরোর পাশে থাকবেন বলে।

মৃত্যুর পরও যার পাশে বা কাছাকাছি শায়িত হওয়ার জন্য এমন আকুলতা দেখা যাচ্ছে, চলুন জীবদ্দশায় বলা তার কিছু কথা আগে জেনে নিই।   

ম্যারিলিন মনরোর সমাধিফলক।

ম্যারিলিন মনরো বচন

‘‘আমার জীবনের সবচেয়ে ভালো একটি ঘটনা হচ্ছে আমি নারী।’’

‘‘ যে নারী পুরুষের সমান হতে চায় তার উচ্চাকাঙ্ক্ষার ঘাটতি রয়েছে।’’

‘‘ পুরুষ মানুষের পৃথিবীতে বসবাস করতে আমার আপত্তি নেই— যতক্ষণ না আমি আমার নারীসত্তা ধরে রাখতে পারি।’’

‘‘ বিয়ের আগে একজন পুরুষকে ধরে রাখার জন্য তার সাথে শারীরিক সম্পর্ক করতে হয় আর বিয়ের পর তার সাথে শারীরিক সম্পর্ক করার জন্য তাকে ধরে রাখতে হয়।’’

‘‘ মেকআপ ও হাসির তলদেশে আমি একজন সাধারণ মেয়ে যে পৃথিবীতে অনেককিছু প্রত্যাশা করে।’’

‘‘কখনো আমার মনে হয় আমার গোটা জীবনটাই একটা বিশাল প্রত্যাখ্যান।’’

এই কথাগুলো যার সেই মার্কিন অভিনেত্রী ম্যারিলিন মনরোকে নিয়ে পৃথিবীজুড়ে যত লেখালেখি হয়েছে, যত  প্রতিভাধরই হোন না কেন, অন্য কোনো অভিনেতা ও অভিনেত্রী এই সূচকে তার ধারেকাছেও আসতে পারেননি, সেই আলোড়নও কেউ তুলতে পারেন নি, বছরের পর বছর ধরে মানুষের অন্তরে এমন স্থায়ী আসনও কেউ দখলে রাখতে পারেন নি। শতবর্ষের চলচিত্রের ইতিহাসে সৌন্দর্যে, অভিনয়গুণে, গ্ল্যামারে, জীবনের বৈচিত্রে আলাদা আলাদাভাবে খ্যাতিমান অনেক নায়িকাই, কিন্তু সব মিলিয়ে অনতিক্রম্য একজনকে যদি খুঁজতে হয়, তিনি অবশ্যই ম্যারিলিন মনরো। জীবদ্দশায় তিনি সবচেয়ে বেশি আলোচিত ছিলেন, অকালমৃত্যুর পর সে আলোচনা কমেনি, বেড়েছে বহুগুণ।

শতবর্ষের চলচিত্রের ইতিহাসে সৌন্দর্যে, অভিনয়গুণে, গ্ল্যামারে, জীবনের বৈচিত্রে আলাদা আলাদাভাবে খ্যাতিমান অনেক নায়িকাই, কিন্তু সব মিলিয়ে অনতিক্রম্য একজনকে যদি খুঁজতে হয়, তিনি অবশ্যই ম্যারিলিন মনরো। জীবদ্দশায় তিনি সবচেয়ে বেশি আলোচিত ছিলেন, অকালমৃত্যুর পর সে আলোচনা কমেনি, বেড়েছে বহুগুণ।

শিশু নোরমা থেকে ম্যারিলিন মনরো
শিশু নোরমা জিন মর্টেনসন হয়ে উঠলেন সমকালের এবং উত্তরকালের সবচেয়ে আলোচিত সেলিব্রেটি সুন্দরতম ম্যারিলিন মনরো। জন্ম ১ জুন ১৯২৬ সকাল সাড়ে ৯টায় লস এঞ্জেলস জেনারেল হসপিটাল। মা গ্ল্যাডিস গার্ল মনরো। বাবা কে? জন্ম সনদে বাবার নাম লেখা হয়েছে এডওয়ার্ড মর্টেনসন। কিন্তু জন্মের সময় এবং গ্ল্যাডিসের সাথে তার সম্পর্কের কাল এসব বিবেচনা করলে মর্টেনসনের বাবা হবার কোনো কারণ নেই।

ডোনাল্ড হল ‘দ্য লাস্ট ডেজ অব ম্যারিলিন মনরো’-তে দেখিয়েছেন তার প্রকৃত পিতা চার্লস স্ট্যানলি গিফোর্ড। ‘কনসোলিডেশন ফিল্ম  ইন্ডাস্ট্রিজ’ নামক একটি প্রতিষ্ঠানে ফিল্ম কাটার কাজ করতেন আরো অনেকের সাথে গ্ল্যাডিস ও স্ট্যানলি— এই দুজন শ্রমিক।

দু’জনের মধ্যে স্বল্পকালীন সম্পর্ক গ্ল্যাডিসকে গর্ভবতী করে। পেটে যখন সন্তান তখন গ্ল্যাডিস বুঝতে পারলেন তার পুরুষ সটকে পড়েছে। এটি তার তৃতীয় সন্তান নোরমা জিন। গ্ল্যাডিসের আগে একটি বিয়ে হয়েছিল, স্বামী জেসপার বেকার স্ত্রীর মাদকাসক্তির কারণে এক পুত্র এবং এক কন্যাকে নিজের কাছে রেখে গ্ল্যাডিসকে তালাক দেন। গ্ল্যাডিস মার্টিন মোর্টেনসনকে বিয়ে করে চার মাস সংসার করে আবার রাস্তায় নামেন।

শিশু নোরমা জিন ১০ মাস।

নোরমা সামাজিকভাবে অবৈধ সন্তান হিসেবে বেড়ে উঠেন। নোরমার ৩৬ বছরের জীবনে তার ওই সৎ ভাইবোনের সাথে কখনো দেখা হয়নি। প্রতিবেশীদের বাড়িতে রেখে গ্ল্যাডিস কাজে যেতেন, কিন্তু মানসিক অসুস্থতার কারণে তাকে প্রায়ই হাসপাতালে থাকতে হতো। নোরমা যখন নয় তখন তার মা গ্ল্যাডিসকে স্থায়ীভাবে নরওয়ার্ক স্টেট মানসিক রোগ হাসপাতালে স্থানান্তর করতে হলো।

গ্ল্যাডিসের বান্ধবী গ্রেইস ম্যাককি নোরমাকে লালন-পালন করতে এগিয়ে এলেন, কিন্তু আর্থিক অসামর্থ্যের কারণে তাকে লস এঞ্জেলেস এতিমখানায় দিয়ে দেন। কিছু সময় পালক পরিবারে, কিছু সময় এতিমখানায় তার জীবন কাটে। এ সময় তিনি একাধিকবার ধর্ষণের শিকার হন।

একটি সাক্ষাৎকারে শৈশব স্মৃতির কথা জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, ‘‘আমার সবচেয়ে আগের স্মৃতি… এ তো টিকে থাকার জন্য জীবন সংগ্রামের স্মৃতি। আমি তখনো খুব ছোট, ছোট্ট বিছানার ছোট্ট শিশু আর আমি তখন টিকে থাকার লড়াই করছি… এটা খুব নির্মম গল্প।’’ শৈশবের যৌন নিপীড়ন নিয়ে তিনি বলেছেন, ‘‘সেজন্য আমাকে নিশ্চয় সাজা দেওয়া হবে না, কিংবা চাবকানো হবে না, আমাকে ভালোবাসা হবে না কিংবা নরকে পাঠানো হবে এমন তো নয়।’’

১৯ জুন ১৯৪২, বয়স তখন ১৬। বিয়ে করলেন, জেমস ডোগার্টিকে, বিয়েটি টেকসই হয়নি।

রেডিও প্লেইন মিউনিশন ফ্যাক্টরির কর্মচারী হিসেবে ক্যামেরায় তোলা নোরমার একটি ছবি ১৯৪৫-এ ইয়াঙ্ক ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হলে দরজা খুলে যায়। তিনি মডেল হবার সুযোগ পান। তারপর সিনেমা বেন লিয়ন হলিউডের চর্চা অনুযায়ী নোরমা জিন মোর্টেনসনের নামের ওপর কাঁচি চালিয়ে তাকে ‘ম্যারিলিন মনরো’ করে তুলেন। ১৯৪৯ সালে ক্যালেন্ডারের ছবির জন্য নগ্ন পোজ দিয়ে ৫০ ডলার কামাই করেন আর ১৯৫৩-তে যখন হিউ হেফনার সম্পাদিত প্লেবয়তে ন্যুড মডেল হলেন, পেলেন ৫০০ ডলার।

আলোচনার মোড় ঘুরে গেল এত সুন্দর নগ্ননারী পৃথিবীতে আর একজনও কি আছে? নেই।

একটি সাক্ষাৎকারে শৈশব স্মৃতির কথা জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, ‘‘আমার সবচেয়ে আগের স্মৃতি… এ তো টিকে থাকার জন্য জীবন সংগ্রামের স্মৃতি। আমি তখনো খুব ছোট, ছোট্ট বিছানার ছোট্ট শিশু আর আমি তখন টিকে থাকার লড়াই করছি… এটা খুব নির্মম গল্প।’’ শৈশবের যৌন নিপীড়ন নিয়ে তিনি বলেছেন, ‘‘সেজন্য আমাকে নিশ্চয় সাজা দেওয়া হবে না, কিংবা চাবকানো হবে না, আমাকে ভালোবাসা হবে না কিংবা নরকে পাঠানো হবে এমন তো নয়।’’

বিয়ে করলেন জো ডিম্যাজিওকে। এটিও কাজ করল না। তারপর নাট্যকার আর্থার মিলার, তিনি তো ধীরে ধীরে তাকে মৃত্যুর দিকেই ঠেলে দিলেন। একটি একটোপিক প্রেগন্যান্সি এবং চারটি গর্ভপাতের রেকর্ড থাকলেও নরমান মেইলার দাবি করেছেন ২৯ বছর বয়স পর্যন্ত ম্যারিলিনকে ১২টি গর্ভপাত মেনে নিতে হয়।

পিতার অভাব তাকে সারাজীবন তাড়া করেছে। চার্লস স্ট্যানলে গিফোর্ডের সাথে সরু গোঁফের নায়ক ক্লার্ক গ্যাবলের হয়তো কোনো মিল থাকতে পারে, নাও থাকতে পারে, কিন্তু ম্যারিলিন ভাবতেন ক্লার্ক গ্যাবলই ‘বাবা’।

‘‘ক্লার্ক গ্যাবল যখন মারা গেলেন, আমি একটানা দু’দিন কেঁদেছি, খেতে পারিনি, ঘুমাতে পারিনি।’’

পঞ্চাশের দশকের শেষার্ধে ১৯৫৬, ১৯৫৭ এবং ১৯৫৮ প্রতি বছর একবার গর্ভপাত ম্যারিলিনের আবাল্য লালিত মা হবার স্বপ্নটিকে ম্লান করে দিতে থাকে। তারপরও তিনি উঠে দাঁড়ান। নিজের বেদনা লুকিয়ে আনন্দের ঝর্ণাধারা বইয়ে দেন। ১৯৫৯-এর সেপ্টেম্বরে সোভিয়েত নেতা নিকিতা ক্রুশ্চেভের সম্মানে দেওয়া মধ্যাহ্ন ভোজে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৬০-এর মার্চে সাম লাইক ইট হট-এ অভিনয় তাকে এনে দেয় গোল্ডেন গ্লোব অ্যাওয়ার্ড।

ম্যারিলিন তখনো আর্থার মিলারের স্ত্রী। এর মধ্যে নিক মিনারভোস, গ্রিক-আমেরিকান অভিনেতা ছাড়াও ফরাসি ইভ মোতা-এর সাথে ম্যারিলিনের বিয়ে বহির্ভূত সম্পর্ক অব্যাহত থাকে। এদিকে তার মনোলোক আচ্ছন্ন করে রেখেছেন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি, আমেরিকান প্রেসিডেন্ট।

ম্যারিলিন মনরো ও তৃতীয় স্বামী নাট্যকার আর্থার মিলার: আরো একটি সংসার স্বপ্নের মৃত্যু।

আরো একটি সংসার স্বপ্নের মৃত্যু
৫ আগস্ট ১৯৬০ ইভ মোতা-র সাথে ম্যারিলিনের সম্পর্ক ও ডেটিং নিয়ে আর্থার মিলার তার সাথে দুর্ব্যবহার করেন। ২৬ আগস্ট ম্যারিলিন আত্মহত্যার উদ্দেশ্যে বহুসংখ্যক ঘুমের বড়ি খান। দ্রুত হস্তক্ষেপ ঘটায় ম্যারিলিন রক্ষা পান। আর্থার মিলার বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যান। ১৯ নভেম্বর ম্যারিলিন আর্থার মিলারের সাথে তার তালাকের ঘোষণা দেন। ২৪ জানুয়ারি ১৯৬১ তালাক চূড়ান্ত হয়।

১৯৬১-র জানুয়ারিতে জন এফ কেনেডির প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণের ক’দিন আগে ম্যারিলিন ঘনিষ্ঠজনের কাছে স্বীকার করেন যে তার সাথে তিনি শয্যা গ্রহণ করেছেন। ৩০ মার্চ সাবেক স্বামী জো ডিম্যাজিওর সাথে ফ্লোরিডার রেডিংটন সমুদ্র সৈকতে অবস্থান করেন।

এপ্রিলে লস এঞ্জেলেসে ফিরে এসে ফ্রাঙ্ক সিনাত্রার সাথে থাকেন। ৮৮২ নর্থ ডোহেনি ড্রাইভ, ওয়েস্ট হলিউডে একটি অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া করেন। ১৯৫৩ সালেও তিনি এই ভবনের ৬৪৮ বর্গফুট একটি এক বেডরুম অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া নেন এবং জো ডিম্যাজ্জিওকে নিয়ে বসবাস করেন।

১৯৬১-র এপ্রিলে ছয় সন্তানের জনক, যুক্তরাষ্ট্রের তরুণতম অ্যাটর্নি জেনারেল, প্রেসিডেন্ট  জন এফ কেনেডির ভাই রবার্ট এফ কেনেডির সাথে তার সখ্য গড়ে ওঠে। দুজনের অন্তরঙ্গ সময়ও কাটে।

ফ্রাঙ্ক সিনাত্রাকে বিয়ে করবেন ভেবে নিয়ে আগস্টে তার সাথে এক সপ্তাহ উষ্ণ সমুদ্রে সময় কাটান। সিনাত্রা তাকে এমারেল্ডের কানের রিং উপহার দেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সম্পর্কটি বিয়ে পর্যন্ত গড়ায়নি।

ম্যারিলিন মনরোর মৃত্যু সর্বত্রই সংবাদ শিরোনাম।

সত্যিই কি আত্মহত্যা?
সাংঘর্ষিক বক্তব্য: ৪ আগস্ট  ১৯৬২ শনিবার রাত ৭টা পনের মিনিটে তিনি জো ডিম্যাজিও জুনিয়রের সাথে কথা বলেন। তখন তিনি উৎফুল্ল ছিলেন। ঠিক আধঘণ্টা পর পিটার লফোর্ড যখন ফোন করলেন তখন তিনি ড্রাগের ঘোরে, বিড়বিড় করে যা বলেন তাকে আত্মহননের পূর্ণকথন বলে ধরে নেওয়া যায়। লফোর্ড আতঙ্কিত হয়ে তার বন্ধু মিল্টন ইবিনসকে ফোন করেন। তিনি ম্যারিলিন মনরোর অ্যাটর্নি রুডিনকে ফোন করে ম্যারিলিনের বাড়িতে ফোন করে সব ঠিকঠাক আছে কি-না জানাতে অনুরোধ করেন।

রুডিন বলেন, তিনি সাড়ে আটটায় ফোন করে ম্যারিলিন কেমন আছেন তা চেক করার জন্য কেয়ারটেকার ইউনিসকে বলেন। ইউনিস তাকে জানান তিনি চেক করেছেন এবং ম্যারিলিন ঠিক আছেন।

লফোর্ড সন্তুষ্ট না হয়ে রাত ১১টার দিকে তার বন্ধু জো নারকে ফোন করেন। তার বাড়ি থেকে ম্যারিলিনের বাড়ি খুব দূরে না হওয়ায় তিনি নিজে গিয়ে দেখে আসতে সম্মত হলেন— ম্যারিলিন অতিরিক্ত মাত্রার ওষুধ সেবন করেছেন কি-না? জো নার যখন তার বাড়ি থেকে বের হতে যাচ্ছেন তখন মিল্টন রুডিন তাকে যেতে নিষেধ করলেন এবং বললেন, ডাক্তার গ্রিনসন তাকে ঘুমের ওষুধ দিয়েছেন।

যে সময় পিটার লফোর্ডের মনে হয়েছে ম্যারিলিন অতিরিক্ত মাত্রার ওষুধ সেবন করেছেন ততক্ষণে আরো দু’জন বন্ধু ম্যারিলিনের সাথে ফোনে কথা বলেছেন।

‘দ্য অ্যাসাসিনেশন অব ম্যারিলিন মনরো’ গ্রন্থের গবেষক ও লেখক ডোনাল্ড এইচ ওলফের মতে ম্যারিলিন তার হেয়ারড্রেসার সিডনি গিলারফের সাথেও কথা বলেছেন।

হেয়ারড্রেসার সিডনি দাবি করেছেন ম্যারিলিন তাকে বলেছেন যে, তিনি কেনেডিদের সম্পর্কে বিপজ্জনক গোপনীয় বিষয় জানেন। সেই সন্ধ্যায় তিনি আরো কিছু ফোন কল পান। ম্যারিলিনের খন্ডকালীন প্রেমিক হোসে বোলানোসকে ফোন করেন।

বোলানোস দাবি করেছেন রাত সাড়ে ন’টার দিকে তিনি ম্যারিলিনের সাথে কথা বলেছেন এবং পৃথিবী কাঁপিয়ে দেবার মতো কিছু গোপন কথা ম্যারিলিনও তার কাছে প্রকাশ করেছেন। আলাপ চলাকালে দরজায় বিচলিত হবার মতো কোনো শব্দ শুনে তাকে কথা শেষ করার জন্য ঝুলিয়ে না রেখে ফোন রেখে দেন। তিনি আর ফোন করেননি।

ওলফ লিখেছেন: রোববার সকাল সাড়ে ৫টা থেকে ৬টার মধ্যে যে লোকটি ম্যারিলিনকে মর্গে নিতে এসেছেন তিনি হিসেব করে দেখেছেন রিগর মর্টিস (মৃত্যুজনিত কারণে শরীর শক্ত  হওয়া) অনুযায়ী রাত সাড়ে ৯টা থেকে রাত সাড়ে ১১টার মধ্যে ম্যারিলিনের মৃত্যু হয়েছে।

ইউনিস বলেছেন রাত তিনটার দিকে জেগে উঠে দেখেছেন ম্যারিলিনের দরজার নিচ দিয়ে আলো আসছে, দরজা তালাবদ্ধ। তিনি ডাক্তার গ্রিনসনকে ডাকলেন। রাত ৩টা ৫০ মিনিটে ম্যারিলিনের ঘরে গিয়ে তাকে মৃত ঘোষণা করলেন।

সিআইএ, এফবিআই কিংবা রবার্ট কেনেডি ও দুজন হোয়াইট হাউসকে কেলেঙ্কারি মুক্ত রাখতে তাকে হত্যা করেছে। হত্যা তত্ত্বেই যুক্তি প্রবল। দাপ্তরিক প্রতিবেদনে আত্মহত্যা বলা হলেও এখনো ম্যারিলিন ভক্তরা মনে করেন তাদের সুন্দরতম নারী ক্ষমতাসীনদের হত্যাকাণ্ডের শিকার— ম্যারিলিন মনরো হয়ে উঠাই তার মৃত্যুর কারণ।

ওলফের মতে ডিপ পাইল কার্পেটিংয়ের কারণে রুমের ভেতর থেকে দরজার নিচ দিয়ে আলো আসার ব্যাপারটি সম্পূর্ণ অসম্ভব। কাজেই ইউনিসের এই কথাটি বানোয়াট! অধিকন্তু দরজার কোনো ফাংশনাল লক না থাকায় তালাবদ্ধ থাকার বিষয়টিও সত্য নয়।  বাড়িতে সে রাতে ইউনিস এবং তার জামাতা নরমান জেফ্রিস ছিলেন। জেফ্রিস দাবি করেছেন রাত সাড়ে ৯টা থেকে দশটার মধ্যে তিনি রবার্ট কেনেডি এবং অপরিচিত অপর দুজনকে ম্যারিলিনের দরজা পর্যন্ত আসতে দেখেছেন। তারা তাকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবার নির্দেশ দেন। জেফ্রিসের কথা অনুযায়ী তিনি এক প্রতিবেশীর বাড়িতে চলে আসেন এবং তারা চলে না যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করেন।

সাড়ে দশটায় ফিরে এসে জেফ্রিস দেখলেন ম্যারিলিন উপুড় হয়ে আছেন, নগ্ন, হাতে কিছু একটা ধরে আছেন, মনে হয় ফোন। জেফ্রিস বললেন, মনে হলো ম্যারিলিন মৃত। ইউনিস আগে অ্যাম্বুলেন্সের জন্য ফোন করে গ্রিনসনকে ডাকেন। জেফ্রিস দেখেছেন লফোর্ড এবং প্যাট্রিশিয়া নিউকম্ব এসে পৌঁছলেন এবং হতবাক হয়ে গেলেন।

সামার্স লিখেছেন: কেম হান্টার নামে একজন অ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভার বলেছেন অতিভোরে ম্যারিলিনের দেহ পাবার পরই তিনি আদেশ পেয়ে চলে আসেন। অ্যাম্বুলেন্স কোম্পানি-প্রধান বলছেন, ম্যারিলিন জীবিত ছিলেন তবে কোমাতে। তাকে সান্তা মনিকা হাসপাতালে আনা হলে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তারপরই তার মরদেহ আবার বাড়িতে নিয়ে আসা হয়।

নগ্ন ও নিষ্প্রাণ ম্যারিলিন মনরোকে নীল কম্বলে পেঁচিয়ে স্ট্রেচারের স্ট্র্যাপে আটকে ৭৫,০০০ ডলারে কেনা কেবল অর্ধসজ্জিত ব্রেন্ট উডের বাড়ি থেকে বের করে মর্গে নেওয়া হচ্ছে।

সাংঘর্ষিক ময়না তদন্ত
ম্যারিলিন মনরোর শরীরে পাওয়া চেতনা নাশক ঘুমের ওষুধ, প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী কৌটার উপস্থিতি, শরীরে কোনো আঘাতের অনুপস্থিতি, তার আত্মহত্যার পূর্বচেষ্টা এবং ডাক্তার গ্রিনসনের মতামতের ওপর ভিত্তি করে করোনার কার্ফে সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে ম্যারিলিন আত্মহত্যা করেছেন।

বিতর্কের বিষয় হচ্ছে তার পাকস্থলিতে কিংবা অন্ত্রনালীতে নেমবুটালের কোনো চিহ্নও পাওয়া যায়নি। নেমবুটাল হয়ে থাকলে এর হলুদ ক্যাপসুলের চিহ্ন পাবার কথা; তা তো পাওয়া যায় নি, এমনকি পাকস্থলিতে কোনো হলুদ রঙও না।

রক্ত পরীক্ষায় বলা হয়: ব্লাড কাউন্টে আট মিলিগ্রাম ক্লোরাল হাইড্রেট এবং সাড়ে চার মিলিগ্রাম নেমবুটাল পাওয়া গেছে; কিন্তু লিভারে তেরো মিলিগ্রাম—অনেক বেশি মাত্রার নেমবুটাল। লিভারের তুলনায় রক্তে প্রাপ্ত নেমবুটালের অনুপাত থেকে মনে হয় ড্রাগ গ্রহণের পর অনেক ঘণ্টা তিনি বেঁচেছিলেন।

সারাদিন বিপাকক্রিয়ার মধ্যদিয়ে তা লিভারে পৌঁছেছে, বার্বিচুয়েট গ্রহণ করা হয়েছে মিনিট নয় অনেক ঘণ্টা আগে— যা মৃত্যুকে প্রতিষ্ঠিত করে না। দুটো কারণে বার্বিচুয়েট ইনজেকশনের ধারণাটি প্রত্যাখ্যান করতে হয়। প্রথমত, অত্যন্ত নিবিড় পরীক্ষার পরও তার শরীরে সুঁই ফোটানোর কোনো চিহ্ন পাওয়া যায়নি; দ্বিতীয়ত, ইনজেকশন নেওয়া হলে তাৎক্ষণিক মৃত্যু ঘটত এবং শরীরে চিহ্ন থাকত।

ম্যারিলিন মনরোর মৃত্যুর তদন্তে অনেক বিষয় বিবেচনায় আনা হয়নি, তাড়াহুড়া করে তদন্ত গুটিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশ অনুযায়ী প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে বলে মনে করা হয়।

জীবনের শেষ ফটোশুটে ম্যারিলিন মনরো।

ম্যারিলিন মনরোর মৃত্যুতত্ত্ব
তিনটি তত্ত্ব সামনে রেখে ম্যারিলিন গবেষকরা সামনে এগিয়েছেন : আত্মহত্যা তত্ত্ব, দুর্ঘটনা তত্ত্ব, হত্যা তত্ত্ব।

আত্মহত্যার তত্ত্ব: এটিই হচ্ছে ম্যারিলিন মনরোর জীবনের শেষ অধ্যায়ের দাপ্তরিক উপসংহার। এমনিতেই তিনি মানসিক রোগের জন্য সার্বক্ষণিক চিকিৎসাধীন ছিলেন। তার মা গ্ল্যাডিস মর্টেনসনকে পাগলাগারদেই থাকতে হয়েছে, নানাকেও, মামা আত্মহত্যা করেছেন। মুড সুইং—মানসিক অবস্থার দ্রুত পরিবর্তন তাকে আত্মহত্যায় প্ররোচিত করেছে। তা ছাড়া আগেও অনেকবার ঘুমের ওষুধের ওভারডোজ গ্রহণ করেছেন। এই তত্ত্বের দুর্বলতা হচ্ছে ফরেনসিক সাক্ষ্যে পরস্পর বিরোধী বক্তব্য। যেহেতু সে সময় সাবেক স্বামী জো ডিম্যাজিও-র সাথে আবার বিয়ের কথা হচ্ছিল, তিনি সেজন্য উৎফুল্লই ছিলেন। মৃত্যুর জন্য মরিয়া হয়ে উঠবেন এমন কোনো পরিস্থিতি তার তখন ছিল না।

দুর্ঘটনা তত্ত্ব: হতে পারে ভুলবশত তিনি অধিক পরিমাণ নেমবুটাল সেবন করেছেন। প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষা ও দেহে প্রাপ্ত নেমবুটাল এবং এর প্রতিক্রিয়াকাল দুর্ঘটনা তত্ত্বকে সমর্থন করে না।

হত্যা তত্ত্ব: সিআইএ, এফবিআই কিংবা রবার্ট কেনেডি ও দুজন হোয়াইট হাউসকে কেলেঙ্কারি মুক্ত রাখতে তাকে হত্যা করেছে। হত্যা তত্ত্বেই যুক্তি প্রবল। দাপ্তরিক প্রতিবেদনে আত্মহত্যা বলা হলেও এখনো ম্যারিলিন ভক্তরা মনে করেন তাদের সুন্দরতম নারী ক্ষমতাসীনদের হত্যাকাণ্ডের শিকার— ম্যারিলিন মনরো হয়ে উঠাই তার মৃত্যুর কারণ।

পাদটীকা: চার্লি চ্যাপলিনের মৃতদেহ কবর থেকে চুরি হয়ে গিয়েছিল। হাই সিকিউরিটি  জোনে কবর হওয়ায় ম্যারিলিন মনরোকে ছিনতাই করার উদ্যোগের কথা শোনা যায়নি। তিনি এখনো সেখানেই ২৪ নম্বর ক্রিপ্ট বা প্রকোষ্টেই আছেন। দিন যতই যাচ্ছে আশেপাশের ক্রিপ্টগুলোর দাম বেড়েই চলেছে। যারা বাংলাদেশ থেকে লক্ষ কোটি টাকা পাচার করেছেন, সব টাকা তো আর উড়িয়ে দেবার সুযোগও পাবেন না। তার চেয়ে ম্যারিলিন মনরোর পাশের একটি অন্তিম নিবাস কিনে নিন; তাতে আপনার নামধাম হবে, আপনার মাধ্যমে বাংলাদেশও জাতে উঠবে।

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও অনুবাদক।
ইমেইল: momen98765@gmail.com

আন্দালিব রাশদী।প্রতিকৃতি অঙ্কন: সব্যসাচী মজুমদার
ad

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত