Beta
বুধবার, ৮ মে, ২০২৪
Beta
বুধবার, ৮ মে, ২০২৪

কলাম

আদিবাসী বর্ণমালা ও মাতৃভাষার রক্তক্ষত

পাভেল পার্থ । প্রতিকৃতি অঙ্কন: সব্যসাচী মজুমদার

‘জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২’ অনুযায়ী দেশে আদিবাসী জনসংখ্যা দেখানো হয়েছে ১৬,৫০,১৫৯ জন এবং জাতিসংখ্যা ৫০। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইন্সটিটিউট পরিচালিত ২০১৮ সনে শেষে হওয়া ভাষাগত জরিপের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে ৪১টি মাতৃভাষা আছে। এর ভেতর কন্দ, খাড়িয়া, কোডা, সৌরা, মুন্ডারি, কোল, মালতো, খুমি, পাংখোয়া, রেংমিটচা, চাক, খিয়াং, লুসাই ও লালেং এই ১৪টি আদিবাসী মাতৃভাষা বিপন্ন।

আন্তজার্তিক মাতৃভাষা ইন্সটিটিউটের জরিপের পর জনশুমারি হয়েছে। এই প্রতিষ্ঠান হদিশ পেলেও জনশুমারিতে ‘কোডা’ এবং ‘সৌরা’ ভাষীরা নথিভূক্ত হননি। কোডাভাষী কডা জনগোষ্ঠী রাজশাহীর পুঠিয়া, মোহনপুর, পবা ও তানোরে বসবাস করেন। জনসংখ্যা হাজারের কাছাকাছি। আর সৌরাভাষী সৌরা জনগোষ্ঠী মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল ও কমলগঞ্জে বসবাস করছেন। অনেকে নিজেদের ভীম পরিচয়দানকারী সৌরাদের জনসংখ্যা প্রায় তিন হাজারের কাছাকাছি। তো কডা এবং সৌরাদের মতো এমন অনেক সংখ্যায় কম জনগোষ্ঠী এখনও রাষ্ট্রীয় দলিলে অর্ন্তভুক্ত হতে পারেননি।

তাহলে দেশে আদিবাসী জাতির সংখ্যা প্রশ্নে আমরা কোন নথিকে বিবেচনা করব? ‘মাতৃভাষা ইন্সটিটিউটের ভাষা জরিপ’ নাকি ‘ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইন ২০১০’-এর তফসিল? রাষ্ট্রের এসব খতিয়ান প্রমাণ করে আদিবাসী প্রশ্নে রাষ্ট্রের দলিলায়ন এবং পরিসংখ্যান কতোটাই অবহেলার এবং একইসাথে জাত্যাভিমানী।

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী কিংবা শহীদ দিবসের ৭২ বছরের ময়দানে দাঁড়িয়ে দেখা যায়, রাষ্ট্র বাংলা ভাষা ও বর্ণমালা ভিন্ন দেশের অপরাপর মাতৃভাষা ও বর্ণমালার সুরক্ষা ও স্বীকৃতি নিশ্চিত করতে পারেনি। এটি রাষ্ট্রের এক অনিবার্য বর্ণাভিমানী চরিত্র। এই দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টানো জরুরি।

বাংলাদেশে সকল আদিবাসী জাতিরই নিজস্ব মাতৃভাষা চলমান থাকলেও অনেকেরই লেখ্য লিপি নেই। চাকমা, মারমা, রাখাইন, ত্রিপুরা, মৈতৈ মণিপুরী, সাঁওতাল, ম্রো, বর্মণ-ক্ষত্রিয় আদিবাসীদের নিজস্ব বর্ণমালা রয়েছে। এছাড়া মান্দি, লেঙাম, কোচ আদিবাসীদের ভেতর বেশকিছু বর্ণমালা দীর্ঘদিন ধরে প্রস্তাবিত হয়ে আছে। খাসি, মান্দি, মাহালী, বম, খুমী এবং সাঁওতালদের খৃষ্টীয় মিশন প্রভাবিত পক্ষ রোমান হরফকে নিজেদের মতো পরিবর্তন করে ব্যবহার করছেন কেউ কেউ। বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী, কোল, হাজং, সাঁওতাল, মুন্ডা, ওঁরাও আদিবাসীরা বাংলা হরফেই মাতৃভাষার চর্চা করছেন।

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী কিংবা শহীদ দিবসের ৭২ বছরের ময়দানে দাঁড়িয়ে দেখা যায়, রাষ্ট্র বাংলা ভাষা ও বর্ণমালা ভিন্ন দেশের অপরাপর মাতৃভাষা ও বর্ণমালার সুরক্ষা ও স্বীকৃতি নিশ্চিত করতে পারেনি। এটি রাষ্ট্রের এক অনিবার্য বর্ণাভিমানী চরিত্র। এই দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টানো জরুরি।

‘জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০’ আদিবাসী শিশুদের মাতৃভাষা শিক্ষার অধিকারের বিষয়টি প্রথম রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইন-২০১০’ সকল আদিবাসী জাতির ভাষা ও ঐতিহ্য সংরক্ষণের কথা স্বীকার করেছে। উক্ত আইনের ৯নং অনুচ্ছেদে ‘সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে বসবাসরত প্রত্যেক ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সম্প্রদায়ের ইতিহাস, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য তথা ভাষা, সাহিত্য, সংগীত, নৃত্য, কারুশিল্প, ধর্ম, আচার-অনুষ্ঠান, রীতিনীতি, সংস্কার ইত্যাদি বিষয়ে তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ, সংরক্ষণ এবং গবেষণা কর্মসূচি পরিচালনা করার’ কথা উল্লেখ রয়েছে।

২০১২ সনে চাকমা, মারমা, সাঁওতাল, মান্দি, ত্রিপুরা ও ওঁরাও আদিবাসীদের মাতৃভাষায় পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নের রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ তৈরি হয়। সেখানে চাকমাদের জন্য ‘চাঙমা’ বর্ণমালা, মারমাদের জন্য ‘মারমা’, ত্রিপুরা ও মান্দিদের জন্য ‘পরিবর্তিত রোমান’ এবং মুন্ডা-ওঁরাওসহ সাদ্রীভাষী আদিবাসীদের জন্য ‘বাংলা’ হরফ ব্যবহারের সিদ্ধান্ত হয়।

দুঃখজনকভাবে অলচিকি, বাংলা না রোমান এ বিতর্কে সাঁওতালি ভাষা বিষয়ে সিদ্ধান্তটি এখনও থমকে আছে। মাতৃভাষায় পাঠ্যপুস্তক প্রকাশিত হলেও পার্বত্য চট্টগ্রাম ব্যতীত সমতল অঞ্চলের সকল আদিবাসী শিশুরা এখনও এই পাঠ্যপুস্তকের নাগাল পায়নি। এছাড়া বই পড়াবার জন্য উপযুক্ত শিক্ষক ও নিরাপদ শিক্ষাঙ্গণের অভাব এখনও আছে।

মাতৃভাষা ও বর্ণমালা টিকে থাকবার আরও হাজারো তর্ক ও বাহাসে না গিয়ে চলতি লেখায় খুব সংক্ষেপে দেশের আদিবাসী ভাষাসমূহের বর্ণমালা ও ভাষাসমূহের সাধারণ পরিস্থিতিটি বোঝার চেষ্টা করব।

চাকমা

চাকমা জাতির চাঙমা বর্ণমালা নিজেদের ভেতরে কিছুটা প্রচলিত। বেশকিছু বইপুস্তক প্রকাশিত। বর্ণমালা শিক্ষার বই প্রকাশিত হয়েছে। ঐতিহ্যবাহী চাকমা চিকিৎসাশাস্ত্র ‘চাকমা তালিক’ সম্পূর্ণই চাঙমা ভাষা ও বর্ণমালায় লিখিত। এছাড়া এ পর্যন্ত বাংলা বর্ণমালায় চাকমা সাহিত্য রচিত ও চর্চা হয়ে আসছে। চাঙমা ভাষা ও বর্ণমালায় দেবপ্রিয় চাকমার ‘ফেবো’ নামে উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে।

মারমা (ম্রাইনমা)

মারমা জনগোষ্ঠীর ভেতরে কিছুটা প্রচলিত। বেশকিছু বইপুস্তক প্রকাশিত। বর্ণমালা শিক্ষার বই প্রকাশিত হয়েছে। মারমা বৈদ্যরা মারমা বর্ণমালায় রচিত পুস্তক ব্যবহার করেন। খ্যাং (বৌদ্ধ মন্দির) গুলোতে অনেকেই ব্যবহার করেন। এছাড়া এ পর্যন্ত বাংলা বর্ণমালায় মারমা সাহিত্য রচিত হয়ে আসছে।

রাখাইন

রাখাইন ভাষার বর্ণমালার নাম রাখাইন এ্যাক্ষারা। জনগোষ্ঠীর ভেতরে প্রচলিত। বেশকিছু বইপুস্তক প্রকাশিত। বর্ণমালা শিক্ষার বই প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া এ পর্যন্ত বাংলা বর্ণমালায় রাখাইন সাহিত্য রচিত হয়ে আসছে।

ত্রিপুরা

ত্রিপুরাদের ককবরক ভাষার বর্ণমালা ককবরকনি বাথাই জনগোষ্ঠীর ভেতরে খুব বেশি প্রচলিত নয়। বর্ণমালা শিক্ষার বই প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া এ পর্যন্ত বাংলা বর্ণমালায় ত্রিপুরা সাহিত্য রচিত হয়ে আসছে।

মান্দি (গারো)

মান্দিদের আ.চিক ভাষার বর্ণমালা ‘আ.চিক থোকবিরিম’-এ এই পর্যন্ত মোট চারটি বর্ণমালা প্রস্তাবিত এবং প্রকাশিত হয়েছে। জনগোষ্ঠীর ভেতর এখনও পর্যন্ত প্রচলিত নয়। তবে কেউ কেউ বর্ণমালা ব্যবহার করে সাহিত্য রচনা করছেন। কিন্তু মান্দিদের ভেতর রোমান হরফ নিজেদের মতো পরিবর্তন করে কিছু ব্যবহার করতে দেখা যায়। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি প্রভাব রয়েছে খৃস্টান ধর্মীয় মিশনারিগুলোর। বাইবেল, উপাসনাগ্রন্থ, প্রার্থনা সংগীতের বই সেই পরিবর্তিত রোমান হরফে প্রকাশিত। এছাড়া এ পর্যন্ত বাংলা বর্ণমালায় মান্দি সাহিত্য চর্চা ও রচিত হয়ে আসছে।

মৈতৈ মণিপুরী

মৈতৈ মণিপুরীদের মৈতৈ লোন (মৈতৈ মণিপুরীদের ভাষা) এর বর্ণমালা মৈতৈ মেয়েক জনগোষ্ঠীর ভেতরে অল্প বিস্তর প্রচলিত। বেশকিছু বইপুস্তক প্রকাশিত। বর্ণমালা শিক্ষার বই প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া এ পর্যন্ত বাংলা বর্ণমালায় মৈতৈ সাহিত্য রচিত হয়ে আসছে।

লেঙাম

লেঙাম জাতির লেঙাম থপিরসইট নামে একটি বর্ণমালা প্রস্তাবিত হয়েছে এবং প্রকাশিত হয়েছে। জনগোষ্ঠীর ভেতরে অনেকই বর্ণমালা ব্যবহার করে সাহিত্য ও গান রচনা করছেন। বেশকিছু লেঙাম শিশু এই প্রস্তাবিত বর্ণমালা আয়ত্ত্ব করেছে। এছাড়া এ পর্যন্ত বাংলা বর্ণমালায় লেঙাম সাহিত্য রচিত হয়ে আসছে।

ম্রো

ক্রামা ধর্মের প্রবর্তক মেনলে ম্রো ‘ম্রোচেট’ নামের ম্রো ভাষার বর্ণমালা উদ্ভাবন করেছেন। জনগোষ্ঠীর ভেতরে প্রচলিত হচ্ছে। ক্রামা ধর্মের বইপুস্তক প্রকাশিত। বর্ণমালা শিক্ষার বই প্রকাশিত হয়েছে। ইয়াংঙান ম্রো সহ আরও কিছু লেখকের বই ম্রো বর্ণমালা ও ভাষায় একইসাথে কখনওবা বাংলা অনুবাদে প্রকাশিত হয়েছে। 

বর্মণ-ক্ষত্রিয়

বর্মণদের ঠার ভাষার নাগরী বর্ণমালা জনগোষ্ঠীর ভেতর পূর্বে প্রচলিত থাকলেও এখন আর তেমন প্রচলন দেখা যায় না। পুরনো বেশকিছু হাতে লেখা নথিপত্র রয়েছে এই বর্ণমালায় লেখা। এ পর্যন্ত বাংলা বর্ণমালাতেই বর্মণ সাহিত্য রচিত হয়ে আসছে।

অলচিকি

১৯২৫ সনে পণ্ডিত রঘুনাথ মুরমু কর্তৃক উদ্ভাবিত সাঁওতালি ভাষার বর্ণমালা অলচিকি ভারতে রাষ্ট্রীয় অনুমোদন পেলেও বাংলাদেশে এখনও প্রচলিত হয়নি অলচিকি। অলচিকি বর্ণমালায় বেশকিছু পুস্তক ও বর্ণমালার বই প্রকাশিত। বাংলাদেশে রোমান, বাংলা নাকি অলচিকি হরফ ব্যবহার করা হবে এই নিয়ে বিতর্ক চলমান। এ পর্যন্ত বাংলা বর্ণমালায় সাঁওতালি সাহিত্য চর্চা ও রচিত হয়ে আসছে। বাংলাদেশে বাংলা হরফ ব্যবহার করে প্রাথমিক পর্যায়ে সাঁওতালি ভাষার বেশকিছু বইপুস্তক প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া পরিবর্তিত রোমান হরফেও কিছু প্রকাশনা রয়েছে। রয়েছে খৃষ্ট ধর্ম সংশ্লিষ্ট বেশ কিছু পুস্তক।

মাহালী

২০০৬ সনে মাহালী ভাষার জন্য রোমান হরফের সমন্বয়ে পরিবর্তিত এক বর্ণমালা ‘মাহালে’ প্রকাশিত হয়েছে। বর্ণমালা শিক্ষার পুস্তক প্রকাশিত এবং কিছু প্রতিষ্ঠানে পড়ানোর কথা জানা যায়।

বম

রোমান হরফ নিজেদের মতো পরিবর্তন করে ব্যবহার করতে দেখা যায়। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি প্রভাব রয়েছে খৃস্টান ধর্মীয় মিশনারিগুলোর। উপাসনাগ্রন্থ, প্রার্থনা সংগীতের বই ও পরিবর্তিত বর্ণমালার বই সেই পরিবর্তিত রোমান হরফে প্রকাশিত।

খাসি

রোমান হরফ নিজেদের মতো পরিবর্তন করে ‘আ-বি-কে’ নামের বর্ণমালাটি নিজেদের ভেতর ব্যবহার করতে দেখা যায়। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি প্রভাব রয়েছে খৃস্টান ধর্মীয় মিশনারিগুলোর। বাইবেল, উপাসনাগ্রন্থ, প্রার্থনা সংগীতের বই ও পরিবর্তিত বর্ণমালার বই সেই পরিবর্তিত রোমান হরফে প্রকাশিত। ভারতের মেঘালয়ে পরিবর্তিত রোমান বর্ণমালায় ‘মাওফর’ নামে দৈনিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়।

কোচ

বাংলা হরফ ব্যবহার করে মাতৃভাষা শিক্ষার বই প্রকাশিত হয়েছে। সাহিত্য ও সংগীত চর্চা চলছে বাংলা হরফেই। উচ্চারণের সুবিধার্থে ভারতে বাংলা হরফে আরও কিছু সংযোজন ঘটেছে।

হাজং

আসাম ও বাংলাদেশ উভয়প্রান্তে বাংলা হরফকে ব্যবহার করেই বেশ কিছু হাজং প্রকাশনা রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরেই সাহিত্য চর্চা ও লেখালেখি চলছে বাংলা বর্ণমালায়।

বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী

বাংলা বর্ণমালা ব্যবহার করেই দীর্ঘ সময়ের সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন চলছে। ভারতের আসাম রাজ্যে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির জন্য শহীদ হয়েছেন সুদেষ্ণা সিংহ।

কোল

বাংলা হরফ ব্যবহার করে রাজশাহী অঞ্চলে ছোট পরিসরে কোলদের ভেতর প্রাক-প্রাথমিক পর্যায়ে কোল ভাষা শিক্ষা কার্যক্রম বেসরকারি উদ্যোগে কিছুটা চলছে।

ভাষার জন্য লড়াই কেবল বাংলার নয়

আমাদের স্মরণে রাখা জরুরি বাংলা ভাষার জন্যে কেবল বাঙালি নয়, দেশের আদিবাসী জনগণেরও রক্ত-ঘাম ঝরেছে। ভিন্ন ভিন্ন আদিবাসী ভাষাসমূহের অজস্র শব্দ ও ব্যঞ্জনা নিয়ে হাজার বছর ধরে সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে বাংলা ভাষা। কেবল বাংলা নয়, বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষার জন্য ১৯৯৬ সনের ১৬ মার্চ শহীদ হয়েছেন সুদেষ্ণা সিংহ। সাঁওতালি ভাষা ও অলচিকি বর্ণমালার সাংবিধানিক স্বীকৃতির জন্য ভারতে সংগঠিত হয়েছে দীর্ঘ গণসংগ্রাম। আদিবাসী জনগণের বর্ণমালার স্বীকৃতির প্রশ্নে আজ জেগে উঠুক বাংলাদেশের সব গ্রাম, ঘুমিয়ে থাকা বইয়ের পাতা কি প্রস্তাবিত বর্ণমালার যাদুবিভা, গল্পের ভাঁজ, কাহিনীর গতি, দুবির্নীত আলাম, বিদ্রোহী কারাম, উজ্জীবিত জাহেরথান, যুক্তির গ্রীকা কি প্রবীণ তালিক। এখানে নিশ্চুপতা মানে মাতৃভাষা দ্রোহের সাথে অবিচার।

আদিবাসী সাহিত্যের প্রান্তিকতা

আদিবাসী লিপিতর্কের পাশাপাশি আলাপের এ পর্যায়ে আমরা আদিবাসী সাহিত্য বিষয়ে রাষ্ট্রীয় অস্বীকৃতি এবং তথাকথিত জাতীয় সাহিত্য পরিসরে আদিবাসী সাহিত্যের প্রান্তিকতা নিয়ে কথা বলব।

‘ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইন ২০১০’ দেশের আদিবাসী জনগণের ভাষা, সংস্কৃতি, সাহিত্য, ঐতিহ্য সুরক্ষা ও উন্নয়নের অঙ্গীকার করেছে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত আদিবাসী ভাষা ও সাহিত্য সুরক্ষা এবং বিকাশের প্রশ্নে আমরা কোনও ন্যায়পরায়ণ রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ দেখতে পাইনি। স্বাধীনতার ৫৩ বছর পর বাংলাদেশ প্রথম একজন আদিবাসী লেখককে পদক দিয়ে সম্মানিত করতে পেরেছে। চাকমা কবি ও লেখক মৃত্তিকা চাকমা ‘বাংলা একাডেমি পুরস্কার’ অর্জন করেছেন।

আদিবাসী জনগণ রাষ্ট্রের উপনিবেশিক পরিচয়-রাজনীতি এবং জনমিতি-বাহাদুরির ঐতিহাসিক নিশানা। আন্তজার্তিক মাতৃভাষা দিবস একুশে ফেব্রুয়ারি ও ৯ আগস্ট আদিবাসী দিবসে ‘হারিয়ে যাচ্ছে আদিবাসী ভাষা’ শিরোনামে গণমাধ্যমে কিছু প্রচার প্রচারণা হয়। ‘সব কিছু হারিয়ে গেল’ বলে নাগরিক জীবনে কিছু উন্নয়নবাদী জাদুঘরমার্কা মেকি-কান্না চলে। কিন্তু আদিবাসী জনগণের ভাষা ও সাহিত্যের ন্যায়বিচার সুরক্ষায় রাষ্ট্র জান-জবান নিয়ে দাঁড়ায় না।

রাষ্ট্র বরাবরের মতোই বৈষম্যের বন্দুক নিয়েই চোখরাঙিয়ে থাকে, আর একুশে ফেব্রুয়ারি এলে ঠোঁট ফুঁলিয়ে বলে ‘সব ভাষাকে বাঁচাতে হবে’। রাষ্ট্রকে বুঝতে হবে ভাষা এমনি এমনি বেঁচেবর্তে থাকে না। এর জন্য অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান-শিক্ষা ও পরিচর্যার প্রয়োজন হয়। রাষ্ট্রকে এও বুঝতে হবে বন্দুক দিয়ে এলোপাথারি ফানা ফানা রক্তাক্ত করেও কোনও ভাষাকে গায়েব করে ফেলা যায় না। দেশের আদিবাসী জাতিসমূহের প্রত্যেকের মাতৃভাষার সুরক্ষায় রাষ্ট্রের আচরণ, দৃষ্টিভঙ্গি, রাজনৈতিক দর্শন ও নীতি বৈষম্যহীন ও ন্যায়পরায়ণ হতে হবে। একটি ভাষা টিকে থাকবার অনেক শর্তের ভেতর কাজ করে তার সাহিত্য ও যাপিতজীবনের চর্চার নিরাপত্তা, স্বীকৃতি ও মর্যাদা।

রাষ্ট্রীয়ভাবে আদিবাসীদের ভাষা ও সাহিত্যকে মর্যাদা ও স্বীকৃতি দিয়ে ‘আদিবাসী ভাষা ও সাহিত্য সম্মাননা’ চালু করা জরুরি। মান্দি সমাজের শেরানজিংপালা, রেরে, আজিয়া, চাকমাদের রাধামন-ধনপুদি বা মৈতৈ ও বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী সমাজের রাসপালা, ম্রো রূপকথা, ওঁরাও ও সাঁওতালি কাহিনী পালা আখ্যান, হাজংদের দেবীদূর্গাপালার মতো আদিবাসী জনগণের রয়েছে অবিস্মরণীয় সব মৌখিক আখ্যান। ‘আদিবাসী ভাষা ও সাহিত্য সম্মাননা’ দেওয়ার ক্ষেত্রে অবশ্যই মৌখিক ও লিখিত সাহিত্যকীর্তি উভয়কেই গুরুত্ব ও মর্যাদা দিয়ে বিবেচনা করা জরুরি।

লেখক: প্রাণ ও প্রতিবেশ বিষয়ক গবেষক ও লেখক।
ইমেইল: animistbangla@gmail.com

ad

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত