Beta
বুধবার, ৮ মে, ২০২৪
Beta
বুধবার, ৮ মে, ২০২৪

সাক্ষাৎকার

বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠায় জনগণকেও দায়িত্ব নিতে হবে

হাকিম আরিফ

ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট সারা বিশ্বের সব ভাষা নিয়ে কাজ করার অঙ্গীকার নিয়ে কাজ শুরু করেছে। বাংলাদেশে বাংলাসহ রয়েছে আরও ৪১টি ভাষা। এর মধ্যে ১০টি ভাষা বিপন্নতার পর্যায়ে চলে গেছে। এমন পরিস্থিতিতে সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠায় সরকারের পাশাপাশি জনগণের মানসিকতার পরিবর্তন প্রয়োজন বলে মনে করেন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের (আমাই) মহাপরিচালক ড. হাকিম আরিফ। এই ভাষাবিজ্ঞানী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিউনিকেশন ডিসঅর্ডারস বিভাগের অধ্যাপক। আমাই’র বর্তমান কার্যক্রম এবং বাংলাদেশে বিভিন্ন ভাষার অবস্থা ও করণীয় নিয়ে সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সকাল সন্ধ্যার জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক আহমেদ মুনীরুদ্দিন

বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠায় জনগণকেও দায়িত্ব নিতে হবে

হাকিম আরিফ

ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট সারা বিশ্বের সব ভাষা নিয়ে কাজ করার অঙ্গীকার নিয়ে কাজ শুরু করেছে। বাংলাদেশে বাংলাসহ রয়েছে আরও ৪১টি ভাষা। এর মধ্যে ১০টি ভাষা বিপন্নতার পর্যায়ে চলে গেছে। এমন পরিস্থিতিতে সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠায় সরকারের পাশাপাশি জনগণের মানসিকতার পরিবর্তন প্রয়োজন বলে মনে করেন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের (আমাই) মহাপরিচালক ড. হাকিম আরিফ। এই ভাষাবিজ্ঞানী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিউনিকেশন ডিসঅর্ডারস বিভাগের অধ্যাপক। আমাই’র বর্তমান কার্যক্রম এবং বাংলাদেশে বিভিন্ন ভাষার অবস্থা ও করণীয় নিয়ে সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সকাল সন্ধ্যার জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক আহমেদ মুনীরুদ্দিন

সকাল সন্ধ্যা: একুশে ফেব্রুয়ারিকে কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট (আমাই) বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হলো। আমাই’র জন্ম হলো কীভাবে?

হাকিম আরিফ: কানাডায় একটি সংগঠন আছে ‘মাদার ল্যাংগুয়েজ লাভার্স অব দ্য ওয়ার্ল্ড সোসাইটি’। ১৯৯৯ সালে এই সংগঠনটির দুইজন প্রতিনিধি রফিকুল ইসলাম এবং আবদুস সালাম শহীদ দিবসকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দিতে ইউনেস্কোকে পত্র দিয়েছিল।

ইউনেস্কো যেহেতু কোনও ব্যক্তির পত্র গ্রহণ করে না, সেটি বাংলাদেশ সরকারকে অবহিত করার পর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের ২১শে ফেব্রুয়ারির শহীদ দিবসকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস করার জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে চিঠি লেখেন। এরই প্রতিক্রিয়ায় ১৯৯৯ সালে শহীদ দিবসকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয় ইউনেস্কো। যার মধ্য দিয়ে জাতিসংঘের সদস্য সব রাষ্ট্রে শহীদ দিবস আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হয়ে থাকে। সেই থেকে এটি চলে আসছে গত ২৪ বছর ধরে।

ভাষা দিবসকে যখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে জাতিসংঘ ঘোষণা করে, এর প্রতি সন্তুষ্টি প্রকাশ করে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, বাংলাদেশে ভাষা বিষয়ে এমন একটি প্রতিষ্ঠান হবে— যেটি সারাবিশ্বের সব মাতৃভাষা নিয়ে গবেষণা করবে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০০১ সালের ১৫ মার্চ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। এ অনুষ্ঠানে জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব কফি আনান উপস্থিত ছিলেন। যার ফলে এ প্রতিষ্ঠান শুরু থেকেই একটি আন্তর্জাতিক মাত্রা পেয়েছে।

সকাল সন্ধ্যা: আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের লক্ষ্য কী?

হাকিম আরিফ: সারাবিশ্বের মাতৃভাষা নিয়ে গবেষণা, কাজ ও সংরক্ষণ করতে আমাই কাজ করে। তাই নিঃসন্দেহে এই প্রতিষ্ঠানের কিছু লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য আছে। প্রথম লক্ষ্য হচ্ছে, পৃথিবী থেকে যেসব মাতৃভাষা হারিয়ে গেছে, হারিয়ে যেতে বসেছে, বিপদাপন্ন বা কিছু ভাষা হারিয়ে গেছে— সেগুলোর নথিকরণ করা। এরপর সেগুলোকে প্রকাশ করা, যাতে এই ভাষারূপটি স্থায়ীত্ব পেয়ে যায়।

দ্বিতীয় লক্ষ্য হচ্ছে, যেসব মাতৃভাষা বিকশিত হয়নি বা কম বিকশিত হয়েছে সেগুলোর বিকাশ ও উন্নয়নের প্রচেষ্টা করা। এক্ষেত্রে ভাষার লিপির প্রবর্তন করার বিষয়টি থাকতে পারে অথবা যে ভাষার শব্দ সম্ভার কম সেই ভাষার শব্দ সংখ্যা বৃদ্ধি করা যেতে পারে। এছাড়া পরিভাষা নির্ণয়ের কাজটি করা যেতে পারে।

আরেকটি বড় লক্ষ্য হচ্ছে, ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের কারণে আমরা শহীদ দিবস পেয়েছি। এর পথ ধরে আমরা পেয়েছি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। তাই ভাষা আন্দোলনের সঠিক ইতিহাস প্রণয়ন করতে হবে। এর জন্য আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট কাজ করে যাবে।

সকাল সন্ধ্যা: এই প্রতিষ্ঠানের বিশেষ উদ্দেশ্য সম্পর্কে আরও জানতে চাই।

হাকিম আরিফ: সরকার প্রধান ঘোষণা করেছেন যে, মাতৃভাষা নিয়ে গবেষণা করার জন্য একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান তৈরি হবে। তাই এ প্রতিষ্ঠানের একটি রাষ্ট্রগত ভিত্তি থাকা উচিত। এ কারণেই এই প্রতিষ্ঠান তৈরি করার জন্য ২০১০ সালে জাতীয় সংসদে একটি আইন পাস করা হয়। এ আইনটিকে ‘‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা আইন ২০১০’’ নামে অবহিত করা হয়েছে। এই আইনেই কিন্তু এই প্রতিষ্ঠানটি কীভাবে কাজ করবে, এর লক্ষ্য-উদ্দেশ্য, কী কী দায়িত্ব আছে, কারা কারা এখানে কাজ করবে— সবিস্তারে এখানে বর্ণনা করা আছে।

yআমাদের যে ৪১টি ভাষা— মানে ৪১ ধরনের সৃজন ক্ষমতার প্রকাশ পাওয়া যায়। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট এ কাজটি করতে পারলে কৃতার্থ হবে। এ ধরনের প্রকল্প গ্রহণের মাধ্যমে দেশব্যাপী না, বিশ্বব্যাপী মানুষের সৃজনক্ষমতা সম্পর্কে ধারণা লাভের সুযোগ হবে।

সকাল সন্ধ্যা: আমরা জানি যে, ২০১৯ সালকে আন্তর্জাতিক আদিবাসী ভাষা বর্ষ ঘোষণা করেছিল ইউনেস্কো। এ বর্ষ নিয়ে আমাই কী ভূমিকা পালন করেছে?

হাকিম আরিফ: আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট সবসময় মাতৃভাষার প্রচার-প্রসার, সংরক্ষণ ও গবেষণার কাজ করে থাকে। বছরজুড়েই এ প্রতিষ্ঠানটি এসব নিয়ে কাজ করে। ওই বছর ইউনেস্কোর ভাষা বর্ষ ঘোষণাকে অবলম্বন করে বাংলাদেশে যেসব মাতৃভাষা হারিয়ে যাচ্ছে সেসব ভাষা নিয়ে সভা-সেমিনার ও কনফারেন্সের আয়োজন করেছিল।

সকাল সন্ধ্যা: এসব আয়োজন থেকে আপনাদের কোনও পর্যবেক্ষণ ও ফলাফল পেয়েছেন?

হাকিম আরিফ: আমাদের পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা যদি বলেন, ২০১৪ সালে একটি প্রকল্প গ্রহণ করেছিল আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট। প্রকল্পটি হলো— ‘এথনোলিঙ্গুস্টিক সার্ভে অব বাংলাদেশ’। বাংলাদেশের ভাষার এই নৃ-গবেষণার কাজটি শেষ হয় ২০১৯ সালে। এ গবেষণা কাজের সারাৎসার হিসেবে ১০টি খণ্ড প্রকাশ হওয়ার কথা রয়েছে। এরই মধ্যে একটি খণ্ড প্রকাশিত হয়েছে।

সকাল সন্ধ্যা: এ গবেষণা অনুসন্ধান থেকে আপনারা কী পেলেন?

হাকিম আরিফ: বাংলাদেশে যে ভাষা পরিস্থিতি— বাংলাদেশে কতগুলো মাতৃভাষা আছে, কতগুলো নৃগোষ্ঠী আছে, নৃগোষ্ঠীগুলো কয়টি ভাষায় কথা বলে, তার একটি সার্বিক চিত্র পেয়েছি। আমরা জানতে পেরেছি, বাংলাদেশে বাংলাসহ ৪১টি মাতৃভাষা প্রচলিত আছে। এ ভাষাগুলোর ভাষাতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যগুলো কী, এই ভাষাগুলো কোন পরিবারের অন্তর্ভুক্ত সেগুলো আমরা নির্ধারণ করেছি।

সকাল সন্ধ্যা: কোনও কোনও ভাষা বিপন্ন অবস্থায় আছে বা প্রায় বিপন্ন অবস্থায় আছে বলে আমরা জানি। এ বিষয়ে আপনাদের সমীক্ষার ফলাফল কী? বা কতগুলো ভাষা এখন পর্যন্ত বিলুপ্ত হয়ে গেছে?

হাকিম আরিফ: আমাদের জরিপ বলে, আমাদের দেশে কোনও ভাষা এখনো বিলুপ্ত হয়ে যায়নি। তবে ‘কুকিচিন’ পরিবারের অন্তর্ভুক্ত ‘রেংমিটচা’ নামের ভাষাটি প্রায় বিলুপ্ত হওয়ার পথে। এ ভাষায় কথা বলতে পারে এমন ছয়জন মানুষ এখনও বেঁচে আছে। পরবর্তী প্রজন্মের আর কেউ এ ভাষায় কথা না বললে এই ভাষাটির মৃত্যু হবে। এছাড়া আরও কিছু ভাষা আছে যেগুলো প্রায় বিপদাপন্ন। বেদেদের যে ভাষা— ‘ঠার’ ভাষা কিংবা বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলে বাস করা এক জনগোষ্ঠীদের ‘কোচ’ ভাষা, সিলেটে চা বাগানের শ্রমিকদের ভাষা ‘ভোজপুরী দোমাই’ প্রায় বিপন্ন। এ ভাষাগুলো প্রায় বিলুপ্তির পথে— যদি না আমরা কোনও উদ্যোগ গ্রহণ করি।

সকাল সন্ধ্যা: বাংলাদেশে তাহলে কতগুলো ভাষা বিপন্ন ভাষা হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়েছে?

হাকিম আরিফ: বাংলাদেশে প্রচলিত ৪১ ভাষার মধ্যে প্রায় ১০টি ভাষা বিপন্নতার পর্যায়ে চলে গেছে।

সকাল সন্ধ্যা: বিলুপ্ত বা বিপন্ন হয়ে যাওয়া ভাষার বিষয়ে সরকার বা আমাই’র কোনও উদ্যোগ আছে?

হাকিম আরিফ: বিলুপ্ত হয়নি, বিলুপ্ত হতে যাচ্ছে এসব ভাষা। যেমন— ‘রেংমিটচা’ ভাষায় পরবর্তী প্রজন্মের আর কেউ কথা না বলে, তাহলে এই ভাষাটি বিলুপ্ত হবে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট সরকারের পক্ষে কাজ করে। সুতরাং আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে, যে ভাষাটি ‍বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে সেই ভাষাটির নথিকরণ ও ডকুমেন্টশন সম্পন্ন করা। অন্তত ওই ভাষায় ব্যবহৃত শব্দগুলো নির্ধারণ করে অভিধান হিসেবে রূপ দেওয়া। আরও বৃহত্তর পরিবেশে কাজ করলে ওই ভাষার ব্যাকরণিক কাঠামো নিয়ে গবেষণা করে বই আকারে প্রকাশ করা যায়। এই কাজটিও আমরা আস্তে আস্তে করব।

সকাল সন্ধ্যা: ভাষার মধ্যে জ্ঞান সঞ্চিত থাকে। আমাদের দেশে যে জাতিগোষ্ঠী বা নৃগোষ্ঠীগুলো আছে তাদের ভাষাগত জ্ঞান, পরিবেশগত জ্ঞান, তাদের সংস্কৃতির জ্ঞান, তাদের বিশ্ব দর্শনের আধার ওই ভাষাগুলো। এই ভাষাগুলো থেকে জ্ঞান নথিবদ্ধের কোনও সুনির্দিষ্ট উদ্যোগ ‘আমাই’র পক্ষ থেকে নেওয়া হয়েছে?

হাকিম আরিফ: এখনও এমন কোনও উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। যদিও ভাষা তো শুধু ভাষা নয়। ভাষা হলো সংস্কৃতি। ভাষার মধ্য দিয়েই সংস্কৃতির প্রতিফলন ঘটে। মস্তিষ্কের একটা প্রক্রিয়াকরণই হচ্ছে ভাষা। ভাষা যেমন বাস্তুতন্ত্র বা সংস্কৃতির সম্পদ— আবার ভাষা মানুষের চিন্তাচেতনার ফসল— বোধগত সম্পদ। একটা ভাষাকে যদি আমরা রক্ষা করতে পারি, মানুষের যে সৃজনশীলতা সেটির বৈচিত্র্যকে আমরা ভাষার মধ্য দিয়ে খুঁজে পাই। আমরা মনে করি, আমাদের যে ৪১টি ভাষা— মানে ৪১ ধরনের সৃজন ক্ষমতার প্রকাশ পাওয়া যায়। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট এ কাজটি করতে পারলে কৃতার্থ হবে। এ ধরনের প্রকল্প গ্রহণের মাধ্যমে দেশব্যাপী না, বিশ্বব্যাপী মানুষের সৃজনক্ষমতা সম্পর্কে ধারণা লাভের সুযোগ হবে।

সকাল সন্ধ্যা: আমরা জানি যে, বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে—

বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর প্রাক বা প্রাথমিক পর্যায়ে মাতৃভাষায় শিক্ষাগ্রহণ ও পাঠ্যপুস্তক রচনা করবে। এটি এখন কী অবস্থায় আছে?

হাকিম আরিফ: এটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের নেওয়া কোনও প্রকল্প নয়। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড এ প্রকল্প গ্রহণ করেছে। আমরা এ বিষয়ে যতটুকু জেনেছি যে, তারা বহুভাষী শিক্ষাপদ্ধতি চালু করেছে। বাংলাদেশে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের ভাষাগুলোর মধ্যে পাঁচটি ভাষার লিপি আছে। সেগুলো দিয়ে ভাষার বই প্রকাশ করা হয়েছে। এই বইগুলো দিয়ে শিক্ষার্থীরা প্রথম শ্রেণি থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পাঠ করে। এটা কোনও আবশ্যিক বই নয়। অবকাঠামো ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক পেলে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীরা তারা তাদের মাতৃভাষায় পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করবে। এটি এখনও পরিকল্পনার মধ্যে আছে। এখনও এটি সম্ভব হয়নি।

সকাল সন্ধ্যা: আমরা দেখেছি যে, আমাদের যে শহীদ দিবস ছিল, সেটি সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পরিসর থেকে পিছু হটে গেছে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস— এখন এই কথাটিই বেশি উচ্চারিত হচ্ছে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক হিসেবে শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের চেতনা আপনি কীভাবে দেখেন?

হাকিম আরিফ: আমরা বিশ্বাস করি, প্রত্যেক কাজেরই একটি ধারাবাহিকতা থাকে। পাকিস্তান পর্বে ভাষা আন্দোলন করে আমাদের পূর্বপুরুষরা জীবন দিয়েছেন। তাদের কারণে আমরা বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে পেয়েছি। ভাষাগত দিক থেকে এটি আমাদের বিকাশের একটি পর্যায়। বাংলাদেশ হওয়ার পরে প্রজাতন্ত্রের ভাষা হয়েছে বাংলা। এটিও আমাদের বিকাশের একটি পর্যায়। ১৯৯৯ সালের আগ পর্যন্ত এটিকে শুধু শহীদ দিবস বলা হতো। এটি আমাদের জাতীয় বা রাষ্ট্রের বিষয় ছিল। যেহেতু এই দিনটি একটি মাত্রা অর্জন করেছে— জাতীয় থেকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পৌঁছেছে— জাতীয় থেকে আন্তর্জাতিক হয়েছে— তার আর একটি রূপান্তর হয়েছে। কিন্তু এটি আমাদের মনে করার কোনও কারণ নেই যে, আমরা শহীদ দিবসকে ভুলে গেছি—বা

আমরা শুধু আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করি। আমাদের প্রতিষ্ঠান যেমন একইসঙ্গে শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করে। রাষ্ট্রীয়ভাবেই আমরা এটি করছি। সাধারণ মানুষ যে শহীদ দিবস ধারণ করে না— এটি কিন্তু ঠিক নয়।

সকাল সন্ধ্যা: ‘আমাই’র মহাপরিচালক হিসেবে নয়, একজন ভাষাবিজ্ঞানী ও অধ্যাপক হিসেবে আপনার কাছে জানতে চাইব, ভাষা আন্দোলনের ৭২ বছর অতিবাহিত হলেও রাষ্ট্রের সকল কর্মকাণ্ডে বাংলা ভাষার ব্যবহার হচ্ছে না— বাংলা ভাষাকে সঠিকভাবে মর্যাদা দেওয়া হচ্ছে না। এই বিষয়টি আপনি কীভাবে দেখছেন?

হাকিম আরিফ: একজন ভাষাবিজ্ঞানী হিসেবে আমি বলবো, ভাষা আন্দোলনের ৭২ বছর পরও সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন হয়নি। এটা কিন্তু এক ধরনের বাস্তবতা। এ বিষয়ে আপনার সঙ্গে আমি সম্পূর্ণ একমত। কিন্তু আপনারা একটু চুলচেরা বিশ্লেষণ করে দেখেছেন, এই বিষয়ে দায়টা আসলে কার? শুধু কি সরকারের দায়, নাকি জনগণের দায়? আপনারা দেখেন, পাকিস্তান আমলে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়েছে। বাংলাদেশ হওয়ার পর সংবিধানে লেখা হয়েছে, প্রজাতন্ত্রের ভাষা বাংলা। এরপর সম্ভবত এরশাদ সরকারের সময় ঘোষণা এসেছিল—

সব সাইনবোর্ড বাংলায় লিখতে হবে। সেইসঙ্গে ইংরেজি লেখা যাবে। সেই সময় এটি নিয়ে অভিযান চলেছে। এই ধরনের অভিযান কিন্তু এখনও প্রায়ই হয়। সরকারের কাজের মধ্যে একমাত্র আন্তর্জাতিক বিষয় ছাড়া সব নথি বাংলায় লেখা হয়।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একটি বিভাগ আছে যেটির কাজ সব ইংরেজি নথিপত্র বাংলায় অনুবাদ করা। উচ্চ আদালত মাঝে মাঝে বাংলায় রায় দেয়। তবে নিম্ন আদালতে এর ব্যবহার আরও বাড়াতে হবে। প্রয়োজনে ইংরেজি-বাংলা মিলিয়ে রিটে অন্তত এ রায় দেওয়া যেতে পারে।

সরকার কিন্তু সাধ্যমতো চেষ্টা করে যাচ্ছে। তাহলে দায়টা কার? দায়টা হচ্ছে জনগণের। এত ইংরেজি মিডিয়াম স্কুল কেনও হয়েছে, এত মাদ্রাসা কেনও হয়েছে? জনগণ যদি তার সন্তানের এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে না পাঠাতো তাহলে কি এসব প্রতিষ্ঠান হতো? হতো না। আমরা শুধু সরকারের ওপর দায় বর্তাবো— জনগণের কোনও ইচ্ছা থাকবে না! দেখুন, আমরা ফেব্রুয়ারি মাসে শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে আসব, আর বাকি ১১ মাস ইংরেজিতে কথা বলবো— বিষয়টি কেমন হয়ে যাচ্ছে না? জনগণের মধ্যে যে ঔপনিবেশিক মানসিকতা আছে সেটির পরিবর্তন ঘটাতে হবে।

১৯৯৯ সালের আগ পর্যন্ত এটিকে শুধু ভাষা দিবস বা শহীদ দিবসই বলা হতো। এটি আমাদের জাতীয় বা রাষ্ট্রের বিষয় ছিল। যেহেতু এই দিনটি একটি মাত্রা অর্জন করেছে— জাতীয় থেকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পৌঁছেছে— জাতীয় থেকে আন্তর্জাতিক হয়েছে— তার আর একটি রূপান্তর হয়েছে।

সকাল সন্ধ্যা: সরকারী পরিসেবার অনেক নথিপত্রই আমরা বাংলায় দেখি না…

হাকিম আরিফ: সরকারকে এ বিষয়ে আরও উদ্যোগী হতে হবে। আগে কিন্তু এগুলো বাংলায় ছিল। এখন প্রযুক্তির কারণে বিদেশি ভাষার ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। তাহলে বাংলা ভাষাকে ‍প্রযুক্তি উপযোগী করে তুলতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদ্যুৎ বিল এখনও বাংলায় করা হয়। সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রয়োগের জন্য সরকারের পাশাপাশি জনগণের মানসিকতার পরিবর্তন ঘটাতে হবে। জনগণের ওপর সবকিছু ছেড়ে দিলে হবে না। কারণ জনগণ জনপ্রিয়তার মানদণ্ডে চলে। তাই সরকারকেও কিছু দায়িত্ব নিতে হবে। দেশের প্রতি দায় থেকেও আমাদের কিছু করার আছে। এ কথা আমাদের মনে রাখতে হবে।

সকাল সন্ধ্যা: উচ্চ শিক্ষায় আমরা এখনও বাংলা প্রচলন করতে পারিনি। আমাদের কোনও অনুবাদ কেন্দ্র নেই। বাংলা ভাষার জ্ঞান অন্য ভাষাভাষী মানুষের কাছে তুলে ধরার কোনও প্রকল্প নেই। রাষ্ট্রের যেমন কোনও উদ্যোগ নেই, তেমনি স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোরও নেই। এ বিষয়ে আপনার মতামত কী?

হাকিম আরিফ: সরকার কিন্তু কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে হস্তক্ষেপে করে না কোন ভাষায় উচ্চশিক্ষা দেওয়া হবে। এক্ষেত্রে আমি বলি, অধ্যাপক-শিক্ষক, অভিভাবক, শিক্ষার্থীদের যদি মানসিকতার পরির্বতন না হয়— সবার যদি সম্মিলিত উদ্যোগ যদি না থাকে, তাহলে কীভাবে এর বাস্তবায়ন সম্ভব হবে। স্বাধীনতার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ বিভাগের পরীক্ষার প্রশ্ন বাংলায় করা হতো— পাঠদানও করা হতো। নব্বইয়ের পর থেকে এই প্রেক্ষাপট বদলাতে শুরু করে। কারণ জনসাধারণ এমন চেয়েছে। ছাত্র-শিক্ষকও চেয়েছে। এর মধ্য দিয়ে হয়তো তাদের দ্রুত প্রসার ঘটবে।

সকাল সন্ধ্যা: উচ্চশিক্ষায় বাংলায় পাঠ্যপুস্তক তৈরির কোনও প্রকল্প আছে বলে আপনার জানা আছে?

হাকিম আরিফ: এমন কোনও প্রকল্প সম্পর্কে আমি অবগত নই। তবে একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক চাইলে এ কাজটি করতে পারেন। বাংলা ভাষার প্রতি দায় থেকে তিনি তার পাঠদানের বিষয় নিয়ে বাংলায় বই লিখতে পারেন। এ ক্ষেত্রেও অধ্যাপক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা আছে।  

সকাল সন্ধ্যা: আপনাকে ধন্যবাদ।
হাকিম আরিফ: আপনাকেও ধন্যবাদ।

ad

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত